‘জালালাবাদের পাহাড়েতে রক্তে লিখেছি কত নাম, চট্টগ্রাম, বীর চট্টগ্রাম।’ ব্রিটিশবিরোধী লড়াই-সংগ্রামের অগ্নিযুগের বীর পুরুষ মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের বীর সন্তানরা পরাক্রমশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল ১৯৩০ সালে। দেশপ্রেমের বীরত্বপূর্ণ সেই আত্মত্যাগের নজির দেশ ও জাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বীর চট্টলা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামে থাকা সেনা-জনতা সম্মিলিতভাবে ঘটিয়েছিল প্রায় একই রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি।
১৯৩০ সালের ১৮ থেকে ২১ এপ্রিল তিন দিন চট্টগ্রাম ছিল স্বাধীন, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত। চট্টগ্রামে ওই তিন দিন ব্রিটিশের পতাকার পরিবর্তে উড়েছিল স্বাধীন ভারতবর্ষের পতাকা। একইভাবে একাত্তরের ২৫ মার্চ-পরবর্তী তিন দিন হানাদার পাকিস্তানি জান্তামুক্ত ছিল চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের সর্বত্র উড়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রসংবলিত জাতীয় পতাকা।
একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোতে পাহাড়তলীস্থ ওয়্যারলেস কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ফিরোজশাহ কলোনির অবাঙালিদের বাঙালিবিরোধী নির্মম তাণ্ডবে স্থানীয় বাঙালিরা ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযোগিতা-সমর্থনে, এমনকি অস্ত্র জোগানের মাধ্যমে অবাঙালি বিহারিদের দৌরাত্ম্যের সীমা-পরিসীমা ছিল না। কৈবল্যধাম মন্দিরসহ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বেপরোয়া হামলা-লুণ্ঠন চালায় তারা। ২ ও ৩ মার্চ রেলওয়ে কলোনি, ওয়্যারলেস কলোনি ও শেরশাহ কলোনি এলাকায় চট্টগ্রামের সামরিক প্রশাসক কর্নেল ফাতেমির নেতৃত্বে পাকিস্তানি সেনারা এবং বিহারিরা যৌথভাবে বাঙালিদের আবাসে, স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
চট্টগ্রামে মার্চের শুরু থেকেই ঘটতে থাকে এমনই নানা অঘটন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে সেনানিবাস, ইপিআর, পুলিশ লাইনসহ দেশজুড়ে পাকিস্তানি হানাদাররা শুরু করে নারকীয় গণহত্যা। ঘুমন্ত বাঙালি সেনা, ইপিআর ও পুলিশের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। চট্টগ্রাম সেনানিবাসেও চালিয়েছিল একই কায়দায় গণহত্যা। প্রকৃতপক্ষে মার্চের শুরুতেই চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামানোকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছিল সর্বস্তরের ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ।
২ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে এমভি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করা সম্ভব হয়নি।
২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ঘুমন্ত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণে হতবিহ্বল বাঙালি সেনারা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলির মুখে আত্মরক্ষার্থে ক্রলিং করে কেউ অস্ত্র নিয়ে, কেউ বা অস্ত্র ছাড়াই রাতের অন্ধকারে পশ্চিমের পাহাড়-জঙ্গল ডিঙিয়ে বহু কষ্টে মিরসরাই-সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন লোকালয়ে আশ্রয় নেন এবং স্থানীয় জনগণের কাছে ঘটনা সবিস্তারে বর্ণনা করেন। স্থানীয় মানুষ তাঁদের আশ্রয়, খাবার ও বিশ্রামের বন্দোবস্তে পূর্ণ সহায়তা করে।
জাতীয়-প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্র-জনতার সম্মিলিত অংশগ্রহণে তখন চট্টগ্রাম ছিল সম্পূর্ণরূপে হানাদারমুক্ত। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানি হানাদাররা নিতে পারেনি। সেনানিবাসে অবরুদ্ধ থেকেছে। একইভাবে অবরুদ্ধ থেকেছে বিহারি অধ্যুষিত ফিরোজশাহ কলোনি, শেরশাহ কলোনি ও ওয়্যারলেস কলোনিতে বসবাসকারী অবাঙালি বিহারিরাও। কালুরঘাট বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা বিপন্ন দেশ-জাতিকে উজ্জীবিত ও নতুন পথের দিশা দিয়েছিল।
২৬ থেকে ২৮ মার্চ দুপুর পর্যন্ত সারা চট্টগ্রাম ছিল হানাদার পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রণমুক্ত। চারদিকে চলছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৮ মার্চ ঢাকা ট্রাংক রোড ধরে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে আসে বিশাল সাঁজোয়া বহর। শুভপুর ব্রিজ থেকে মিরসরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে এবং সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা, জোড়া আমতল, মাদাম বিবির হাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, নিউ পতেঙ্গা, পাকিস্তান বাজার, দক্ষিণ সলিমপুরের ঢাকা ট্রাংক রোডের পূর্ব ও পশ্চিম পাশের সুবিধাজনক স্থানে সেনা ও ইপিআর জওয়ানরা প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নেন। বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে মাত্র কয়েক ঘণ্টার বেশি তাঁরা টিকতে পারেননি, পারা সম্ভবও ছিল না। হানাদার বাহিনী যেসব স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেসব এলাকা নির্বিচারে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিয়েছিল। প্রতিরোধ যুদ্ধের বাধা অতিক্রম করে কুমিল্লা থেকে আসা সাঁজোয়া যানগুলো সন্ধ্যার আগেই চট্টগ্রাম শহরে ঢুকে পড়ে এবং ওই দিনই তিন দিনের পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত স্বাধীন চট্টগ্রামের পতন ঘটে।
পাকিস্তানি হানাদারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় স্বাধীন চট্টগ্রাম। ভীতসন্ত্রস্ত শহরের মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে সমুদ্রের তীর-গ্রামের মেঠোপথ ধরে হেঁটে আত্মরক্ষার্থে শহর ছেড়ে শহরতলি ও গ্রাম অভিমুখে কাফেলার মতো ছুটে আসে। গ্রামগুলো অপরিচিত লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন যে যার সাধ্যানুযায়ী তাদের সাহায্য-সহযোগিতাসহ আশ্রয় প্রদান করে। সে বছর টমেটো ও কহির মাত্রাতিরিক্ত ফলনের কারণে মানুষের প্রাণ রক্ষা সহজ হয়েছিল। ভাতের সঙ্গে টমেটোর ঝোল এবং কহির ভাজি-নিরামিষ দুর্গত মানুষের খাদ্যতালিকায় ছিল একমাত্র বস্তু। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণের পরই হানাদার বাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। পথঘাট, পাকিস্তানি বিরোধীদের এবং সংখ্যালঘুদের খুঁজে খুঁজে চিনিয়ে দেওয়ার ঘৃণিত কাজে যুক্ত হয় মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম দলের নানা স্তরের নেতাকর্মীসহ বিহারিদের একটি বড় অংশ। বাঙালি কারো জীবনই নিরাপদ ছিল না। নির্মম হত্যাযজ্ঞে কত মানুষের প্রাণ গেছে সেই সংখ্যা নিরূপণ আজও সম্ভব হয়নি এবং হওয়ারও নয়।
চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক সেনার কাছে জেনেছিলাম, ২৫ মার্চ দিনে তাঁদের দীর্ঘ সময় মাত্রাতিরিক্ত পিটি, প্যারেড করানো হয়। অতিরিক্ত শারীরিক পরিশ্রমে এমনিতেই তাঁরা ছিলেন ক্লান্ত এবং বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। সেই সুযোগে ঘুমিয়ে থাকা বাঙালি সেনাদের হানাদাররা ব্রাশফায়ারে, ট্যাংকের গোলা নিক্ষেপে হত্যা করে এবং অনেকে গুলির শব্দে দিশাহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছোটাছুটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। তিনি নিজে এবং অনেকে ক্রলিং করে বহু কষ্টে সেনানিবাস ছেড়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়-জঙ্গল অতিক্রম করে এখানে এসেছেন।
পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতির আশঙ্কা সবাই করছিল। সেই সেনা সদস্য নিজেও বুঝেছিলেন। বেশ কয়েকজন সেনা আমাদের ফৌজদারহাটের বাড়িতে সেদিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশ নিতে তাঁরা ২৮ তারিখ সকালে সেই যে চলে গিয়েছিলেন আর ফেরেননি।
লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত