বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল কি শৈশবস্মৃতি হয়েই থাকবে?

  • মুহাম্মদ ইব্রাহীম
শেয়ার
বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল কি শৈশবস্মৃতি হয়েই থাকবে?
বিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীরা। ছবি : শেখ হাসান

আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার অংশ হিসেবে আমাকে বাণিজ্য, মানবিক ইত্যাদি বিষয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান পড়াতে হয়। তখন দেখি অনেক আগ্রহ করে বিজ্ঞান পড়তে চাইলেও এর আগে তাদের অনেকের বিজ্ঞান পড়ার সুযোগ হয়েছে সুদূর অতীতে স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। একই অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে বিজ্ঞানের ছাত্রদের নিয়ে, তারা ইতিহাস-ভূগোল ইত্যাদিও শেষবার পড়েছে ওই অষ্টম শ্রেণিতেই। এটি ওদের ও আমার কারো জন্যই সুখকর অভিজ্ঞতা নয়।

নেহাত বাল্যকালে ওই নবম শ্রেণি থেকে এভাবে শিক্ষার বিশেষায়িত পথে হাঁটার চেষ্টাটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষার কাজে বাধা হওয়াই স্বাভাবিক, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর চারদিক দ্রুত বদলে যাওয়া দিনগুলোর জন্য শিক্ষা।

১৯৫৯ সালে বিখ্যাত রসায়নবিজ্ঞানী ও ঔপন্যাসিক সি পি স্নো কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দিয়ে সে দেশে হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন। ‘দুই সংস্কৃতি’ নামের এই বক্তৃতা এবং পরে তার প্রকাশিত রূপ উন্নত বিশ্বে বড় আকারের দীর্ঘস্থায়ী একটি বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। দুই সংস্কৃতি শিরোনামের কারণ ছিল তিনি এতে তখনকার ব্রিটেনের সমাজকে মানবিক বিষয়ে পড়া এবং বিজ্ঞানের বিষয়ে পড়া—এ দুই সংস্কৃতিতে বিভক্ত হয়ে থাকার ব্যাপারটিতে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন।

মানবিকে পড়া মানুষরাই ছিলেন রাজনীতি, দেশশাসন থেকে শুরু করে আইন-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, এমনকি বিদ্বৎসমাজের শিরোমণি হিসেবে গণ্য হওয়ার ব্যাপারে প্রায় একচেটিয়া। এই একপেশে প্রভাব এবং দুই সংস্কৃতির মানুষদের পরস্পরের বিষয়ে অজ্ঞতা সেদিনের বিজ্ঞান অগ্রগতির আবহে দেশের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনবে—এমন সতর্কবাণী তিনি দিয়েছিলেন। ব্রিটেন দ্রুত তার শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করে ব্যাপারটি সামলে নিয়েছিল। তারও বহু আগে থেকে ওই ব্রিটেনের শিক্ষাকে অনুকরণ করে আমরাও সেভাবেই শুরু করেছিলাম, কিন্তু আমরা সেখান থেকে বদলেছি কি?

শিশু শিক্ষা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা পর্যন্ত সবকিছুতে নিজ নিজ পর্যায়ের চাহিদামাফিক একটি চতুর্মুখী শিক্ষা হবে, এটিই কাম্য।

স্কুলের ওপরের দিক থেকে ওতে নিজস্ব ঝোঁক অনুযায়ী কিছু কিছু পছন্দের বিষয় বাছাই করার সুযোগ থাকবে এবং তারপর এতে কিছু বিশেষায়ণেরও প্রয়োজন হতে পারে বটে, কিন্তু শিক্ষার পূর্ণাঙ্গতা বজায় রেখেই তা করা প্রয়োজন। কেউ কেউ আর্টস ও সায়েন্সকে আলাদা বাক্সে বন্দি করতে চাইতে পারেন, কিন্তু সেটি মানব মননের বিপরীত কাজ হবে। উভয়েই মানবজাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন, যার উভয়টিতে যথেষ্ট পরিমাণে সিক্ত না হলে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা ঘটে না। বিশেষ করে আজ উভয়ে যেভাবে পরস্পর মিশ্রিতভাবে এগোচ্ছে, তাতে একটিতে বিশেষজ্ঞ হতে চাইলেও অন্যটি থেকেও রস আহরণ করেই তা হতে হয়। তাই এ রস আহরণের সক্ষমতা বরাবরই বজায় রেখেই শিক্ষার আয়োজন করতে হয়—সব পর্যায়েই।
উন্নত শিক্ষাব্যবস্থাগুলোতে এটিই করা হয়।

আমাদের দেশে যখন আমরা নবম শ্রেণিতে উঠে কেউ বিজ্ঞানকে, কেউ ইতিহাস-ভূগোল-মানবিককে চিরতরে বিদায় জানাচ্ছি, তখন ওই অনুকরণীয় দেশগুলোতে কী হচ্ছে? সেখানে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা গণ্য করা হয়, তাতে সব দিক থেকে নানা বিষয় সবাই পড়ে। কিছু বিষয় সবাইকেই পড়তে হয়, বাকিগুলোতে বাছাই করার সুযোগ থাকে; যদিও তাতে বিভিন্ন শৃঙ্খলা থেকেই বিষয় রাখতে হয়। শেষের দিকে কিছু বিষয়ের ওপর নিজের আগ্রহ অনুযায়ী বিশেষ জোর দেওয়া যায়। সেগুলো বেশি ব্যাপক ও বেশি গভীর পর্যায়ে পড়া হয়। স্কুলের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা যায়, সেখানেও চার বছরের স্নাতক করতে গিয়ে কোনো একটি পথে এগোয় বটে, কিন্তু অন্য পথগুলো থেকেও বাছাই করা বিষয় নিয়ে প্রধান পথকে অনেক বেশি প্রশস্ত করতে হয়। প্রশস্ত করার মানে হলো প্রধান পথের বাইরের ভৌত বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস-সমাজবিদ্যা, অর্থনীতি, পরিবেশ ইত্যাদি নানা শৃঙ্খলা থেকে নির্দিষ্টসংখ্যক কোর্স করতেই হয়। এখানে বেছে নেওয়ার যে স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাতে ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আনন্দভরা আগ্রহের একটি রূপায়ণ ঘটাতে হবে। এভাবে স্কুলের নিম্ন শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ডিগ্রি প্রোগ্রাম পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই রয়েছে চতুর্মুখী শিক্ষার একটি বাতাবরণ।

আমাদের দেশেও কিন্তু একসময় দশম শ্রেণি পর্যন্ত সবাইকে সব বিষয় পড়তে হতো—বিজ্ঞানের ও মানবিকের। শেষের দুই বছর একটি বিষয়কে উচ্চতর বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। আমার নিজের স্কুলজীবনও এই নিয়মেই কেটেছে। শুধু তা-ই নয়, আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের প্রথম বছরে সবাইকে ইংরেজি ভাষা এবং কলা অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাস ও বিজ্ঞান অনুষদের ছাত্র-ছাত্রীদের সভ্যতার ইতিহাস পড়তে হয়েছে। এটি নতুন চালু হয়ে কিছুদিন চলেছে, তারপর ছাত্র আন্দোলনের মুখে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

সব দেখে মনে হয়, আমরা বারবার উল্টো পথে হেঁটেছি। শিক্ষার পথ প্রশস্ত না করে আমরা বরং সংকীর্ণতার ও বিশেষায়িত করার দিকেই ঘুরে গেছি। আর সেটি করেছি শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে, স্কুলের মাঝামাঝি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। সব সময় এর পেছনে যুক্তি ছিল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি যেভাবে ঘটছে তাতে একটি বিশেষ দিকে কেন্দ্রীভূত না হলে সামাল দেওয়া যাবে না, উচ্চতর বিষয়গুলো পড়ার অবকাশ ঘটবে না। এটি যে ভুল যুক্তি, তা দুনিয়ার অন্যদের দেখে বোঝা যায়। জ্ঞান বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলানোর আসল উপায় হলো এর সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্যক্রমে উপযুক্ত পরিবর্তন আনা। এ জন্য মৌলিক বিষয়গুলোকে নতুন আলোকে দেখা হয়। সেই সঙ্গে সাহস করে নতুন ও উচ্চতর বিষয়বস্তু কিছু আগে থেকেই এতে যোগ করা হয়। নতুনভাবে ও সহজভাবে উপস্থাপিত হয়ে তা সেখানেও উপযুক্ত ও উপভোগ্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ একটি অবাক করা সাম্প্রতিক খবর হলো, চীনে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন লার্নিং প্রক্রিয়ায় হাতেখড়ি দেওয়া হচ্ছে। এর মানে এই নয় যে তারা শিশুদের শিশুতোষ চীনা ভাষা ও সাহিত্য, ইতিহাস-সংস্কৃতি ইত্যাদি শেখানো বাদ দিয়েছে।

পাঠ্যক্রম মাঝে মাঝে পরিবর্তন করার অর্থ শিক্ষার খোলনলচে উপড়ে ফেলা নয়। আমাদের দেশে সাম্প্রতিককালে এমনই ঘটার উপক্রম হয়েছিল, পাঠ্যক্রম সংস্কারের অজুহাতে। সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী যাতে শুধু তথ্য মুখস্থ করার ওপর নির্ভর করার বদলে নিজে চিন্তা করে, বিশ্লেষণের সক্ষমতা অর্জন করে, পাঠে ও পরীক্ষায় সেই দিকটি আনার একটি চেষ্টা ছিল। কিন্তু তাতে আগাগোড়া সবকিছু এত বেশি পাল্টে দেওয়া হলো যে মূল প্রচেষ্টাটিই ছেড়ে দিতে হলো। পরের সংস্কারের বাস্তবায়ন তো আরো ভয়াবহ হয়েছে। এই সাম্প্রতিক চেষ্টাটির মূল উদ্দেশ্য যতটুকু বোঝা যাচ্ছিল তা হলো শিক্ষাকে দৈনন্দিন জীবনের দক্ষতাগুলোর অর্জনের সঙ্গে যুক্ত করা এবং শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগে অভিজ্ঞতা অর্জন। সেটি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান, তবে তার জন্য খুবই ভিন্ন ধনী ও অল্প মানুষের একটি দেশের উদাহরণকে অদ্ভুতভাবে অনুসরণের কোনো অবকাশ ছিল না—যা করা হয়েছে। এটি কার্যত ধরে নিয়েছে যে শিক্ষায় মুখস্থের কোনো স্থান নেই, পরীক্ষায় বসার কোনো প্রয়োজন নেই, বাড়িঘরের কাজগুলোও নম্বর উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত হবে—এসব আজগুবি নীতিরও দরকার ছিল না। এটি শিক্ষার পুরো শৃঙ্খলা ভেঙে ফেলার জোগাড় করেছিল। অবশ্যম্ভাবীভাবে পাঠ্যক্রমকে আবার উল্টো দিকে যেতে হয়েছে। অথচ যুগোপযোগী করার জন্য পাঠ্যক্রমকে বদলাতেই হবে, এবং সেটি বুঝে বুঝে ধীরে ধীরে করতে হবে। এতে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা চাইতে হবে বটে, তাই বলে পরিবর্তন মাত্রকেই রুখে দাঁড়ানোর অভ্যাসটি মেনে নেওয়া যায় না।

উন্নত প্রায় সব দেশে যা বহুদিন ধরে চলছে, বিষয় নির্বাচনে তাদের অনুসরণ করার মধ্যে বড় কোনো জটিলতা নেই। বাংলা, ইংরেজি, অন্য ভাষা, সাহিত্য, গণিত, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, অর্থনীতি, কম্পিউটার—এসবকে শিক্ষার মৌলিক কাঠামো হিসেবে প্রায় পুরো শিক্ষাজীবনে কমবেশি বজায় রাখতেই হবে। স্কুলের ওপরের দিকে, বিশেষ করে উচ্চ মাধ্যমিকে বেশি মনোযোগ দেওয়ার কিছু বিষয় থাকবে, সেগুলো নানা দিকের ও পথের হবে, যাকে শুধু একক বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় সীমাবদ্ধ রাখার দরকার নেই। যুগের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এর নানা মিশ্রণ ও নতুন দিকও হতে পারে—সেই চীনাদের স্কুলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতেখড়ির মতো। উচ্চতর গণিতের বা উচ্চতর জীববিদ্যার বা উচ্চতর তথ্যবিজ্ঞানের মতো বিষয়ে এভাবে আগ্রহ সৃষ্টিতে স্কুলেই ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহিত করা যায়। এগুলো পরে আজকের জ্ঞানের নানা অগ্রবর্তী অংশে অবদান রাখতে তাদের সাহায্য করবে।

একই কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও। বিশেষায়িত প্রধান বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব বেশি পাবে, তার জন্য প্রয়োজনীয় সহায়ক বিষয়গুলোসহ। কিন্তু স্নাতক হওয়ার একটি প্রধান শর্ত হিসেবে এখানেও শিক্ষার প্রশস্ত পথে হাঁটতে হবে। শিক্ষা হবে চতুর্মুখী—যা তাকে আজকের ও শিগগির আসছে এমন দিনের উপযোগী করবে। সারা দুনিয়ার ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ জন্য কী কী হচ্ছে, তা তো জানাই আছে।

দেশে ও বিদেশে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আগাগোড়া শিক্ষার মধ্যে দুটি উপাদান কোনো না কোনোভাবে থাকাটি জরুরি। এর একটিকে আমি নাম দিয়েছি ‘আপন ভুবন’, আর অন্যটিকে ‘উন্মুক্ত কাজ’। আপন ভুবন হলো নিজের চিন্তার বিকাশ ও প্রকাশ—যেটি ওই সৃজনশীল পদ্ধতিতে কিছুটা ছিল। এটি হলো কোনো কিছু পড়ে, দেখে, তা নিয়ে নিজের চিন্তা ও মতামত প্রকাশ করতে পারা। আজ ইন্টারনেটের যুগে ইচ্ছে করলে যে কেউ এর ওপর বাড়তি হিসেবে একটি ছোটখাটো রিসার্চও করে ফেলতে পারে। একজন স্কুলছাত্রও তা করতে পারে। যেমন—সে জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের কথা যখন পড়ছে, তখন সামাজিক কিছু ভুল ধারণা ও আচরণের কারণে এই দুইয়ের ক্ষেত্রে স্থানীয়ভাবে যা ঘটছে, বাইরের কোথাও কোথাও যা ঘটছে, তার খোঁজখবর যথাসম্ভব সরাসরি করে অথবা বই-ইন্টারনেট ঘেঁটে মতামত দেওয়া। নিজের চিন্তা, আগ্রহ ও অনুসন্ধান কিভাবে প্রকাশ পেয়েছে, সেটি দেখাই এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

অন্যদিকে ‘উন্মুক্ত কাজ’ হলো বাইরে যা হচ্ছে, তাতে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন ও পাঠ্যবস্তুর সঙ্গে তার সম্পর্ক স্থাপন। নানা কর্মস্থল আগ্রহ নিয়ে ভ্রমণ করে পর্যবেক্ষণ, এমনকি সম্ভব হলে এ রকম কিছুতে শিক্ষানবিশি করে এটি শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হতে পারে। এগুলো যদিও অনেকটা নিজের উৎসাহে ও নিজের উদ্যোগে ঘটবে, তাতে শিক্ষকের ও স্থানীয় সমাজের সহযোগিতা থাকতে হবে। বাইরের কাজের ও ক্লাসের প্রায়োগিক কাজের মধ্যে যথাসম্ভব সম্পর্ক স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কাজ পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই থেকে উৎসারিত হতে পারে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে এই শেষের অংশগুলোই শুধু আনুষ্ঠানিক পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হবে—বাকিগুলো কিছুটা সহশিক্ষা কার্যক্রমের মতো বাড়তি কাজ হবে নিজের উদ্যোগে।

আপন ভুবন ও উন্মুক্ত কাজের এক ধরনের উদাহরণ আমাদের দেশেই নানা সময়ে সৃষ্টি হয়েছে। আশির দশকে নতুন ধরনের বিজ্ঞান পাঠ ও বিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়ের প্রচলন হয়েছিল, যাতে সব অধ্যায়ের পর ‘নিজে কর’ বলে কিছু কাজের কথা থাকত। স্কুলের সাধারণ আয়োজনেই সেগুলো সম্ভব ছিল— অনেকে তা বাস্তবায়নও করেছে। কিন্তু শিক্ষক ও অভিভাবকরা গোড়া থেকেই এর বিরোধিতা করার কারণে কিছুদিনের মধ্যেই তা বাদ গেছে। এ রকম ‘নিজে কর’ শুধু বিজ্ঞানে কেন, সব বিষয়েই থাকা উচিত। অন্যান্য বহু দেশে এটি নিয়মিতভাবেই থাকে। আমি যখন সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি (১৯৫৬-৫৭), তখন সরকারিভাবেই যুক্তরাষ্ট্রে চালু পাঠ্যবইয়ের অনুকরণে নতুন ধরনের ভূগোলের পাঠ্যবই চালু হয়েছিল আমাদের জন্য। ওই বই থেকেই ভূগোলের বিষয়ে আমাদের কাজ করতে দেওয়া হতো। প্রতিটি অধ্যায়েই যে প্রচুর ফটোগ্রাফ ও ম্যাপ ছিল, সেগুলো থেকে নানা বিষয় বিশ্লেষণটাই ছিল কাজ। এটিও বেশিদিন টেকেনি। আশির দশক থেকে ২০১৫ পর্যন্ত আমরা আমাদের বেসরকারি সংস্থা বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্রের উদ্যোগে দেশের নানা জায়গায় অনানুষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে ঠিক এ রকম প্রচেষ্টা বইয়ের মাধ্যমে ও হাতে-কলমে বহুদিন চালিয়েছি।

আপন ভুবনের কথাই বলি আর উন্মুক্ত কাজের কথাই বলি, এর বড় সমস্যা হলো, ছাত্র-ছাত্রীর মূল্যায়নে এই কাজগুলোর একটি স্থান রাখতে পারা। এতে যে প্রচুর সময় দিতে হয় মূল্যায়নে পুরস্কৃত না হলে ওরা তাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলা স্বাভাবিক। অবশ্য যারা এর স্বাদ পেয়েছে তারা ও রকম পুরস্কার ছাড়াও নিজের আনন্দে এগুলো করতে চাইবে এমন উদাহরণও প্রচুর। এতে নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন তারা ঠিকই বুঝতে পারে। তবে সমস্যাটি সমাধানের একটি পথ হলো, সব পরীক্ষার প্রশ্নগুলো এমনভাবে করা, শুধু মুখস্থ করে যার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, এ জন্য নিজের চিন্তার (আপন ভুবন থেকে) আর নিজের অভিজ্ঞতার (উন্মুক্ত কাজ থেকে) ছাপটি প্রচুর সাহায্য যেন করে। এর বিপরীত মেরু হবে কিছু বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে যা শোনা যায়, সে রকম শত শত প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করাকে উৎসাহিত করা—যাতে ঘটনার সন-তারিখ, কে উদ্বোধন করেছিলেন, বা দলিলের বা আইন-কানুনের ধারা-উপধারার নম্বর ইত্যাদি গিলে খাওয়া। এর মাধ্যমে সঠিক মূল্যায়ন কখনো সম্ভব নয়।

তবে আপন ভুবন ও উন্মুক্ত কাজকে পুরস্কৃত করার আরো সরাসরি উপায় আছে—এ নিয়ে শিক্ষকের ‘প্রোগ্রেস রিপোর্ট’কে ছাত্রের মূল্যায়নে গুরুত্ব দেওয়া। ক্লাসের শিক্ষক প্রত্যেক ছাত্রের এই দিকটার মূল্যায়ন করেই এমন প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিয়মিত তৈরি করে যাবেন। পরবর্তী সময়ে ছাত্রের উচ্চ পর্যায়ে ভর্তি, বৃত্তি লাভ, এবং চাকরি ইত্যাদিতে এই প্রোগ্রেস রিপোর্টের সারসংক্ষেপ বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় আমাদের দেশের শিক্ষকদের এ ধরনের রিপোর্টকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়। মাধ্যমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরেই পর্যায় অনুযায়ী এসবের প্রচলন থাকা জরুরি—এখনো বেসরকারি কোনো কোনো ক্ষেত্রে রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ছাত্রের কাজের নিজস্ব উদ্যোগ এবং নানা বিষয়ের মিশ্রণ অত্যন্ত অপরিহার্য হয়ে ওঠে। এটিই তো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মূল নিয়ামক—নিজের কাজে নিজের উদ্যোগে সেখান থেকে জ্ঞান নিংড়ে নেওয়া। একে স্কুলের একটি উচ্চতর রূপ মনে করলে খুবই ভুল করা হবে, কারণ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বদৃষ্টি (ওয়ার্ল্ড ভিউ) অর্জনের জায়গা। শিক্ষার প্রশস্ত পথ সে জন্য এখানেও এত জরুরি। এই বিশ্বদৃষ্টি যতটা না অর্জিত হয় বিশেষ বুদ্ধিতে, তার চেয়ে অনেক বেশি অর্জিত হয় মুক্তবুদ্ধিতে। শিক্ষা একটি পথের ভেতরেই যদি শুধু বিশেষায়িত হতে থাকে, ক্রমে তা একটি টেকনিক্যাল বা ‘কারিগরি রূপ’ লাভ করে—বিষয়টি যদি ভাষা, সাহিত্য বা ইতিহাস হয় তবু। এটি বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। কিন্তু যখন মুক্তবুদ্ধির প্রশ্ন ওঠে, তখন এর সব ছাপিয়ে গিয়ে বিষয়টির একটি ‘দার্শনিক রূপ’ থাকাটা দরকার হয়। কারিগরি রূপটিকে কিছুটা ভিন্ন মাত্রায় প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলোতেও হয়তো দেওয়া সম্ভব। কিন্তু দার্শনিক     রূপটির জন্য অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় চাই। প্রতিটি বিষয়ে বুদ্ধিকে মুক্ত করার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের।

পথ প্রশস্ত না করেও চার বছরের স্নাতক হওয়ার পথে এক রকম বিশেষজ্ঞ তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সেই বিশেষজ্ঞ আজ একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ের বিশ্বে কতখানি কাজে আসবে তাতে সন্দেহ রয়েছে। এ জন্য স্কুলের গোড়া থেকেই পথ প্রশস্ত রেখেই চলা দরকার। তাহলেই বিশ্ববিদ্যালয় তাকে স্নাতক হিসেবে আগামী দুনিয়াকে আবাহন জানানোর প্রস্তুতিটি দিয়ে দিতে পারবে। অন্য অনেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে না গিয়েও অন্য শিক্ষাব্যবস্থায় সে রকম আবাহন জানানোর প্রস্তুতি নিতে পারে কর্মজীবনের সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা, কমিউনিটি কলেজ ইত্যাদি মিশিয়ে। উন্নত দেশে অসংখ্য তরুণ-তরুণী তা-ই করছে এবং একবিংশ শতাব্দীর সমান চালিকাশক্তি হচ্ছে। আমাদের দেশে তারা নিষ্প্রভ থাকছে বৈষম্য ও মানবিক মর্যাদার অভাবে। পার্থক্যটি হওয়া উচিত ছিল শুধু যার যার সহজাত ঝোঁক ও আনন্দকে অনুসরণ করার মধ্যে, অন্য কিছুতে নয়। সেই অন্য ব্যবস্থায়ও অবশ্য চতুর্মুখী ও প্রশস্ত পথ একইভাবে থাকা চাই।

আমাদের দেশে আরো একটি ব্যাপার শিক্ষার ক্ষেত্রে ঘটছে, যার প্রয়োজন ছিল না। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ছাত্র-ছাত্রীর জন্য চার বছরের স্নাতক হওয়ার পরও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে সেই ডিগ্রিটি লাভ করা সামাজিকভাবে প্রায় অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ উন্নত বিশ্বে স্নাতকোত্তর শ্রেণিটি শুধু প্রয়োজন হয় শিক্ষকতা বা গবেষণার জন্য, অথবা নিজের কর্মজীবনে এমন একটি পর্যায়ে উপনীত হওয়া মানুষের, যাকে পরবর্তী পর্যায়ে নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে হাত লাগাতে হবে, অথবা নতুন সৃজনশীলতার সম্ভাবনা যার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। মোটের ওপর এটি জ্ঞান অর্জনের থেকে জ্ঞান সৃষ্টির জন্যই বেশি প্রয়োজন। আমাদের দেশের স্নাতকোত্তরের বাধ্যবাধকতার সঙ্গে এটি মেলে না। এ ব্যাপারে অনাবশ্যক চাপ সবার ওপর না দিলে একদিকে কাজের মাধ্যমে নিজের ও দেশের জন্য অবদান রাখার সুযোগ যেমন সবার ক্ষেত্রে বাড়ত, অন্যদিকে সত্যিকারের স্নাতকোত্তর শিক্ষার উন্নতি ঘটানো যেত। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ক্ষেত্রে এই চাপটি না থাকা সত্ত্বেও তাদের কোনো অসুবিধা হয় না।

বড় কথা হলো শিক্ষাকে অর্থপূর্ণ করা, উপযুক্ত করা, প্রশস্ত করা। ‘মানুষ আমরা’ নামের বইতে এ রকম কাম্য শিক্ষাব্যবস্থাকে আমি দেশ-বিদেশের নানা উদাহরণ নিয়ে আরো বিস্তৃত করেছি। শিশু শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত প্রতিটি স্তরকে আলাদাভাবে আলোচনা করেছি তাকে অর্থপূর্ণ করার দিক থেকে। দেশকে বদলানোর এই সময়টিতে সব স্তরে অর্থপূর্ণ শিক্ষার দিকে আমরা বড় বড় কিছু পদক্ষেপ নিতে পারি। অষ্টম শ্রেণিতে অনেকগুলো বিষয়কে বিসর্জন দেওয়ার রীতিটা বদলে দিয়ে আমরা প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারি।

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ