কধা’ ন এব’ মুয়েদি।
বল ন’ থেব’ লোরিবের। গিরিত চুর নেই ভরিবের।
ইত্তোকুদুমে বেরেবাক। গমে চেধাক দোরেবাক।
ঠাগুর-লোরি আনিবেক। আগর তারা মাদেবাক।
পুধি-বারমাস গেই দিবেক। বাঝি সারেন্দ বেই দিবেক।
ইত্তোকুদুমে চেবাক্কি। ব্যেক মানেইয়ে দেবাক্কি।
লুগে চেবাক্কি দুরত্তুন। উমেয়্যে বাচ নিঘিলিব’ মুরত্তুন।
নাগেই মুয়েই জোর বেভ’। মানেইর গরন ন’ থেব’।
আদাম্মেউনে থুবেবাক। গাঙকুলে সিধু বোই নিবাক।’
এই পালাটি বাদেও ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে শিবচরণ চাঙমার রচিত ‘গোঝেন লামা’ পালায় ধর্মীয় নানা বিষয়ে লেখা রয়েছে। চাকমা সমাজে শিবচরণের এই পালাটি এখনো জনপ্রিয় রয়ে গেছে। ‘গোঝেন লামা’ বাদে চাকমা সমাজে আরো একটি ধর্মীয় সূত্র বা ‘তারা’ রয়েছে। এই তারাগুলো সাধারণত চাকমাদের ধর্মীয় পুরোহিত লুরিরা ব্যবহার করেন। কোনো মরা-মৃত্যুর ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এই ‘তারা’গুলো লুরিদের পাঠ করতে শোনা যায়।
তাঁরা এই ‘তারা’গুলো ২৮টি পাঠে ভাগ করেছেন। এর মধ্যে সচরাচর এ কয়েকটি ‘তারা’ ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করে থাকেন। যেমন—আরিন্নামা তারা, পুদুমফুল তারা, পিণ্ডদানের সাকসুত্তুন তারা, আগুন ধরা সর্বদেহে তারা এবং মালেম তারা।
এই তারাগুলোর সুনির্দিষ্টভাবে লেখকের নাম নেই, তবে সবই চাকমা বর্ণের এবং হাতের লেখা। এই হাতের লেখা ‘তারা’গুলো লুরিদের বংশপরম্পরা (গুরু-শিষ্য) এখনো বহন করে আসছে। অনেকেই এ তারাগুলোর ভাষা দুর্বোধ্য হওয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের পালি ভাষা বলে মনে করেন।
সমাজ ও সঙ্গী-সাথি : এ যুগের সাহিত্যের আরো একটি দিক হলো সমাজবদ্ধ সাহিত্য। সে সময় রচিত পালা হয়েছে সামাজিক, প্রেম-প্রণয় ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলি নিয়ে। এগুলোর রচয়িতা অনেকের নাম রয়েছে, আবার অনেকের নাম হারিয়ে যায়। এর মূল কারণ হচ্ছে, এগুলোর লিখিত রূপ না থাকা। যা পাওয়া গেছে, তা চাকমা মধ্যযুগীয় সাহিত্যের অতুলনীয় রূপ। যেমন—
ক. চান্দবী বারমাস : রচয়িতা ধর্মধন পণ্ডিত; এটি চাকমা রাজা ভুবন মোহন রায়ের রাজত্বকালের সময় (১৮৯৭-১৯৩০)।
খ. কালেশ্বরী বারমাস : এই পালার রচনাকার পাওয়া যায়নি। শুধু হাতের লেখা চাকমা বর্ণমালায় সংরক্ষিত।
গ. মেয়েবী বারমাস : এটিরও কোনো রচনাকার পাওয়া যায়নি। এই পালার কাহিনিতে রচনাকার মেয়েদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনবৃত্তান্ত লিখে গেছেন।
ঘ. তান্যেবী বারমাস : চাকমাদের মধ্যে এই পালাটি একটি জনপ্রিয় পালা। এখানে পালাকার তান্যেবীকে রোমান্টিক চরিত্রে অঙ্কন করেছেন। ফলে তার জীবনে আবির্ভূত হয়েছে অনেক রোমান্টিক পুরুষ চরিত্র। যার কারণে সমাজ থেকে তাকে অনেক নিগৃহীত হতে হয়। তার একটি বিখ্যাত শ্লোক—
‘তান্যেবী রান্যেত যায়
সুগুরি দাদি তানেল্লোই
পুরনী কধা ইধোত তুলি
গুজুরী গুজুরী কানেল্লোই।
আইরে নাদিন তান্যেবী
তুল্যে সাঙু পাজ্জ্যে দিলে কার লাগি।’
তান্যেবী বারমাস ছাড়াও চাকমাদের আরো বারমাসী রয়েছে। তার মধ্যে মা-বাবার বারমাস, এটিও একটি বিখ্যাত বারমাস। যেমন—মা-বাবার ঋণ কিভাবে শোধ করতে হয় তা সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। এবার আসা যাক আধুনিক যুগে।
আধুনিক যুগ
বিংশ শতকে চাকমা সাহিত্যের আধুনিক যুগ সৃষ্টি হয়। এ যুগের (১৯৪০-১৯৪৫) প্রথম চাকমা চিত্রশিল্পী চুনিলাল দেওয়ান। তাঁর অনেক চিত্রশিল্প রয়েছে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙামাটির মিউজিয়ামে। এ ছাড়া আরো বহু চিত্রকলা রয়েছে তাঁর পারিবারিক চিত্রশালায়। তিনি চিত্রশিল্পের পাশাপাশি প্রথম চাকমা আধুনিক কবিতা লিখেছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। তিনি ছাড়াও আরো অনেক চাকমা কবি আধুনিক কবিতায় হাত দিয়েছেন। ১৯৫৬ সালে নোয়ারাম চাকমা ‘চাংমা শিক্ষা’, ১৯৬৭ সালে ‘পার্বত্যবাণী’ প্রকাশের পর লেখেন মুকুন্দ চাকমা, সলিল রায়, বীর কুমার তঞ্চঙ্গ্যা প্রমুখ।
১৯৭০ সালে সুগত চাকমা ননাধন প্রকাশ করেন ‘রাঙামাত্যে’ নামে ছোট একটি কবিতার বই। এরপর ‘পাদা রং কোচপানা’ নামে একটি ছোট কবিতার বই দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাঙমা প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর (জুভাপ্রদ) মুরুল্যে সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, জাগরণী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, গিরিসুর শিল্পীগোষ্ঠী, মুরুল্যে লিটারেচার গ্রুপ। এরপর ১৯৮১ সালে জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিল (জাক), জুম ইয়াং লিটারেচার সোসাইটি, বনযোগীছড়া কিশোর-কিশোর কল্যাণ সমিতি, আদিবাসী লেখক ফোরাম, পরবর্তীকালে চিটাগং হিলট্র্যাক্টস রাইটার্স ইউনিয়ন নামে নাম পরিবর্তন হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম আদিবাসী কবি পরিষদ সর্বশেষ ‘রীদিসুদম’ নামে আরো একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন জন্ম নিয়েছে। এ ছাড়া সরকারিভাবে তিন জেলায় তিনটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট রয়েছে। তারাও একযোগে সাহিত্য-সংস্কৃতির কাজে সহযোগিতা করছে।
এ ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাঙমা, সুগত চাঙমা, প্রগতি খীসা, শিশির চাঙমা, শ্যামল তালুকদার, তরুণ কুমার চাঙমা, জড়িতা চাঙমা, কুলদীপ রায়, সুসময় চাঙমা, আর্যমিত্র চাঙমা, নিউ হ্যাপি চাঙমা, নির্মল চাঙমা, চিত্রমোহন চাঙমা, অনুকণা চাঙমা, কিশলয় চাঙমা, তরুণ আলো চাঙমা, রূপসী চাঙমা, সমীরণ চাঙমা, বীর চাঙমা, মুক্তা চাঙমা, অম্লান চাঙমা, রনেল চাঙমা, লালনকান্তি চাঙমা, ভদ্রসেন চাঙমা, আনন্দজ্যোতি চাঙমা, সুপ্রিয় তালুকদার, সুলভ চাঙমা, নয়নজ্যোতি চাঙমা, আনন্দমোহন চাঙমা, বিপম চাঙমা, পুলক রায়, জগেজ্যাতি চাঙমা, রিপন তালুকদার, অভয় প্রকাশ চাঙমা, আলোময় চাঙমা, প্রিয়দর্শী খীসা, অজিত কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মধন তঞ্চঙ্গ্যা, কর্মসেন তঞ্চঙ্গ্যা, জগদীশ তঞ্চঙ্গ্যা, শুদ্ধধন তঞ্চঙ্গ্যা, মলয় ত্রিপুরা, মুকুল ত্রিপুরা, মুক্তা চাঙমা, চন্দন চাঙমা, লালন চাঙমা, সীমা দেবান, কিকো দেবান, শোভারানী চাঙমা, পুঞ্জিকা চাঙমা, সুশীল চাঙমা, সুশীল জীবন চাঙমা, পূর্ণ বিকাশ চাঙমা, রিপ রিপ চাঙমা, মিঠুন চাঙমা পহ্র, সুগম চাঙমা, কে ভি দেবাশীষ চাঙমা, উদয় শংকর চাঙমা, উজ্জ্বল কান্তি চাঙমা, অরুমিতা চাঙমা প্রমুখ কাজ করে গেছেন বা যাচ্ছেন। ম্যাগলিন চাঙমা, দীপংকর খীসাসহ অনেকে ছোট-বড় কবিতার বই প্রকাশ করেছেন এবং আরো অনেকেই আছেন বা আসছেন, যাঁরা ভবিষ্যতে আমাদের এই চাকমা সাহিত্যকে উজ্জ্বল ও সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন এবং যাবেন।
পাশাপাশি চাকমা নাট্যসাহিত্যও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে, যা স্বদেশের জাতীয় সাহিত্যে চাকমা নাটক বা নাট্যকারদের অনুপ্রেরণা জোগাতে ভূমিকা রাখতে সহায়ক হবে।
যেমন—রাঙামাটিতে নাট্য মঞ্চায়নের বহু আগে থেকে মঞ্চায়নের ইতিহাস রয়েছে। তখন ছিল পাকিস্তান অঞ্চল। পাড়াগ্রামের মানুষ জুমে এবং ধানি জমিতে কৃষিকাজ বোনার বা ফসল তোলার পর জমিতে কিছু সময় বিনোদন হিসেবে যাত্রা-নাটক আর চাকমা চারণ কবিদের গাওয়া গেংখুলি (পালাগান), কবিগান (সমতলের জারি-সারি গানের মতো) আসর বসাত। এগুলো সবই চাকমা ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ওপর পরিবেশিত হতো। তখন চাকমা ভাষায় কোনো নাটক রচিত না হওয়ায় বাংলা ভাষায় রচিত যাত্রা-নাটক পরিবেশন করত। এভাবে টানা ভাদ্র-আশ্বিন মাস থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত পাড়াগ্রামে এই ধারার প্রচলন ছিল। তারপর বৈশাখ মাস আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার জমি জুমের কাজে লেগে যায় আদিবাসী জুমিয়ারা।
সদ্য স্বাধীন দেশ। তখন মানুষের মনে এবং ঘরে ঘরে স্বস্তির নিঃশ্বাস। ভুলে যায় দীর্ঘ ৯ মাস স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার মধ্যে নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি-ইতিহাস-পালা-নাটকের ইতিকথা। তাই স্বস্তির মাঝে আবার জাগরিত হয় জুমিয়া মানুষের সেইসব চিত্তবিনোদন। শুরু হয় সেই পুরনো রীতিতে পালা-যাত্রাগানের আসর।
স্বাধীনতা-পরবর্তী ১৯৭৪ সালে রাঙামাটিতে পুরাতন স্টেডিয়ামে মাসব্যাপী আনন্দ মেলা শুরু হয়। এই মেলার মাধ্যমে রাঙামাটিবাসী উপভোগ করে কুমিল্লা, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলার স্বনামখ্যাত অপেরা দলের যাত্রাগানের পালা। সেই থেকে পরবর্তী চাকমা উচ্চশিক্ষিত তরুণরা ভাবতে শুরু করে নিজের ভাষার নাটক, গান, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙামাটিতে প্রথম উপজাতীয় সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট। বর্তমানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট, রাঙামাটির মাধ্যমে এসে যায় বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে আধুনিকতার ছোঁয়া।
আশির দশকের শুরুতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীরা (আদিবাসী) বিভিন্ন বিষয়ে আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি গড়ে তোলে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংগঠন, যার নাম রাঙামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ সালের পরে তিন পার্বত্য জেলার সদস্যদের অনুরোধক্রমে রাঙামাটি ঈসথেটিকস কাউন্সিল (রাক) থেকে নাম পরিবর্তিত হয়ে জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের (জাক) আত্মপ্রকাশ ঘটে। তারও আগে ঢাকাভিত্তিক আদিবাসীদের একমাত্র লিটারেচার ফোরাম ‘মুরল্যা লিটারেচার গ্রুপ’ এবং চট্টগ্রামভিত্তিক লিটারেচার ফোরাম ‘হিল্লো লিটারেচার গ্রুপ’। বিঝু, বৈসুক, সাংগ্রাইকে কেন্দ্র করে এ দুই লিটারেচার ফোরামের বেশ কয়েকটি সংকলন প্রকাশিত হয়। মূলত এ দুই ফোরামের সদস্যদের নিয়ে এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ।
এখানে জুম ঈসথেটিকস কাউন্সিলের একটি লেখা উদ্ধৃতি হিসেবে পরিবেশন করলাম। ‘জাক’ মূলত নাটক মঞ্চায়ন করে ১৯৮৩ সালে। নাটকটির রচয়িতা সেই সময়ের সংগঠনের সভাপতি চিরজ্যোতি চাকমা। নাটকটির নাম ‘আনাত ভাজি উধে কা মু’ অর্থাৎ আয়নায় ভেসে ওঠে কার মুখ। নাটকটি মূলত চাকমাদের উঠতি শিক্ষিত লোকদের মানসিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে রচিত। তখনকার সময়ে মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় সার্বিক দিক থেকে আমরা খুবই দুর্বল। আশির দশকে সংগঠনের মোট পাঁচটি নাটক মঞ্চায়িত হয়। শান্তিময় চাকমার রচিত তিনটি নাটক যথাক্রমে ‘যে দিনত যে কাল’ (যেদিনে যেমন, ১৯৮৫), ‘আন্দারত জুনি পহ্র’ (আঁধারে জোনাকির আলো, ১৯৮৬) এবং মৃত্তিকা চাকমার রচিত ‘দেবংসি আহ্ধর কালা ছাবা’ (অদৃশ্য হাতের কালো ছায়া, ১৯৮৯)। ১৯৮০-১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও উত্তপ্ত পার্বত্য পরিস্থিতির কারণে নাটক মঞ্চায়নসহ কোনো ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যে পাঁচটি নাটক মঞ্চায়ন করা হয়েছিল সেই সময়ে রাঙামাটি পৌরসভার টাউন হলে নাটক মঞ্চায়নের কোনো ধরনের সুব্যবস্থা বা পরিবেশই ছিল না। আধুনিক নাটক মঞ্চায়ন বলতে যা বোঝায়, যেমন সেট ব্যবহার, প্রপস, কস্টিউম ব্যবহার, মিউজিক, আলোর ব্যবস্থাপনা—সেসব ব্যবস্থা করা বা ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। নাটক মঞ্চায়নের অনেক দুর্বল দিক থাকা সত্ত্বেও শুধু কলাকুশলীদের আন্তরিক প্রেরণাই নাটক মঞ্চায়নের মতো দুরূহ কাজে হাত দেওয়া। আর সমাজের শিক্ষিত সম্প্রদায় কল্পনাই করতে পারেনি যে চাকমা ভাষায় নাটক মঞ্চায়ন করা সম্ভব। তাঁরা ভাবতেন, ভাষাটাই নাটকের সংলাপের উপযোগী নয়। সেসব তথাকথিত শিক্ষিত লোকদের অনেক কষ্টে বাস ভাড়া করে, টাউন হলে নিয়ে এসে, আবার নাটক মঞ্চায়ন শেষে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। তার পরও তাঁরা ঘোরলাগা চোখে বলেছেন, এটা আবার আমরা কী ধরনের নাটক দেখলাম। কিন্তু কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রাণভরে নাটক উপভোগ করেছে এবং নাটক মঞ্চায়নে উৎসাহ দিয়েছে।
আশির দশকে মঞ্চস্থ নাটকগুলোর মধ্যে শান্তিময় চাকমার রচিত ‘যে দিনত যে কাল’ নাটকটি শহরে বাবুদের বাবুয়ানা ও অপসংস্কৃতির ভ্রম নিয়ে কটাক্ষ করে লেখা। তবে সেই সময় মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মধ্যে ‘বিঝু রামর স্বর্গত যানা’ নাটকটি দর্শকদের মন আলোড়িত করতে পেরেছিল। এই নাটকটি রূপকধর্মী। নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন রুনু খাঁ, যিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধের সেনাপতি ছিলেন।
মৃত্তিকা চাকমার ‘দেবংসি আহ্ধর কালা ছাবা’ নাটকটি গ্রামীণ সমাজের কুটিল—‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের কীর্তিকাহিনি নিয়ে রচিত। নব্বইয়ের দশকে ‘জাক’ ৯টি নাটক মঞ্চায়ন করে। মৃত্তিকা চাকমা রচিত পাঁচটি নাটক যথাক্রমে ‘গোজেন’ (ভগবান, ১৯৯০), ‘মহেন্দ্রর বনভাজ’ (মহেন্দ্রর বনবাস, ১৯৯১), ‘একজুুর মান্নেক’ (এক জোড়া মানিক, ১৯৯২), ‘জোঘ্য’ (যজ্ঞ, ১৯৯৪), ‘হক্কানির ধন পানা’ (হক্কানির ধন-দৌলত পাওয়া, ১৯৯৯)।
প্রথম চারটি নাটকে খুব একটা সফল মঞ্চায়ন করতে হয়েছে তা বলা যাবে না। তবে ‘মহেন্দ্রর বনভাজ’ নাটকটি রাঙামাটির বাইরে প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ হয় ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে নিজস্ব নাট্যমঞ্চে। আধুনিক নাটকের রীতি অনুসারে মৃত্তিকা চাকমার ‘হক্কানির ধন পানা’ নাটকটি সফল মঞ্চনাটক। এ থেকে মূলত ‘জাক’-এর আধুনিক মঞ্চনাটকের পদযাত্রা।
আধুনিক নাটক প্রয়োগ রীতি অনুসারে যেকোনো নাটক মঞ্চায়ন করা বেশ কঠিন। রাঙামাটির মতো ছোট শহরে যেখানে নাটক মঞ্চায়ন করার উপযোগী মঞ্চ নেই, নাটক মঞ্চায়ন করার মতো সব উপাদান থাকলেও নাটক মঞ্চায়ন করার উপযোগী মঞ্চ না হলে নাটক দাঁড় করানো খুবই কষ্টসাধ্য।
ডা. ভগদত্ত খীসার ষাটের দশকের শেষ প্রান্তে রচিত ‘অয় নয় বদ্য’ (হওয়া না হওয়া বৈদ্য, ১৯৯৩), শান্তিময় চাকমা রচিত ‘ঝরা পাদার জিংকানি’ (ঝরে পড়া জীবনের কাহিনি, ১৯৯৪) এবং ঝিমিত ঝিমিত চাকমার নিজের লেখা দুটি নাটক ‘অহ্দত’ (স্থির, ১৯৯৫) ও ‘আন্দলত পহ্র’ (আড়ালে আলো, ১৯৯৬) তিনজনের চারটি নাটক মঞ্চস্থ হয়।
‘হক্কানির ধন পানা’ নাটকটি সর্বাধিকসংখ্যক মঞ্চায়ন করা হয়। শুধু প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে ঢাকায় মঞ্চায়ন করা হয় মহিলা সমিতির মঞ্চে, শহীদ মিনার, মিরপুর আউটার স্টেডিয়াম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক্সপেরিমেন্টাল হলে এবং রাঙামাটি জেলায় ২০ বারের বেশি মঞ্চস্থ হয়।
এ আলোচনা মঞ্চায়িত নাটকগুলোর মূল্যায়ন করা নয়, শুধু নাটকের বয়ান। এ আলোচনায় দুই দশকের মঞ্চায়িত নাটকগুলোর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে আলোচনা শেষ করা হলো। এর পরবর্তীকালে রাঙামাটিতে চাকমা নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে ‘অয় নয় বৈদ্য’, ‘ঝরা পাদার জিংকানি’, ‘অহ্দত’, ‘আন্দালত পহ্র’, ‘কাত্তোন’, ‘এগাত্তুরর তরনী’, ‘ভূত’, ‘দুলুকুমারী’, ‘অঈনজেব’, ‘থবাক’, ‘ঘুও চিল্যেবলী’, ‘আহ্জারী মু বাহ্’, ‘ফিরিই’, ‘দুলো পেদার দোলী নাজানা’। এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে রাঙামাটির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড।