মাস দুয়েক তার কোনো খবর নেই। ঠিক যখন মহসিন ভাবছে বুবুর মতো মেহদির লাশও সে একদিন মেঘনায় ভাসিয়ে দিয়েছে, কাতার থেকে ফোন এলো। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মেহদি কাঁদল। বলল, উটের পিঠের কুঁজোটা জাপটে ধরে বসে থেকে তাকে উটটাকে দৌড়াতে হয়। ব্যস, এই পর্যন্তই সে বলল, অথবা বলতে পারল। তারপর একদিন মাকে একজন কিছু টাকা দিয়ে গেল। উটের জকি মেহদির উপার্জন। তারপর মা যে কদিন বেঁচে ছিলেন, মাঝেমধ্যে মেহদি থেকে টাকা আসত। মা সেই টাকার একটিও খরচ করতেন না, একটা টিনের তোরঙে রেখে দিতেন। শেষে ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়ে যেদিন তাকে হাসপাতালে যেতে হলো, এবং ডাক্তার জানালেন তাঁর পেটে একটা অপারেশন না করলে তাঁকে বাঁচানো যাবে না, মহসিন হিসাব করে দেখল অপারেশন এবং ওষুধপত্রের জন্য যে টাকা লাগবে, পুরনো কাপড়ের বান্ডিলসহ বাবার দোকানটা বিক্রি করেও তার জোগাড় হবে না। তাকে শেষ পর্যন্ত সেই ছোট্ট টিনের তোরঙটাও খুলতে হবে। সে গাঝাড়া দিয়ে উঠে দোকানটা বিক্রি করল। কিন্তু সেই টাকার পুরোটা খরচ করা থেকে মা তাকে রেহাই দিলেন। তিনি কোনো শব্দ না করে, কোনো হা-হুতাশ না তুলে, সৃষ্টিকর্তাকে কোনো অভিযোগ না জানিয়ে বিদায় নিলেন। মহসিনকে শুধু আস্তে করে বললেন, একদিন আফলাতুন ফিরবে, মেহদিও। সেদিন এই তোরঙটা খুলিস।
শাহরাস্তির জীবনটাও যখন হারিয়ে গেল, যে জীবনে অন্তত মা ছিলেন—এবং তার থাকা ছিল একটা ফুটো পয়সার ফুটোটা ঘিরে থাকা তামার মতোই বাস্তব—মহসিন ভাসতে থাকল। এই ভাসা তাকে শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গা হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দিল। তার গুম হওয়া গ্রামের ফরিদুদ্দিন থাকেন দনিয়ায়, এক মসজিদে ইমামতি করেন। ফরিদুদ্দিনের পরিবারকে দুর্দিনে কিছু জমি দিয়ে বেঁচে থাকার একটা উপায় মহসিনের বাবা করে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ ফরিদুদ্দিন সেই সহায়তা স্মরণে রেখেছেন। তিনি বললেন, বাবা মহসিন, আমিও তোমার মতো ভাসতে ভাসতে ঢাকা এসেছি, একটা আশ্রয় পেয়েছি। বউ-বাচ্চা এখনো শ্বশুরবাড়ি। তাদের ঢাকা আনার একটা স্বপ্ন আছে, সেটা কবে ফলবে, ওপরওয়ালা জানেন। সেই পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকোক।
‘সেই পর্যন্ত’ কথাটা মহসিনের ভালো লাগল। তাতে সে একটা মাইল-নিশানা পেল। সে সিদ্ধান্ত নিল, সেই কদিনের মধ্যে ফুটো পয়সা থেকে অন্তত সিকি হতে হবে, যেন একটা কাঠের চৌকির মালিক হয়ে যে ঘরে চৌকিটা পাতা হবে, তার ভাড়াটা সে দিতে পারে।
মহসিন দেখল, স্কুল থেকে সে ষোলো আনা আদায় করলেও তা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, কলেজে পড়তে হবে। ফরিদুদ্দিন তাকে নিয়ে গেলেন দনিয়া কলেজে। এলাকায় ফরিদুদ্দিনের সুনাম আছে নির্ভেজাল ভালো মানুষ হিসেবে। কলেজে তার জায়গা হলো।
এক বিকেলে গুলিস্তানে ঘুরতে গেল মহসিন। গুলিস্তানের নাম সে শাহরাস্তিতেই শুনেছিল। এক মুরব্বি তার বাবাকে বলেছিলেন, যার কপালে কিছু পাওয়ার যোগ থাকে, যাকে ওপরওয়ালা কিছু দেবেন বলে ঠিক করেন, সে এই জায়গায় এলে সোনার কলস পায়। কিন্তু গ্রাম হারানো ক্লান্ত বাবা গুলিস্তানের ফুটপাতে পুরনো কাপড় ফেরি করে সোনার কলস পেতে কিছুমাত্র উৎসাহী ছিলেন না। মুরব্বিকে বলেছিলেন, তিনি ভবিতব্যে বিশ্বাস করেন না। যে জীবন হারিয়েছে, তা ফিরবে না।
মহসিনের কাছে গুলিস্তানের বিকেলটা কেন জানি ভোজবাজি মনে হচ্ছিল। প্রতিমুহূর্তে এর ছবি পাল্টাচ্ছিল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে এই দেখে পঁচিশটা বাস, পাঁচ হাজার মানুষ, রিকশা-ভ্যান, পুলিশ-মাস্তান, অন্য মুহূর্তে সেই ছবিটাই আরো আকীর্ণ হয়ে যায়, নয়তো এলিয়ে পড়ে, নয়তো এর ভেতর হঠাৎ ওঠে মেঘনার দশরথ মাঝির বইঠার গতি। নৌকাবাইচে গ্রামের দশরথ তার বিশ-বাইশ মাঝিকে এমন দক্ষতায় পরিচালনা করতেন যে তাঁর দলকে হারানো ছিল কঠিন। কোন সে দশরথ মাঝি এই মানুষ-বাহন-কোলাহল নিয়ন্ত্রণ করে গুলিস্তানের, মহসিন ভাবে।
সেদিন দুটি উপকার গুলিস্তান তাকে করেছিল। ঘোরলাগা হাঁটার একটা সময় সে দেখল, পুরনো স্যুটকেস বিক্রি করছে একজন। অনেক দিন থেকে মায়ের টিনের তোরঙটা নিয়ে উদ্বেগ তার। এটিকে খবরের কাগজে মুড়ে চৌকির নিচে সে রেখেছে। কিন্তু ঘরটা ফরিদুদ্দিনের। তাঁর কাছে লোকজন আসে। কেউ চাইলেই তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাক্সটা হাতিয়ে নিতে পারে। স্যুটকেসটা দেখে সে ভাবল, এর ভেতর টিনের বাক্সটা রেখে একটা চেন দিয়ে সে চৌকির একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখবে। শাহরাস্তির এক লোক ভারতে গিয়েছিলেন স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে। তিনি দেখেছেন, সে দেশের ট্রেনে এ রকম চেন দিয়ে বেঁধে স্যুটকেস রাখে যাত্রীরা। এক দেশের সতর্কতা আরেক দেশেও দেখানো যায়, সতর্কতার যেহেতু কোনো বর্ডার নেই।
দ্বিতীয় লাভটা অবশ্য দুনিয়াদারির না, যেহেতু এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে তেলেসমাতির—সাদাকে কালো করে দেওয়ার, আস্তিন থেকে গোলাপের কুঁড়ি বের করে ফুল ফোটানোর। এর নাম ম্যাজিক। জাদুবিদ্যা।
মহসিন দেখল এক দালানের সামনে এক চটপটে লোক চিৎকার করে বলছে, ম্যাজিক দেখে যান ভাইজানেরা। দেখে যান। ভালো লাগলে এই বাক্সে কিছু দেবেন, না লাগলে না। দালানটার নাম জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। জুমাবার বলে দালান বন্ধ। তার গেটে হেলান দিয়ে লোকটা জাদু দেখাবে বলে তৈরি হচ্ছে। আর একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। ভেলকিবাজি বলেন, জাদু-চালাকি বলেন, আসেন দেখে যান, সে একটা চোঙায় ঘোষণা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট্ট ভিড় দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা তার জাদু দেখানো শুরু করল। এক লোকের কাছ থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট নিয়ে মুঠোয় পুরল। মুঠো খুললে দেখা গেল দুই টাকা। লোকটা হৈচৈ শুরু করল। জাদুকর হেসে বলল, পকেট দেখেন। দেখা গেল পাঁচ টাকার নোটটা তার পকেটে। তারপর একটা রুমালে সে বাঁ হাতের মুঠি ঢেকে দিল। মহসিনকে বলল, কী আছে হাতে? মহসিন আমতা আমতা করে বলল, গোলাপ ফুল। লোকটা হাসল। আরো দু-তিনজনকে বলল। তারা নানা বস্তুর নাম বলল। লোকটা মহসিনকে বলল, রুমালটা সরাও। রুমাল সরালে দেখা গেল একটা পাখি, সেটা ফুড়ুত উড়াল দিল।
এইসব।
মিনিট পনেরো ম্যাজিক দেখানোর পর সে একটা খোলা জুতার বাক্স সবার সামনে ধরল, কেউ পাঁচ টাকা, কেউ দুই টাকা দিল। একজন একটা আধুলি দিল দেখে মহসিনও তা-ই করল। ভিড় ভেঙে গেলে একসময় মহসিন বলল, সে ছাত্র। তার কাছে টাকা থাকলে সে পাঁচ কেন, দশ টাকাও দিত।
লোকটা মহসিনের দিকে তাকাল। তারপর কী ভেবে তার আধুলিটা ফেরত দিল। বলল, যাও। বাসায় ফিরা পড়তে বসো। পড়াশোনা করো। আমি স্কুলে পড়ছি। কলেজে পড়ার কপাল হয় নাই। করলে এইসব বড় দালানে চাকরি হইত।
মহসিন সেই কথায় ভাগ নিল না। সে বলল, আমারে ম্যাজিক শেখাইবেন?
লোকটা এবার রেগে গেল। ম্যাজিক শিখা কি এসপি-ডিসি হইবা? মন্ত্রী-নেতা হইবা? এইসব দালানে চাকরি পাইবা? যাও।
এমনভাবে ‘যাও’ কথাটা বলল লোকটা যে এরপর দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে একটা বাঁদর বানিয়ে ফেলতে পারে, এ রকম একটা ভয়ও হলো। সে দৌড়ে পালাল।
কিন্তু এক বুধবারে গুলিস্তানে ফিরে গিয়ে মহসিন সোজা গেল গ্রন্থকেন্দ্রের ভেতর। ম্যাজিকের বই পেলে কিনে নেবে, সে রকম একটা আশা তার মনে জেগেছে। গ্রন্থকেন্দ্র তাকে নিরাশ করল। সেখানকার এক লোক মহসিনের উৎসাহ দেখে দয়াপরবশ হলেন। তিনি বললেন, কাটাবন যাও। পুরনো বইয়ের দোকানে দোকানে জিজ্ঞেস করো।
মহসিন তা-ই করল। জনে জনে জিজ্ঞেস করে সে জায়গাটা খুঁজে পেল। এক দোকানদার একটা বইয়ের স্তূপ থেকে ম্যাজিকের দুটি বই বের করল। দাম বলল, একটা বই তিন শ। দুইটা নিলে পাঁচ শ।
শাহরাস্তির পুরনো কাপড়ের দোকানে বসে দরদামের কৌশলটা সে শিখেছে। সে জানে কোথা থেকে ক্রেতাকে শুরু করতে হয়, কতটা দূর বিক্রেতা যেতে রাজি থাকে। বিদ্যাটা কাজে লাগল। জাদুবিদ্যার দুটি বই সে কিনল তিন শ টাকায়। দোকান বিক্রির যেটুকু সঞ্চয় ছিল মায়ের চিকিৎসা আর গোর দেওয়ার পর, তার একটা অংশ হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু মহসিন জানে, এই টাকা একদিন কয়েক গুণ হয়ে তার হাতে ফিরবে। জাদুবিদ্যা তা-ই বলে।
এরপর শুরু হলো তার দনিয়া কলেজে বাণিজ্যবিদ্যা শেখার পাশাপাশি জাদুবিদ্যায় তালিম নেওয়া। এই তালিমদারদের মধ্যে একজন শেখান হাতে-কলমে, আরেকজন বেশি জোর দেন বুদ্ধির ওপর। হাতে-কলমে যিনি ম্যাজিকের সহজ পাঠ দেন, তাঁর নাম মুরাদ আলী জিন্না। তার পরিচিতিতে লেখা আছে ‘জুয়েল আইচের প্রশংসাধন্য’। বইটি পড়তে পড়তে মহসিনের মনে হয়েছে, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য কেউ থাকলে তিনি এই জিন্না। তবে জিন্না সাহেবকে একদিন মহসিন যে ছাড়িয়ে যাবে, এই প্রত্যয় তার হলো। বইপড়ার কাজটা সে অবশ্য করে গোপনে। সে জানে ফরিদুদ্দিন এই বিদ্যাকে পছন্দ করবেন না। সে দুটি বইয়ে বাদামি কাগজের মলাট দিল। সেগুলো থাকে তার বালিশের নিচে, খোলের ভেতরে, রাতে ফরিদুদ্দিন বিছানায় গেলে সে বই দুটি বের করে পড়ে। আসরের নামাজের পর ফরিদুদ্দিন কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নেন, সেই সময়টুকুতে সে জিন্নার দেখানো ম্যাজিক প্র্যাকটিস করে।
একসময় জাদুবিদ্যার মর্মটা সে ধরতে পারল। একটা আস্ত বিদ্যা যে এতকাল টিকে আছে স্রেফ হাতের খেল আর চোখের ভ্রমের ওপর, তা নিশ্চয় সম্ভব হয়েছে অলীকের ওপর মানুষের বিশ্বাসের জন্য। তবে সবকিছুর পেছনে কাজ করে এক কৌতূহল—যা আছে মানুষের সেই আদিকাল থেকে—সৃষ্টির নানা করণকৌশল সম্পর্কে জানার। প্রাচীন মানুষ বিপদে পড়লে পরিত্রাণ চাইত অলীকের কাছে, গুহায় আটকে গেলে, খাদের কন্দরে পড়লে ‘ছিছিম ফাঁক’ মন্ত্রে নির্বাণ চাইত। সেই সঙ্গে ছিল মানুষের অমরত্বের বাসনা। এই সবকিছু মিলেমিশেই তো ম্যাজিক।
না, কথাগুলো আমাদের বা মহসিনের না। এসব গুলিস্তানের জাদুকর মুরসালিন মিয়ার ওস্তাদের, যিনি তাকে জাদুর অ আ থেকে নিয়ে সব শিখিয়েছেন।
মাঝেমধ্যেই জুমাবারে মহসিন গুলিস্তান এসেছে মুরসালিনের জাদু দেখতে। তিন-চারবার দেখা হলে সে বুঝতে পারল, মুরাদ আলী জিন্নার লেসন নাম্বার তেরো থেকে বেশি এগোননি এই জাদুকর। একদিন মুরসালিন যখন ছোটখাটো একটা ভিড় জমিয়ে কয়েকটা তাস সবাইকে দেখিয়ে একটি তাস হাতে উল্টো করে রেখে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করল তার হাতে কোন তাস, এবং সবাই একেকটা তাসের নাম বলল, মহসিন বলল ইস্কাপনের টেক্কা। মুরসালিনের মুখটা যেন ধড় থেকে খসে পড়ল। বাধ্য হয়ে ভিড়কে সে দেখাল, তার হাতে ইস্কাপনের টেক্কা। ভিড় এতে খুব হাসল, এবং হাসতে হাসতে পাতলা হয়ে গেল। এতে এক কিস্তির আয় থেকে মুরসালিন বঞ্চিত হলো। মহসিনকে এরপর তার খুন করার কথা। কিন্তু তা না করে ক্লান্ত স্বরে তাকে ডাকল। তারপর পাশে বসিয়ে প্রায় ধসে যাওয়া গলায় বলল, ভাইজান, কেন এই কাজটা করলা? আজ আমার আয়ে যে টান পড়বে, তাতে কি সংসার চালানোর টাকাটাও জুটবে?
মহসিন দেখল লোকটা হাঁপাচ্ছে। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার মনে হলো, একটা ইতরের কাজ সে করেছে। লোকটার কাছে ক্ষমা চেয়ে সে বলল, আমি ভাবি নাই আপনি এমন হতবুদ্ধি হইয়া যাবেন। জানলে তো আমি চুপ কইরা থাকতাম। মুরসালিন হাসল। শরীরটা ভালো থাকলে আমি ওই টেক্কা দিয়াই তোমারে টেক্কা দিতে পারতাম, কিন্তু শরীরটা খারাপ। আমার যতটা, বউয়ের তার থাইকাও বেশি।
একটুক্ষণ আলাপ করে মহসিন বুঝল, শরীরে জ্বর নিয়েও লোকটা—মুরসালিন ভাই, যেহেতু পরিচয় একটু গাঢ় হলে ম্যাজিকওয়ালা তার নামটা বলেছে—এসেছে তার বউয়ের ওষুধ কেনার জন্য টাকা জোগাড় করতে। ওষুধ মানেই একগাদা টাকা। মহসিন বলল, মুরসালিন ভাই, আপনে একটু জিরান। ম্যাজিকটা আজ আমি দেখাই। পয়সা যা পামু, তা দিয়া আপনি ভাবির ওষুদ কিনবেন।
মহসিন মনে মনে তার আরেক তালিমদার নিরঞ্জন তলাপাত্রের কিছু তত্ত্ব, কিছু কর্তব্য মনে করে নিল। পাবলিকে ম্যাজিক দেখাতে গেলে অনেক গুণ থাকতে হয়, লোক হাসানোর, চুটকি বলার। মনে রাখবেন, তলাপাত্র বলেছেন, ইউ আর এ পারফরমার। দনিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনার শিক্ষক আবুল বরকতও বলেন, করপোরেট দুনিয়ায় পা রাখলেই বুঝবা, ইউ হ্যাভ টু বি এ পারফরমার।
তাকেও পারফরমার হতে হবে।
ও ভাইজানেরা, কই যান, এট্টু থামেন, গ্রন্থকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মহসিন চিৎকার করে বলতে শুরু করল। বাড়ি যাওনের কী এমন তাড়া? বরং এট্টু ম্যাজিক দেইখ্যা যান। আর বাড়ি গিয়া করবেন কী, বলেন তো? বাড়ি গিয়া তো—
ততক্ষণে জনা দশেক মানুষ জমা হয়েছে। তাদের দেখে সে ‘বাড়ি যাওনের’ থেকে আবার শুরু করল। বলল, বাড়ি গিয়া বউয়ের সারা দিনের গঞ্জনার কথা কইবেন তো? গলাটা কাতর কইরা কইবেন, সবাই মিলে আপনারে কেমনে চটকায়। তো বউ কইব, ভালো উপাজ্জনের মুরোদ নাই, চটকাইব না তো কী করব? কন ভাইজান, এই কথা শুইনা বাড়ি থাইকা পলাইতে মন চাইব না আপনার?
জনা বিশের ভিড়ের মুখে হাসি ফুটল। এমনকি বউয়ের কষ্টে কাতর মুরসালিনের মুখেও। মহসিন দেখল, তলাপাত্রের তত্ত্ব পেপারে সে ‘এ’ পেয়েছে। এখন ভরসা মুরাদ আলী জিন্না।
আধাঘণ্টা পর পঞ্চান্ন টাকা মুরসালিনের হাতে তুলে দিল মহসিন। বলল, ভাবি ভালো হইবেন, দোয়া করি।
এরপর গুলিস্তানে এক জুমাবার পর পর মহসিনকে দেখা যেতে লাগল। তলাপাত্র আর জিন্নাকে সে বিদায় জানাল। এবার শুরু হলো অধ্যাপক এ এস কামালের ইন্দ্রজালের ‘কারিগর’ বইটির উচ্চতর ম্যাজিকের প্রদর্শনী। লোকজন জানল, মুরসালিনের সে ছোট ভাই। অনেক ছোট হলেও, ভাই। একদিন মহসিন বলল, ভাইজানেরা, আপনাদের দান-খয়রাতে, আলহামদুলিল্লাহ, ভাবি ভালো হয়েছেন। দেখেন না, আমার ভাইজান এখন কেমন সুখী। স্বাস্থ্যও আগের চাইতে তাগড়া। কন চাইন ক্যান?
ভিড়ের একজন বলল, আরে ভাইজান, ভাবি তার সোয়ামিরে মোটাতাজা করতাছে। সামনে কোরবানির ঈদ।
জনা ত্রিশের ভিড় হো হো করে হাসল। তারপর মুরসালিন ম্যাজিক দেখাল। তারপর মহসিন শুরু করল। জনা পঞ্চাশেকের ভিড়কে এ এস কামালের কিছু ভেলকিবাজি দেখাল। আর সাতটা জোক বলল। মানুষ হাসল। জুতার বাক্সে জমা হলো দুই শ চল্লিশ টাকা। মহসিন তা থেকে নিল চল্লিশ টাকা। খুশি হয়ে মুরসালিন বলল, আইজ তোমার ভাবিরে আর মেয়েটারে নিয়া সদরঘাটের নদীতে গিয়া নৌকায় ঘুরমু। আর ফুচকা চটপটি খামু।
নৌকায় নদীতে কেউ ঘুরছে শুনলে এখনো পুরনো একটা ক্ষতে টান পড়ে মহসিনের। আশ্বিন-কার্তিকের মেঘনা দিয়ে তাদের নিয়ে মা যেতেন তাঁর বাপের বাড়ি। মাইল দশেক ভাটিতে। কী যে সুখ ছিল সেই নৌকাযাত্রায়! সে তাড়াতাড়ি বলল, যান মুরসালিন ভাই।
মুরসালিনকে বিদায় জানিয়ে দনিয়ার পথ ধরল মহসিন। সে জানল, গ্রন্থকেন্দ্রের প্রদর্শনীতে তাকে আর কেউ দেখবে না। এটা এখন শুধুই মুরসালিনের, বরাবর যেমন ছিল। মুরসালিন হলো শীতে আরো বুড়িয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার মাঝি, আর সে ভরা বর্ষার মেঘনা। গুলিস্তানের এই একটুকরা জায়গায় মেঘনাকে ধরা যাবে না। এখন সে যাবে গুলশান মার্কেটে। বড়লোকের জায়গা। দনিয়ার এক লোক এই মার্কেটে কাজ করে, সে একটা ব্যবস্থা করে দেবে। দালাল-মাস্তান সবাইকে চাঁদা দিয়েও সপ্তায় দুই দিন ম্যাজিক দেখালে শ পাঁচেক টাকা উঠবে।
দুই
দনিয়ার পড়া শেষ হলে কলেজের প্রিন্সিপাল মহসিনকে বললেন, এবার একটা এমবিএ করো। তোমার রেজাল্ট ভালো, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নাও। ভালো রেজাল্টের ছেলেমেয়েদের পুরো বেতন মাফ করে দেয়।
সপ্তাহ দুয়েক কয়েক দরজায় ঘুরে সে দেখল, শুভংকর নামের লোকটা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকি দেওয়ার চাকরি করে। এক রাতে সে ফরিদুদ্দিনকে বলল, চাচা, বলেন তো কী করতে পারি?
ফরিদুদ্দিন ভাবলেন। বললেন, শুনছি তো এগুলোতে বিশেষ মেধার পুলা-মাইয়াদের মাগনা পড়তে দেয়। তুমি তো ভালো ম্যাজিক দেখাইতে পারো—
মহসিনের মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ফরিদুদ্দিন সবই তাহলে জানেন।
ফরিদুদ্দিন হাসলেন। বললেন, শোনো মহসিন, চুরিচামারি তো করতাছ না। ঘুষ খাইতাছ না। তুমি ম্যাজিক শিখছ শখে। এখন এইটা যদি বিদ্যা অর্জনের কাজে লাগাইতে পারো, মন্দ কি?
মহসিন এরপর একটা বেশ ভালো মানের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে টার্গেট করল। সেই ইউনিভার্সিটির একটা অনুষ্ঠান চলছিল। সে সোজা হাজির হলো সেই অনুষ্ঠানে। গেটে তাকে সিকিউরিটি আটাকাল। সে বলল, ম্যাজিক দেখাতে এসেছি। ভিসি স্যার জানেন।
সিকিউরিটি তাকে ভিসির কাছে নিয়ে গেলে সে স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমি এইচএসসিতে বাণিজ্যে গোল্ডেন এ। কিন্তু বেতন দেওয়ার পয়সা নাই। ম্যাজিক জানি। দেখাতে পারি। যদি ভালো লাগে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেবেন স্যার।
ভিসি নিজে বাণিজ্যের শিক্ষক। তিনি বললেন প্রোভিসিকে, ছেলেটার স্পাংক দেখেছেন? তারপর মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইটস এ ডিল।
তিন
চার বছরে মহসিন অনেক দূর গেল, রেজাল্ট উত্তম হলো। বাণিজ্যের অনেক কিছু শেখা হলো। শিক্ষকদের প্রশংসা পেল। একসময় করপোরেট দুনিয়ার দরজা গলিয়ে ভেতরে ঢোকাও সম্ভব হলো। পাশাপাশি তার ম্যাজিকও অধ্যাপক কামালকে ছাড়িয়ে পশ্চিমের বিখ্যাতদের টেনে আনল। গুগল ঘেঁটে একদিন সে ডিন র্যাডিন পিএইচডিকে আবিষ্কার করল। তাঁর থেকে জাদুবিদ্যার অনেক তত্ত্ব-তালাশের হদিস পেল। তাঁর একটা বইয়ে জাদুবিদ্যার ইতিহাস পড়তে গিয়ে একসময় তার গায়ে কাঁটা দিল। ইতালির বিখ্যাত জাদুকর টনি স্লাইডিনির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন, উনিশ শতক পর্যন্ত জাদুকররা হারিয়ে যাওয়া সময়ের কাছে মানুষকে ফেরত নিতে পারতেন, ঘড়ির কাঁটা ধরে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ সেকেন্ডের জন্য। হারানো ঘোড়া, বিড়াল অথবা—এমনকি মানুষকেও তারা হাজির করতে পারতেন, যদিও তাদের স্থিতি হতো আরো কম, দশ থেকে পনেরো সেকেন্ডের জন্য।
মহসিন জানে, এখন জ্যান্ত মানুষকে হাওয়া করে দেওয়ার দিন। এখন ম্যাজিকও এ দেশে সেই পুরনো দিন ফিরিয়ে আনবে না।
ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জাদু দেখিয়ে নাম কুড়িয়েছে মহসিন, কিন্তু অনেক অনুরোধেও তাকে বড় মঞ্চে কেউ নিতে পারেনি। একবার ইউনিভার্সিটির কমেন্সমেন্ট বক্তা হিসেবে এসেছিলেন জুয়েল আইচ। বড় একটা মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। বক্তৃতা শেষে সবার অনুরোধে দুটি জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি। দুটিই মহসিনের জানা। তবে আইচের মতো শিল্পগুণ তার নেই। ফলে সে চুপচাপ বসে দেখল। একসময় মহসিনের ডাক পড়ল। সে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন এক জাদু দেখাল। তার জাদু দেখে জুয়েল আইচ খুশি হলেন। তার পিঠ চাপড়ে বললেন, চর্চা চালিয়ে যাবে।
মহসিন হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, জাদু কি স্যার শুধুই হাতের আর বুদ্ধির খেলা, চোখের ভ্রম—নাকি এর নিজস্ব বাস্তবতা আছে?
জুয়েল আইচ একটু ভাবলেন। তারপর হেসে বললেন, নির্ভর করে বাস্তবের সংজ্ঞার ওপর, যে সংজ্ঞাটা খুঁজছে, তার ওপর।
স্লাইডিনির কথা মেনে নিলে জাদুবিদ্যা অবাস্তব হয়ে যাওয়া একটা কঠিন বাস্তবকে তার অবাস্তবতার আবরণ ঘুচিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে, দশ সেকেন্ডের জন্য হলেও। তার গায়ে আবার কাঁটা দিল। তার মনে হলো, বাস্তবের সংজ্ঞা হয়তো সব সময় ইট-কাঠ-সিমেন্টের সূত্র মানে না। মানলে মানুষ এখনো কেন আষাঢ়ে গল্পে বুঁদ হয়ে থাকে, ছোটবেলায় শোনা রূপকথার জাদুতে এমন আকর্ষণ বোধ করে?
চার
করপোরেটে চাকরি পাওয়ার পর দনিয়া থেকে ঢাকার নয়া দুনিয়ায় মহসিনের থাকাটা জরুরি হয়ে গেল। ফরিদুদ্দিন তাকে হাসিমুখেই বিদায় দিলেন। হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, বাবা, একটা ম্যাজিকের মতো ঘটনাই ঘটল মনে হইল, দুই জুম্মাবার আগে আমার বেতন বাড়ল, গত জুম্মাবারে একটা ঘর ভাড়া নিতে পারলাম পাশের গলিটায়!
এইবার তাইলে চাচিরে নিয়া আইবেন?
আইব না মানে? দুই বাচ্চা আমার। একসঙ্গে থাকতে পারি না, দিলটা ফাইটা যায়। এখন কত শান্তি!
আমিও এই ঘর ছাড়লাম, আপনেও। এত দিন পর। এত কাছাকাছি সময়। অবাক! মহসিন বলল।
ওপরওয়ালার কুদরত। বুঝলা বাবা, এর অর্থ বোঝা আমাদের কাম না।
এই হঠাৎ যোগাযোগগুলো মহসিনকে সব সময় বিস্মিত করে। আজও করল। হয়তো মনে মনে একটা প্রার্থনাও করল, বুবু আর মেহদি যদি হঠাৎ একদিন হাজির হতো, সময়ের দেয়াল টপকে। অথবা সময়কে সঙ্গে করেই।
সময় মেরামত করার শক্তিটা একটু একটু করে তার বেড়েছে।
পাঁচ
জাদুবিদ্যা নিয়ে যত সে পড়তে থাকল, তার মনে হলো, এই বিদ্যা অসম্ভবকে নিশ্চয় সম্ভব করতে পারে। হাত-পা বাঁধা হুদিনি কিভাবে লোহার বাক্সে বন্দি হয়ে পানির নিচ থেকে তিন-চার মিনিটে বের হয়ে যান? ডেভিড কপারফিল্ড কিভাবে আস্ত একটা ট্রেন হাজির করেন, অথবা ট্রেনটাকে হাওয়া করে দেন? একি শুধুই ভোজবাজি?
এবার সে এক কঠিন ব্রত নিয়ে নামল। আঠারো শতকের জাদুবীর জ্যাকব ফিলাডেলফিয়া ভিয়েনায় দ্বিতীয় কাইজার জোসেফকে কয়েকটি অশরীরী আত্মার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, একবার তাঁর এক হারানো বন্ধুকেও কিছুক্ষণের জন্য হাজির করেছিলেন। ফিলাডেলফিয়ার এই কীর্তির বিষয় পড়তে গিয়ে তৃতীয়বার তার শরীরে কাঁটা দিল। সে ভাবল, ওই জাদুবীর পারলে সে কেন পারবে না? সে তো তেমন কিছুই চাইছে না, শুধু বুবু আর মেহদির একটা খবর চাইছে। বাকিটা বাস্তবের রাস্তায় সে মোকাবেলা করবে।
আজকাল এই দুজনের কথা মনে হলে তার চোখে পানি আসে। তার জেদ প্রবল হয়। আজকেও তা-ই ঘটল, সে জেদি হলো, ফিলাডেলফিয়ার সূক্ষ্ম কলা তাকে আয়ত্ত করতেই হবে। অ্যামাজনে ঢুকে সে খুঁজেপেতে একটি বই পেল। তার অফিসের এক ক্লায়েন্টকে সে অনুরোধ করল, বইটা কি তিনি আনতে পারেন? ভদ্রলোক দুমাসে-তিনমাসে একবার আমেরিকা যান।
প্রথম পদক্ষেপটা তার হলো। এখন সময় তাকে চালিয়ে নেবে।
ছয়
ছয় মাস পর ফরিদুদ্দিন এসে হাজির হলেন মহসিনের নিকেতনের ফ্ল্যাটে। তার এক সহকর্মীর সঙ্গে সে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। লিফটে পাঁচতলায় পৌঁছে তিনি দরজার বেল বাজালেন। আগের দিন সন্ধ্যায় ফরিদুদ্দিনের ফোন পাওয়ার পর থেকে মহসিন উতলা হয়ে ছিল। জরুরি খবর আছে, তিনি বলেছিলেন। দেখা হলে বিস্তারিত বলবেন। মহসিন চাইছিল ফরিদুদ্দিনের ঘরে সে চলে যায়। তিনি বলেছেন, না, তিনিই যাবেন মহসিনের ফ্ল্যাটে। অনেক পীড়াপীড়িতে তিনি বলেছিলেন—হ্যাঁ, খবরে মেহদি আছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
রাতে তার ঘুম হয়নি। উত্তেজনায়। শঙ্কায়। এটাও তাহলে সম্ভব? ফিলাডেলফিয়া যা পেরেছেন, সেও তাই পেরেছে?
কিন্তু মনের কোথাও যে একটা উদ্বেগ এসে জমেছে, তার কী হবে?
ফরিদুদ্দিন স্পষ্ট কথার মানুষ। তার হাতে সময়ও কম, তিনি বললেন, মহসিন দনিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় দিয়েই মেহদি উট থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। খবরটা যারা পেয়েছিল, তারা তা চেপে গিয়েছিল, অথবা মহসিনকে তারা খুঁজে পায়নি।
মাটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ বসে রইল মহসিন। একটা কথাও যেন তার বলার নেই।
অনেক দিন পর উটের জকিদের নিয়ে হৈচৈ হয়েছে। বাচ্চাদের এখন আর উটের জকি করা হয় না। মেহদির বয়সীদেরও। এক বড় এনজিও মামলা করেছে। মামলায় বিরাট জরিমানা হয়েছে উটের দৌড় আয়োজনকারীদের। জেলও হয়েছে কারো কারো। বাংলাদেশের এক মানবাধিকার সংস্থাও ছিল মামলার বাদীদের মধ্যে। আর জখম হওয়াদের জন্য ভিন্ন হিসাব। তাদের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। কথা সংক্ষিপ্ত করলেন ফরিদুদ্দিন। মহসিন স্তব্ধ বসে আছে, যেন সে পাথর। তার চোখও পাথর। অথচ ফরিদুদ্দিনের কান্না আসছে। তিনি কান্না চেপে বললেন, স্থানীয় পুলিশ মেহদির থাকার ঘরে মহসিনের নাম পেয়েছে, নামটা বাংলাদেশের ওই সংস্থাকে দিয়েছে, তারা দিয়েছে ফরিদুদ্দিনকে, এনআইডি করতে ভোগান্তি হচ্ছে বলে ওদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, এবং তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা বলেছিলেন। আজ তারা মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।
করলও। সপ্তাহ দুয়েক পর নানা কাগজে স্বাক্ষর করে, নানাজনের এক শ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে যেন এক অদৃশ্য শক্তিকে সন্তুষ্ট করল, তার হাতে বিশ লাখ টাকার একটা চেক সংস্থাটি তুলে দিল।
এই দুই সপ্তাহ একটা পাথর-মানুষের মতো কাজগুলো করে গেল মহসিন। যেন তার বোধশক্তি নেই। অথবা মেঘনার স্র্রোতের আঘাতে ভোঁতা হয়ে গেছে। তার চোখ জুড়ে বসে থাকল মেহদি। একটা উটের কুঁজো ধরে, ভীতসন্ত্রস্ত্র চোখ মেলে। এত সুন্দর একটা ছেলের এই ছিল প্রাপ্য? তার পরও মহসিনের পাথর-হাত চেকটা ব্যাংকে জমা দিল।
সাত
এরপর দুটি কাজ করল মহসিন। জাদুবিদ্যার যত বই ছিল তার ঘরে, সব কটির পাতা ছিঁড়ে আবর্জনার বস্তায় ভরে রাস্তার মোড়ের ডাস্টবিনে ফেলে দিল। তার রাগটা বেশি গেল ফিলাডেলফিয়ার ওপর। তার বিশ্বাস হলো, লোকটা একটা আস্ত ফেরেববাজ।
দ্বিতীয় কাজটা ছিল টিনের বাক্সটা খোলা। মা বলেছিলেন বুবু আর মেহদি ফিরলে বাক্সটা খুলতে। মেহদি ফিরেছে, তবে চিরদিনের জন্য ছবি হয়ে থাকার জন্য। এতগুলো বছর পর। ফেরাই তো, এক বড় অর্থে।
বাক্সটা খুলতেই ন্যাফথালিনের একটা মৃদু গন্ধ মহসিনের নাকে ঢুকল, এবং তাকে কাবু করে দিল। মার্বেল পাথরের মতো ন্যাফথালিনের বলগুলো আর নেই। টাকার চার-পাঁচটা ছোট বান্ডেল। সুতা দিয়ে বাঁধা, হাতে নিতেই তার চোখ ঝাপসা হয়েছে। ঝাপসা চোখে সে দেখল, পত্রিকার কাগজে জড়ানো কিছু একটা। হয়তো চিঠিপত্র, কে জানে। সুতা দিয়ে হালকা করে বাঁধা। সুতাটা খুললে তার সামনে ভাসল কয়েকটি মুখ। পাঁচটি ছবি। মেহদির বয়স এক বছর হলে বাবা এক ফটোগ্রাফার ডেকে তাদের কিছু ছবি তুলেছিলেন। ছবিতে তারা সবাই আছে।
একটা ছবিতে শুধু মা আর বুবু। মা প্রসন্ন মুখে দাওয়ায় বসেছেন। বুবু তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে।
নিজেকে ধরে রাখা তার সম্ভব হলো না।
আট
চেতনা ফিরল ফোনের আওয়াজে। অফিস থেকে সেক্রেটারি লাইলি ফোনে জানতে চেয়েছে, সে অফিসে আসবে কি না। মহসিন ঘড়ি দেখল। এগারোটা বাজে। সে বলল, যাবে, তবে লাঞ্চের পর।
নিজেকে তার একটু সময় দিতে হবে।
করপোরেট ফোনটা তাকে শুধু অচেতন থেকে জাগায়নি, তার একটা চোখও যেন খুলে দিয়েছে। সেই চোখ দিয়ে সে দেখল, ছবিতে মা যেন তাকে বলছেন, ম্যাজিকের শিক্ষাটা কাজে লাগাও। প্রশ্ন করো। খোঁজো। যে খুঁজতে জানে না, সে পেতেও জানে না।
মহসিন চমকে উঠল। মায়ের পাশে দাঁড়ানো বুবুও যেন সেই কথায় সায় দিয়েছে। আয়, বুবু বলছে, খুঁজলে পাবি।
মহসিনের মনে পড়ল, মানবাধিকার সংস্থাটি মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়া তিন মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক টাকার ক্ষতিপূরণসহ।
সংস্থার সেলিনা আপার সঙ্গে তার বেশির ভাগ কাজ ছিল। তাঁকে একটা ফোন করতে হবে।
মেহদি হারিয়ে গিয়েও বুবুকে খোঁজার টাকাটা তাকে দিয়ে গেছে।
লাঞ্চের পর বসকে এক মাসের ছুটির জন্য অনুরোধ করতে হবে। এখন সেলিনা আপা কী বলেন, তার অপেক্ষায় থাকতে হবে।
দুরুদুরু বুকে টিনের বাক্সটা বন্ধ করতে গিয়ে সে শুনল, বুবু তাকে বলছে, তা কেন হবে? তুই না ম্যাজিক জানস, তোর আবার সেলিনা আপাকে কেন লাগবে?
মাথাটা হালকা লাগছে মহসিনের। সে বুঝল, কাজটা তাকে করতে হবে। পাওয়ার জন্য খুঁজতে হবে। তার মনে পড়ল, নিরঞ্জন তলাপাত্র বলেছেন, বড় ট্রিক দেখানোতে নামার আগে মাথাটা হালকা করতে হয়।
এখন মাথায় আর কোনো জটিল কিছু ঢোকানো যাবে না। মাথায় কোনো বোঝাও চাপানো যাবে না।
দেখা যাক।