জাদুকর

  • সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শেয়ার
জাদুকর
অঙ্কন : মাহবুবুল হক

মহসিন মিয়াজির একসময় একটা জীবন ছিল, যে জীবন এখন ঝাপসা স্মৃতি, অথবা এক রাতে মেঘনায় গুম হয়ে যাওয়া শৈশব। নদীর ভাঙনে গ্রাম হারিয়ে ঘরের মানুষগুলো বেঁচে থাকল সিকি-আধুলি হয়ে, যত দিন তার বাবা শাহরাস্তি বাজারে পুরনো কাপড় বিক্রির একটা দোকান খুলে দুই বেলা তাদের আহার জুটিয়ে গেলেন। জীবনযুদ্ধে ইস্তফা দিয়ে একদিন তিনি হারিয়ে গেলে সিকি-আধুলিগুলো খুচরা পয়সা হয়ে গেল, এবং হাতে হাতে ঘুরতে থাকল। মহসিনের মা কাজ নিলেন এক ভাতের হোটেলে।

মহসিনের বড় বোন পড়ল কিছু ভয়ানক লোকের হাতে, তার দেখা এরপর আর কোনো দিন কেউ পায়নি। মহসিন ভাবে, বুবু নিশ্চয় সাপের কামড়ে অথবা মাথায় জামগাছের মরা ডাল ভেঙে পড়লে মারা গেছে, এবং তার লাশ সে মেঘনায় নিজের হাতে ভাসিয়ে দিয়েছে। ভাবতে ভাবতে এখন এটিই তার কাছে সত্য, তার সান্ত্বনা।

এখন সে আরো ভাবে, বুবুর হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তার চিন্তায় যে বিভ্রম তৈরি হয়েছে, যার একদিকে আছে সত্য, অন্যদিকে মিথ্যা, অথবা সত্যর জায়গাটা একসময় দখল করে নিয়েছে মিথ্যা, তা-ই কি তাকে রাস্তায় নিয়ে গেছে? একটা কাজ জুটিয়ে দিয়েছে, যে কাজটা এক জাদুশিল্পীর, ম্যাজিশিয়ানের? ম্যাজিকও তো তা-ই করে, শূন্য থেকে একটা আস্ত গোলাপ হাতে তুলে দেয়, আস্তিন থেকে পাখি বের করে আনে।

তার ফুটো পয়সা হওয়া জীবনের গল্পের থেকেও ছোট আরেকটি গল্প তার থেকে ছয় বছরের ছোট ভাই মেহদির উটের জকি হয়ে কাতারে চলে যাওয়া। মেহদির শরীরটা বয়স অনুযায়ী বাড়েনি, তার ওজনেও ঘাটতি ছিল। ফলে আদম ব্যাপারীদের চোখ তার ওপর পড়েছিল। দুপুর পর্যন্ত দোকানে বসে একসময় খেতে চলে গেলে, এবং খাওয়া শেষে ভাতঘুমে গেলে সে আর মেহদি তার জায়গা নিত।

মহসিনের বাবা দুই ছেলের নাম এক বুজুর্গের কথা শুনে রেখেছিলেন, কিন্তু তাদের মাদরাসায় না পাঠিয়ে স্কুলেই পড়িয়েছিলেন। শাহরাস্তি এসেও তাদের তিনি স্কুলছাড়া করেননি। মহসিন স্কুল থেকে ষোলো আনাই নিয়েছে, কিন্তু মেহদি দুই আনাও নিতে পারেনি। তার তো বলতে গেলে স্কুলে তেমন পড়াও হয়নি। বাবা মারা গেলে একদিন কিছু মানুষ তাকে তুলে নিয়ে চলে গেল।
মাস দুয়েক তার কোনো খবর নেই। ঠিক যখন মহসিন ভাবছে বুবুর মতো মেহদির লাশও সে একদিন মেঘনায় ভাসিয়ে দিয়েছে, কাতার থেকে ফোন এলো। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে মেহদি কাঁদল। বলল, উটের পিঠের কুঁজোটা জাপটে ধরে বসে থেকে তাকে উটটাকে দৌড়াতে হয়। ব্যস, এই পর্যন্তই সে বলল, অথবা বলতে পারল। তারপর একদিন মাকে একজন কিছু টাকা দিয়ে গেল। উটের জকি মেহদির উপার্জন। তারপর মা যে কদিন বেঁচে ছিলেন, মাঝেমধ্যে মেহদি থেকে টাকা আসত। মা সেই টাকার একটিও খরচ করতেন না, একটা টিনের তোরঙে রেখে দিতেন। শেষে ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়ে যেদিন তাকে হাসপাতালে যেতে হলো, এবং ডাক্তার জানালেন তাঁর পেটে একটা অপারেশন না করলে তাঁকে বাঁচানো যাবে না, মহসিন হিসাব করে দেখল অপারেশন এবং ওষুধপত্রের জন্য যে টাকা লাগবে, পুরনো কাপড়ের বান্ডিলসহ বাবার দোকানটা বিক্রি করেও তার জোগাড় হবে না। তাকে শেষ পর্যন্ত সেই ছোট্ট টিনের তোরঙটাও খুলতে হবে। সে গাঝাড়া দিয়ে উঠে দোকানটা বিক্রি করল। কিন্তু সেই টাকার পুরোটা খরচ করা থেকে মা তাকে রেহাই দিলেন। তিনি কোনো শব্দ না করে, কোনো হা-হুতাশ না তুলে, সৃষ্টিকর্তাকে কোনো অভিযোগ না জানিয়ে বিদায় নিলেন। মহসিনকে শুধু আস্তে করে বললেন, একদিন আফলাতুন ফিরবে, মেহদিও। সেদিন এই তোরঙটা খুলিস।

শাহরাস্তির জীবনটাও যখন হারিয়ে গেল, যে জীবনে অন্তত মা ছিলেন—এবং তার থাকা ছিল একটা ফুটো পয়সার ফুটোটা ঘিরে থাকা তামার মতোই বাস্তব—মহসিন ভাসতে থাকল। এই ভাসা তাকে শীতলক্ষ্যা-বুড়িগঙ্গা হয়ে ঢাকায় পৌঁছে দিল। তার গুম হওয়া গ্রামের ফরিদুদ্দিন থাকেন দনিয়ায়, এক মসজিদে ইমামতি করেন। ফরিদুদ্দিনের পরিবারকে দুর্দিনে কিছু জমি দিয়ে বেঁচে থাকার একটা উপায় মহসিনের বাবা করে দিয়েছিলেন। কৃতজ্ঞ ফরিদুদ্দিন সেই সহায়তা স্মরণে রেখেছেন। তিনি বললেন, বাবা মহসিন, আমিও তোমার মতো ভাসতে ভাসতে ঢাকা এসেছি, একটা আশ্রয় পেয়েছি। বউ-বাচ্চা এখনো শ্বশুরবাড়ি। তাদের ঢাকা আনার একটা স্বপ্ন আছে, সেটা কবে ফলবে, ওপরওয়ালা জানেন। সেই পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকোক।

‘সেই পর্যন্ত’ কথাটা মহসিনের ভালো লাগল। তাতে সে একটা মাইল-নিশানা পেল। সে সিদ্ধান্ত নিল, সেই কদিনের মধ্যে ফুটো পয়সা থেকে অন্তত সিকি হতে হবে, যেন একটা কাঠের চৌকির মালিক হয়ে যে ঘরে চৌকিটা পাতা হবে, তার ভাড়াটা সে দিতে পারে।

মহসিন দেখল, স্কুল থেকে সে ষোলো আনা আদায় করলেও তা দিয়ে বেশিদূর যাওয়া যাবে না, কলেজে পড়তে হবে। ফরিদুদ্দিন তাকে নিয়ে গেলেন দনিয়া কলেজে। এলাকায় ফরিদুদ্দিনের সুনাম আছে নির্ভেজাল ভালো মানুষ হিসেবে। কলেজে তার জায়গা হলো।

এক বিকেলে গুলিস্তানে ঘুরতে গেল মহসিন। গুলিস্তানের নাম সে শাহরাস্তিতেই শুনেছিল। এক মুরব্বি তার বাবাকে বলেছিলেন, যার কপালে কিছু পাওয়ার যোগ থাকে, যাকে ওপরওয়ালা কিছু দেবেন বলে ঠিক করেন, সে এই জায়গায় এলে সোনার কলস পায়। কিন্তু গ্রাম হারানো ক্লান্ত বাবা গুলিস্তানের ফুটপাতে পুরনো কাপড় ফেরি করে সোনার কলস পেতে কিছুমাত্র উৎসাহী ছিলেন না। মুরব্বিকে বলেছিলেন, তিনি ভবিতব্যে বিশ্বাস করেন না। যে জীবন হারিয়েছে, তা ফিরবে না।

মহসিনের কাছে গুলিস্তানের বিকেলটা কেন জানি ভোজবাজি মনে হচ্ছিল। প্রতিমুহূর্তে এর ছবি পাল্টাচ্ছিল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে সে এই দেখে পঁচিশটা বাস, পাঁচ হাজার মানুষ, রিকশা-ভ্যান, পুলিশ-মাস্তান, অন্য মুহূর্তে সেই ছবিটাই আরো আকীর্ণ হয়ে যায়, নয়তো এলিয়ে পড়ে, নয়তো এর ভেতর হঠাৎ ওঠে মেঘনার দশরথ মাঝির বইঠার গতি। নৌকাবাইচে গ্রামের দশরথ তার বিশ-বাইশ মাঝিকে এমন দক্ষতায় পরিচালনা করতেন যে তাঁর দলকে হারানো ছিল কঠিন। কোন সে দশরথ মাঝি এই মানুষ-বাহন-কোলাহল নিয়ন্ত্রণ করে গুলিস্তানের, মহসিন ভাবে।

সেদিন দুটি উপকার গুলিস্তান তাকে করেছিল। ঘোরলাগা হাঁটার একটা সময় সে দেখল, পুরনো স্যুটকেস বিক্রি করছে একজন। অনেক দিন থেকে মায়ের টিনের তোরঙটা নিয়ে উদ্বেগ তার। এটিকে খবরের কাগজে মুড়ে চৌকির নিচে সে রেখেছে। কিন্তু ঘরটা ফরিদুদ্দিনের। তাঁর কাছে লোকজন আসে। কেউ চাইলেই তার চোখ ফাঁকি দিয়ে বাক্সটা হাতিয়ে নিতে পারে। স্যুটকেসটা দেখে সে ভাবল, এর ভেতর টিনের বাক্সটা রেখে একটা চেন দিয়ে সে চৌকির একটা পায়ার সঙ্গে বেঁধে রাখবে। শাহরাস্তির এক লোক ভারতে গিয়েছিলেন স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে। তিনি দেখেছেন, সে দেশের ট্রেনে এ রকম চেন দিয়ে বেঁধে স্যুটকেস রাখে যাত্রীরা। এক দেশের সতর্কতা আরেক দেশেও দেখানো যায়, সতর্কতার যেহেতু কোনো বর্ডার নেই।

দ্বিতীয় লাভটা অবশ্য দুনিয়াদারির না, যেহেতু এর সঙ্গে সম্পর্ক আছে তেলেসমাতির—সাদাকে কালো করে দেওয়ার, আস্তিন থেকে গোলাপের কুঁড়ি বের করে ফুল ফোটানোর। এর নাম ম্যাজিক। জাদুবিদ্যা।

মহসিন দেখল এক দালানের সামনে এক চটপটে লোক চিৎকার করে বলছে, ম্যাজিক দেখে যান ভাইজানেরা। দেখে যান। ভালো লাগলে এই বাক্সে কিছু দেবেন, না লাগলে না। দালানটার নাম জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র। জুমাবার বলে দালান বন্ধ। তার গেটে হেলান দিয়ে লোকটা জাদু দেখাবে বলে তৈরি হচ্ছে। আর একনাগাড়ে কথা বলে যাচ্ছে। ভেলকিবাজি বলেন, জাদু-চালাকি বলেন, আসেন দেখে যান, সে একটা চোঙায় ঘোষণা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা ছোট্ট ভিড় দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা তার জাদু দেখানো শুরু করল। এক লোকের কাছ থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট নিয়ে মুঠোয় পুরল। মুঠো খুললে দেখা গেল দুই টাকা। লোকটা হৈচৈ শুরু করল। জাদুকর হেসে বলল, পকেট দেখেন। দেখা গেল পাঁচ টাকার নোটটা তার পকেটে। তারপর একটা রুমালে সে বাঁ হাতের মুঠি ঢেকে দিল। মহসিনকে বলল, কী আছে হাতে? মহসিন আমতা আমতা করে বলল, গোলাপ ফুল। লোকটা হাসল। আরো দু-তিনজনকে বলল। তারা নানা বস্তুর নাম বলল। লোকটা মহসিনকে বলল, রুমালটা সরাও। রুমাল সরালে দেখা গেল একটা পাখি, সেটা ফুড়ুত উড়াল দিল।

এইসব।

মিনিট পনেরো ম্যাজিক দেখানোর পর সে একটা খোলা জুতার বাক্স সবার সামনে ধরল, কেউ পাঁচ টাকা, কেউ দুই টাকা দিল। একজন একটা আধুলি দিল দেখে মহসিনও তা-ই করল। ভিড় ভেঙে গেলে একসময় মহসিন বলল, সে ছাত্র। তার কাছে টাকা থাকলে সে পাঁচ কেন, দশ টাকাও দিত।

লোকটা মহসিনের দিকে তাকাল। তারপর কী ভেবে তার আধুলিটা ফেরত দিল। বলল, যাও। বাসায় ফিরা পড়তে বসো। পড়াশোনা করো। আমি স্কুলে পড়ছি। কলেজে পড়ার কপাল হয় নাই। করলে এইসব বড় দালানে চাকরি হইত।

মহসিন সেই কথায় ভাগ নিল না। সে বলল, আমারে ম্যাজিক শেখাইবেন?

লোকটা এবার রেগে গেল। ম্যাজিক শিখা কি এসপি-ডিসি হইবা? মন্ত্রী-নেতা হইবা? এইসব দালানে চাকরি পাইবা? যাও।

এমনভাবে ‘যাও’ কথাটা বলল লোকটা যে এরপর দাঁড়িয়ে থাকলে তাকে একটা বাঁদর বানিয়ে ফেলতে পারে, এ রকম একটা ভয়ও হলো। সে দৌড়ে পালাল।

কিন্তু এক বুধবারে গুলিস্তানে ফিরে গিয়ে মহসিন সোজা গেল গ্রন্থকেন্দ্রের ভেতর। ম্যাজিকের বই পেলে কিনে নেবে, সে রকম একটা আশা তার মনে জেগেছে। গ্রন্থকেন্দ্র তাকে নিরাশ করল। সেখানকার এক লোক মহসিনের উৎসাহ দেখে দয়াপরবশ হলেন। তিনি বললেন, কাটাবন যাও। পুরনো বইয়ের দোকানে দোকানে জিজ্ঞেস করো।

মহসিন তা-ই করল। জনে জনে জিজ্ঞেস করে সে জায়গাটা খুঁজে পেল। এক দোকানদার একটা বইয়ের স্তূপ থেকে ম্যাজিকের দুটি বই বের করল। দাম বলল, একটা বই তিন শ। দুইটা নিলে পাঁচ শ।

শাহরাস্তির পুরনো কাপড়ের দোকানে বসে দরদামের কৌশলটা সে শিখেছে। সে জানে কোথা থেকে ক্রেতাকে শুরু করতে হয়, কতটা দূর বিক্রেতা যেতে রাজি থাকে। বিদ্যাটা কাজে লাগল। জাদুবিদ্যার দুটি বই সে কিনল তিন শ টাকায়। দোকান বিক্রির যেটুকু সঞ্চয় ছিল মায়ের চিকিৎসা আর গোর দেওয়ার পর, তার একটা অংশ হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু মহসিন জানে, এই টাকা একদিন কয়েক গুণ হয়ে তার হাতে ফিরবে। জাদুবিদ্যা তা-ই বলে।

এরপর শুরু হলো তার দনিয়া কলেজে বাণিজ্যবিদ্যা শেখার পাশাপাশি জাদুবিদ্যায় তালিম নেওয়া। এই তালিমদারদের মধ্যে একজন শেখান হাতে-কলমে, আরেকজন বেশি জোর দেন বুদ্ধির ওপর। হাতে-কলমে যিনি ম্যাজিকের সহজ পাঠ দেন, তাঁর নাম মুরাদ আলী জিন্না। তার পরিচিতিতে লেখা আছে ‘জুয়েল আইচের প্রশংসাধন্য’। বইটি পড়তে পড়তে মহসিনের মনে হয়েছে, প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য কেউ থাকলে তিনি এই জিন্না। তবে জিন্না সাহেবকে একদিন মহসিন যে ছাড়িয়ে যাবে, এই প্রত্যয় তার হলো। বইপড়ার কাজটা সে অবশ্য করে গোপনে। সে জানে ফরিদুদ্দিন এই বিদ্যাকে পছন্দ করবেন না। সে দুটি বইয়ে বাদামি কাগজের মলাট দিল। সেগুলো থাকে তার বালিশের নিচে, খোলের ভেতরে, রাতে ফরিদুদ্দিন বিছানায় গেলে সে বই দুটি বের করে পড়ে। আসরের নামাজের পর ফরিদুদ্দিন কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নেন, সেই সময়টুকুতে সে জিন্নার দেখানো ম্যাজিক প্র্যাকটিস করে।

একসময় জাদুবিদ্যার মর্মটা সে ধরতে পারল। একটা আস্ত বিদ্যা যে এতকাল টিকে আছে স্রেফ হাতের খেল আর চোখের ভ্রমের ওপর, তা নিশ্চয় সম্ভব হয়েছে অলীকের ওপর মানুষের বিশ্বাসের জন্য। তবে সবকিছুর পেছনে কাজ করে এক কৌতূহল—যা আছে মানুষের সেই আদিকাল থেকে—সৃষ্টির নানা করণকৌশল সম্পর্কে জানার। প্রাচীন মানুষ বিপদে পড়লে পরিত্রাণ চাইত অলীকের কাছে, গুহায় আটকে গেলে, খাদের কন্দরে পড়লে ‘ছিছিম ফাঁক’ মন্ত্রে নির্বাণ চাইত। সেই সঙ্গে ছিল মানুষের অমরত্বের বাসনা। এই সবকিছু মিলেমিশেই তো ম্যাজিক।

না, কথাগুলো আমাদের বা মহসিনের না। এসব গুলিস্তানের জাদুকর মুরসালিন মিয়ার ওস্তাদের, যিনি তাকে জাদুর অ আ থেকে নিয়ে সব শিখিয়েছেন।

মাঝেমধ্যেই জুমাবারে মহসিন গুলিস্তান এসেছে মুরসালিনের জাদু দেখতে। তিন-চারবার দেখা হলে সে বুঝতে পারল, মুরাদ আলী জিন্নার লেসন নাম্বার তেরো থেকে বেশি এগোননি এই জাদুকর। একদিন মুরসালিন যখন ছোটখাটো একটা ভিড় জমিয়ে কয়েকটা তাস সবাইকে দেখিয়ে একটি তাস হাতে উল্টো করে রেখে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করল তার হাতে কোন তাস, এবং সবাই একেকটা তাসের নাম বলল, মহসিন বলল ইস্কাপনের টেক্কা। মুরসালিনের মুখটা যেন ধড় থেকে খসে পড়ল। বাধ্য হয়ে ভিড়কে সে দেখাল, তার হাতে ইস্কাপনের টেক্কা। ভিড় এতে খুব হাসল, এবং হাসতে হাসতে পাতলা হয়ে গেল। এতে এক কিস্তির আয় থেকে মুরসালিন বঞ্চিত হলো। মহসিনকে এরপর তার খুন করার কথা। কিন্তু তা না করে ক্লান্ত স্বরে তাকে ডাকল। তারপর পাশে বসিয়ে প্রায় ধসে যাওয়া গলায় বলল, ভাইজান, কেন এই কাজটা করলা? আজ আমার আয়ে যে টান পড়বে, তাতে কি সংসার চালানোর টাকাটাও জুটবে?

মহসিন দেখল লোকটা হাঁপাচ্ছে। তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। তার মনে হলো, একটা ইতরের কাজ সে করেছে। লোকটার কাছে ক্ষমা চেয়ে সে বলল, আমি ভাবি নাই আপনি এমন হতবুদ্ধি হইয়া যাবেন। জানলে তো আমি চুপ কইরা থাকতাম। মুরসালিন হাসল। শরীরটা ভালো থাকলে আমি ওই টেক্কা দিয়াই তোমারে টেক্কা দিতে পারতাম, কিন্তু শরীরটা খারাপ। আমার যতটা, বউয়ের তার থাইকাও বেশি।

একটুক্ষণ আলাপ করে মহসিন বুঝল, শরীরে জ্বর নিয়েও লোকটা—মুরসালিন ভাই, যেহেতু পরিচয় একটু গাঢ় হলে ম্যাজিকওয়ালা তার নামটা বলেছে—এসেছে তার বউয়ের ওষুধ কেনার জন্য টাকা জোগাড় করতে। ওষুধ মানেই একগাদা টাকা। মহসিন বলল, মুরসালিন ভাই, আপনে একটু জিরান। ম্যাজিকটা আজ আমি দেখাই। পয়সা যা পামু, তা দিয়া আপনি ভাবির ওষুদ কিনবেন।

মহসিন মনে মনে তার আরেক তালিমদার নিরঞ্জন তলাপাত্রের কিছু তত্ত্ব, কিছু কর্তব্য মনে করে নিল। পাবলিকে ম্যাজিক দেখাতে গেলে অনেক গুণ থাকতে হয়, লোক হাসানোর, চুটকি বলার। মনে রাখবেন, তলাপাত্র বলেছেন, ইউ আর এ পারফরমার। দনিয়া কলেজের ব্যবস্থাপনার শিক্ষক আবুল বরকতও বলেন, করপোরেট দুনিয়ায় পা রাখলেই বুঝবা, ইউ হ্যাভ টু বি এ পারফরমার।

তাকেও পারফরমার হতে হবে।

ও ভাইজানেরা, কই যান, এট্টু থামেন, গ্রন্থকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মহসিন চিৎকার করে বলতে শুরু করল। বাড়ি যাওনের কী এমন তাড়া? বরং এট্টু ম্যাজিক দেইখ্যা যান। আর বাড়ি গিয়া করবেন কী, বলেন তো? বাড়ি গিয়া তো—

ততক্ষণে জনা দশেক মানুষ জমা হয়েছে। তাদের দেখে সে ‘বাড়ি যাওনের’ থেকে আবার শুরু করল। বলল, বাড়ি গিয়া বউয়ের সারা দিনের গঞ্জনার কথা কইবেন তো? গলাটা কাতর কইরা কইবেন, সবাই মিলে আপনারে কেমনে চটকায়। তো বউ কইব, ভালো উপাজ্জনের মুরোদ নাই, চটকাইব না তো কী করব? কন ভাইজান, এই কথা শুইনা বাড়ি থাইকা পলাইতে মন চাইব না আপনার?

জনা বিশের ভিড়ের মুখে হাসি ফুটল। এমনকি বউয়ের কষ্টে কাতর মুরসালিনের মুখেও। মহসিন দেখল, তলাপাত্রের তত্ত্ব পেপারে সে ‘এ’ পেয়েছে। এখন ভরসা মুরাদ আলী জিন্না।

আধাঘণ্টা পর পঞ্চান্ন টাকা মুরসালিনের হাতে তুলে দিল মহসিন। বলল, ভাবি ভালো হইবেন, দোয়া করি।

এরপর গুলিস্তানে এক জুমাবার পর পর মহসিনকে দেখা যেতে লাগল। তলাপাত্র আর জিন্নাকে সে বিদায় জানাল। এবার শুরু হলো অধ্যাপক এ এস কামালের ইন্দ্রজালের ‘কারিগর’ বইটির উচ্চতর ম্যাজিকের প্রদর্শনী। লোকজন জানল, মুরসালিনের সে ছোট ভাই। অনেক ছোট হলেও, ভাই। একদিন মহসিন বলল, ভাইজানেরা, আপনাদের দান-খয়রাতে, আলহামদুলিল্লাহ, ভাবি ভালো হয়েছেন। দেখেন না, আমার ভাইজান এখন কেমন সুখী। স্বাস্থ্যও আগের চাইতে তাগড়া। কন চাইন ক্যান?

ভিড়ের একজন বলল, আরে ভাইজান, ভাবি তার সোয়ামিরে মোটাতাজা করতাছে। সামনে কোরবানির ঈদ।

জনা ত্রিশের ভিড় হো হো করে হাসল। তারপর মুরসালিন ম্যাজিক দেখাল। তারপর মহসিন শুরু করল। জনা পঞ্চাশেকের ভিড়কে এ এস কামালের কিছু ভেলকিবাজি দেখাল। আর সাতটা জোক বলল। মানুষ হাসল। জুতার বাক্সে জমা হলো দুই শ চল্লিশ টাকা। মহসিন তা থেকে নিল চল্লিশ টাকা। খুশি হয়ে মুরসালিন বলল, আইজ তোমার ভাবিরে আর মেয়েটারে নিয়া সদরঘাটের নদীতে গিয়া নৌকায় ঘুরমু। আর ফুচকা চটপটি খামু।

নৌকায় নদীতে কেউ ঘুরছে শুনলে এখনো পুরনো একটা ক্ষতে টান পড়ে মহসিনের। আশ্বিন-কার্তিকের মেঘনা দিয়ে তাদের নিয়ে মা যেতেন তাঁর বাপের বাড়ি। মাইল দশেক ভাটিতে। কী যে সুখ ছিল সেই নৌকাযাত্রায়! সে তাড়াতাড়ি বলল, যান মুরসালিন ভাই।

মুরসালিনকে বিদায় জানিয়ে দনিয়ার পথ ধরল মহসিন। সে জানল, গ্রন্থকেন্দ্রের প্রদর্শনীতে তাকে আর কেউ দেখবে না। এটা এখন শুধুই মুরসালিনের, বরাবর যেমন ছিল। মুরসালিন হলো শীতে আরো বুড়িয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গার মাঝি, আর সে ভরা বর্ষার মেঘনা। গুলিস্তানের এই একটুকরা জায়গায় মেঘনাকে ধরা যাবে না। এখন সে যাবে গুলশান মার্কেটে। বড়লোকের জায়গা। দনিয়ার এক লোক এই মার্কেটে কাজ করে, সে একটা ব্যবস্থা করে দেবে। দালাল-মাস্তান সবাইকে চাঁদা দিয়েও সপ্তায় দুই দিন ম্যাজিক দেখালে শ পাঁচেক টাকা উঠবে।

 

দুই

দনিয়ার পড়া শেষ হলে কলেজের প্রিন্সিপাল মহসিনকে বললেন, এবার একটা এমবিএ করো। তোমার রেজাল্ট ভালো, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নাও। ভালো রেজাল্টের ছেলেমেয়েদের পুরো বেতন মাফ করে দেয়।

সপ্তাহ দুয়েক কয়েক দরজায় ঘুরে সে দেখল, শুভংকর নামের লোকটা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ফাঁকি দেওয়ার চাকরি করে। এক রাতে সে ফরিদুদ্দিনকে বলল, চাচা, বলেন তো কী করতে পারি?

ফরিদুদ্দিন ভাবলেন। বললেন, শুনছি তো এগুলোতে বিশেষ মেধার পুলা-মাইয়াদের মাগনা পড়তে দেয়। তুমি তো ভালো ম্যাজিক দেখাইতে পারো—

মহসিনের মনে হলো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। ফরিদুদ্দিন সবই তাহলে জানেন।

ফরিদুদ্দিন হাসলেন। বললেন, শোনো মহসিন, চুরিচামারি তো করতাছ না। ঘুষ খাইতাছ না। তুমি ম্যাজিক শিখছ শখে। এখন এইটা যদি বিদ্যা অর্জনের কাজে লাগাইতে পারো, মন্দ কি?

মহসিন এরপর একটা বেশ ভালো মানের প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে টার্গেট করল। সেই ইউনিভার্সিটির একটা অনুষ্ঠান চলছিল। সে সোজা হাজির হলো সেই অনুষ্ঠানে। গেটে তাকে সিকিউরিটি আটাকাল। সে বলল, ম্যাজিক দেখাতে এসেছি। ভিসি স্যার জানেন।

সিকিউরিটি তাকে ভিসির কাছে নিয়ে গেলে সে স্যারের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার, আমি এইচএসসিতে বাণিজ্যে গোল্ডেন এ। কিন্তু বেতন দেওয়ার পয়সা নাই। ম্যাজিক জানি। দেখাতে পারি। যদি ভালো লাগে বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ দেবেন স্যার।

ভিসি নিজে বাণিজ্যের শিক্ষক। তিনি বললেন প্রোভিসিকে, ছেলেটার স্পাংক দেখেছেন? তারপর মহসিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ইটস এ ডিল।

 

তিন

চার বছরে মহসিন অনেক দূর গেল, রেজাল্ট উত্তম হলো। বাণিজ্যের অনেক কিছু শেখা হলো। শিক্ষকদের প্রশংসা পেল। একসময় করপোরেট দুনিয়ার দরজা গলিয়ে ভেতরে ঢোকাও সম্ভব হলো। পাশাপাশি তার ম্যাজিকও অধ্যাপক কামালকে ছাড়িয়ে পশ্চিমের বিখ্যাতদের টেনে আনল। গুগল ঘেঁটে একদিন সে ডিন র্যাডিন পিএইচডিকে আবিষ্কার করল। তাঁর থেকে জাদুবিদ্যার অনেক তত্ত্ব-তালাশের হদিস পেল। তাঁর একটা বইয়ে জাদুবিদ্যার ইতিহাস পড়তে গিয়ে একসময় তার গায়ে কাঁটা দিল। ইতালির বিখ্যাত জাদুকর টনি স্লাইডিনির উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানাচ্ছেন, উনিশ শতক পর্যন্ত জাদুকররা হারিয়ে যাওয়া সময়ের কাছে মানুষকে ফেরত নিতে পারতেন, ঘড়ির কাঁটা ধরে সর্বোচ্চ পঞ্চাশ সেকেন্ডের জন্য। হারানো ঘোড়া, বিড়াল অথবা—এমনকি মানুষকেও তারা হাজির করতে পারতেন, যদিও তাদের স্থিতি হতো আরো কম, দশ থেকে পনেরো সেকেন্ডের জন্য।

মহসিন জানে, এখন জ্যান্ত মানুষকে হাওয়া করে দেওয়ার দিন। এখন ম্যাজিকও এ দেশে সেই পুরনো দিন ফিরিয়ে আনবে না।

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় জাদু দেখিয়ে নাম কুড়িয়েছে মহসিন, কিন্তু অনেক অনুরোধেও তাকে বড় মঞ্চে কেউ নিতে পারেনি। একবার ইউনিভার্সিটির কমেন্সমেন্ট বক্তা হিসেবে এসেছিলেন জুয়েল আইচ। বড় একটা মিলনায়তনে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। বক্তৃতা শেষে সবার অনুরোধে দুটি জাদু দেখিয়েছিলেন তিনি। দুটিই মহসিনের জানা। তবে আইচের মতো শিল্পগুণ তার নেই। ফলে সে চুপচাপ বসে দেখল। একসময় মহসিনের ডাক পড়ল। সে অনেক কুণ্ঠা নিয়ে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে কঠিন এক জাদু দেখাল। তার জাদু দেখে জুয়েল আইচ খুশি হলেন। তার পিঠ চাপড়ে বললেন, চর্চা চালিয়ে যাবে।

মহসিন হঠাৎ তাঁকে জিজ্ঞেস করল, জাদু কি স্যার শুধুই হাতের আর বুদ্ধির খেলা, চোখের ভ্রম—নাকি এর নিজস্ব বাস্তবতা আছে?

জুয়েল আইচ একটু ভাবলেন। তারপর হেসে বললেন, নির্ভর করে বাস্তবের সংজ্ঞার ওপর, যে সংজ্ঞাটা খুঁজছে, তার ওপর।

স্লাইডিনির কথা মেনে নিলে জাদুবিদ্যা অবাস্তব হয়ে যাওয়া একটা কঠিন বাস্তবকে তার অবাস্তবতার আবরণ ঘুচিয়ে ফিরিয়ে আনতে পারে, দশ সেকেন্ডের জন্য হলেও। তার গায়ে আবার কাঁটা দিল। তার মনে হলো, বাস্তবের সংজ্ঞা হয়তো সব সময় ইট-কাঠ-সিমেন্টের সূত্র মানে না। মানলে মানুষ এখনো কেন আষাঢ়ে গল্পে বুঁদ হয়ে থাকে, ছোটবেলায় শোনা রূপকথার জাদুতে এমন আকর্ষণ বোধ করে?

 

চার

করপোরেটে চাকরি পাওয়ার পর দনিয়া থেকে ঢাকার নয়া দুনিয়ায় মহসিনের থাকাটা জরুরি হয়ে গেল। ফরিদুদ্দিন তাকে হাসিমুখেই বিদায় দিলেন। হাসিটা ধরে রেখেই বললেন, বাবা, একটা ম্যাজিকের মতো ঘটনাই ঘটল মনে হইল, দুই জুম্মাবার আগে আমার বেতন বাড়ল, গত জুম্মাবারে একটা ঘর ভাড়া নিতে পারলাম পাশের গলিটায়!

এইবার তাইলে চাচিরে নিয়া আইবেন?

আইব না মানে? দুই বাচ্চা আমার। একসঙ্গে থাকতে পারি না, দিলটা ফাইটা যায়। এখন কত শান্তি!

আমিও এই ঘর ছাড়লাম, আপনেও। এত দিন পর। এত কাছাকাছি সময়। অবাক! মহসিন বলল।

ওপরওয়ালার কুদরত। বুঝলা বাবা, এর অর্থ বোঝা আমাদের কাম না।

এই হঠাৎ যোগাযোগগুলো মহসিনকে সব সময় বিস্মিত করে। আজও করল। হয়তো মনে মনে একটা প্রার্থনাও করল, বুবু আর মেহদি যদি হঠাৎ একদিন হাজির হতো, সময়ের দেয়াল টপকে। অথবা সময়কে সঙ্গে করেই।

সময় মেরামত করার শক্তিটা একটু একটু করে তার বেড়েছে।

 

পাঁচ

জাদুবিদ্যা নিয়ে যত সে পড়তে থাকল, তার মনে হলো, এই বিদ্যা অসম্ভবকে নিশ্চয় সম্ভব করতে পারে। হাত-পা বাঁধা হুদিনি কিভাবে লোহার বাক্সে বন্দি হয়ে পানির নিচ থেকে তিন-চার মিনিটে বের হয়ে যান? ডেভিড কপারফিল্ড কিভাবে আস্ত একটা ট্রেন হাজির করেন, অথবা ট্রেনটাকে হাওয়া করে দেন? একি শুধুই ভোজবাজি?

এবার সে এক কঠিন ব্রত নিয়ে নামল। আঠারো শতকের জাদুবীর জ্যাকব ফিলাডেলফিয়া ভিয়েনায় দ্বিতীয় কাইজার জোসেফকে কয়েকটি অশরীরী আত্মার হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, একবার তাঁর এক হারানো বন্ধুকেও কিছুক্ষণের জন্য হাজির করেছিলেন। ফিলাডেলফিয়ার এই কীর্তির বিষয় পড়তে গিয়ে তৃতীয়বার তার শরীরে কাঁটা দিল। সে ভাবল, ওই জাদুবীর পারলে সে কেন পারবে না? সে তো তেমন কিছুই চাইছে না, শুধু বুবু আর মেহদির একটা খবর চাইছে। বাকিটা বাস্তবের রাস্তায় সে মোকাবেলা করবে।

আজকাল এই দুজনের কথা মনে হলে তার চোখে পানি আসে। তার জেদ প্রবল হয়। আজকেও তা-ই ঘটল, সে জেদি হলো, ফিলাডেলফিয়ার সূক্ষ্ম কলা তাকে আয়ত্ত করতেই হবে। অ্যামাজনে ঢুকে সে খুঁজেপেতে একটি বই পেল। তার অফিসের এক ক্লায়েন্টকে সে অনুরোধ করল, বইটা কি তিনি আনতে পারেন? ভদ্রলোক দুমাসে-তিনমাসে একবার আমেরিকা যান।

প্রথম পদক্ষেপটা তার হলো। এখন সময় তাকে চালিয়ে নেবে।

 

ছয়

ছয় মাস পর ফরিদুদ্দিন এসে হাজির হলেন মহসিনের নিকেতনের ফ্ল্যাটে। তার এক সহকর্মীর সঙ্গে সে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছে। লিফটে পাঁচতলায় পৌঁছে তিনি দরজার বেল বাজালেন। আগের দিন সন্ধ্যায় ফরিদুদ্দিনের ফোন পাওয়ার পর থেকে মহসিন উতলা হয়ে ছিল। জরুরি খবর আছে, তিনি বলেছিলেন। দেখা হলে বিস্তারিত বলবেন। মহসিন চাইছিল ফরিদুদ্দিনের ঘরে সে চলে যায়। তিনি বলেছেন, না, তিনিই যাবেন মহসিনের ফ্ল্যাটে। অনেক পীড়াপীড়িতে তিনি বলেছিলেন—হ্যাঁ, খবরে মেহদি আছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই।

রাতে তার ঘুম হয়নি। উত্তেজনায়। শঙ্কায়। এটাও তাহলে সম্ভব? ফিলাডেলফিয়া যা পেরেছেন, সেও তাই পেরেছে?

কিন্তু মনের কোথাও যে একটা উদ্বেগ এসে জমেছে, তার কী হবে?

ফরিদুদ্দিন স্পষ্ট কথার মানুষ। তার হাতে সময়ও কম, তিনি বললেন, মহসিন দনিয়া কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় দিয়েই মেহদি উট থেকে পড়ে মারা গিয়েছিল। খবরটা যারা পেয়েছিল, তারা তা চেপে গিয়েছিল, অথবা মহসিনকে তারা খুঁজে পায়নি।

মাটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ বসে রইল মহসিন। একটা কথাও যেন তার বলার নেই।

অনেক দিন পর উটের জকিদের নিয়ে হৈচৈ হয়েছে। বাচ্চাদের এখন আর উটের জকি করা হয় না। মেহদির বয়সীদেরও। এক বড় এনজিও মামলা করেছে। মামলায় বিরাট জরিমানা হয়েছে উটের দৌড় আয়োজনকারীদের। জেলও হয়েছে কারো কারো। বাংলাদেশের এক মানবাধিকার সংস্থাও ছিল মামলার বাদীদের মধ্যে। আর জখম হওয়াদের জন্য ভিন্ন হিসাব। তাদের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। কথা সংক্ষিপ্ত করলেন ফরিদুদ্দিন। মহসিন স্তব্ধ বসে আছে, যেন সে পাথর। তার চোখও পাথর। অথচ ফরিদুদ্দিনের কান্না আসছে। তিনি কান্না চেপে বললেন, স্থানীয় পুলিশ মেহদির থাকার ঘরে মহসিনের নাম পেয়েছে, নামটা বাংলাদেশের ওই সংস্থাকে দিয়েছে, তারা দিয়েছে ফরিদুদ্দিনকে, এনআইডি করতে ভোগান্তি হচ্ছে বলে ওদের কাছে তিনি গিয়েছিলেন, এবং তাদের অদৃশ্য হয়ে যাওয়া গ্রামের কথা বলেছিলেন। আজ তারা মহসিনের সঙ্গে যোগাযোগ করবে।

করলও। সপ্তাহ দুয়েক পর নানা কাগজে স্বাক্ষর করে, নানাজনের এক শ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সে যেন এক অদৃশ্য শক্তিকে সন্তুষ্ট করল, তার হাতে বিশ লাখ টাকার একটা চেক সংস্থাটি তুলে দিল।

এই দুই সপ্তাহ একটা পাথর-মানুষের মতো কাজগুলো করে গেল মহসিন। যেন তার বোধশক্তি নেই। অথবা মেঘনার স্র্রোতের আঘাতে ভোঁতা হয়ে গেছে। তার চোখ জুড়ে বসে থাকল মেহদি। একটা উটের কুঁজো ধরে, ভীতসন্ত্রস্ত্র চোখ মেলে। এত সুন্দর একটা ছেলের এই ছিল প্রাপ্য? তার পরও মহসিনের পাথর-হাত চেকটা ব্যাংকে জমা দিল।

 

সাত

এরপর দুটি কাজ করল মহসিন। জাদুবিদ্যার যত বই ছিল তার ঘরে, সব কটির পাতা ছিঁড়ে আবর্জনার বস্তায় ভরে রাস্তার মোড়ের ডাস্টবিনে ফেলে দিল। তার রাগটা বেশি গেল ফিলাডেলফিয়ার ওপর। তার বিশ্বাস হলো, লোকটা একটা আস্ত ফেরেববাজ।

দ্বিতীয় কাজটা ছিল টিনের বাক্সটা খোলা। মা বলেছিলেন বুবু আর মেহদি ফিরলে বাক্সটা খুলতে। মেহদি ফিরেছে, তবে চিরদিনের জন্য ছবি হয়ে থাকার জন্য। এতগুলো বছর পর। ফেরাই তো, এক বড় অর্থে।

বাক্সটা খুলতেই ন্যাফথালিনের একটা মৃদু গন্ধ মহসিনের নাকে ঢুকল, এবং তাকে কাবু করে দিল। মার্বেল পাথরের মতো ন্যাফথালিনের বলগুলো আর নেই। টাকার চার-পাঁচটা ছোট বান্ডেল। সুতা দিয়ে বাঁধা, হাতে নিতেই তার চোখ ঝাপসা হয়েছে। ঝাপসা চোখে সে দেখল, পত্রিকার কাগজে জড়ানো কিছু একটা। হয়তো চিঠিপত্র, কে জানে। সুতা দিয়ে হালকা করে বাঁধা। সুতাটা খুললে তার সামনে ভাসল কয়েকটি মুখ। পাঁচটি ছবি। মেহদির বয়স এক বছর হলে বাবা এক ফটোগ্রাফার ডেকে তাদের কিছু ছবি তুলেছিলেন। ছবিতে তারা সবাই আছে।

একটা ছবিতে শুধু মা আর বুবু। মা প্রসন্ন মুখে দাওয়ায় বসেছেন। বুবু তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে।

নিজেকে ধরে রাখা তার সম্ভব হলো না।

 

আট

চেতনা ফিরল ফোনের আওয়াজে। অফিস থেকে সেক্রেটারি লাইলি ফোনে জানতে চেয়েছে, সে অফিসে আসবে কি না। মহসিন ঘড়ি দেখল। এগারোটা বাজে। সে বলল, যাবে, তবে লাঞ্চের পর।

নিজেকে তার একটু সময় দিতে হবে।

করপোরেট ফোনটা তাকে শুধু অচেতন থেকে জাগায়নি, তার একটা চোখও যেন খুলে দিয়েছে। সেই চোখ দিয়ে সে দেখল, ছবিতে মা যেন তাকে বলছেন, ম্যাজিকের শিক্ষাটা কাজে লাগাও। প্রশ্ন করো। খোঁজো। যে খুঁজতে জানে না, সে পেতেও জানে না।

মহসিন চমকে উঠল। মায়ের পাশে দাঁড়ানো বুবুও যেন সেই কথায় সায় দিয়েছে। আয়, বুবু বলছে, খুঁজলে পাবি।

মহসিনের মনে পড়ল, মানবাধিকার সংস্থাটি মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়া তিন মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছে। অনেক টাকার ক্ষতিপূরণসহ।

সংস্থার সেলিনা আপার সঙ্গে তার বেশির ভাগ কাজ ছিল। তাঁকে একটা ফোন করতে হবে।

মেহদি হারিয়ে গিয়েও বুবুকে খোঁজার টাকাটা তাকে দিয়ে গেছে।

লাঞ্চের পর বসকে এক মাসের ছুটির জন্য অনুরোধ করতে হবে। এখন সেলিনা আপা কী বলেন, তার অপেক্ষায় থাকতে হবে।

দুরুদুরু বুকে টিনের বাক্সটা বন্ধ করতে গিয়ে সে শুনল, বুবু তাকে বলছে, তা কেন হবে? তুই না ম্যাজিক জানস, তোর আবার সেলিনা আপাকে কেন লাগবে?

মাথাটা হালকা লাগছে মহসিনের। সে বুঝল, কাজটা তাকে করতে হবে। পাওয়ার জন্য খুঁজতে হবে। তার মনে পড়ল, নিরঞ্জন তলাপাত্র বলেছেন, বড় ট্রিক দেখানোতে নামার আগে মাথাটা হালকা করতে হয়।

এখন মাথায় আর কোনো জটিল কিছু ঢোকানো যাবে না। মাথায় কোনো বোঝাও চাপানো যাবে না।

দেখা যাক।

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

শীত বিকেল

    শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া
শেয়ার
শীত বিকেল
অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’

কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।

যে শহরে তার নিজেরই ঠিকানার ঠিক নেই, সেখানে আবার কাক!

মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।

‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’

প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।

‘দেখান তো ভাই।’

র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।

লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।

দুজনই মোবাইল নিয়ে রাতভর পড়ে থাকে। ফেসবুক, টিকটক—আরো কত কী দেখে! ফাঁক পেলেই এসব নিয়ে কথা বলে দুজন। ফেসবুক অবশ্য মাশুকও দেখে। রাতে ঘুম না এলে ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখে।

অঙ্কন : বিপ্লব চক্রবর্ত্তী

‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’

নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।

মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!

লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’

লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!

তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?

পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।

‘কী করছ, বাবা?’

‘এইতো—দোকানে বসছি।’

‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’

‘কেন?’

‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’

‘খুব দরকার?’

‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’

‘দেখি।’

‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’

লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।

মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’

বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।

এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।

দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।

মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।

এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।

‘তুমি!’

যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।

মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’

‘আসো।’

দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’

নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’

‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’

‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’

‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’

‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’

নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।

মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’

নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’

মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’

নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’

‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’

নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’

এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’

নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।

নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।

নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’

নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’

এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।

নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’

হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা  মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’

মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’

‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’

‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’

নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।

বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’

‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’

‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’

মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!

নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’

মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’

নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’

নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।

 

 

 

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

একটি পুরনো গল্প

    ইউসুফ শরীফ
শেয়ার
একটি পুরনো গল্প
অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।

ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।

বেশ ক’দিন ধরে এই রিনঝিন চাপা সুবাস ছড়ানো হাসির ঢেউ ঠিক এখানে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গেই তার ওপর আছড়ে পড়ে।

সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।

হাসি মানবীয় সম্পর্কের এক আদি নির্ভরযোগ্য সেতু। এটা আদৌ যদি তত্ত্বকথা হয়, তাহলে ভাবতে পেরে ইলিয়াস মুচকি হাসল—অতৃপ্ত মানুষের তৃপ্তির হাসি।

স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।

তবে আমি কথা দিচ্ছি, দু-একটা ভালো টিউশনি আপনাকে জোগাড় করে দেওয়ার চেষ্টা করব।

অঙ্কন : শতাব্দী জাহিদ

মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!

হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।

তার হাত যদি তেমন হতো তাহলে হয়তো এই হাসির খনিকটা উপড়ে নিয়ে আসতে পারত! তবু হাসিটাকে সে ঠিক চিনে ফেলেছে—এই হাসি অদৃশ্য হাতের আঙুল হয়ে হৃদয়ের গোপন দরজায় টুকটুক করে কড়া নাড়ে।

গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!

মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।

ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।

রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।

ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!

রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।

ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?

রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।

ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?

রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!

ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!

রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!

ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।

রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।

ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—

রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।

লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।

খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।

ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।

তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?

রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।

ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?

রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—

ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?

রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!

ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?

রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!

ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।

অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?

ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।

রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!

রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?

রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?

ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!

রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?

ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...

রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!

ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!

রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।

ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না! 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

ঈদে অভিজাত সাজ

    ঈদে গরম থাকবে, তাই স্টাইলের সঙ্গে সাজে আরামের দিকটাও খেয়াল রাখুন। ঈদের সাজ নিয়ে পরামর্শ দিয়েছেন রেড বিউটি স্যালনের রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন। লিখেছেন মোনালিসা মেহরিন
শেয়ার
ঈদে অভিজাত সাজ

ঈদের দিনের অনুভূতিই অন্য রকম। এদিন সাজে সুন্দর ও সাবলীল থাকা চাই। ঈদ সকালটা শুরু হয় কাজের ব্যস্ততা দিয়ে। দুপুরে অতিথি আপ্যায়নে সময় কাটে।

বিকেল আর রাতে নিজের জন্য একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘোরাঘুরি, আড্ডা কিংবা দাওয়াতে যাওয়া হয়। এ জন্য তিন বেলায় চাই তিন রকম সাজ।

সকালে হালকা সাজ

সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।

সকালে যেহেতু কাজের ব্যস্ততা থাকে তাই সাজ-পোশাক আরামদায়ক হওয়া চাই। শোভন মেকওভারের স্বত্বাধিকারী শোভন সাহা বললেন, ‘ঈদের দিন ব্যস্ততায় তিনবার লুক বদলানো বেশ ঝামেলার কাজ। সকালের সাজ দিয়েই দুপুর ও রাতের সাজটা সেরে ফেলতে পারেন। সকালে হালকা ফাউন্ডেশন দিন।
ঠোঁটে এ সময় ন্যুড রঙের লিপস্টিক দিতে পারেন। চোখ সাজাতে হালকা আইশ্যাডো দিলে সুন্দর লাগবে।’

সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।

কম বয়সীরা কপালের দুই পাশে একটু স্টাইলিশ বেণি করে নিলে সুন্দর দেখাবে।

 

ঈদে অভিজাত সাজ

দুপুরে চাই আরাম

গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’

 

ঈদে অভিজাত সাজ

রাতে জমকালো

রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’

যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।

 

 

 

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য
ফ্যাশন

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

    ঈদের দিন পাঞ্জাবি না পরলে ছেলেদের ফ্যাশন যেন অপূর্ণ থেকে যায়। প্রতিবছর নতুন নকশা, থিম ও প্যাটার্নের পাঞ্জাবি নিয়ে আসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে এবারকার ঈদের পাঞ্জাবির খোঁজ জানাচ্ছেন আতিফ আতাউর
শেয়ার
ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।

লাল, নীল, সাদা, কালো, খয়েরিসহ বিভিন্ন রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে পাঞ্জাবিতে। গলা ও হাতায় রয়েছে আলাদা নকশা ও কাজ। ঐতিহ্যবাহী কাঁথা স্টিচ, মোগল শৈলী, উইভিং মোটিফের অনুপ্রেরণা ছাড়াও গুজরাটি, ইক্কত, কলকা আর্ট, জামদানি, ফ্লোরাল, ট্র্যাডিশনাল, টার্কিশ আর্ট ও ইসলামিক মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রয়েছে আরামদায়ক কাপড়ের ব্যবহার।
প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার খালিদ মাহমুদ খান বলেন, ‘পাঞ্জাবির গলা, বুক ও হাতার পাশাপাশি কাঁধেও নতুন নকশা করা হয়েছে। কটন, ডিজাইন কটন, হ্যান্ডলুম কটন, লিনেন, জর্জেট, সিল্ক, হাফসিল্ক, টিস্যু ও সাটিনের মতো আরামদায়ক কাপড় বেছে নেওয়া হয়েছে। যেন গরমে স্বস্তি পাওয়া যায়। হাতের কাজ, এমব্রয়ডারি, স্ক্রিন ও ব্লক প্রিন্ট, কারচুপি ও টাইডাইয়ের সাহায্যে পাঞ্জাবির নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।

একই সঙ্গে মোটিফেও থাকছে ইসলামিক, ফ্লোরাল, ফুল, লতাপাতা ও মোগল কারুকার্য।’

 

ঈদের ফ্যাশনেবল পাঞ্জাবি

প্রিন্টে পরিপাটি

প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।

 

কাটছাঁটে নতুন কী

গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’

একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।

 

কখন কেমন পাঞ্জাবি

ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।

 

কোথায় পাবেন, কেমন দাম

বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।

 

 

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ