ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও অর্থনৈতিক সংকটে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ঋণ। এরই মধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ঋণ ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ধনী দেশগুলোর জোট অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (ওইসিডি) এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সার্বভৌম ঋণ ও করপোরেট বন্ড মিলে বিশ্বজুড়ে ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সালে ১০০ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে।
এসব ঋণের সুদহার বেড়ে চলায় তা পরিশোধ ঋণগ্রহীতাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় তাদের উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
প্রতিবেদনে ধনী দেশগুলোর ঋণ নিয়ে বলা হয়, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধনী দেশগুলোর সরকারি পর্যায়ে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে। এতে ২০০৭ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে এ বাবদ সুদ পরিশোধের হার, যা কি না এসব দেশের প্রতিরক্ষা ও আবাসন খাতে ব্যয়ের তুলনায় অনেক বেশি।
প্যারিসভিত্তিক সংস্থাটির ‘গ্লোবাল ডেট রিপোর্ট’ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে ওইসিডিভুক্ত দেশে ঋণ পরিশোধ বাবদ খরচ জিডিপির ৩.৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ২০২১ সালে ছিল ২.৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, একই দেশগুলো ২০২৩ সালে সামরিক খাতে মোট জিডিপির ২.৪ শতাংশ ব্যয় করেছে।
২০২৪ সালে ওইসিডি দেশগুলোর মোট সরকারি ঋণের ৮৫ শতাংশ গ্রহণ করেছে পাঁচটি দেশ। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র একাই দুই-তৃতীয়াংশ।
এরপর রয়েছে জাপান, ফ্রান্স, ইতালি ও যুক্তরাজ্য। এ সময় সুদ পরিশোধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যয় করেছে জিডিপির ৪.৭ শতাংশ, যুক্তরাজ্য ২.৯ শতাংশ ও জার্মানি ১ শতাংশ। ঋণ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিশ্বব্যাপী সুদহার ও অন্যান্য খরচ বেড়েছে। কারণ সরকারি বন্ডে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করছে এবং সরকারগুলো প্রতিরক্ষা ও অন্যান্য খাতে ব্যয় বাড়াচ্ছে।
ওইসিডি সতর্ক করে বলেছে, উচ্চ সুদহার ও ক্রমবর্ধমান ঋণের বোঝা ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাকে সীমিত করতে পারে।
অথচ ওই সময় বিনিয়োগের প্রয়োজন আগের তুলনায় বেশি হতে পারে। তাই বৈশ্বিক ঋণ বাজারের সম্ভাব্য ‘কঠিন পরিস্থিতি’ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছে সংস্থাটি। পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোয় ঋণ গ্রহণ ২০২৫ সালে ১৭ ট্রিলিয়ন বা এক লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ২০২৩ সালে ছিল ১৪ লাখ কোটি ডলার।
গত বছর ওইসিডি সরকারগুলোর নেওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি ডলার, যার মধ্যে পুরনো ঋণ পরিশোধের পর তিন লাখ কোটি ডলার ছিল নতুন ঋণের অংশ। ফলে ওইসিডি দেশগুলোর মোট সরকারি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫৫ লাখ কোটি ডলার এবং বিশ্বব্যাপী সার্বভৌম ঋণের পরিমাণ ৬৫ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। এ ছাড়া করপোরেট ঋণ ৩৫ লাখ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যার বেশির ভাগই শেয়ার বাইব্যাক ও লভ্যাংশ প্রদানের জন্য নেওয়া হয়েছে।
বিপুল পরিমাণ ঋণের কারণে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও ঋণ স্থায়িত্ব নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ওইসিডির আর্থিক ও করপোরেট বিষয়ক পরিচালক কারমিন ডি নোইয়ার মতে, বড় ঋণের বোঝা ‘খারাপ নয়’। তবে গত দুই দশকে নেওয়া বেশির ভাগ ঋণ ২০০৮ সালের আর্থিক সংকট ও কভিড-১৯ মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারে ব্যয় হয়েছে। এখন অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অবকাঠামো ও জলবায়ু প্রকল্পের মতো বিনিয়োগের দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, ‘সরকার যদি ঋণ নেয়, তাহলে সেই ঋণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করা উচিত। অর্থনীতির আকার বড় হলে ঋণ নেওয়া কার্যকর হবে এবং দীর্ঘ মেয়াদে ঋণের ভার কমাতে সাহায্য করবে।’
কিন্তু উচ্চ সুদহার ঋণ পরিশোধে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ডের সুদহার বাড়ায় ঋণের পুনরর্থায়ন ব্যয় বেড়ে গেছে। ২০২৭ সালের মধ্যে ওইসিডি দেশগুলোর প্রায় ৪৫ শতাংশ সার্বভৌম ঋণ পরিশোধ করতে হবে। আগের নমনীয় ঋণ গ্রহণের পরিবেশ এখন বদলে গেছে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিনিয়োগকারীদের জন্য আরো অনিশ্চয়তার সৃষ্টি করেছে।
সংস্থাটি বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মহামারির সময় নেওয়া জরুরি বন্ড কেনার কর্মসূচি থেকে সরে আসছে। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে থাকা সরকারি বন্ডের পরিমাণ থেকে তিন লাখ কোটি ডলার কমেছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে আরো এক লাখ কোটি ডলার কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে মূল্য সংবেদনশীল বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। ফলে সরকারগুলো বাজারের অস্থিরতা ও ভূরাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে।
ওইসিডির মহাসচিব ম্যাথিউস কোরম্যান বলেছেন, উচ্চ ঋণের ব্যয় ‘ভবিষ্যতের ঋণগ্রহণ ক্ষমতাকে সীমিত করছে’, বিশেষত এমন সময়ে যখন উচ্চ প্রবৃদ্ধি, বয়স্ক জনসংখ্যার চাহিদা মেটানো ও প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়ানো দরকার। ২০২৫ সালে ওইসিডি দেশগুলোর গড় ঋণ-জিডিপি অনুপাত ৮৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি এবং ২০০৭ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ।