অজানা ‘জগৎ’—অভিজ্ঞতায় না থাকা ‘জগৎ’ অনেকটা নিশ্চিন্তেই জায়গা করে নেয় মানুষের মনে, বিশ্বাসে। দেখতে না-পাওয়া এই জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত এই বিশ্বাস থেকেই।
কখনো বিশ্বাসের এই সম্পর্ক দূরের, আবার খুব কাছের। তবে কাছে-দূরের দূরত্বকে অস্বীকার করে মানুষ এগিয়ে যায় এই বিশ্বাস নিয়েই।
এক অন্তিম সত্যের মুখোমুখি করে কোনো বাধা না মেনে। এই সব কিছু নিয়ে মহাজগতের সঙ্গে এক গভীর সংযোগ স্থাপন করে শিল্পী লিটন সরকারের চিত্রমালা।
এমন নানা আলাপ শেষ হলেও দেখতে না-পাওয়া এই আরাধ্য জগেকও মানুষ দেখতে চায়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ডামাডোল পেরিয়ে দেখতে চাওয়া জগতেই আস্থা রাখতে চায় মানুষ।
বিশ্বাসের সেই দেখতে পাওয়া জগতেই মানুষ খুঁজে পায় নির্ভরতা—স্বস্তিতে জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস।
বিচ্ছিন্নতা থেকে এই বিশ্বাসের জন্ম হয় না। দীর্ঘদিনের সঙ্গ, লালন-পালন আর চর্চার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় বিশ্বাসবিদ্যার। প্রাণ-প্রকৃতিতেই রয়েছে এই বিদ্যার নির্যাস।
মানুষের যাপিত জীবনকে দুর্গম পথে যেতে না দিয়ে দেখিয়ে দেয় সহজ পথ। বলে দেয় অমরত্বের পথে যাওয়ার উপায়।
মানুষ হয়তো ওই পথেই যেতে চায়। হয়তো ওই পথে যাওয়ার উপায় খোঁজে। মানুষ চায় একটা জীবনকে উদযাপন করতে, উদ্ভাবন করতে, আবিষ্কার করতে।
তবে বিশ্বাসের চিহ্নে আস্থা রাখাই তার অবলম্বন হয়ে ওঠে সহজেই। এই জীবন থেকে খোঁজে আরো অনেক জীবন; খুঁজে পায় জীবনের নানা মাত্রা।
এই বিশ্বাস থেকে মানুষ ছড়িয়ে যায় বিচিত্র জীবনে—বহু বিশ্বাসের কাছে। মন-শরীর আর বিশ্বাসের সাধনায় গভীর দ্যোতনা তৈরি হয় তাতে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হতে থাকে নানা পথ। লিটন সরকারের সৃষ্টিতে আছে এই নানা পথে ভ্রমণের চিহ্ন।
লিটনের সৃষ্টিতে হয়তো আছে সেই অমরত্বের পথ। আর আছে অমরত্বকে আঁকার চিহ্ন। কোনো বিশেষ একটি পথ নয় এটি। নানা পথ আর মতের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে জনঐক্য। ভালোবাসা থেকে এই ঐক্য হয়। এই ঐক্যই গড়ে জনবিশ্বাসের জনপদ। জন্ম হয় চিহ্নের। মহাজগতে এই চিহ্নের প্রমাণ রেখে যায় মানবসভ্যতা। জনবিশ্বাসের কি কোনো চিহ্ন আছে? কী করে তাকে চেনা যায়? বিশ্বাসই এই চিহ্নকে নেয় চিনে। আবার চিহ্নও দেয় এই বিশ্বাসের চিত্র।
এই জনবিশ্বাসের কথা বলেছেন, জনবিশ্বাসের চিহ্নের ছবি এঁকেছেন শিল্পী লিটন সরকার। আলাদা একেকটি সেইসব ছবি মানুষের মনের কথা বলে, চিন্তার কথা বলে বিশ্বাসের কথা বলে। বিশ্বাসের চিহ্ন, বিশ্বাসের গাথাই লিটনের চিত্র, যা তার সৃষ্টিতে সহজভাবে আঁকা। সহজভাবে তিনি গ্রহণও করেছেন সেইসব আখ্যানকে।
আধুনিকতার প্রসঙ্গে ব্যক্তির শক্তি—ব্যক্তিই যে প্রধান—এই ধারণাকে খুব একটা মানেননি লিটন। বরং তাঁর ছবিতে আছে মানুষের কথা। আছে মানবসভ্যতার চিরায়ত আখ্যানের আলাপ। মানুষের বিশ্বাসের চিহ্নও আছে তাতে। বহু মানুষের চিন্তার মিলিত আখ্যানেরই চিত্র এঁকেছেন শিল্পী লিটন সরকার। ধর্মবিশ্বাসের পথ পেরিয়ে যে গাথা তৈরি হয়, যে দৃশ্য তৈরি হয়, যে চিহ্ন তৈরি হয়—সেটাই এই চিত্রমালার প্রধান সম্বল। এ ছাড়া অঙ্কনশৈলীতে প্রাচ্যদেশীয় শিল্প ঐতিহ্যে মুক্ত পরিসরের ব্যবহার পরম্পরার উত্তরসূরি লিটনের চিত্রমালা।
ধর্ম আর পুরাণের ঐতিহ্যের সূত্র ধরে লিটন সরকারের সৃজনশীলতায় আছে সহজ হওয়ার কথা, সহজে সৃষ্টি করার ভাষা। সাবলীলভাবে বলে যাওয়ার শৈলী তিনি রপ্ত করেছেন নিশ্চিন্তে, স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে। ঐতিহ্য-স্থান-ইতিহাস আর সৃজনকৌশলের মিলনের প্রকাশই লিটনের চিত্রভাষা।
প্রত্যাশিত স্পেসে সহজে লিটন বলেন সেই গল্প। তাতে হয়তো আপাত জোর করে বলা কোনো কথা নেই, কিন্তু আছে এক সাবলীল ভাষা—রঙের গভীর হওয়ার ভাষা। এটাই লিটন সরকারের শিল্পভাষার শক্তি। মুক্তভাবে সেই চিহ্ন আর আখ্যান মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া। মানুষের কাছে লিটন এই বিশ্বাস, এই চিত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন। লিটনের এই চিত্র সরল আর গভীর সম্পর্কের আখ্যান।
এই আখ্যান মানুষের কাছেই থাকবে। নানা চিন্তার মানুষ, নানা বিশ্বাসের মানুষ, নানা ভাবনার মানুষ লিটন সরকারের এই চিত্রমালা নানাভাবে গ্রহণের সুযোগ নেবে নিঃসন্দেহে। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে কলাকেন্দ্রে শুরু হওয়া শিল্পী লিটন সরকারের একক চিত্র প্রদর্শনী ‘পৌরাণিক মন’।