প্রদর্শনী

জনবিশ্বাসের চিহ্ন, জনচিত্রের আখ্যান

আশফাকুর রহমান
আশফাকুর রহমান
শেয়ার
জনবিশ্বাসের চিহ্ন, জনচিত্রের আখ্যান

অজানা জগৎ’—অভিজ্ঞতায় না থাকা জগৎ অনেকটা নিশ্চিন্তেই জায়গা করে নেয় মানুষের মনে, বিশ্বাসে। দেখতে না-পাওয়া এই জগতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভিত এই বিশ্বাস থেকেই।

কখনো বিশ্বাসের এই সম্পর্ক দূরের, আবার খুব কাছের। তবে কাছে-দূরের দূরত্বকে অস্বীকার করে মানুষ এগিয়ে যায় এই বিশ্বাস নিয়েই।

এক অন্তিম সত্যের মুখোমুখি করে কোনো বাধা না মেনে। এই সব কিছু নিয়ে মহাজগতের সঙ্গে এক গভীর সংযোগ স্থাপন করে শিল্পী লিটন সরকারের চিত্রমালা।

এমন নানা আলাপ শেষ হলেও দেখতে না-পাওয়া এই আরাধ্য জগেকও মানুষ দেখতে চায়। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ডামাডোল পেরিয়ে দেখতে চাওয়া জগতেই আস্থা রাখতে চায় মানুষ।

বিশ্বাসের সেই দেখতে পাওয়া জগতেই মানুষ খুঁজে পায় নির্ভরতাস্বস্তিতে জীবন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস।

বিচ্ছিন্নতা থেকে এই বিশ্বাসের জন্ম হয় না। দীর্ঘদিনের সঙ্গ, লালন-পালন আর চর্চার মধ্য দিয়েই জন্ম নেয় বিশ্বাসবিদ্যার। প্রাণ-প্রকৃতিতেই রয়েছে এই বিদ্যার নির্যাস।

মানুষের যাপিত জীবনকে দুর্গম পথে যেতে না দিয়ে দেখিয়ে দেয় সহজ পথ। বলে দেয় অমরত্বের পথে যাওয়ার উপায়।

মানুষ হয়তো ওই পথেই যেতে চায়। হয়তো ওই পথে যাওয়ার উপায় খোঁজে। মানুষ চায় একটা জীবনকে উদযাপন করতে, উদ্ভাবন করতে, আবিষ্কার করতে।

তবে বিশ্বাসের চিহ্নে আস্থা রাখাই তার অবলম্বন হয়ে ওঠে সহজেই। এই জীবন থেকে খোঁজে আরো অনেক জীবন; খুঁজে পায় জীবনের নানা মাত্রা।

এই বিশ্বাস থেকে মানুষ ছড়িয়ে যায় বিচিত্র জীবনেবহু বিশ্বাসের কাছে। মন-শরীর আর বিশ্বাসের সাধনায় গভীর দ্যোতনা তৈরি হয় তাতে। এরই ধারাবাহিকতায় তৈরি হতে থাকে নানা পথ। লিটন সরকারের সৃষ্টিতে আছে এই নানা পথে ভ্রমণের চিহ্ন।

লিটনের সৃষ্টিতে হয়তো আছে সেই অমরত্বের পথ। আর আছে অমরত্বকে আঁকার চিহ্ন। কোনো বিশেষ একটি পথ নয় এটি। নানা পথ আর মতের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে জনঐক্য। ভালোবাসা থেকে এই ঐক্য হয়। এই ঐক্যই গড়ে জনবিশ্বাসের জনপদ। জন্ম হয় চিহ্নের। মহাজগতে এই চিহ্নের প্রমাণ রেখে যায় মানবসভ্যতা। জনবিশ্বাসের কি কোনো চিহ্ন আছে? কী করে তাকে চেনা যায়? বিশ্বাসই এই চিহ্নকে নেয় চিনে। আবার চিহ্নও দেয় এই বিশ্বাসের চিত্র।

এই জনবিশ্বাসের কথা বলেছেন, জনবিশ্বাসের চিহ্নের ছবি এঁকেছেন শিল্পী লিটন সরকার। আলাদা একেকটি সেইসব ছবি মানুষের মনের কথা বলে, চিন্তার কথা বলে বিশ্বাসের কথা বলে। বিশ্বাসের চিহ্ন, বিশ্বাসের গাথাই লিটনের চিত্র, যা তার সৃষ্টিতে সহজভাবে আঁকা। সহজভাবে তিনি গ্রহণও করেছেন সেইসব আখ্যানকে।

আধুনিকতার প্রসঙ্গে ব্যক্তির শক্তিব্যক্তিই যে প্রধানএই ধারণাকে খুব একটা মানেননি লিটন। বরং তাঁর ছবিতে আছে মানুষের কথা। আছে মানবসভ্যতার চিরায়ত আখ্যানের আলাপ। মানুষের বিশ্বাসের চিহ্নও আছে তাতে। বহু মানুষের চিন্তার মিলিত আখ্যানেরই চিত্র এঁকেছেন শিল্পী লিটন সরকার। ধর্মবিশ্বাসের পথ পেরিয়ে যে গাথা তৈরি হয়, যে দৃশ্য তৈরি হয়, যে চিহ্ন তৈরি হয়সেটাই এই চিত্রমালার প্রধান সম্বল। এ ছাড়া অঙ্কনশৈলীতে প্রাচ্যদেশীয় শিল্প ঐতিহ্যে মুক্ত পরিসরের ব্যবহার পরম্পরার উত্তরসূরি লিটনের চিত্রমালা।

ধর্ম আর পুরাণের ঐতিহ্যের সূত্র ধরে লিটন সরকারের সৃজনশীলতায় আছে সহজ হওয়ার কথা, সহজে সৃষ্টি করার ভাষা। সাবলীলভাবে বলে যাওয়ার শৈলী তিনি রপ্ত করেছেন নিশ্চিন্তে, স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে। ঐতিহ্য-স্থান-ইতিহাস আর সৃজনকৌশলের মিলনের প্রকাশই লিটনের চিত্রভাষা।

প্রত্যাশিত স্পেসে সহজে লিটন বলেন সেই গল্প। তাতে হয়তো আপাত জোর করে বলা কোনো কথা নেই, কিন্তু আছে এক সাবলীল ভাষারঙের গভীর হওয়ার ভাষা। এটাই লিটন সরকারের শিল্পভাষার শক্তি। মুক্তভাবে সেই চিহ্ন আর আখ্যান মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া। মানুষের কাছে লিটন এই বিশ্বাস, এই চিত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন। লিটনের এই চিত্র সরল আর গভীর সম্পর্কের আখ্যান।

এই আখ্যান মানুষের কাছেই থাকবে। নানা চিন্তার মানুষ, নানা বিশ্বাসের মানুষ, নানা ভাবনার মানুষ লিটন সরকারের এই চিত্রমালা নানাভাবে গ্রহণের সুযোগ নেবে নিঃসন্দেহে। ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে কলাকেন্দ্রে শুরু হওয়া শিল্পী লিটন সরকারের একক চিত্র প্রদর্শনী পৌরাণিক মন

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

পাঠকের প্রিয় বই

আফ্রিকার সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি

    সাগর মল্লিক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
আফ্রিকার সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি
সাগর মল্লিক

সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সাংস্কৃতিক বোমা। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যার সাহায্যে একটা জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা সম্ভব। কেনিয়ায় জন্ম নেওয়া নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা তার ‘Decolonising the Mind’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন ভাষা এবং সাহিত্য কিভাবে মানুষের মনে প্রভাব পড়ে। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কিভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের মাধ্যমে মাতৃভাষাও বিলুপ্ত করে দেয়।

আর যে নাগরিকের নিজস্ব মাতৃভাষা থাকে না তারা পরিণত হয় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে। ইতিহাস এবং তত্ত্বীয় আলাপের কারণে মনোজগতের বিউপনিবেশায়ন গ্রন্থটি ভাষা ও ভাষার রাজনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

বইয়ের শুরুতে আলোকপাত করা হয়েছে আফ্রিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ঔপনিবেশিক শাসকরা যে প্রক্রিয়ায় হঠিয়ে দিয়েছিল। উপনিবেশ পরবর্তী কেনিয়ায় কী ঘটেছিল সেসব বিষয়েও বিস্তারিত আছে।

দেশটিতে ভাষা, সাহিত্য, রাজনীতির বিউপনিবেশায়ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় শাসকরা যেসব নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেগুলোর বর্ণনা প্রবন্ধগুলোতে মিলবে। প্রবন্ধগুলো সাহিত্যতত্ত্বের গবেষকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয়, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছেও তেমনই প্রাসঙ্গিক। অতীতে উপনিবেশ হিসেবে এবং আধুনিক যুগে নব্য-উপনিবেশ হিসেবেও আফ্রিকার দেশগুলো ইউরোপের ভাষার আলোকে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এবং নিজেদের সংজ্ঞায়িত করছে। অর্থাৎ তারা পরিচিত হয়েছে আফ্রিকার ইংরেজিভাষী, ফরাসিভাষী অথবা পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র হিসেবে।
এই ঔপনিবেশিক মনোভাব আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে আফ্রিকার সাহিত্য-সংস্কৃতির এমনকি নাগরিক জীবনও। তারা বিলীন হয়ে যাচ্ছে জাতি হিসেবে। এমনকি লেখকরাও লেখালেখি করছেন ভিন্ন ভাষায়।

সাংস্কৃতিক বোমা মানুষের নাম, জাতি, ভাষা, ঐতিহ্য, একতা, সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এবং সর্বশেষে নষ্ট করে নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস।

তখন নিজের দেশ, জাতি সব কিছু নিয়ে তৈরি হয় হতাশা। মানুষ অবচেতন মনে গ্রহণ করতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, তৈরি হয় দাস মনোবৃত্তি। তখন নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে গ্রহণ করতে ইচ্ছে হয় অন্য সংস্কৃতি, গ্রহণ করে ঋণ, পরিণত হয় দাসে। আগে ছিল সরাসরি শাসন, এখন পরোক্ষ কিন্তু আরো শক্ত শাসন। এ জন্য দরকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ। আফ্রিকার ওপর সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবার ইতিহাস পাঠের পর সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি হিসেবে বলতেই হয় ভালোবাসি বাংলার মা, মাটি, মানুষ। ভালোবাসি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি। একে রক্ষা করতেই হবে।

গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

মন্তব্য
প্রদর্শনী

চিত্রশালায় নারী শিল্পীদের কাজ

মোহাম্মদ আসাদ
মোহাম্মদ আসাদ
শেয়ার
চিত্রশালায় নারী শিল্পীদের কাজ

নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় দীপ্ত নয়ন শিরোনামে শুরু হয়েছে এ দেশের নারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী। দুটি গ্যালারিতে ৮৩ জন নারী শিল্পীর ১৩০টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। বর্তমানে নারী-পুরুষ শিল্পী হিসেবে কিছুটা সমতা এলেও বিগত শতাব্দীতে নারীর শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ ছিল কঠিন এক বিষয়। এর মধ্যেই কম হলেও নিজের দক্ষতায় কয়েকজন নারী শিল্পী নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পীদের মধ্যে নারী-পুরুষ দেয়ালটা ভেঙে দিয়েছেন। 

১৯৪৮ সালে ঢাকায় কলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শুরুতে ছেলেরাই এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ১৯৫৪ সালে সেখানে মেয়েরা ভর্তির সুযোগ পায়।

প্রথম ব্যাচে পাঁচজন নারী শিক্ষার্থীর সবাই শিল্পী হয়েছিলেন। তারপর পরাধীন দেশে নারীরা সেভাবে ভর্তি হননি চারুকলায়। হয়তো সুযোগও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে আবার দেখা যায় নারী শিল্পীদের চারুকলায় ভর্তি হতে।
বিগত শতাব্দীর শেষ তিন দশকে বেশ কয়েকজন নারী গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন। সেসব শিল্পীর কাজ এবং এই শতাব্দীর প্রতিশ্রুতিশীল নারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী। সে শিল্পীদের মধ্যে আছে ফরিদা জামান, নূরুন নাহার পাপা, দীপা হক, নাসরীন বেগম, নাইমা হক, রোকেয়া সুলতানা, ফারেহা জেবা, সুফিয়া বেগম প্রমুখ শিল্পীর চিত্রকর্ম। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আইভি জামান, শামীম সিকদারের মতো ভাস্করে ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে প্রথম ব্যাচের শিল্পী তাহেরা খানমের একটি কাজ করেছে এই প্রদর্শনীতে।
তাহেরা খানম ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সহধর্মিণী। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পী নূরুন নাহার পাপার দুটি কাজ। এই শিল্পী তাঁর কোলাজ কাজ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছেন। করছেন গহনা নিয়ে কাজ। এমনতি তাঁর নামটা পর্যন্ত পরিবর্তন করে লিখেন পাপা নূরুন নাহার। তিনটি কাজ রয়েছে শিল্পী দীপা হকের। মারণব্যাধি ক্যান্সারে মৃত্যুর পর তাঁর কাজ আর চোখে পড়েনি। এই দুই শিল্পীর কাজ অনেক দিন পর দর্শকের সামনে এলো। নারী শিল্পীরা অনেকেই শক্ত অবস্থান করে নিয়েছেন। এ বছর চারুকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন শিল্পী রোকেয়া সুলতানা। তাঁর কাজ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এই শতাব্দীতে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে পরিচিত এমন শিল্পীদের কাজ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। সবগুলো শিল্পকর্ম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগ্রহ।

প্রদর্শনী কিউরেটিংয়ে আছে নতুনত্ব। কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করে ছবিগুলো সাজানো হয়েছে। মা ও মুক্তি, আত্মসত্তার রাজনীতি, পুরাতত্ত্ব, দেশমাত্রিকতা, অমৃত বাগান বিভাগে রয়েছে ছবিগুলো। প্রতিটি বিভাগে প্রবেশের আগে লিখে দিয়েছে কয়েক লাইন। যার কারণে ছবির সঙ্গে সহজে যোগাযোগ সম্ভব হয়। প্রদর্শনীর শেষ দিন ২২ মার্চ শনিবার।              

মন্তব্য
স্মরণ

মহিউদ্দীন আহমদকে যেমন দেখেছি

    ফজলে রাব্বি
শেয়ার
মহিউদ্দীন আহমদকে যেমন দেখেছি
গত ১৫ মার্চ ছিল তাঁর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী

হাজি মহিউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ষাটের দশকে যখন আমি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশনা ও বিক্রয় বিভাগে কর্মরত।

১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে একাডেমির বেশ কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে সে বইগুলোর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের তাগিদ আসছিল।

তাগিদ আসছিল লেখক ও পাঠক উভয়ের তরফ থেকে। কিন্তু একাডেমিতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ ছিল না। সরকারের কাছে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য আর্থিক অনুদান চাইলেও পাওয়া যেত না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল যে নিঃশেষিত প্রথম সংস্করণের বইগুলোর মধ্য থেকে কোনো বই যদি কোনো প্রকাশক দ্বিতীয় সংস্করণ বা পরবর্তী প্রকাশ করতে চান, তাহলে সে বইগুলো সেই প্রকাশককে দিয়ে দেওয়া হবে।

হাজি সাহেব তখন এসেছিলেন দ্বিতীয় সংস্করণের বই প্রকাশনা নিয়ে আলোচনা করতে। সে সূত্রে হাজি সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। বাংলা একাডেমির দ্বিতীয় সংস্করণের বইগুলো কিভাবে প্রকাশ করা যায়, সে প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়। এ সময় মরহুম কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু একাডেমির বাজেটে তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। অপরদিকে হাজি সাহেব বিশ্বনবী প্রকাশ করতে দারুণ আগ্রহী। আমরা শর্ত দিলাম হাজি সাহেব যদি বাংলা একাডেমির আরো কিছু বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে আগ্রহী থাকেন, তাহলেই বিশ্বনবী একাডেমির পক্ষ থেকে তাঁকে প্রকাশ করতে দেওয়া হবে। হাজি সাহেব সম্মত হলেন। তিনি শুধু বিশ্বনবীর প্রকাশক হলেন তা-ই নয়, একই সঙ্গে তিনি একাডেমির বেশ কয়েকটি বইয়ের দ্বিতীয় ও পরবর্তী সংস্করণের প্রকাশক হলেন।
যত দূর মনে পড়ে, এসব বইয়ের মধ্যে একটি ছিল মুনীর চৌধুরীর নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর, সিরাজউদ্দীন কাসিমপুরীর লোকসাহিত্যে ছড়া ও আরো বেশ কিছু বই।

তিনি যখন একাডেমিতে আসতেন সাধারণত প্রথমেই আসতেন প্রকাশনা বিভাগে। তারপর পরিচালকের ঘরে যেতেন। তিনি প্রায়ই একাডেমিতে আসতেন কখনো কাজে অথবা নিছক গল্প করতে বা আড্ডা দিতে। তখন একাডেমিতে সব সাহিত্যিক ও সাহিত্যামোদীর আগমন ঘটত, আড্ডা হতো। এসব আড্ডায় আসতেন আবদুল গনি হাজারী, সানাউল হক, সিকান্দার আবু জাফর, ফর্রুখ আহমদ, কবি আবদুল কাদির, সুফি জুলফিকার হায়দার, প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, গোলাম রহমান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, এককথায় এ দেশের সব কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের অনেকেই আজ আর ইহজগতে নেই। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। আবু যোহা ছিলেন হাজি সাহেবের বাঁধা লেখক।

বাঁধা লেখক বলছি এ কারণে যে তিনি আহমদ পাবলিশিং হাউসের বহু বইয়ের লেখক ছিলেন। একটি বিষয়ে হাজি সাহেবের সুনাম ছিল। তিনি কোনো লেখককে তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটি বা পারিশ্রমিক দেননি এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

ঢাকায় যখন তিনি প্রথম প্রকাশনা আরম্ভ করেন তখনই তিনি শিশুসাহিত্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শৈশবেই যদি শিশুরা মহৎ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসতে পারে অথবা মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করে, তবে তারাও মহৎ ব্যক্তিদের জীবন অনুসরণ করে বড় হয়ে উঠবে। তাহলেই তারা সঠিকভাবে মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। সে কারণে তিনি প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন মহৎ জীবনী গ্রন্থমালা। মাত্র আট আনা অর্থাৎ আজ যাকে আমরা পঞ্চাশ পয়সা বলি সে মূল্যের এক একটি বই। এই সিরিজের বেশির ভাগ বই লিখতেন আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। বইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

প্রকাশনা নিয়ে হাজি সাহেব যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যে সংগ্রাম করেছেন এবং যে ভিত্তির ওপর তাঁর সংস্থাকে দাঁড় করিয়েছেন সেগুলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করি, তাহলে বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারব। এবং সেটাই হবে বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাস।

মন্তব্য

শব্দকথা

    বিশ্বজিৎ ঘোষ
শেয়ার
শব্দকথা

মুহূর্ত

সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত মুহূর্ত শব্দের বর্তমান অর্থ দাঁড়িয়েছে অতি অল্প সময়। কিন্তু আদিতে এ অর্থ ছিল না। মুহূর্ত মূলত সময়ের একক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার ৩০ ভাগের এক ভাগকে বলা হয় মুহূর্ত।

সে হিসাবে মুহূর্ত ৪৮ মিনিট সময়। এখন মুহূর্ত বলতে আর ৪৮ মিনিট সময়ের কথা কেউ ভাবে না। এখন মুহূর্ত বলতে অতি অল্প সময়ের কথাই সবাই বুঝে থাকে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ