মায়ানমার ও থাইল্যান্ডে আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা এক হাজার ৬০০ ছাড়িয়ে গেছে। উদ্ধারকর্মীরা শনিবার ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে জীবিতদের সন্ধানে মরিয়া হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
স্থানীয় সময় শুক্রবার দুপুরের দিকে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্প মায়ানমারের মধ্যাঞ্চলের সাগাইং শহরের উত্তর-পশ্চিমে আঘাত হানে। এর কয়েক মিনিট পরই ৬.৭ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়।
এতে মায়ানমারের বিশাল এলাকাজুড়ে ভবন ধসে পড়ে, সেতু ভেঙে যায় এবং সড়কগুলো মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখা গেছে, যেখানে প্রায় ১৭ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। ৬৮ বছর বয়সী মান্দালয়ের বাসিন্দা থার আয় বলেন, ‘আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত কিছুই নেই।’
সামরিক জান্তা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মায়ানমারে কমপক্ষে এক হাজার ৬৪৪ জন নিহত এবং তিন হাজার ৪০০ জনের বেশি আহত হয়েছে। পাশাপাশি ১৩৯ জন এখনো নিখোঁজ। অন্যদিকে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে আরো ১০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আসল ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি এবং মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
মান্দালয়ে এএফপির সাংবাদিকরা উদ্ধারকর্মীদের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করতে দেখেছেন। রেড ক্রসের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ভবনটির নিচে ৯০ জনের বেশি আটকে থাকতে পারে।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর স্কাই ভিলা কনডোমিনিয়ামের ধ্বংসস্তূপ থেকে ৩০ বছর বয়সী ফিউ লেই খাইংকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। ভবনটির ১২ তলার অর্ধেক অংশ ভূমিকম্পে ভেঙে পড়েছিল। তাকে স্ট্রেচারে করে বের করে আনা হলে স্বামী তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
কিন্তু অন্য এক নারী ততটা ভাগ্যবান নন। তার ২০ বছর বয়সী ছেলে এখনো নিখোঁজ, যিনি ওই ভবনে কর্মরত ছিলেন। ওই ভবনের রান্নাঘরে কাজ করা ৫৬ বছর বয়সী মিন মিন খাইং বলেন, ‘আমরা এখনো তাকে খুঁজে পাইনি। সে আমার একমাত্র সন্তান—আমি ভেঙে পড়েছি। ও আমার ডাইনিং রুমে বসে খেয়েছিল, আমাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল, তারপর ভূমিকম্প হলো। যদি সে আমার সঙ্গে থাকত, হয়তো আমার মতোই বেঁচে যেত।’
এদিকে মান্দালয়ের বিভিন্ন এলাকায় অনেক মানুষ রাত কাটানোর জন্য রাস্তায় আশ্রয় নিচ্ছে। তারা ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের ভেতরে থাকার ঝুঁকি নিতে চায় না।
প্যাগোডা-মঠ ধ্বংসস্তূপে পরিণত
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি মায়ানমারে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প। এটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে ব্যাঙ্ককের মতো শত শত কিলোমিটার দূরের শহরেও ভবনগুলোর মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। মান্দালয়ের শত শত বছরের পুরোনো একটি বৌদ্ধ প্যাগোডা ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
একজন সেনা সদস্য বলেন, ‘প্যাগোডার পাশের মঠটিও ভেঙে পড়েছে। একজন ভিক্ষু মারা গেছেন, কয়েকজন আহত হয়েছে। আমরা আহতদের উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়েছি।’
মান্দালয়ে বিমানবন্দরেরও ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। এটি উদ্ধার তৎপরতায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, বিশেষ করে এমন এক দেশে যেখানে ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে গৃহযুদ্ধ চলছে এবং স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও বিপর্যস্ত।
জান্তার বিরল আবেদন
এদিকে মায়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং শুক্রবার বিরল এক আহ্বানে আন্তর্জাতিক সহায়তার অনুরোধ জানিয়েছেন, যা এই বিপর্যয়ের ভয়াবহতা নির্দেশ করে। অতীতে দেশটির সামরিক সরকার বড় ধরনের দুর্যোগের পরও বিদেশি সাহায্য নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল।
ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ছয়টি অঞ্চলে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। রাজধানী নেপিদোতে একটি প্রধান হাসপাতালে আহতদের খোলা জায়গায় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে বিদেশি সাহায্য পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ভারত থেকে ত্রাণ পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া চীন ৮০ জনের বেশি উদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছে বলে জানিয়েছে এবং ১৩.৮ মিলিয়ন ডলার জরুরি সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো সতর্ক করে বলেছে, মায়ানমার এমন ভয়াবহ বিপর্যয় সামলানোর মতো প্রস্তুত নয়। গৃহযুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যে ৩৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং অনেকেই খাদ্যসংকটের মধ্যে ছিল।
ব্যাঙ্ককে ভবন ধস
সীমান্তের ওপারে থাইল্যান্ডের ব্যাঙ্ককে শুক্রবার একটি ৩০ তলা নির্মীয়মাণ ভবন ধসে পড়ে। দ্বিতীয় রাতেও উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গভর্নর চাদচার্ট সিত্তিপুন্ট জানান, ভবন ধসে এখন পর্যন্ত আটজনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এবং অন্তত আটজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তবে ৭৯ জন এখনো নিখোঁজ, যাদের বেশির ভাগই চাতুচাক উইকএন্ড মার্কেটের কাছে নির্মাণকাজে নিয়োজিত ছিলেন।
ব্যাঙ্কক নগর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ভূমিকম্পের ফলে ক্ষয়ক্ষতির দুই হাজারের বেশি প্রতিবেদন পাওয়ার পর শতাধিক প্রকৌশলী বিভিন্ন ভবনের নিরাপত্তা পরিদর্শনে নিয়োজিত থাকবেন।