বুদ্ধদেব বসু : স্মৃতিগদ্যে কবিমুখ

  • ফারুক সুমন
শেয়ার
বুদ্ধদেব বসু : স্মৃতিগদ্যে কবিমুখ
জন্ম : ৩০ নভেম্বর ১৯০৮; মৃত্যু : ১৮ মার্চ ১৯৭৪

বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অত্যুজ্জ্বল শিল্পপ্রতিভা। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি ছিলেন সদর্পে সচল। ফলে তাঁর শিল্পভুবন বিষয় ও ব্যাপ্তিতে বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করেছে। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, রম্যরচনা,

ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, অনুবাদ, পত্রসাহিত্য, আত্মজৈবনিক রচনা, শিশুসাহিত্যসহ শিল্পের বিচিত্রপরিসরে তিনি কাজ করেছেন।

তাঁর লেখা সাহিত্যকর্ম যুগপৎ সময় ও শিল্পের দায়কে স্বীকরণের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। বুদ্ধদেব বসুর সমবয়সী শিল্পবন্ধুদের মধ্যে এমন সব্যসাচী

লেখকসত্তা একেবারেই হাতে গোনা। জীবনব্যাপী শিক্ষকতা, পত্রিকা-সম্পাদনা ও লেখালেখিতে তিনি নিমগ্ন সময় অতিবাহিত করেছেন।

বুদ্ধদেব বসুর গ্রন্থসংখ্যা সর্বমোট ১৫৬টি।

রবীন্দ্র-পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রসঙ্গক্রমে বুদ্ধদেব বসু সম্পর্কে জগদীশ ভট্টাচার্যের মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের যে অধ্যায়কে বলা হয় কল্লোল যুগ সেই অধ্যায়ের তরুণতম প্রতিনিধি ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। ১৩৩০ বঙ্গাব্দে যখন কল্লোল প্রকাশিত হয় তখন বুদ্ধদেবের বয়স মাত্র পনেরো।
কলকাতায় কল্লোল (১৩৩০) এবং কালিকলমের (১৩১৩) মতো ঢাকায় প্রগতি ছিল সে যুগের আধুনিকতার মুখ্য বার্তাবহ। (আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান সম্পাদিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত পৃ. ৩১৮) বক্ষ্যমাণ লেখায় এই দীপ্তিমান মনীষার আত্মজৈবনিক রচনা সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়াস থাকবে।

লেখকের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কৌতূহল থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের জীবনগল্প ও জীবনাভিজ্ঞতা সাধারণের মনকে আন্দোলিত করে। ফলে তাঁদের লেখার মাঝে জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে কি না এটাও পাঠকের আগ্রহের বিষয় বৈকি।

বোধকরি পাঠকের এমন আগ্রহের প্রত্যুত্তরে

সাহিত্যিকগণ আত্মজীবনী লেখার তাগিদ অনুভব করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁর জীবনকথা লিখেছেন এমন তিনটি স্মৃতিগদ্য যথাক্রমে আমার ছেলে বেলা (১৯৭২) আমার যৌবন (১৯৭৩) ও আমাদের কবিতাভবন (১৯৭৪)। যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁর কন্যা দময়ন্তী বসু এই তিনটি স্মৃতিগদ্যকে একত্রে আত্মজৈবনিক গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যে ব্যক্তি কবির চেয়ে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে এসব লেখাকে আত্মজীবনীর চেয়ে বাংলা সাহিত্যের কয়েক দশকের ইতিহাস বললে অত্যুক্তি হবে না। আত্মজীবনী সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর কন্যা দময়ন্তী বসু লিখেছেন : দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ বহুকাল ধরেই চাইছিলেন বাবা এবার তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করুন। অসংখ্য কাজের চাপে আত্মজীবনী লেখার মতো বৃহৎ কর্মে হাত দিতে চাননি। কিন্তু সেই সময়ে সাগরদার অনুরোধের কাছে মাথা নোয়ালেন। আপাতত তিনি খণ্ডে খণ্ডে জীবনের বিভিন্ন পর্বের স্মৃতি লিখবার প্রকল্প নিলেন। সম্পাদকের ইচ্ছা ছিল প্রিয়-অপ্রিয় সমস্ত কথাই যেন অকপটে লেখক নিজের বয়ানে লিপিবদ্ধ করে যান, কিন্তু বাবা অপ্রিয় প্রসঙ্গের তিক্ত স্মৃতি ফিরে দেখতে চাননি। (প্রাককথন, আত্মজৈবনিক)

আমার ছেলেবেলায় বুদ্ধদেব বসুর অন্তর্গত অন্তরঙ্গ কথাগুলো প্রকাশ পেয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি নানা সংকটের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর জন্মকথা, পিতামাতা ও পরিবারের দুর্দিনের কথা পড়তে গিয়ে আমাদের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু যখন লেখেন, আমি বিনয়কুমারীর প্রথম ও শেষ সন্তানআমার জন্মের পরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রসবোত্তর ধনুষ্টংকার রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুই আমার নামকরণের কারণ। ...আমি আমার মাতামহ-মাতামহীর ঘরেই মানুষ হয়েছিলাম, কার্যত তাঁরাই ছিলেন আমার পিতামাতা। (আমার ছেলেবেলা, পৃ. ১০)

বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যকে শুধু আত্মজীবনী কিংবা বেড়ে ওঠার কালানুক্রমিক ধারাবিবরণী হিসেবে মূল্যায়ন করা সমীচীন হবে না। এখানে যুগের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। বইয়ের পটভূমি পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। স্থানিক বিবরণের

হাত ধরে উঠে এসেছে সমকালীন সাহিত্যযাত্রার কথা। আবার লেখক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ, প্রস্তুতি ও সাধনার নেপথ্যকথাও নবীন লেখকদের জন্য প্রেরণাসঞ্চারী হতে পারে। স্মৃতিগদ্যে প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যামিনী রায় কিংবা জীবনানন্দ

দাশের কথাও এসেছে। এই লেখায় প্রগতি, কল্লোল হয়ে কবিতা পত্রিকার মধ্য দিয়ে এক নতুন যুগের সূচনাপর্বও উন্মোচিত হয়েছে।

বুদ্ধদেব বসু প্রথমত কবি। কবি বলেই তাঁর লেখা গদ্যে কাব্যময়তা লক্ষণীয়। আত্মজীবনীর ফিরিস্তি লিখতে গিয়েও তাঁর প্রাঞ্জল গদ্যে পাঠক মুগ্ধ হবেন। কবির হাতের গদ্যের যে ঔজ্জ্বল্য, সেটা তাঁর গদ্যপাঠে অনুভূত হয়। স্মৃতিময় সময়ের কথা লিখতে গিয়ে তিনি যেন সুললিত গদ্যভাষায় ছবি আঁকেন। তাঁর ভাষায় : কুমিল্লা আমার জন্মস্থান, কিন্তু আমার স্মৃতির শুরু নোয়াখালিতে। মনে পড়ে ফেরুল-সাহেবের বাগান নামে একটি বাড়ি-উঠোন ঘিরে খানচারেক ঘর, দর্মার বেড়ার ফাঁকে-ফাঁকে সোনালি রোদ ঝিলমিল করে ভোরবেলা, খড়ের চালে মাটির মেঝেতে দুপুরবেলাগুলো ঠাণ্ডা। লাগোয়া এক মস্তবড় বাগিচারোদের দিনে নীল সবুজ ঝাপসা এক আভার মতো। ফল এত প্রচুর যে মহিলারা ডাবের জলে পা ধোন, পাখিরা ঠুকরে-ঠুকরে জামরুল-কালোজাম শেষ করতে পারে না। কাছেই গির্জেসেখানে মসৃণ ঘন ঘাসের বিছানায় হলদের ওপর লাল-ছিটেওলা বড়ো-বড়ো কলাবতী ফুল ফুটেছে, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও শান্ত। (আমার ছেলেবেলা, পৃ. ২২)

আমার যৌবন তথ্যবহুল স্মৃতিগদ্যের বই। আমার ছেলেবেলা যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আমার যৌবন শুরু। এখানে বুদ্ধদেব বসুর যৌবনের উন্মাতাল কবিতাযাপনের প্রসঙ্গ এসেছে। এটি বৃহৎ কলেবরের বই নয়। তবে লেখকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের গল্প পড়ে আমরা রোমাঞ্চিত হই। বিশেষ করে তৎকালীন ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিবরণ এখানে এসেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। বাদ যায়নি সে সময়ের বাংলা সাহিত্য ও কলকাতার কথা। ১৯২৭ সালে বুদ্ধদেব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। একাডেমিক পরীক্ষা ও পড়াশোনার মাঝেও দেশি-বিদেশি কবিতা-সাহিত্য সম্পর্কে একজন তরুণের অতি আগ্রহ চোখে পড়ে। যেমন : এপ্রিল মাস, আমার অনার্স পরীক্ষা চলছে। আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত পরীক্ষার সময়; বাড়ি থেকে বেরোই তপ্ত রোদে, প্রান্তর-পেরোনো ঝিরিঝিরি হাওয়ায়। কার্জন হল-এর সবুজ লন-এ আমি পায়চারি করি খানিকক্ষণ। মনে-মনে আওড়াই বেওউল্ফ-এর লাইন, বা আলেকজান্ডার পোপের ব্যঙ্গকবিতা, বা সুইনবার্নের কোনো অশ্বখুরতাল স্তবকঅথবা ভাবি ফলস্টাফকে কাপুরুষ বলার সার্থকতা কী। পরীক্ষা-দেয়া ব্যাপারটা আমার বরাবরই বেশ ভালো লেগেছে; সে-যাত্রায় বিশেষ সুখদায়ক বলে মনে হয়েছিল।...পরীক্ষামণ্ডপের স্তব্ধ গম্ভীর আবহাওয়ায় আমি যেন এক ধরনের উদ্দীপনা অনুভব কবি। (আমার যৌবন, পৃ. ৪৬)

তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এসেছেন। বুদ্ধদেব বসু স্মৃতিকথায় নজরুল প্রসঙ্গে লিখেছেন : সেই প্রথম দেখলাম নজরুলকে, অন্য অনেক অসংখ্যের মতো দেখামাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম।... কণ্ঠে তার হাসি, কণ্ঠে তার গান, প্রাণে তার অফুরান আনন্দসব মিলিয়ে মনোলুণ্ঠনকারী একটি মানুষ তার। (আমার যৌবন, পৃ. ৩৬)

বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যের শেষ পর্ব আমাদের কবিতাভবন (১৯৭৪)। এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায়। দুঃখের বিষয় স্মৃতিগদ্যের এই অধ্যায় সমাপ্ত না হতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অসমাপ্ত এই স্মৃতিগদ্য পরবর্তীতে দেশ পত্রিকায় আমাদের কবিতাভবন শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকা ছাড়াও সমকালীন অন্যান্য পত্রিকায় ফরাসি প্রতীকবাদী ও ইংরেজি কাব্যপ্রবণতা নিয়ে লিখেছেন। মজার ব্যাপার এই, তিনি তাঁর বাসভবনের নাম দিয়েছেন কবিতাভবন। কবি ও কবিতার আলোচনায় মুখর হয়ে উঠ েকবিতাভবনের অন্দরমহল। কবিতাভবন প্রকাশনা নামে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনী। এখান থেকেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পদাতিক প্রকাশিত হয়। কবিতাভবনের সাহিত্য-আড্ডা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন : কবিতাভবনে আড্ডা চলে বিশুদ্ধ বাঙালি শৈলীতে, আয়োজনহীন, স্বতঃস্ফূর্ত; সন্ধে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলা, অতিথিরা যাওয়া-আসা করেন যেমন খুশি, সপ্তাহে প্রতিদিন,

বারো মাস, প্রায় একটা সন্ধ্যাও ফাঁকা যায় না। একান্ত চায়ে আপ্যায়ন উপসংহারে কখনো-কখনো পান আর আনুষঙ্গিক বড়জোর কখনো ডালমুট বা পাঁপর ভাজা। এ-ই ছিল তখনকার দিনের রেওয়াজ...। (আমাদের কবিতাভবন, পৃ. ৫৫)

সর্বোপরি স্মৃতিগদ্য পাঠান্তে এটাই প্রতীয়মান হয় যে বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সার্বিক উৎকর্ষ সাধনে নিরলস কাজ করে যাওয়া একজন উদ্যমী সম্পাদকও বটে। তিনি শিল্প-সাহিত্যে সমর্পিত হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন সমগ্র জীবন। তাঁর স্মৃতিগদ্যের দর্পণে ভেসে ওঠে মহৎ ও মৌলিক শিল্পীর অবয়ব।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

পাঠকের প্রিয় বই

আফ্রিকার সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি

    সাগর মল্লিক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
আফ্রিকার সাহিত্যে ভাষার রাজনীতি
সাগর মল্লিক

সাম্রাজ্যবাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো সাংস্কৃতিক বোমা। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় সাহিত্য এবং সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যার সাহায্যে একটা জাতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা সম্ভব। কেনিয়ায় জন্ম নেওয়া নগুগি ওয়া থিয়োঙ্গা তার ‘Decolonising the Mind’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন ভাষা এবং সাহিত্য কিভাবে মানুষের মনে প্রভাব পড়ে। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা কিভাবে সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের মাধ্যমে মাতৃভাষাও বিলুপ্ত করে দেয়।

আর যে নাগরিকের নিজস্ব মাতৃভাষা থাকে না তারা পরিণত হয় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে। ইতিহাস এবং তত্ত্বীয় আলাপের কারণে মনোজগতের বিউপনিবেশায়ন গ্রন্থটি ভাষা ও ভাষার রাজনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিতাব।

বইয়ের শুরুতে আলোকপাত করা হয়েছে আফ্রিকার সাহিত্য ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ঔপনিবেশিক শাসকরা যে প্রক্রিয়ায় হঠিয়ে দিয়েছিল। উপনিবেশ পরবর্তী কেনিয়ায় কী ঘটেছিল সেসব বিষয়েও বিস্তারিত আছে।

দেশটিতে ভাষা, সাহিত্য, রাজনীতির বিউপনিবেশায়ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তার প্রতিক্রিয়ায় শাসকরা যেসব নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিল, সেগুলোর বর্ণনা প্রবন্ধগুলোতে মিলবে। প্রবন্ধগুলো সাহিত্যতত্ত্বের গবেষকদের কাছে যেমন আকর্ষণীয়, রাজনৈতিক কর্মীদের কাছেও তেমনই প্রাসঙ্গিক। অতীতে উপনিবেশ হিসেবে এবং আধুনিক যুগে নব্য-উপনিবেশ হিসেবেও আফ্রিকার দেশগুলো ইউরোপের ভাষার আলোকে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে এবং নিজেদের সংজ্ঞায়িত করছে। অর্থাৎ তারা পরিচিত হয়েছে আফ্রিকার ইংরেজিভাষী, ফরাসিভাষী অথবা পর্তুগিজভাষী রাষ্ট্র হিসেবে।
এই ঔপনিবেশিক মনোভাব আস্তে আস্তে গিলে খাচ্ছে আফ্রিকার সাহিত্য-সংস্কৃতির এমনকি নাগরিক জীবনও। তারা বিলীন হয়ে যাচ্ছে জাতি হিসেবে। এমনকি লেখকরাও লেখালেখি করছেন ভিন্ন ভাষায়।

সাংস্কৃতিক বোমা মানুষের নাম, জাতি, ভাষা, ঐতিহ্য, একতা, সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এবং সর্বশেষে নষ্ট করে নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস।

তখন নিজের দেশ, জাতি সব কিছু নিয়ে তৈরি হয় হতাশা। মানুষ অবচেতন মনে গ্রহণ করতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী সংস্কৃতি, তৈরি হয় দাস মনোবৃত্তি। তখন নিজের সংস্কৃতি ছেড়ে গ্রহণ করতে ইচ্ছে হয় অন্য সংস্কৃতি, গ্রহণ করে ঋণ, পরিণত হয় দাসে। আগে ছিল সরাসরি শাসন, এখন পরোক্ষ কিন্তু আরো শক্ত শাসন। এ জন্য দরকার ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ। আফ্রিকার ওপর সাম্রাজ্যবাদের কালো থাবার ইতিহাস পাঠের পর সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি হিসেবে বলতেই হয় ভালোবাসি বাংলার মা, মাটি, মানুষ। ভালোবাসি বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি। একে রক্ষা করতেই হবে।

গ্রন্থনা : পিন্টু রঞ্জন অর্ক

মন্তব্য
প্রদর্শনী

চিত্রশালায় নারী শিল্পীদের কাজ

মোহাম্মদ আসাদ
মোহাম্মদ আসাদ
শেয়ার
চিত্রশালায় নারী শিল্পীদের কাজ

নারী দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির চিত্রশালায় দীপ্ত নয়ন শিরোনামে শুরু হয়েছে এ দেশের নারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে বিশেষ প্রদর্শনী। দুটি গ্যালারিতে ৮৩ জন নারী শিল্পীর ১৩০টি শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। বর্তমানে নারী-পুরুষ শিল্পী হিসেবে কিছুটা সমতা এলেও বিগত শতাব্দীতে নারীর শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ ছিল কঠিন এক বিষয়। এর মধ্যেই কম হলেও নিজের দক্ষতায় কয়েকজন নারী শিল্পী নিজের অবস্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পীদের মধ্যে নারী-পুরুষ দেয়ালটা ভেঙে দিয়েছেন। 

১৯৪৮ সালে ঢাকায় কলা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। শুরুতে ছেলেরাই এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভের সুযোগ পায়। চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পর ১৯৫৪ সালে সেখানে মেয়েরা ভর্তির সুযোগ পায়।

প্রথম ব্যাচে পাঁচজন নারী শিক্ষার্থীর সবাই শিল্পী হয়েছিলেন। তারপর পরাধীন দেশে নারীরা সেভাবে ভর্তি হননি চারুকলায়। হয়তো সুযোগও ছিল না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সাল থেকে আবার দেখা যায় নারী শিল্পীদের চারুকলায় ভর্তি হতে।
বিগত শতাব্দীর শেষ তিন দশকে বেশ কয়েকজন নারী গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী হিসেবে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করেছেন। সেসব শিল্পীর কাজ এবং এই শতাব্দীর প্রতিশ্রুতিশীল নারী শিল্পীদের কাজ নিয়ে এই প্রদর্শনী। সে শিল্পীদের মধ্যে আছে ফরিদা জামান, নূরুন নাহার পাপা, দীপা হক, নাসরীন বেগম, নাইমা হক, রোকেয়া সুলতানা, ফারেহা জেবা, সুফিয়া বেগম প্রমুখ শিল্পীর চিত্রকর্ম। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী, আইভি জামান, শামীম সিকদারের মতো ভাস্করে ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এর মধ্যে প্রথম ব্যাচের শিল্পী তাহেরা খানমের একটি কাজ করেছে এই প্রদর্শনীতে।
তাহেরা খানম ছিলেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর সহধর্মিণী। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পী নূরুন নাহার পাপার দুটি কাজ। এই শিল্পী তাঁর কোলাজ কাজ থেকে অনেক দূরে সরে এসেছেন। করছেন গহনা নিয়ে কাজ। এমনতি তাঁর নামটা পর্যন্ত পরিবর্তন করে লিখেন পাপা নূরুন নাহার। তিনটি কাজ রয়েছে শিল্পী দীপা হকের। মারণব্যাধি ক্যান্সারে মৃত্যুর পর তাঁর কাজ আর চোখে পড়েনি। এই দুই শিল্পীর কাজ অনেক দিন পর দর্শকের সামনে এলো। নারী শিল্পীরা অনেকেই শক্ত অবস্থান করে নিয়েছেন। এ বছর চারুকলায় অবদানের জন্য একুশে পদক পেয়েছেন শিল্পী রোকেয়া সুলতানা। তাঁর কাজ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। এই শতাব্দীতে দেশ ছাড়িয়ে বিশ্বে পরিচিত এমন শিল্পীদের কাজ রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। সবগুলো শিল্পকর্ম বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সংগ্রহ।

প্রদর্শনী কিউরেটিংয়ে আছে নতুনত্ব। কয়েকটি বিষয়ে ভাগ করে ছবিগুলো সাজানো হয়েছে। মা ও মুক্তি, আত্মসত্তার রাজনীতি, পুরাতত্ত্ব, দেশমাত্রিকতা, অমৃত বাগান বিভাগে রয়েছে ছবিগুলো। প্রতিটি বিভাগে প্রবেশের আগে লিখে দিয়েছে কয়েক লাইন। যার কারণে ছবির সঙ্গে সহজে যোগাযোগ সম্ভব হয়। প্রদর্শনীর শেষ দিন ২২ মার্চ শনিবার।              

মন্তব্য
স্মরণ

মহিউদ্দীন আহমদকে যেমন দেখেছি

    ফজলে রাব্বি
শেয়ার
মহিউদ্দীন আহমদকে যেমন দেখেছি
গত ১৫ মার্চ ছিল তাঁর ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকী

হাজি মহিউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা আহমদ পাবলিশিং হাউসের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ষাটের দশকে যখন আমি বাংলা একাডেমিতে প্রকাশনা ও বিক্রয় বিভাগে কর্মরত।

১৯৬৪-৬৫ সালের দিকে একাডেমির বেশ কিছু বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে সে বইগুলোর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের তাগিদ আসছিল।

তাগিদ আসছিল লেখক ও পাঠক উভয়ের তরফ থেকে। কিন্তু একাডেমিতে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দ ছিল না। সরকারের কাছে দ্বিতীয় সংস্করণের জন্য আর্থিক অনুদান চাইলেও পাওয়া যেত না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একাডেমি কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিল যে নিঃশেষিত প্রথম সংস্করণের বইগুলোর মধ্য থেকে কোনো বই যদি কোনো প্রকাশক দ্বিতীয় সংস্করণ বা পরবর্তী প্রকাশ করতে চান, তাহলে সে বইগুলো সেই প্রকাশককে দিয়ে দেওয়া হবে।

হাজি সাহেব তখন এসেছিলেন দ্বিতীয় সংস্করণের বই প্রকাশনা নিয়ে আলোচনা করতে। সে সূত্রে হাজি সাহেবের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। বাংলা একাডেমির দ্বিতীয় সংস্করণের বইগুলো কিভাবে প্রকাশ করা যায়, সে প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে আলোচনা হয়। এ সময় মরহুম কবি গোলাম মোস্তফার বিশ্বনবী বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু একাডেমির বাজেটে তার জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ ছিল না। অপরদিকে হাজি সাহেব বিশ্বনবী প্রকাশ করতে দারুণ আগ্রহী। আমরা শর্ত দিলাম হাজি সাহেব যদি বাংলা একাডেমির আরো কিছু বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করতে আগ্রহী থাকেন, তাহলেই বিশ্বনবী একাডেমির পক্ষ থেকে তাঁকে প্রকাশ করতে দেওয়া হবে। হাজি সাহেব সম্মত হলেন। তিনি শুধু বিশ্বনবীর প্রকাশক হলেন তা-ই নয়, একই সঙ্গে তিনি একাডেমির বেশ কয়েকটি বইয়ের দ্বিতীয় ও পরবর্তী সংস্করণের প্রকাশক হলেন।
যত দূর মনে পড়ে, এসব বইয়ের মধ্যে একটি ছিল মুনীর চৌধুরীর নাটক রক্তাক্ত প্রান্তর, সিরাজউদ্দীন কাসিমপুরীর লোকসাহিত্যে ছড়া ও আরো বেশ কিছু বই।

তিনি যখন একাডেমিতে আসতেন সাধারণত প্রথমেই আসতেন প্রকাশনা বিভাগে। তারপর পরিচালকের ঘরে যেতেন। তিনি প্রায়ই একাডেমিতে আসতেন কখনো কাজে অথবা নিছক গল্প করতে বা আড্ডা দিতে। তখন একাডেমিতে সব সাহিত্যিক ও সাহিত্যামোদীর আগমন ঘটত, আড্ডা হতো। এসব আড্ডায় আসতেন আবদুল গনি হাজারী, সানাউল হক, সিকান্দার আবু জাফর, ফর্রুখ আহমদ, কবি আবদুল কাদির, সুফি জুলফিকার হায়দার, প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ, গোলাম রহমান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, মুনীর চৌধুরী, এককথায় এ দেশের সব কবি-সাহিত্যিক। তাঁদের অনেকেই আজ আর ইহজগতে নেই। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। আবু যোহা ছিলেন হাজি সাহেবের বাঁধা লেখক।

বাঁধা লেখক বলছি এ কারণে যে তিনি আহমদ পাবলিশিং হাউসের বহু বইয়ের লেখক ছিলেন। একটি বিষয়ে হাজি সাহেবের সুনাম ছিল। তিনি কোনো লেখককে তাঁর প্রাপ্য রয়্যালটি বা পারিশ্রমিক দেননি এ কথা কেউ বলতে পারবে না।

ঢাকায় যখন তিনি প্রথম প্রকাশনা আরম্ভ করেন তখনই তিনি শিশুসাহিত্য প্রকাশের দিকে মনোযোগ দেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন শৈশবেই যদি শিশুরা মহৎ ব্যক্তিত্বের সংস্পর্শে আসতে পারে অথবা মহৎ ব্যক্তিদের জীবনী পাঠ করে, তবে তারাও মহৎ ব্যক্তিদের জীবন অনুসরণ করে বড় হয়ে উঠবে। তাহলেই তারা সঠিকভাবে মানুষ হয়ে উঠতে পারবে। সে কারণে তিনি প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন মহৎ জীবনী গ্রন্থমালা। মাত্র আট আনা অর্থাৎ আজ যাকে আমরা পঞ্চাশ পয়সা বলি সে মূল্যের এক একটি বই। এই সিরিজের বেশির ভাগ বই লিখতেন আবু যোহা নূর মোহাম্মদ। বইগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

প্রকাশনা নিয়ে হাজি সাহেব যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, যে সংগ্রাম করেছেন এবং যে ভিত্তির ওপর তাঁর সংস্থাকে দাঁড় করিয়েছেন সেগুলোকে যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করি, তাহলে বাংলাদেশের প্রকাশনাশিল্পের সমস্যা ও সম্ভাবনার প্রকৃত অবস্থা অনুধাবন করতে পারব। এবং সেটাই হবে বাংলাদেশের প্রকাশনার ইতিহাস।

মন্তব্য

শব্দকথা

    বিশ্বজিৎ ঘোষ
শেয়ার
শব্দকথা

মুহূর্ত

সংস্কৃত ভাষা থেকে আগত মুহূর্ত শব্দের বর্তমান অর্থ দাঁড়িয়েছে অতি অল্প সময়। কিন্তু আদিতে এ অর্থ ছিল না। মুহূর্ত মূলত সময়ের একক। দিন-রাত ২৪ ঘণ্টার ৩০ ভাগের এক ভাগকে বলা হয় মুহূর্ত।

সে হিসাবে মুহূর্ত ৪৮ মিনিট সময়। এখন মুহূর্ত বলতে আর ৪৮ মিনিট সময়ের কথা কেউ ভাবে না। এখন মুহূর্ত বলতে অতি অল্প সময়ের কথাই সবাই বুঝে থাকে।

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ