বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম অত্যুজ্জ্বল শিল্পপ্রতিভা। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি ছিলেন সদর্পে সচল। ফলে তাঁর শিল্পভুবন বিষয় ও ব্যাপ্তিতে বহুমাত্রিকতাকে ধারণ করেছে। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, সমালোচনা, রম্যরচনা,
ভ্রমণসাহিত্য, নাটক, অনুবাদ, পত্রসাহিত্য, আত্মজৈবনিক রচনা, শিশুসাহিত্যসহ শিল্পের বিচিত্রপরিসরে তিনি কাজ করেছেন।
বোধকরি পাঠকের এমন আগ্রহের প্রত্যুত্তরে
সাহিত্যিকগণ আত্মজীবনী লেখার তাগিদ অনুভব করেছেন। বুদ্ধদেব বসু তাঁর জীবনকথা লিখেছেন এমন তিনটি স্মৃতিগদ্য যথাক্রমে ‘আমার ছেলে বেলা’ (১৯৭২) ‘আমার যৌবন’ (১৯৭৩) ও ‘আমাদের কবিতাভবন’ (১৯৭৪)। যদিও পরবর্তী সময়ে তাঁর কন্যা দময়ন্তী বসু এই তিনটি স্মৃতিগদ্যকে একত্রে ‘আত্মজৈবনিক’ গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যে ব্যক্তি কবির চেয়ে সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। ফলে এসব লেখাকে আত্মজীবনীর চেয়ে বাংলা সাহিত্যের কয়েক দশকের ইতিহাস বললে অত্যুক্তি হবে না। আত্মজীবনী সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসুর কন্যা দময়ন্তী বসু লিখেছেন : ‘দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ বহুকাল ধরেই চাইছিলেন বাবা এবার তাঁর আত্মজীবনী লিখতে শুরু করুন। অসংখ্য কাজের চাপে আত্মজীবনী লেখার মতো বৃহৎ কর্মে হাত দিতে চাননি। কিন্তু সেই সময়ে সাগরদার অনুরোধের কাছে মাথা নোয়ালেন। আপাতত তিনি খণ্ডে খণ্ডে জীবনের বিভিন্ন পর্বের স্মৃতি লিখবার প্রকল্প নিলেন। সম্পাদকের ইচ্ছা ছিল প্রিয়-অপ্রিয় সমস্ত কথাই যেন অকপটে লেখক নিজের বয়ানে লিপিবদ্ধ করে যান, কিন্তু বাবা অপ্রিয় প্রসঙ্গের তিক্ত স্মৃতি ফিরে দেখতে চাননি।’ (প্রাককথন, আত্মজৈবনিক)
‘আমার ছেলেবেলা’য় বুদ্ধদেব বসুর অন্তর্গত অন্তরঙ্গ কথাগুলো প্রকাশ পেয়েছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি নানা সংকটের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। তাঁর জন্মকথা, পিতামাতা ও পরিবারের দুর্দিনের কথা পড়তে গিয়ে আমাদের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। বুদ্ধদেব বসু যখন লেখেন, ‘আমি বিনয়কুমারীর প্রথম ও শেষ সন্তান—আমার জন্মের পরে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যেই প্রসবোত্তর ধনুষ্টংকার রোগে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুই আমার নামকরণের কারণ। ...আমি আমার মাতামহ-মাতামহীর ঘরেই মানুষ হয়েছিলাম, কার্যত তাঁরাই ছিলেন আমার পিতামাতা।’ (আমার ছেলেবেলা, পৃ. ১০)
বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যকে শুধু আত্মজীবনী কিংবা বেড়ে ওঠার কালানুক্রমিক ধারাবিবরণী হিসেবে মূল্যায়ন করা সমীচীন হবে না। এখানে যুগের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। বইয়ের পটভূমি পূর্ববঙ্গের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা থেকে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। স্থানিক বিবরণের
হাত ধরে উঠে এসেছে সমকালীন সাহিত্যযাত্রার কথা। আবার লেখক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ, প্রস্তুতি ও সাধনার নেপথ্যকথাও নবীন লেখকদের জন্য প্রেরণাসঞ্চারী হতে পারে। স্মৃতিগদ্যে প্রসঙ্গক্রমে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, যামিনী রায় কিংবা জীবনানন্দ
দাশের কথাও এসেছে। এই লেখায় ‘প্রগতি’, ‘কল্লোল’ হয়ে ‘কবিতা’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে এক নতুন যুগের সূচনাপর্বও উন্মোচিত হয়েছে।
বুদ্ধদেব বসু প্রথমত কবি। কবি বলেই তাঁর লেখা গদ্যে কাব্যময়তা লক্ষণীয়। আত্মজীবনীর ফিরিস্তি লিখতে গিয়েও তাঁর প্রাঞ্জল গদ্যে পাঠক মুগ্ধ হবেন। কবির হাতের গদ্যের যে ঔজ্জ্বল্য, সেটা তাঁর গদ্যপাঠে অনুভূত হয়। স্মৃতিময় সময়ের কথা লিখতে গিয়ে তিনি যেন সুললিত গদ্যভাষায় ছবি আঁকেন। তাঁর ভাষায় : ‘কুমিল্লা আমার জন্মস্থান, কিন্তু আমার স্মৃতির শুরু নোয়াখালিতে। মনে পড়ে ফেরুল-সাহেবের বাগান নামে একটি বাড়ি-উঠোন ঘিরে খানচারেক ঘর, দর্মার বেড়ার ফাঁকে-ফাঁকে সোনালি রোদ ঝিলমিল করে ভোরবেলা, খড়ের চালে মাটির মেঝেতে দুপুরবেলাগুলো ঠাণ্ডা। লাগোয়া এক মস্তবড় বাগিচা—রোদের দিনে নীল সবুজ ঝাপসা এক আভার মতো। ফল এত প্রচুর যে মহিলারা ডাবের জলে পা ধোন, পাখিরা ঠুকরে-ঠুকরে জামরুল-কালোজাম শেষ করতে পারে না। কাছেই গির্জে—সেখানে মসৃণ ঘন ঘাসের বিছানায় হলদের ওপর লাল-ছিটেওলা বড়ো-বড়ো কলাবতী ফুল ফুটেছে, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন ও শান্ত।’ (আমার ছেলেবেলা, পৃ. ২২)
‘আমার যৌবন’ তথ্যবহুল স্মৃতিগদ্যের বই। ‘আমার ছেলেবেলা’ যেখানে শেষ, সেখান থেকেই ‘আমার যৌবন’ শুরু। এখানে বুদ্ধদেব বসুর যৌবনের উন্মাতাল কবিতাযাপনের প্রসঙ্গ এসেছে। এটি বৃহৎ কলেবরের বই নয়। তবে লেখকের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের গল্প পড়ে আমরা রোমাঞ্চিত হই। বিশেষ করে তৎকালীন ঢাকা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বিবরণ এখানে এসেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। বাদ যায়নি সে সময়ের বাংলা সাহিত্য ও কলকাতার কথা। ১৯২৭ সালে বুদ্ধদেব বসু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হয়েছেন। একাডেমিক পরীক্ষা ও পড়াশোনার মাঝেও দেশি-বিদেশি কবিতা-সাহিত্য সম্পর্কে একজন তরুণের অতি আগ্রহ চোখে পড়ে। যেমন : ‘এপ্রিল মাস, আমার অনার্স পরীক্ষা চলছে। আটটা থেকে বারোটা পর্যন্ত পরীক্ষার সময়; বাড়ি থেকে বেরোই তপ্ত রোদে, প্রান্তর-পেরোনো ঝিরিঝিরি হাওয়ায়। কার্জন হল-এর সবুজ লন-এ আমি পায়চারি করি খানিকক্ষণ। মনে-মনে আওড়াই বেওউল্ফ-এর লাইন, বা আলেকজান্ডার পোপের ব্যঙ্গকবিতা, বা সুইনবার্নের কোনো অশ্বখুরতাল স্তবক—অথবা ভাবি ফলস্টাফকে কাপুরুষ বলার সার্থকতা কী। পরীক্ষা-দেয়া ব্যাপারটা আমার বরাবরই বেশ ভালো লেগেছে; সে-যাত্রায় বিশেষ সুখদায়ক বলে মনে হয়েছিল।...পরীক্ষামণ্ডপের স্তব্ধ গম্ভীর আবহাওয়ায় আমি যেন এক ধরনের উদ্দীপনা অনুভব কবি।’ (আমার যৌবন, পৃ. ৪৬)
তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সে সময় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় এসেছেন। বুদ্ধদেব বসু স্মৃতিকথায় নজরুল প্রসঙ্গে লিখেছেন : ‘সেই প্রথম দেখলাম নজরুলকে, অন্য অনেক অসংখ্যের মতো দেখামাত্রই প্রেমে পড়ে গেলাম।... কণ্ঠে তার হাসি, কণ্ঠে তার গান, প্রাণে তার অফুরান আনন্দ—সব মিলিয়ে মনোলুণ্ঠনকারী একটি মানুষ তার।’ (আমার যৌবন, পৃ. ৩৬)
বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতিগদ্যের শেষ পর্ব ‘আমাদের কবিতাভবন’ (১৯৭৪)। এটি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল অধ্যায়। দুঃখের বিষয় স্মৃতিগদ্যের এই অধ্যায় সমাপ্ত না হতেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অসমাপ্ত এই স্মৃতিগদ্য পরবর্তীতে ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘আমাদের কবিতাভবন’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। বুদ্ধদেব বসু তাঁর কবিতা পত্রিকা ছাড়াও সমকালীন অন্যান্য পত্রিকায় ফরাসি প্রতীকবাদী ও ইংরেজি কাব্যপ্রবণতা নিয়ে লিখেছেন। মজার ব্যাপার এই, তিনি তাঁর বাসভবনের নাম দিয়েছেন ‘কবিতাভবন’। কবি ও কবিতার আলোচনায় মুখর হয়ে উঠ েকবিতাভবনের অন্দরমহল। কবিতাভবন প্রকাশনা নামে প্রতিষ্ঠা করেন প্রকাশনী। এখান থেকেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক’ প্রকাশিত হয়। কবিতাভবনের সাহিত্য-আড্ডা প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন : ‘কবিতাভবনে আড্ডা চলে বিশুদ্ধ বাঙালি শৈলীতে, আয়োজনহীন, স্বতঃস্ফূর্ত; সন্ধে থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত খোলা, অতিথিরা যাওয়া-আসা করেন যেমন খুশি, সপ্তাহে প্রতিদিন,
বারো মাস, প্রায় একটা সন্ধ্যাও ফাঁকা যায় না। একান্ত চায়ে আপ্যায়ন— উপসংহারে কখনো-কখনো পান আর আনুষঙ্গিক বড়জোর কখনো ডালমুট বা পাঁপর ভাজা। এ-ই ছিল তখনকার দিনের রেওয়াজ...’। (আমাদের কবিতাভবন, পৃ. ৫৫)
সর্বোপরি স্মৃতিগদ্য পাঠান্তে এটাই প্রতীয়মান হয় যে বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক। একই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সার্বিক উৎকর্ষ সাধনে নিরলস কাজ করে যাওয়া একজন উদ্যমী সম্পাদকও বটে। তিনি শিল্প-সাহিত্যে সমর্পিত হয়ে কাটিয়ে দিয়েছেন সমগ্র জীবন। তাঁর স্মৃতিগদ্যের দর্পণে ভেসে ওঠে মহৎ ও মৌলিক শিল্পীর অবয়ব।