<p>মাদরাসা অর্থ বিদ্যালয় হলেও এর দ্বারা ইসলামী জ্ঞানকেন্দ্রকেই বোঝানো হয়। মাদরাসার সূচনা হয়েছিল মহানবী (সা.)-এর যুগে, যা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়ে তার বর্তমান অবকাঠামোতে এসে দাঁড়িয়েছে। ৪৫৯ হিজরিতে প্রতিষ্ঠিত বাগদাদের নিজামিয়া মাদরাসাই আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ আবাসিক মাদরাসা। নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আগেও মুসলিম বিশ্বে একাধিক প্রসিদ্ধ মাদরাসা ছিল। এই প্রবন্ধে নিজামিয়া-পূর্ব মাদরাসা ও মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।</p> <p><strong>নবীজি (সা.)-এর যুগে মাদরাসা</strong></p> <p>মক্কায় সাহাবি আরকাম ইবনে আবিল আরকাম (রা.)-এর বাড়িতে নবীজি (সা.) সাহাবায়ে কিরাম (রা.)-এর সঙ্গে মিলিত হতেন। সেখানে তাদের দ্বিনি বিষয়ে পরামর্শ দিতেন এবং শরিয়তের বিধি-বিধান শেখাতেন। এ হিসেবে দারুল আরকামকে ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মাদরাসা বলা হয়। মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর মসজিদে নববীতে ‘সুফফা’ নামে একটি কক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেখানে জ্ঞানান্বেষী ও আশ্রয়হীন সাহাবিরা অবস্থান করতেন। সেখানে থেকে তাঁরা মহানবী (সা.)-এর কাছ থেকে দ্বিনি শিক্ষা অর্জন করতেন। এই হিসাবে মসজিদে নববীর সুফফাকে মাদরাসা শিক্ষার সূতিকাগার বলা হয়। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর অনেক কিছুই হয়তো দারুল আরকাম ও সুফফাতে ছিল না, তবুও এ দুটিই ছিল ইসলামের ইতিহাসে মাদরাসার মূল ভিত্তি।</p> <p><strong>সাহাবিদের যুগে মাদরাসা</strong></p> <p>মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পরবর্তী ২০০ বছর পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষা পরিচালিত হতো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা একজন প্রসিদ্ধ আলেমের কাছে উপস্থিত হয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করত। সে সময় শহরের জ্ঞানচর্চা আবর্তিত হতো এক বা একাধিক ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে। তাঁরা সাধারণত মসজিদে বা নিজ বাড়িতে পাঠদান করতেন।</p> <p>ইসলামের প্রথম কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্র হিসেবে মদিনা, মক্কা, দামেস্ক, কুফা, বসরা, ফুসতাস ইত্যাদি শহর প্রসিদ্ধ ছিল। এ ক্ষেত্রে মক্কা ও মদিনা ছিল সবচেয়ে অগ্রগামী। কেননা সেখানে একাধিক প্রসিদ্ধ সাহাবি ও তাবেঈরা অবস্থান করতেন। মদিনায় খোলাফায়ে রাশেদিনসহ বড় বড় সাহাবির বেশির ভাগই সেখানে বসবাস করতেন। </p> <p>মক্কার প্রসিদ্ধ শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) ও আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)। কুফার শিক্ষা দান করতেন আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)। বিভিন্ন সময়ে তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আবু সাঈদ খুদরি (রা.), আবু ওয়াক্কাস (রা.), হুজাইফা (রা.), আম্মার (রা.), সালমান ফারেসি (রা.)। বসরার প্রধান শিক্ষক ছিলেন আবু মুসা আশআরি (রা.) ও আনাস বিন মালিক (রা.)। দামেস্কে শিক্ষা দান করেন মুয়াজ বিন জাবাল (রা.), আবু দারদা (রা.), উবাদা বিন সামিত (রা.)। উমাইয়া যুগে আফ্রিকা বিজয় হলে সেখানে প্রসিদ্ধ ১০ তাবেঈকে শিক্ষক হিসেবে পাঠান ওমর ইবনুল আবদুল আজিজ (রহ.)।<br />  <br /> <strong>সোনালি যুগের প্রসিদ্ধ ১০ মাদরাসা</strong></p> <p>স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে মাদরাসার সূচনা হয়েছিল হিজরি দ্বিতীয় শতকের শেষে থেকে হিজরি তৃতীয় শতকের প্রথম ভাগে, যা মুসলিম শাসক, জ্ঞানানুরাগী ও আলেমদের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে বিকশিত হতে থাকে। নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার আগে প্রতিষ্ঠিত ১০টি মাদরাসার পরিচয় তুলে ধরা হলো :</p> <p>১. মাদরাসা ইমাম আবু হাফস বুখারি (রহ.) : ইমাম আবু হাফস বুখারি (রহ.) তাঁর জীবনের মধ্যভাগে এসে বুখারা শহরে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর জীবনকাল ১৫০ থেকে ২১৭ হিজরি পর্যন্ত।</p> <p>২. মাদরাসায়ে ইবনে হিব্বান (রহ.) : শাফেয়ি মাজহাবের প্রসিদ্ধ ফকিহ ইমাম আবু হাতেম মুহাম্মদ ইবনে হিব্বান আত-তামিমি (রহ.) এই মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ৩০৫ হিজরিতে আগফানিস্তানের বুস্ত শহরে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। মাদরাসায় তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য ভবন ও পাঠাগার স্থাপন করেন। তিনি ২৭০ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ৩৫৪ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।</p> <p>৩. মাদরাসায়ে আবুল ওয়ালিদ (রহ.) : নিশাপুরের প্রসিদ্ধ আলেম ছিলেন শায়খ আবুল ওয়ালিদ হাসসান ইবনে আহমদ নিশাপুরি (রহ.)। তিনি নিশাপুরে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ঐতিহাসিকরা লেখেন, তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা নিয়েই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকতেন। তিনি ৩৪৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।</p> <p>৪. মাদরাসায়ে ইবনে হাম্মাদ (রহ.) : আলজেরিয়ার প্রসিদ্ধ আলেম, ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে হাম্মাদ। তিনি আলজেরিয়ার শাসক পরিবার বনু হাম্মাদের সদস্য। তিনি তাঁর জন্মস্থানে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইমাম সুবকি (রহ.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, তিনি জাগতিক জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন এবং তাঁর মাদরাসা ও মসজিদকে আবশ্যক করে নেন। তিনি ৩৮৮ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।</p> <p>৫. মাদরাসায়ে সাদরিয়া : সুজাউদ্দৌলা সাদের বিন আবদুল্লাহ ৩৯১ হিজরিতে দামেস্কে এই মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এটা ছিল দামেস্কের প্রথম স্বতন্ত্র মাদরাসা। আর এর প্রথম শিক্ষক ছিলেন যুগশ্রেষ্ঠ আলেম আলী ইবনে জানকি কাশানি (রহ.)।</p> <p>৬. মাদরাসায়ে রাশাইয়্যা : চতুর্থ হিজরি শতকে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদরসায়ে রাশাইয়্যা। খ্যাতিমান কারি রাশা বিন নাদিফ (রহ.) মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সাদরিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার সঙ্গেও সম্পৃক্ত ছিলেন।</p> <p>৭. মাদরাসায়ে বাইহাকিয়্যা : মাদরাসায়ে বাইহাকিয়্যা ছিল খোরাসানের নিশাপুরের প্রসিদ্ধ মাদরাসা। ঐতিহাসিকরা লেখেন, মাদরাসাটি নিজামুল মুলক তুসি (রহ.)-এর জন্মের আগে প্রতিষ্ঠিত। আর তিনি ৪০৮ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। সুতরাং বাইহাকিয়া মাদরাসা হিজরি চতুর্থ শতকের মধ্য বা শেষ ভাগে প্রতিষ্ঠিত বলে ধরে নেওয়া যায়। কোনো কোনো ঐতিহাসিক এটিকে নিশাপুরের প্রথম মাদরাসা বলেছেন।</p> <p>৮. মাদরাসায়ে আবু বকর বুস্তি : নিশাপুরের খ্যাতিমান নাহুবিদ, বিতার্কিক ও শিক্ষক ছিলেন আবু বকর বুস্তি (রহ.)। তিনি প্রাচীন খোরাসান ও আধুনিক আফগানিস্তানের বুস্ত শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নিশাপুরে তাঁর বাড়ির সামনে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজের সব সহায়-সম্পদ ও উপার্জন মাদরাসার জন্য ওয়াকফ করে দেন। তিনি ৪২৯ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন।</p> <p>৯. মাদরাসায়ে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) : ইরাকে ইমাম আবু হানিফা (রহ.)-এর সমাধির কাছেই মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা আবু সাআদ ইবনে মুস্তাউফা (রহ.)। তিনি একজন ঐতিহাসিক ও কবি ছিলেন। নিজামিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পাঁচ মাস আগে মাদরাসাটি যাত্রা শুরু করে।</p> <p>১০. গজনভিদের মাদরাসাগুলো : গজনভির মুসলিম শাসকরা মাদরাসা শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তাঁদের শাসনামলে একাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। আর গজনভিদের শাসনকাল শুরু হয়েছিল ৩৮৩ হিজরিতে।</p> <p><em>তথ্যঋণ : ইসলাম হিস্টোরি ডটকম, মাকতাবায়ে শামেলা ও আলজাজিরা</em></p> <p> </p>