করোনা মহামারির পর থেকে বিশ্বজুড়ে বেড়ে যায় স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার। মানুষের অনুপস্থিতিতে বা দূর নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কিভাবে কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়, এমন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয় প্রায় সব খাতেই। এ ক্ষেত্রে বাদ পড়েনি ট্রিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাকশিল্পও।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেলাইয়ের কাজে রোবটের ব্যবহার নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে জার্মানির সিমেন্স এজি ও লেভি স্ট্রস অ্যান্ড কম্পানি।
ফলে সস্তা শ্রমের কল্যাণে চীন, বাংলাদেশসহ এশিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা তৈরি পোশাকশিল্প যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে চলে যাওয়ারও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ শ্রমিকের ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমানো গেলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ব্র্যান্ডগুলো এ শিল্প তাদের দেশেই নিয়ে যেতে চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোতে ২০১৮ সাল থেকে সিমেন্সের ল্যাবে তৈরি পোশাকশিল্পে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ প্রকল্পের প্রধান ইউগেন সলোজো বলেন, ‘পোশাকশিল্প হচ্ছে শেষ ট্রিলিয়ন ডলারের শিল্প, যা এখনো স্বয়ংক্রিয় প্রযুুক্তিতে আসেনি।
’ জিন্স কারখানায় কিছু কিছু অংশ স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে তৈরির প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছিলেন জনাথন জরনাও। তিনি বলেন, ‘এ কারণে আমি অনলাইনে ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছিলাম, এমনকি মৃত্যুর হুমকিও।’ তাঁর মতে, পোশাকশিল্পের অনেক উদ্যোক্তাই স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির ব্যাপারে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করেন। কারণ এটি করা হলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর শ্রমিকরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
পোশাক সেলাইয়ে রোবট ব্যবহারের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতাগুলোর একটি হচ্ছে কাপড়ের নমনীয়তা, পুরুত্ব আর বুনন। একজন মানুষ নিজের স্পর্শ দিয়ে যেভাবে কাপড়ের অনুভূতি নিতে পারে, রোবটের সে ক্ষমতা নেই।
ইউজেন সোলোজা রয়টার্সকে বলেন, এ খাতে সিমেন্সের অংশগ্রহণ শুরু হয়েছে রোবটকে সব ধরনের কাপড় চেনার সক্ষমতা দিতে পারবে এমন সফটওয়্যার বানাতে গিয়ে। কাজ শুরু করার কিছুদিনের মধ্যেই তারা উপলব্ধি করে, পোশাকশিল্পই এই উদ্ভাবনী প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় বাজার। পরিসংখ্যানের ওয়েবসাইট স্ট্যাটিসটার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের পোশাকবাজারের আকার এখন এক লাখ ৫২ হাজার কোটি ডলার।
রোবটকে ভিন্ন ভিন্ন বুননের কাপড় নাড়াচাড়া করা শেখানোর বদলে রাসায়নিক প্রয়োগ করে পোশাকের কাপড়কে শক্ত করে তোলার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেছে ‘সিউবো ইনকরপোরেটেড’ নমের স্টার্টআপ কম্পানি। এতে কারখানায় উৎপাদিত গাড়ির বাম্পারের মতোই সহজে পোশাকের কাপড় নিয়ে কাজ করতে পারবে রোবট। সেলাই শেষে ধুয়ে ফেললেই চলে যাবে সেই রাসায়নিক। সিউবোর উদ্ভাবক জোর্নোউয়ের দাবি, যেহেতু সেলাই শেষে প্রায় সব জিনসই ধোয়া হয়, এখনকার উৎপাদনপ্রক্রিয়া ঠিক রেখেই তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করা সম্ভব।
বছর দুয়েক আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে নতুন জিন্স কারখানা বানিয়েছেন সাঞ্জিভ বল। সিউবোর প্রযুক্তি প্রাথমিকভাবে যাচাই করে দেখার পর নিজের কারখানায় প্রথম পরীক্ষামূলক মেশিন বসানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সেপ্টেম্বর মাসে রয়টার্সের সংবাদকর্মীদের নিজের কারখানা ঘুরিয়ে দেখানোর সময় তিনি বলেন, ‘এতে যদি কাজ হয়, তাহলে আবারও যুক্তরাষ্ট্রে বড় পরিসরে জিন্স উৎপাদন শুরু করতে না পারার কোনো কারণ আমি দেখছি না। ’
নিক্কি এশিয়ার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, লেজার নির্দেশক কাটিং যন্ত্র, কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সেলাই মেশিন অনেক বছর যাবৎই এ শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু কাপড় সেলাই করে স্থানান্তর করা এখনো পর্যন্ত মানুষ দিয়েই করতে হয়। নরম-পাতলা কাপড় কিভাবে সেলাই করবে সে প্রশিক্ষণ অনেক দিন ধরেই রোবটকে দেওয়া হচ্ছে। জার্মানির আরডাব্লিউটিএইচ আচেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের হিসাবে পোশাক কারখানায় কাপড় কাটা ও সেলাইয়ের কাজে খরচ হয় উৎপাদনের ৮০ শতাংশ সময় ও খরচ। সে কারণেই এ কাজ রোবটের হাতে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন গবেষকরা। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক কম্পানিগুলো আশাবাদী, অবশেষে তারা পোশাকশিল্পকে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে আনতে সক্ষম হবে। সূত্র : রয়টার্স, নিক্কি এশিয়া