<p>চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ বাবদ সরকারকে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই ঋণের অঙ্ক প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের সময় রিজার্ভ সংকুচিত হয়ে আসায় এই বিপুল পরিমাণ ঋণ পরিশোধের বিষয়টি অন্তর্বর্তী সরকারকে বেশ বিপাকে ফেলেছে। এটি বাজেটের ওপরও বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।</p> <p>ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার গত ১৫ বছরে উন্নয়নের নামে বিপুল অঙ্কের বিদেশি ঋণ নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। ৪৮ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ ১৮ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।</p> <p>অর্থনীতিবিদরা বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ নেওয়াকে সব সময় স্বাগত জানান। গত ১৫ বছরে অনেক বিদেশি ঋণও নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দর-কষাকষি করে ও বাছবিচারহীনভাবে, যা সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতিতে চাপ বাড়িয়েছে। সুদসহ ঋণ পরিশোধের ব্যয় বাড়ায় বাজেটের ওপর চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।</p> <p>ইআরডির তথ্য মতে, গত অর্থবছরে ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধ করতে হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে এই ঋণ পরিশোধের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার।</p> <p>ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে অর্থনীতিতে আরেকটি চাপ তৈরির আশঙ্কা রয়েছে। ২০২৬ সালের পর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নেওয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে। একই সময় মেট্রো রেল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের ঋণের আসল পরিশোধও শুরু হবে। এতে ঋণ পরিশোধের বোঝা আরো বাড়বে।<br /> বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের ঋণ বাড়ছে, সেই সঙ্গে পরিশোধের অঙ্কও বাড়ছে।</p> <p>আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের অঙ্ক বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর মধ্যে আমরা রাজস্ব আদায় যদি বাড়াতে না পারি এবং বৈদেশিক মুদ্রার জোগানও যদি না বাড়ে, তাহলে ঋণ পরিশোধের চাপে অর্থনীতিতে দুর্দশা নেমে আসতে পারে।’</p> <p>ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে ৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে সুদ-আসল মিলিয়ে পরিশোধ করতে হবে প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৫-২৬ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়াবে ৫.২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক ঋণের সুদ-আসল বাবদ পরিশোধ করেছে ২.৭ বিলিয়ন ডলার।</p> <p>ইআরডি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ ও বঙ্গবন্ধু টানেলের মতো বেশ কিছু মেগাপ্রকল্পের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় এসব প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের আসল ও সুদ পরিশোধের চাপ ক্রমে বাড়ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মেট্রো রেলের মতো বড় প্রকল্পগুলোর ঋণ পরিশোধ শুরু হলে চাপ আরো বেড়ে যাবে।</p> <p>এ ব্যাপারে ড. জাহিদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারকে ঋণের অর্থ ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। ঋণ ব্যবহার করে রিটার্ন যাতে সময়মতো পাওয়া যায়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। আর বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে তো বৈদেশিক মুদ্রাই লাগবে। তাই বৈদেশিক মুদ্রা আসার ক্ষেত্রে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না হয়, এ জন্য পলিসিগুলো ঠিক রাখা দরকার। বৈদেশিক মুদ্রা না এলে তো পরিশোধে চাপ পড়বেই।</p> <p><strong>বিদেশি ঋণ পরিশোধ বেড়েছে ২৬%</strong></p> <p>বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার কারণে সুদ ও আসল পরিশোধের চাপ এখন বর্তমান সরকারের ঘাড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে সুদের হারও অনেক বেড়েছে। গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধ ২৬ শতাংশ বেড়ে ৩৩৬ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। উচ্চ সুদহারের কারণে ঋণের সুদ পরিশোধ ৪৪ শতাংশ বেড়ে ১৩৫ কোটি ডলার হয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়িড শেষ হওয়ায় আসল পরিশোধ বাড়ছে। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ আসল ও সুদ বাবদ উন্নয়ন সহযোগীদের পরিশোধ করেছিল ২৬৭ কোটি ডলার। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ১১০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করে বাংলাদেশ।</p> <p><strong>বিদেশি ঋণের বোঝা তিন গুণের বেশি</strong></p> <p>ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ১৫ বছরে বিদেশি ঋণের বোঝা বেড়েছে তিন গুণের বেশি। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ২০.৮৫ বিলিয়ন ডলার। আওয়ামী লীগ সরকার মেগাপ্রকল্পের নামে বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশের কাছ থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নেয়। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সরকারের পুঞ্জীভূত বিদেশি ঋণ দাঁড়ায় ৬৯.৬৬ বিলিয়ন ডলার। সে হিসাবে বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাথার ওপর গড়ে ৪০০ ডলারের মতো বিদেশি ঋণের বোঝা।</p> <p>সূত্রগুলো জানায়, প্রতিবছর সরকার যত বিদেশি ঋণ পায়, তার এক-তৃতীয়াংশ অর্থই চলে যায় ঋণের সুদ ও আসল পরিশোধে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরেই আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয়েছে।</p> <p>রূপপুর প্রকল্পের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সালে। তবে এই ঋণ পরিশোধের সময় আরো দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য দেনদরবার চলছে। বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের ঋণের কিস্তি কমানোর আলোচনা চলছে। নতুন করে ঋণ নেওয়ার বিষয়টিও চলছে ধীরগতিতে।</p> <p>নতুন সরকার দায়িত্বে এসে অবশ্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। সম্প্রতি ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে তিনি বিদেশি ঋণ নেওয়ার সময় সুদের হার, কিস্তি, পরিশোধের মেয়াদসহ বিভিন্ন শর্ত যাচাই-বাছাই করার নির্দেশ দেন।</p>