বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পরও যথারীতি অফিস করছেন। সরকারি সকল ধরনের সুযোগ সুবিধাও ভোগ করছেন। বিভাগীয় চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে শিক্ষক এমনকি কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির হুমকী সন্বলিত অফিস আদেশেও স্বাক্ষর করছেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং উপ-উপাচার্যের মধ্যকার দ্বন্দের কারণে অবসরে গিয়েও রেজিস্ট্রার বহাল তবিয়াতেই রয়েছেন।
অবসরে থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ফাইলে রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষর নিয়ে আগামীতে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ।
কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মামুন অর রশিদ মুঠোফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, রেজিস্ট্রার ১ ফেব্রুয়ারি থেকে অবসরে গেছেন। কিন্তু এখনো তিনি রেজিস্ট্রারের সকল দায়িত্ব পালন করছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা আগের মতোই ভোগ করছেন।
উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিন তাঁর প্রশাসনিক ক্ষমতা বলে, মনিরুল ইসলামকে আবার রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালনের আদেশ দিতেই পারেন।
কিন্তু সেই আদেশের অনুলিপি প্রশাসনে পাঠাতে হবে। কিন্তু রেজিস্ট্রারের নিয়োগ প্রসঙ্গে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত কোন অফিস আদেশ পাইনি। তাই কিভাবে এখনো তিনি রেজিস্ট্রার পদে বহাল রয়েছেন, তা আমি অবগন নই।
তার দায়িত্ব নিয়ে আগামীতে প্রশ্ন উঠবে।
অবসরে গ্রহনের কথা স্বীকার করে রেজিস্ট্রার মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিনের লিখিত আদেশ নিয়েই রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করছি। সে অনুযায়ী সরকারি সুযোগ-সুবিধা আগের মতোই ভোগ করছি। অফিস আদেশে স্বাক্ষরসহ সকল কার্যাদি আগের মতোই পালন করছি।
রেজিস্ট্রারের নতুন দায়িত্বেও অফিস আদেশ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, উপাচার্য আমাকে লিখিত আদেশ দিয়েছেন।
সিন্ডিকেটের সভায় অনুমোদন পেলেই সকলকে অফিস আদেশ দেওয়া হবে। সিন্ডিকেটের সভায় আপনার নিয়োগ যদি বাতিল হয়, সে ক্ষেত্রে আবার স্বাক্ষরিত সকল আদেশই বাতিল হয়ে যাবে। তখন এটি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। এ প্রসঙ্গে মনিরুল ইসলাম জোর দিয়ে বলেন, আমার নিয়োগ হবেই।
উপ-উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম রাব্বানি বলেন, অবসরে যাওয়া মনিরুল ইসলামকে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাকে দিয়ে যা ইচ্ছে উপাচার্য তাই করাচ্ছেন। নৈতিক স্খলনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন রেজিস্ট্রার। চার বছর পর তিনি আদালতের আদেশে চাকুরি ফিরে পেয়েছেন। অযোগ্য এই রেজিস্টারকে ব্যবহার করে উপাচার্য চেয়ারম্যানদের চাকরিচ্যুতির হুমকী দিয়ে নোটিশ দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আমার দপ্তরের একজন মাত্র কর্মকর্তা, তাকেও স্ট্যান্ডরিলিজ করা হয়েছে। তার স্থালে অন্য কোনো কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কারণ ওই কর্মকর্তা যোগদান করে আবার যদি কোনো চিঠি দেয়, সেই ভয়ে কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেয়নি উপাচার্য।
উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিনের মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি তাতে কোনো সাড়া দেননি। তাই তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
যেভাবে রেজিস্ট্রার মনিরুল
জানাগেছে, ঢাকার নন-এমপিওভুক্ত ক্যামব্রিয়ান কলেজে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষর দায়িত্বে ছিলেন মনিরুল। তার স্ত্রী মাসুদা বেগম, তিনি ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকারের তৎকালিন শিক্ষা মন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের মাধ্যমে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। নিয়ম অনুযায়ী কমপক্ষে দুই বছর ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর রেজিস্ট্রার হওয়ার কথা। প্রভাব খাটিয়ে নির্দিষ্ট সময়ে আগেই মনিরুল বিশ্বব্যিালয়ের প্রথম রেজিস্ট্রার হন।
রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করার পর থেকে মনিরুল ইসলাম নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাব বিস্তার শুরু করেন। এরই মধ্যে নৈতিক স্খলন সংক্রান্ত অশালীন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট সভা তাকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের নির্দেশ দেয়। ছুটি নিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। নৈতিক স্খলনের অভিযোগে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছিলেন তৎকালীন উপাচার্য ইমামুল হক।
উচ্চ আদালতের আদেশে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর তিনি আবার রেজিস্ট্রার পদে যোগ দেন।
মেয়াদ শেষেও দ্বন্দ্বে বহাল রেজিস্ট্রার
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত বছরের ৩০ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানি উপ-উপাচার্য হিসেবে প্রথম নিয়োগ পান। সেই থেকেই তিনি উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পরবর্তিতে গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ববির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় অধ্যাপক শুচিতা শরমিনকে। তিনিই ববির প্রথম নারী উপাচার্য, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
অধ্যাপক শুচিতা শরমিন উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহনের পর তার অনুসারী কর্নেল (অব.) আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানকে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ওই ঘটনার পর উপাচার্য এবং কোধাধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোল শুরু করে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কোষাধ্যক্ষ বিরোধী আন্দোলনে শিক্ষকদের একটা অংশ যোগ দেওয়ার পরে কোষাধ্যক্ষ ওই পদে যোগদান করতে পারেননি। আন্দোলনের মুখে সেই কোষাধ্যক্ষের নিয়োগ বাতিল করতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিল। অদৃশ্য কারণে উপাচার্য বিরোধী আন্দোলন একটা পর্যায়ে থেমে যায়।
এমন পরিস্থিতিতে নতুন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মামুন অর রশিদ নিয়োগ পান। উপাচার্যের অনুপস্থিতিতেই নতুন কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. মামুন অর রশিদ যোগদান করেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত। প্রায় তিন মাস হয়েছে উপাচার্য নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এই সময়ে উপ-উপাচার্যকে কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
উপ-উপাচার্য একাডেমিক সভা আহবান করলে উপাচার্য রেজিস্ট্রারের মাধ্যমে অংশগ্রহনকারীদের চাকুরিচ্যুতির হুমকী দিয়ে সভা বন্ধ করিয়ে দেন। শিক্ষকরা বলছেন, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ এই পদের মধ্যে সমন্বয় না থাকলে সব কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে।