<p>ছাত্রসমাজ কোটা সংস্কার আন্দোলনকে পরবর্তী সময়ে একটি বৃহৎ পরিসরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে একটি ব্যাপক পরিবর্তনমুখিনতার প্রত্যয়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের প্রতিপাদ্যে সমন্বয়করা আসলে চেয়েছেন ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রকাঠামোতে বিদ্যমান অচলায়তন সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে বহু কাল ধরে বিরাজমান সব ধরনের অপশাসন, নির্যাতন ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি শোষণহীন, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও ‘রাষ্ট্র মেরামতের’ প্রশ্ন সামনে এনেছিলেন এই ছাত্র তরুণরাই।</p> <p>তাই তাঁদের সম্মিলিত দাবিগুলোতে ঘোষিত প্রত্যয়, যাতে রাষ্ট্রনৈতিক সংস্কারই প্রকৃতপক্ষে সামাজিক ন্যায়বিচার, সুশাসন ও গণতন্ত্রকে আরো সুসঙ্ঘবদ্ধ ও সুসংহত করতে পারে। কেননা ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় যারাই রাজনীতি থেকে শাসনক্ষমতায় যায়, তারাই  এক পর্যায়ে ‘প্রভু’ বনে যায়। এই প্রভুতন্ত্র এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে সেখানে স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও মানুষ স্বাধীনতার মর্যাদা পায় না। জনগণের ওপর ক্ষমতার দাপট প্রদর্শনই প্রতিদিনের রুটিন হয়ে ওঠে। বিপ্লব মানে আমূল পরিবর্তন, অভূতপূর্ব জাগরণ, একটি নতুন কিছুর আকাঙ্ক্ষা।</p> <p>বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এত বিশ্বব্যািলয়ের সার্বিক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার চাপ নিতে সরকারকে যথেষ্ট হিমশিম খেতে হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন নানাভাবে বাধাগ্রস্ত হয় এবং কোনোভাবেই কোনো র্যাংকিংয়ের সারণিতে জায়গা করে নিতে পারে না। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোতে অভিজ্ঞ শিক্ষক পাওয়া যায় না। লেকচারার দিয়েই বিভাগ পরিচালনাসহ অন্য সব একাডেমিক/নন-একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এসব কাজে অনভিজ্ঞ লেকচারারদের সামর্থ্যের উপযোগিতা কতটুকু ফলপ্রসূ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অভিভাবক ইউজিসিও সার্বিক বিষয়ের অত্যধিক চাপে সুনির্দিষ্ট বিষয়ে নজরদারিতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে বাধ্য হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক এক্সিলেন্সির অবনমন ঘটে।</p> <p>আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এতগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ প্রভৃতি পদে নিয়োগ দিতে বা বাছাই করতে সরকারকে গলদঘর্ম হতে হয়। উপযুক্ত পদাধিকারী বাছাই করতে সরকারকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। ফলে ওই পদগুলোতে নিয়োগ দিতে সরকারের ছয় মাস থেকে এক বছরের বেশি, কখনো কখনো তারও বেশি সময় লেগে যায়।</p> <p>এ অবস্থায় চলমান ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ধরলে তিনটি পদ মিলে ১৫০ জনের বেশিসংখ্যক (কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে একাধিক উপ-উপাচার্যের পদ) যোগ্য প্রার্থী খুঁজতে গিয়ে অনেক অযোগ্য প্রার্থী পদাসীন হন এবং নানা রকম অদক্ষতা, দুর্নীতি এবং দলবাজির দৌরাত্ম্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অরাজকতা তৈরি হয়, তা আমরা প্রায়ই পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই।</p> <p>আশি-নব্বইয়ের দশকে অল্প কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের যে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা বা মর্যাদা দেখেছি এবং তাঁদের কর্মদক্ষতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যে গতিশীলতা ও সুনাম তৈরি হয়েছে, ধনে-মানে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কীর্তিগাথা। এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। আশির বা নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত গোটা দেশের কলেজগুলো বড় তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন কলেজগুলো শিক্ষার গুণগত মানসহ অন্যান্য একাডেমিক/নন-একাডেমিক কার্যক্রমে এগিয়ে ছিল।</p> <p>দেখা গেছে, কোনো কোনো বছরে একাডেমিক ফলাফলে, খেলাধুলায় বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কে টেক্কা দিয়েছে। কিন্তু সেটি এখন আর নেই। এখন সময় এসেছে কলেজগুলোকে ঢেলে সাজানোর। এখনো অনেক কলেজ আছে গুণে-মানে, সম্পদে-ভূমিতে অনেক নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে এগিয়ে আছে। কাজেই কলেজগুলোকে নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কলেজগুলো কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একীভূত হলেই হবে না, কলেজগুলোকেও হয়ে উঠতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপর্যায়ের।</p> <p>বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগপ্রক্রিয়ায়ও কিছু বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবশ্যই স্বতন্ত্র পে স্কেল দিতে হবে। স্বতন্ত্র পে স্কেল ছাড়া কোনোভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। তাহলে অবশ্যই এই মহান পেশাটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এবং মেধাবীরা সময় পার করে হলেও এই পেশায় আসতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন।</p> <p><em>লেখক : অধ্যাপক, বাংলা ডিসিপ্লিন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা</em></p> <p><em>dr.roziqul66@gmail.com</em></p> <p> </p>