বিতর্কিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের গুলশানের বাড়িতে অবৈধ মদের বারের পাশাপাশি ক্যাসিনো কারবার চালানোর আলামত পাওয়া গেলেও সে ব্যাপারে কোনো তদন্তই হচ্ছে না। ক্যাসিনো কার্ড ও এএমবি লেখা এক হাজার ৬০০ কয়েন উদ্ধারের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সাধারণ ডায়রি (জিডি) করে তারা পুলিশকে তদন্তে আহবান জানাবেন।
ঘটনার এক সপ্তাহ পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, আলাদা কোনো জিডি বা মামলা হয়নি। মাদক মামলায়ই ক্যাসিনো সামগ্রী জব্দ দেখানো হয়েছে।
এখন ডিএনসি ও পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন কিভাবে ক্যাসিনো চলতো সে বিষয়ে কোনো তদন্ত হচ্ছে না। অথচ চলমান অভিযানে ক্যাসিনো সামগ্রী পাওয়ার প্রতিটি ঘটনারই তদন্ত হচ্ছে। মতিঝিলের কয়েকটি ক্লাবে ক্যাসিনো সামগ্রী উদ্ধারে ঘটনায় জিডি হলেও অন্য মামলায় সংযুক্ত করে তদন্ত চলছে। ১১টি ক্লাব ও বারের ক্যাসিনো কারবারের পেছনে কারা আছেন, তা তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের গডফাদারখ্যাত আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের বাড়ির ক্যাসিনো আছে তদন্তের বাইরে।
এদিকে আজিজ মোহাম্মদের দুই ভাতিজা ওমর মোহাম্মদ ভাই ও আহাদ মোহাম্মদ ভাই গুলশানের ওই বাড়িতে অবৈধ মদের বারের সঙ্গে ক্যাসিনো কারবার চালাতেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে এমন তথ্য পেলেও দুজনকে গ্রেপ্তারে কোনো উদ্যোগ নেই ডিএনসির। গ্রেপ্তারের সাত দিন পর গতকাল রবিবার নবীন মন্ডল ও পারভেজকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছেন ঢাকার মহানগর হাকিম আদালত।
জানতে চাইলে ডিএনসির উপপরিচলক (ঢাকা মেট্টো) মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ক্যাসিনোর সামগ্রীগুলোর তদন্ত আমাদের আইনের আওতায় পড়ে না। পুলিশ বা র্যাব চাইলে নিজ উদ্যোগে তদন্ত করতে পারে। আমরা একটি ফরোয়াডিং দিয়ে এগুলো জমা দিয়েছি। পুলিশ জিডি আকারে নিতে পারে। আবার না নিলেও আমাদের মামলার আলামত হিসেবে এগুলো থাকবে।
গুলশান থানার ওসি এম এম কামরুজ্জামান বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর দুটি মামলা করেছে, যেগুলো তারাই তদন্ত করছে। এ ছাড়া ক্যাসিনোর ব্যাপারে কোন জিডি বা মামলা হয়নি। এগুলো তাদের মামলার আলামত। আদালতের নির্দেশনায় তারাই হয়ত ধংস করবে!
কারা জড়িত তেমন কোন তদন্ত, এমন প্রশ্ন করা হলে ওসি বলেন, এটা তো আমরা বলতে পারবো না।
ডিএনসির সহকারী পরিচালক (ঢাকা উত্তর) খোরশিদ আলম বলেন, গত সপ্তাহে নবীন ও পারভেজের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। বিজ্ঞ আদালত এক দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের পরে এর সঙ্গে কারা জড়িত তা বের করে পরবর্তী তদন্ত চালানো হবে।’
গত ২৭ অক্টোবর গুলশানের ৫৭ নাম্বার সড়কের ১১/এ হোল্ডিংয়ের দুটি ছয় তলা ভবনে অভিযান চালিয়ে ৩৯০ বোতল মদ, চার কেজি সিস, দুই গ্রাম গাঁজা, একটি ক্যাসিনো কার্ড, এক হাজার ৬০০ ক্যাসিনো কয়েন জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় আজিজের ভাতিজা ওমর মোহাম্মদ, গ্রেপ্তারকৃত কর্মচারী নবীন ও পারভেজকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয়। অভিযানের সময় ফায়ার এক্সিট দিয়ে পালিয়ে যান ওমর মোহাম্মদ ভাই।
একটি এজাহারে অভিযোগ করা হয়েছে, গুলশানের ৫৭ নাম্বার সড়কের ১১/এ হোল্ডিংয়ের ছয় তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় ওমর মোহাম্মদ তার ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে ও ছাদে মাদকদ্রব্য মজুদের জন্য বিশেষ কারুকার্য করে ঘর তৈরি করেন। সেখানে মদ ও সিসা বিক্রির এবং সেবনের আড্ডা হতো। অপর মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ছয় তলা বাড়ির চতুর্থ তলার উত্তর-পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাটে বিপুল পরিমাণে মদ রেখে বিক্রি করছিলেন নবীন মন্ডল ও পারভেজ। সেখান থেকে ২৪ ধরনের আলামত সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে চতুর্থ তলার উত্তর-পশ্চিম পাশের ফ্ল্যাট থেকে ৩৭২ বোতল বিদেশি মদ, একটি ক্যাসিনো কার্ড এবং এএমবি নামাঙ্কিত এক হাজার ৬০০ ক্যাসিনো কয়েন জব্দ করা হয়।
ডিএনসিসহ একাধিক সূত্র জানায়, এএমবি হচ্ছে আজিজ মোহাম্মদ ভাই ও তার ভাতিজা আহাদ মোহাম্মদ ভাইয়ের নামের সংক্ষিপ্ত রূপ। আজিজের ভাই রাজা মোহাম্মদের ছেলে আহাদ বাড়িতে ক্যাসিনোর আসর বসাতেন বলে প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। সেখানে টাকার পরিবর্তে ডলারে জুয়া খেলার আলামত মিলেছে। আর কর্মচারীদের দিয়ে মদ বিক্রি করতেন আহাদের ভাই ওমর মোহাম্মদ। তাদের বাড়িতে যেতেন আজিজ মোহাম্মদের ঘনিষ্ঠ বিত্তবান অনেক ব্যক্তি। বিদেশিরাও যেতেন সে বাড়িতে।
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা, সালমান শাহের মৃত্যু ও মাদক কারবার অভিযোগে সমালোচিত হয়েছেন অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক ও অর্ধশত চলচ্চিত্রের প্রযোজক আজিজ। শেয়ার বাজার থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মামলায় পলাতক আজিজ অনেক বছর থাইল্যান্ডে আছেন। সেখানে তার হোটেল ও ক্যাসিনো ব্যবসা আছে। সেখানে বসেই দেশের সম্পর্ক রক্ষা করছেন আজিজ। বাড়িতে অভিযানের দুই দিন আগেই দেশ ছাড়েন তার ভাতিজা আহাদ। আর এখনো গা ঢাকা দিয়ে আছেন ওমর।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকার ১১টি ক্লাবসহ ৪৯ অভিযানে ২৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভিযানে আট কোটি ৪৫ লাখ টাকা, ১৬৬ কোটি টাকার এফডিআর, ১৩২টি চেক বই, ১১ কোটি ৭৭ লাখ টাকার চেক, আট কেজি সোনা, ২০টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বিপুল পরিমাণ মদ বিয়ার ও ইয়াবা জব্দ করা হয়। ১১টি মামলার তদন্ত করছে র্যাব, যার মধ্যে দুটি মামলার চার্জশীটও দিয়েছে। বাকি মামলাগুলো সংশি¬ষ্ট থানা, সিআইডি এবং গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।