<p style=\"text-align:justify\">করোনার মহামারির প্রভাবে স্থবির হয়ে পড়েছে অর্থনীতি। সংক্রমণ কমাতে দেওয়া একের পর এক লকডাউনে কঠিন সংকটে পড়েছে বেসরকারি খাত। নতুন নিয়োগ তো দূরে, টিকে থাকতে অনেক প্রতিষ্ঠানই কর্মী ছাঁটাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে। সব মিলিয়ে ভয়াবহ মন্দার মুখে পড়েছে চাকরির বাজার।</p> <p style=\"text-align:justify\">করোনা মহামারির প্রথম বছরেই চাকরি কমেছিল ২৯ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসেই তা কমে গেছে ২৮ শতাংশ। বছর শেষে তা ৫০ শতাংশ ছাড়ানোর আশঙ্কা করা হচ্ছে। চাকরি কমার পাশাপাশি অনেকের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে। এতে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। কেউ কেউ বিভিন্ন অপরাধেও জড়াচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবস্থা চলতে থাকলে সমাজে নানা ধরনের অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।</p> <p style=\"text-align:justify\">দোলা রোসেলিন (২৩) গত বছর ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক শেষ করেছেন। গত বছর মার্চ মাসে একটি এনজিওতে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তিনি, চাকরিটা হয়েও গিয়েছিল। তবে মার্চ মাসে অতিমারির কারণে তাঁর চাকরির সুযোগটি হাতছাড়া হয়ে যায়, অফিসে লোকবল নিয়োগ দেওয়া বন্ধ করে দেয় প্রতিষ্ঠানটি। করোনা মহামারির দেড় বছর পার হলেও এখনো তিনি চাকরি পাচ্ছেন না।</p> <p style=\"text-align:justify\">সায়েদ আহমেদ শুভ (২৫) ছয় মাস ধরে ঢাকার একটি বেসরকারি কম্পানিতে চাকরি করতেন। করোনা আসার পর দুই মাসের বেতন বকেয়া হয়ে যায়। অবশেষে তিনি চাকরিটি ছেড়ে দেন। শুভ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখনো বকেয়া বেতন পাইনি। বিনা বেতনে আর চাকরি করা যায় না। অফিসে যাতায়াত করতেও তো টাকার প্রয়োজন হয়। দেড় বছর ধরে পত্রিকা, জব সাইটগুলোতে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজে এখনো তার দেখা পাইনি। এভাবে চাকরির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে হতাশ হয়ে যাচ্ছি।’</p> <p style=\"text-align:justify\">দোলা কিংবা সায়েদের মতো অবস্থা দেশের কোটি তরুণের। দেশের শ্রমবাজারে বছরে প্রায় ১০ লাখের মতো নতুন শ্রমশক্তি প্রবেশ করে। দেশে চাকরির যে বাজার, তাতে প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েটের চাকরি পাওয়ার সুযোগ হয় না বলে জানিয়েছেন শ্রমবাজার বিশেষজ্ঞরা। </p> <p style=\"text-align:justify\">ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড ক্রিমিনাল জাস্টিস বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। ঘরবন্দি মানুষের কোনো সামাজিকতা নেই। এতে মানুষের মনে ব্যাপক চাপ পড়ছে। বেকারত্ব, আয় কমে গেলে মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। মানসিক ডিপ্রেশন, সাইকোপ্যাথ, এলিয়েনেশন কাজ করবে, স্পৃহা হারিয়ে গেলে মানুষ কোনো না কোনোভাবে নেতিবাচক কাজ করবে। তাই বেকারদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে, দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।’</p> <p style=\"text-align:center\"><img alt=\"\" src=\"http://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/ckfinder/innerfiles/images/national.jpg\" style=\"height:483px; width:800px\" /></p> <p style=\"text-align:justify\">সর্বশেষ ২০১৭ সালে শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী ছয় কোটি ৩৫ লাখ। আর তাদের মধ্যে কাজ করে ছয় কোটি আট লাখ নারী-পুরুষ। কর্মক্ষম থেকে কর্মরত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বাদ দিলে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। করোনাকালে যে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকার হয়েছে তাতে বেকারত্বের হিসাব ভয়াবহ অবস্থায় দাঁড়িয়েছে।</p> <p style=\"text-align:justify\">বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে কভিড-১৯-এর কারণে অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে (এমএসএমই) কর্মরত ৩৭ শতাংশ মানুষ বেকার হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারির কারণে বেকারত্বের হার দ্বিগুণ হয়েছে। আইএলওর হিসাবে, এই তরুণদের সবাই পূর্ণকালীন কাজে নিয়োজিত থাকলে বাংলাদেশে করোনাকালে বেকারের সংখ্যা হতো অন্তত ১৬ লাখ ৭৫ হাজার।</p> <p style=\"text-align:justify\">দেশের চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশের শীর্ষ অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বিডিজবস ডট কমের তথ্য অনুযায়ী, প্ল্যাটফর্মটিতে ২০১৯ সালে ৬৩ হাজার ৬০৮টি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। করোনার বছর ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৪৫ হাজার ২০৮টিতে। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ২৯ শতাংশ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বিডিজবসে চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে ৩২ হাজার ৭২১টি। ২০২০ সালের তুলনায় চলতি বছরের ছয় মাসে কমেছে ২৮ শতাংশ, যা বছর শেষে ৫০ শতাংশ ছাড়াতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।</p> <p style=\"text-align:justify\">বিডিজবসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৮১৪টি, ফেব্রুয়ারিতে পাঁচ হাজার ৮২টি, মার্চে পাঁচ হাজার ৯৮৬টি, এপ্রিলে তিন হাজার ৩৩৬টি, মে মাসে চার হাজার ১২৯টি, জুনে পাঁচ হাজার ৪৬৪টি চাকরির বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিউটিকেয়ার, হেলথ অ্যান্ড ফিটনেস ক্যাটাগরিতে চাকরি কমেছে ৪০ শতাংশ। এ ছাড়া কৃষি খাতে (প্লান্ট, ফিশারিজ) ২৮ শতাংশ, ভ্রমণ ও পর্যটনে ২১ শতাংশ, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ১১ শতাংশ এবং সেক্রেটারি, রিসেপশনিস্ট ক্যাটাগরিতে চাকরির বিজ্ঞাপন কমেছে ৯ শতাংশ। </p> <p style=\"text-align:justify\">বিডিজবসের সিইও ফাহিম মসরুর কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনা মহামারির আগে থেকেই চাকরি বাজার খারাপ ছিল। গত চার-পাঁচ বছর দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় আর কলেজ থেকে পাস করা নতুন গ্র্যাজুয়েটদের ৫০ শতাংশের বেশি বেকার থাকছে পড়াশোনা শেষ করে। তিনি বলেন, ‘মহামারির আগে ছোট ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান একটা বড় অংশ কর্মসংস্থান তৈরি করত। আমরা দেখেছি, কভিড যত বেশি ধাক্কা দিয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে, তার চেয়ে অনেক বেশি ধাক্কা দিয়েছে ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে। এদের বেশির ভাগ গত এক-দেড় বছর নতুন লোক নেওয়া বন্ধ রেখেছে, অনেক পুরনো লোক ছাঁটাই করেছে। আগের অবস্থায় ফিরে যেতে আরো দু-তিন বছর লাগতে পারে।’</p> <p style=\"text-align:justify\">তরুণ প্রজন্মের জন্য বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারি চাকরির নিয়োগ ও নির্বাচনী পরীক্ষা স্থগিত হয়ে থাকা। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণের এক-তৃতীয়াংশ বা ৩৩.৩২ শতাংশই পুরোপুরি বেকার। আর ১৮.১ শতাংশ পার্টটাইম বা খণ্ডকালীন কাজে নিয়োজিত। এই পরিস্থিতিতে সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থার চাকরির বিজ্ঞপ্তি না থাকা এবং আগের চাকরির পরীক্ষাগুলোও অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকায় শিক্ষিত বেকারদের ভবিষ্যৎ পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়।</p> <p style=\"text-align:justify\">ব্যবসায়ীদের সংগঠন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি রিজওয়ান রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি সংকটে ব্যাংকিং, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন কাটছাঁটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান খরচ কমাতে কর্মী ছাঁটাই করছে। আর বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানই নতুন কর্মী নিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে সাধারণ কর্মীদের ওপর, যারা ইনফরমাল খাত, পর্যটন ও সরবরাহের মতো সেবা খাতে চাকরি করে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে কলকারখানা বন্ধ করেছেন মালিকরা। এই ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, করোনায় অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে ৩৬ লাখ মানুষের আয় দুই ডলারের নিচে নেমে এসেছে।</p> <p style=\"text-align:justify\">ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো, হস্তশিল্প, কারখানার চাকরি, দরজির কাজ এবং হালকা প্রকৌশলের মতো ক্ষেত্রে সাধারণত তরুণীদের কর্মসংস্থান হতো। কিন্তু এই খাতগুলোই মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। খাতগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন ও সময়সাপেক্ষ, তাই করোনাকাল শেষেও তরুণীদের জন্য চাকরিতে ফিরে আসতে অসুবিধা হবে।</p> <p style=\"text-align:justify\">বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি সরকারি চাকরিতেও নিয়োগ কমে গেছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি অনুমোদিত পদ রয়েছে। এসবের বিপরীতে ১৫ লাখ চার হাজার ৯১৩ জন বর্তমানে কর্মরত। শূন্য আছে তিন লাখ ৮৭ হাজার ৩৩৮টি পদ। বর্তমানে শূন্যপদের মধ্যে ৪৬ হাজার ৬০৩টি প্রথম শ্রেণির, ৩৯ হাজার ২৮টি দ্বিতীয় শ্রেণির, এক লাখ ৯৫ হাজার ৯০২টি তৃতীয় শ্রেণির এবং ৯৯ হাজার ৪২২টি চতুর্থ শ্রেণির।</p> <p style=\"text-align:justify\">‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ চাই’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মের কেন্দ্রীয় টিমের সদস্য তানভীর হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার দেড় বছরে মাত্র একটা বিসিএস পরীক্ষা হয়েছে। বড় চাকরির বিজ্ঞপ্তি নেই বললেই চলে। এই সময়ে প্রায় দেড় লাখ উচ্চশিক্ষিত চাকরিপ্রার্থী তাঁদের বয়স হারিয়েছেন। সরকারের কাছে করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ বছর করার দাবি জানাচ্ছি।’</p> <p style=\"text-align:justify\">জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা এ বি আজিজুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, করোনাকালে বিভিন্ন জরিপে ব্যাপকভাবে চাকরি হারানোর কথা বলা হচ্ছে। নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। যাঁরা চাকরিতে আছেন তাঁরা ঠিকমতো বেতন পাচ্ছেন না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হলে বিনিয়োগ বাড়তে হবে, কিন্তু বিনিয়োগও বাড়ছে না। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ৯ শতংশের নিচে নেমে এসেছে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ শতাংশের মতো। দারিদ্র্যসীমার নিচের মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৯ শতাংশ, যা করোনাকালে ৪০ শতাংশে উঠে এসেছে। পরিস্থিতি খুব উদ্বেগজনক। এই অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, ‘সিএমএসএমই খাতে গুরুত্ব বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে। আমাদের দেশে আন-এমপ্লয়মেন্ট ইনস্যুরেন্স বলে তো কিছু নেই, যেটা উন্নত দেশগুলোতে আছে। সেটা চালু করা যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দরকার সরকারের খালি পদগুলোতে ধাপে ধাপে অনলাইনে চাকরির পরীক্ষার ব্যবস্থা করা।’</p>