বিএফইউজে মহাসচিব ও বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্যসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রতিটি দিন দুটি সূর্য উদিত হয়, একটি হচ্ছে প্রভাত সূর্য, অন্যটি হচ্ছে সংবাদ। সূর্যের আলোতে আমরা দেখি আর সংবাদমাধ্যম আমাদের বিশ্ব দেখায় বা জানায়। একজন সাংবাদিকের কাজ সমাজের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা।’
বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) সন্ধ্যায় জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুর আয়োজিত আলোচনাসভা ও ইফতার মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘সাংবাদিকদের সমাজের দর্পণ বলা হয়। সাংবাদিকরা সমাজের ওয়াচডগ করেন। এই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় সমাজের প্রতিচিত্র। অন্যায়, অনিয়ম, নিগ্রহ, শোষণ-বঞ্চনা ও অধিকার হরণের বিরুদ্ধে সব সময় একজন সাংবাদিককে সোচ্চার থাকতে হয়।
চোখ রাঙানোকে তোয়াক্কা না করে নির্ভীক ও নিরলসভাবে কাজ করতে হয়। প্রচলিত সমাজব্যবস্থার চিত্র প্রত্যক্ষ করতে হয়। মানুষের সমস্যার কথা তুলে ধরার দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক বাধা-বিপত্তির মধ্যে তাদের দিন যায়। ক্ষমতাধরদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হয়।’
তিনি বলেন, ‘সাংবাদিকদের হতে হবে সাহসী। কিন্তু রাষ্ট্রের সহযোগিতা না পেয়ে সাহসী সাংবাদিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিক অনেকটা বিলীন হতে চলেছে।’
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘কথায় কথায় সাংবাদিককে হত্যা করা হয়, নিগৃহীত করা হয়, ভয় দেখানো হয়। সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করতে, কাজ ব্যাহত করতে অহরহ দমন-পীড়ন চালানো হয়।
পুলিশ লেলিয়ে দেওয়া, রাজনৈতিক নেতাদের হুমকি, দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাদের অত্যাচার, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের আক্রমণ- এ সব কিছু সাংবাদিকদের সহ্য করে সামনে এগিয়ে যেতে হয়। তার ওপর রয়েছে নিপীড়নমূলক আইন। নানা রকম হয়রানি এড়িয়ে যেতে সাংবাদিকরা যখন সেলফ সেন্সরশিপের আশ্রয় নেন, তখন গণমাধ্যম আর স্বাধীন থাকে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে সেলফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন। অনেক সময় চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ বেশি, তাদের বিষয়গুলো এড়িয়ে যান। এভাবে সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা মারা পড়ছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নামক গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিরোধী আইনের সদ্যবিলুপ্ত ৫৭ ধারায় করা মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন, এমন সাংবাদিকরা মামলা হওয়ার পর নানা সময়ে জটিল বিষয়গুলোতে প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে গেলে আগে নিজের বিপদ এড়ানোর কথা ভাবেন বারবার। ফলে অনেক সময় অনেক তথ্য জেনেও চুপ করে থাকেন। কেননা, বিপদে পড়লে অফিস বা নেতাদের কাছ থেকে খুব বেশি সমর্থন পাওয়া যায় না।’
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, ‘আরেকটা বিষয়ে না বললেই নয়, বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম বিষয়টি কোনো অর্থ বহন করে না। কেননা, বাস্তবতা হলো এখানে সাংবাদিকরা সেলফ সেন্সর্ড। যে কজন সাংবাদিক এই পরিস্থিতির বাইরে থেকে পেশাদারির সঙ্গে সাংবাদিকতা করতে চান, তারা নানা হয়রানির শিকার হন। তাদের নিয়ন্ত্রণের যে প্রক্রিয়া সেটি তাকে সাহসী হতে বাধা দেয়।’
তিনি আরো বলেন, মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। সাংবাদিকতার বিনিময়ে কিছু প্রত্যাশা করলে সঠিক সাংবাদিকতা করা যায় না। সাংবাদিকতার সঙ্গে যু্ক্তরা যখন হয় কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন, নানা হিসাব-নিকাশের মধ্যে পড়ে যান, তখন তিনি মুক্ত সাংবাদিকতা করতে পারবেন না। বিগত সরকারের সময় এই প্রবণতা বেড়েছে। সাংবাদিকদের প্লট, ফ্ল্যাট অর্থসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের বিবেককে কিনে নেওয়া হয়েছিল। ফলে ওই সাংবাদিকরা সত্যিকারের সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতামুখী সাংবাদিকতার দিকে ধাবিত হন। দালালি করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যান। কোনো কোনো সাংবাদিকের অ্যাকাউন্টে হাজার কোটি টাকা লেনদেনের খবর জাতিকে বিস্মিত করেছে। সঠিক সাংবাদিকতা ছেড়ে কিছু কিছু সাংবাদিক দলদাসে পরিণত হন। যার ফলে সাংবাদিকতার বড় ক্ষতি হয়ে গেছে।’
সাংবাদিকদের এ নেতা বলেন, ‘সাংবাদিক কোনো দলের নন, কারো স্বার্থের নন, এমনকি দল-মতের ঊর্ধ্বে থেকে সঠিক ও নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন করবেন–এটাই প্রকৃত সাংবাদিকের কাজ।’
সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুরের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় বক্তব্য দেন বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের গাজীপুর জেলা শাখার সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি অ্যাডভোকেট শহিদুজ্জামান, গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শওকত হোসেন সরকার, জামায়াতে ইসলামীর আমির প্রফেসর জামাল উদ্দিন, গাজীপুরের পুলিশ সুপার ড. চৌধুরী জাবেদ সাবের বিএফইউজে নেতা আবু হানিফ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক ইউনিয়ন গাজীপুরের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ।