দুই বছর পেরিয়ে গেল সুদানে রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হওয়ার। কিন্তু এখনো কোনো শান্তিচুক্তি বা বিরতির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এই সময়ে প্রাণ গেছে হাজার হাজার মানুষের, বাস্তুচ্যুত হয়েছে এক কোটি ৩০ লাখের বেশি, আর বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ মানবিক সংকটের জন্ম দিয়েছে এই যুদ্ধ।
২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দেশটির সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হয় এই সংঘর্ষ।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, অন্যদিকে আরএসএফের নেতৃত্বে তার এক সময়ের ডেপুটি মোহাম্মদ হামদান দাগলো।
সংঘাতের শুরুতেই রাজধানী খার্তুম রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে মৃতদেহ, লাখো মানুষ শহর ছেড়ে পালায়, আর যারা রয়ে যায় তাদের নামতে হয় প্রতিদিন টিকে থাকার লড়াইয়ে।
৫২ বছর বয়সী আব্দেল রাফি হুসেইন, যিনি আরএসএফের নিয়ন্ত্রণাধীন খার্তুমেই ছিলেন, বলেন, ‘আমি শরীরের অর্ধেক ওজন হারিয়ে ফেলেছি।
’
সেনাবাহিনী সম্প্রতি শহরের নিয়ন্ত্রণ নিলেও রাফি জানান, ‘আমরা এখন নিরাপদে আছি, কিন্তু এখনো পানি ও বিদ্যুতের চরম সংকট চলছে, হাসপাতালগুলোর অধিকাংশই অচল।’
খার্তুম পুনর্দখল সেনাবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলেও যুদ্ধ থেমে নেই। আরএসএফ এখন পশ্চিমাঞ্চলের দুর্ভিক্ষপীড়িত দারফুর এলাকায় আরো গভীরে প্রবেশ করছে এবং আল-ফাশের দখলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি দারফুর অঞ্চলে এখনো সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা শেষ প্রাদেশিক রাজধানী।
‘বিপর্যয় ডেকে আনছে অব্যাহত যুদ্ধ’
লন্ডনে মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদের একটি বৈঠকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, ‘দুঃখজনক বাস্তবতা থেকে উত্তরণের একটি পথ নির্ধারণের লক্ষ্যেই আমাদের এই সম্মেলন।’ তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, যুদ্ধে কোনো পক্ষই এই বৈঠকে উপস্থিত হয়নি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, ‘সুদানি জনগণ একই সঙ্গে যুদ্ধ, নির্যাতন, অনাহার ও অসম্মানের শিকার। বিশ্ব নীরব থাকলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।’
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, ‘এই যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
’
সাবেক মার্কিন বিশেষ দূত টম পেরিয়েলোর দেওয়া তথ্য মতে, যুদ্ধের ফলে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে প্রায় দেড় লাখ মানুষ। তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। যুদ্ধরত উভয় পক্ষকেই বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা, বাড়িঘরে গোলাবর্ষণ ও ত্রাণে বাধা দেওয়ার অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
ক্ষুধা, অনাহার ও শিশু হত্যা
জাতিসংঘের হিসেবে, ২০২৩ ও ২০২৪ সালে প্রায় দুই হাজার ৭৭৬ শিশুর মৃত্যু বা পঙ্গুত্ব ঘটেছে, যা ২০২২ সালের তুলনায় প্রায় ২০ গুণ। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল জানান, এই যুদ্ধ লাখ লাখ শিশুর জীবন একেবারে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।
দারফুরের জমজম শরণার্থীশিবিরে ১০ লাখ মানুষের বসবাস। সেখানে গত সপ্তাহে আরএসএফের হামলায় কমপক্ষে ৪০০ জন নিহত হয়েছে। জাতিসংঘ বলছে, ২০২৩ সাল থেকেই অঞ্চলটি দুর্ভিক্ষে রয়েছে।
আরএসএফ এখন দারফুরে আধিপত্য নিশ্চিত করতে এল-ফাশের দখলের জন্য আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অঞ্চল দখল হলে দারফুরে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো পাকাপোক্ত হবে।
বাহ্যিক সহায়তা ও অস্ত্র প্রবাহ
জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেছেন, ‘এই সংঘাতে বাইরের সহায়তা ও অস্ত্রের প্রবাহ বন্ধ করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যাদের এই পক্ষগুলোর ওপর প্রভাব রয়েছে, তাদের উচিত এই প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ব্যবহার করা, এই বিপর্যয় টিকিয়ে রাখার জন্য নয়।’
সুদানের সেনা সমর্থিত সরকার ইতিমধ্যে অভিযোগ তুলেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত আরএসএফকে অস্ত্র সরবরাহ করছে। যদিও উভয় পক্ষই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।