প্রথম অধ্যায়
ভারতে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা
অনুধাবনমূলক প্রশ্ন
১। তরাইনের প্রথম যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : গজনির মুহাম্মদ ঘুরী ও ভারতের চৌহান রাজা পৃথ্বীরাজের মধ্যে তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক অভিযানে অগ্রসর হলে তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মুহাম্মদ ঘুরী পাঞ্জাব, সিন্ধু, মুলতান বিজয়ের পর আশান্বিত হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের পরিকল্পনা করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হলে তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিল্লি ও আজমীরের চৌহান বংশীয় রাজা পৃথ্বীরাজ ১১৯১ সালে তরাইনের প্রান্তরে মুহাম্মদ ঘুরীকে মোকাবেলা করেন।
২।
রাজা দাহীরের স্ত্রী ‘জওহর ব্রত’ পালন করেন কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : মুসলমানদের হাতে যুদ্ধবন্দি হওয়া থেকে রক্ষা পেতে রাজা দাহিরের স্ত্রী ‘জওহর ব্রত’ পালন করেন। সিন্ধুর রাজা দাহির মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের হাতে পরাজিত হলে তাঁর স্ত্রী রানীবাঈ রাওয়ার দুর্গে ১৫,০০০ সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের প্রতিরোধ করেন। কিন্তু পরাজয় যখন অনিবার্য তখন রানীবাঈ মুসলমানদের হাতে বন্দি হওয়া থেকে ধর্মমতে আগুনে আত্মাহুতি দেওয়াকে শ্রেয় মনে করে জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দিয়ে ‘জওহর ব্রত’ পালন করেন।
৩। ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতবর্ষকে নৃতত্ত্বের জাদুঘর বলেছেন কেন?
উত্তর : ৩,৪০০ মাইল সমুদ্র সমতট সংবলিত ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বাস। আর্যদের আগমন থেকে শুরু করে আধুনিককালে ইউরোপীয়দের আগমন পর্যন্ত বহু জাতি ভারতে প্রবেশ করেছে। প্রাচীন যুগে আর্য, দ্রাবিড়, পারসিক প্রভৃতি; মধ্যযুগে আরব, তুর্কি, আফগান, মুঘল এবং আধুনিক যুগে ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে আগমন করে। ফলে ভারতবর্ষ এক মহামানবের সাগরে পরিণত হয়েছে।
মূলত এ জন্যই ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ ভারতবর্ষকে নৃতত্ত্বের জাদুঘর বলে আখ্যা দিয়েছেন।
৪। আলাউদ্দিন হোসেনকে ‘জাহান সুজ’ বলা হয় কেন? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ভ্রাতৃদ্বয়ের হত্যার প্রতিশোধ নিতে আলাউদ্দিন হোসেন গজনী দখল করে সাত দিন সাত রাত ধ্বংসযজ্ঞ চালান। এ জন্য তাকে ‘জাহান সুজ’ বলা হয়। ‘জাহান সুজ’ অর্থ পৃথিবী ধ্বংসকারী। ঘুর নেতা আলাউদ্দিন হোসেন ১১৫১ খ্রিস্টাব্দে গজনী আক্রমণ করেন। কেননা গজনীর শাসক তাঁর দুই ভাইকে হত্যা করেছিলেন। তিনি গজনী দখল করে ভ্রাতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সাত দিন সাত রাত গজনী শহর অগ্নিদগ্ধ করার মাধ্যমে ধংস করেন। যার কারণে তাঁকে ‘জাহান সুজ’ বা পৃথিবী ধ্বংসকারী বলা হয়।
৫। আরবদের সিন্ধু বিজয়ের কারণ কী?
উত্তর : আরবদের সিন্ধু অভিযানের নানা কারণ ছিল। মূলত সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা, বিদ্রোহীদের আশ্রয়দান, সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষা, ইসলাম প্রচারসহ সিন্ধুর দেবল বন্দরে আরব জাহাজ লুণ্ঠিত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আরবরা সিন্ধু বিজয় করে। মূলত সিন্ধু অভিযানের পরোক্ষ নানা কারণ থাকলেও সিংহলরাজ কর্তৃক উমাইয়া খলিফা আল-ওয়ালিদ ও হাজ্জাজ বিন ইউসুফের প্রতি পাঠানো উপঢৌকনভর্তি আটটি জাহাজ সিন্ধুর দেবল বন্দরে লুণ্ঠিত হলে হাজ্জাজ সিন্ধুর রাজা দাহিরের কাছে এর ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। কিন্তু রাজা দাহির তাতে কর্ণপাত না করলে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে আরবরা সিন্ধু বিজয় করে।
৬। তরাইনের প্রথম যুদ্ধ কেন হয়েছিল? ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে স্থায়ী মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক অভিযানে অগ্রসর হলে তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুহাম্মদ ঘুরী পাঞ্জাব, সিন্ধু, মুলতান বিজয়ের পর আশান্বিত হয়ে ভারতের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের পরিকল্পনা করেন। এর অংশ হিসেবে তিনি দিল্লি অভিমুখে অগ্রসর হলে তরাইনের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয়। দিল্লি ও আজমীরের চৌহান বংশীয় রাজা পৃথ্বিরাজ ১১৯১ সালে তরাইনের প্রান্তরে মুহাম্মদ ঘুরীকে মোকাবেলা করেন। তবে এ যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরী পরাজিত হন।
৭। সুলতান মাহমুদের ‘সোমনাথ মন্দির’ বিজয় ইতিহাসে বিখ্যাত কেন?
উত্তর : সুলতান মাহমুদ কর্তৃক ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে সোমনাথ মন্দির অভিযান ও ১০২৬ খ্রিস্টাব্দে বিজয় ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক কারণে খুবই বিখ্যাত। সুলতান মাহমুদ ১০২৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাটের কাথিওয়ারের সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত সোমনাথ মন্দিরে অভিযান চালান। ১০২৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারিতে এ মন্দির তাঁর আয়ত্তে আসে। এ মন্দির রক্ষা করতে গিয়ে পাঁচ হাজার হিন্দু নিহত হয় এবং সুলতান মাহমুদ দুই কোটি দিনার, মণি-মানিক্য, হীরা-জহরত ও ধনসম্পদ লাভ করেন। হিন্দুদের ব্যাপক শ্রদ্ধেয় এই মন্দিরের পরাজয় ঘটলে তাদের ধর্মবিশ্বাস দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সুলতান মাহমুদ অনেক অর্থ হস্তগত করেন।
৮। রাজা পৃথ্বীরাজের সঙ্গে রাজা জয়চন্দ্রের দ্বন্দ্বের কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : রাজা জয়চন্দ্রের কন্যাকে অপহরণ নিয়ে রাজা পৃথ্বীরাজের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব হয়। কনৌজ ছিল ভারতের একটি শক্তিশালী রাজ্য। এ রাজ্যের শেষ শাসক ছিলেন জয়চন্দ্র। জয়চন্দ্রের কন্যাকে রাজা পৃথ্বীরাজ অপহরণ করলে পৃথ্বীরাজ ও জয়চন্দ্রের মধ্যে শত্রুতা সৃষ্টি হয়। যার ফলে রাজা জয়চন্দ্র মুহাম্মদ ঘুরীকে পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাহায্য করেন।
৯। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : মুহাম্মদ বিন কাসিমের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ছিল রাজা দাহিরের কন্যাদ্বয়ের আনীত মিথ্যা অভিযোগ। রাজা দাহিরের দুকন্যা সূর্যদেবী ও পরিমল দেবী যুদ্ধবন্দি হয়ে দামেস্কে খলিফার কাছে প্রেরিত হলে তাঁরা মুহাম্মদ বিন কাসিমের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ তোলেন। খলিফার আদেশে তাঁকে লবণ মাখানো চামড়ায় ভরে খলিফার দরবারে প্রেরণ করা হলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর তাঁর লাশ দেখে সূর্য ও পরিমল দেবী স্বীকার করেন যে তাঁরা মিথ্যা বলেছিলেন। অতঃপর খলিফা তাঁদের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঘোড়ার লেজে বেঁধে টানার আদেশ দেন। তবে অনেকেই মনে করে খলিফা সুলাইমান প্রতিহিংসাবশত কাসিমকে হত্যা করেন।
১০। সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল এবং কেন?
উত্তর : সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক। কারণ সেই যুগে একটি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা, সাম্রাজ্যে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা, বিশাল সেনাবাহিনীকে বেতন-ভাতাদি দেওয়া, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষকতা করা ইত্যাদি বিষয়ে অনেক অর্থের প্রয়োজন ছিল। আর ভারত ছিল অফুরন্ত ধনসম্পদে পরিপূর্ণ। অথচ এর নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত দুর্বল। এ জন্য ধনসম্পদে পরিপূর্ণ ভারত থেকে অর্থ ও রত্নভাণ্ডার লুণ্ঠন করাই ছিল সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য।