ঢাকা, শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫
৮ চৈত্র ১৪৩১, ২১ রমজান ১৪৪৬

ঢাকা, শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫
৮ চৈত্র ১৪৩১, ২১ রমজান ১৪৪৬
রাষ্ট্র সংস্কার

আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না

  • অধ্যাপক ড. তাসনিম আরেফা সিদ্দিকী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না
গ্রাফিতি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছবি : শেখ হাসান

একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হিসেবে একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার কাছ থেকে মূল চাওয়াটা হচ্ছে, আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতার পরিবর্তন, ক্ষমতার বিভাজন এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে গেলে যেসব প্রতিষ্ঠান একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার ভেতর দায়বদ্ধতা আনে, সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীন পদচারণ। বাংলাদেশের দিকে তাকালে দেখি, নব্বইয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা একবার গণতন্ত্রে ফেরত এলাম। তারপর মোটামুটি দুটি ভালো সরকারএকটা আওয়ামী লীগ, একটা বিএনপি পেলাম। তার পর একেকটি দলের যখন দ্বিতীয় মেয়াদ শুরু হলো, তখন থেকেই গণতান্ত্রিক আদর্শগুলো ধারাবাহিকভাবে ক্ষয় হতে থাকল।

এটারই শেষ রূপ আমরা দেখেছি গত প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী লীগের শাসনে।

আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে রাজনৈতিক দল হিসেবে একটা পর্যায়ের পর খুব বড় পার্থক্য যে ছিল তা কিন্তু নয়। দুটিই মূলত পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একটা সংসদীয় গণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে। আসলে দুটি দলের মধ্যে একটা তৈরি করা তফাত ছিলকে স্বাধীনতার পক্ষে আর কে স্বাধীনতার বিপক্ষে।

এই তফাত তৈরি করে সমাজকে বিভক্ত করা হয়েছে। দীর্ঘ সময় ধরে এটা করা হয়েছে।

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর ছিয়ানব্বইয়ে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো, সেই পাঁচ বছরে কিছুটা হলেও গণতন্ত্রের একটা রূপ ছিল। সেই সরকারের মন্ত্রিপরিষদে অনেকেই ছাত্র ইউনিয়ন বা এই ধরনের সংগঠন করে আসা লোকজন ছিল।

এর পরের মেয়াদগুলোর দিকে তাকালে দেখি, অধিকসংখ্যক ব্যবসায়ী শ্রেণি ক্ষমতায় চলে এসেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের জায়গায় আর যেতে চাইল না দলটি। নির্বাচনকে এক ধরনের পাশ কাটিয়ে ক্ষমতায় থাকার পরিণতিটা আমরা ১৬ বছর ধরে দেখলাম। গণতান্ত্রিক প্রতিটি প্রতিষ্ঠান একেবারেই ধ্বংসের মুখে চলে গেছে। এই ধ্বংসটা হয়েছে কয়েকভাবে।
প্রথমত, ক্ষমতার কোনো বিভাজন নেই, যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিই দলের প্রধান, তিনিই আবার সংসদেরও প্রধান। এর মধ্য দিয়ে আমরা ক্রমাগত এক ব্যক্তির শাসনের দিকে চলে গেলাম। পরিবারতন্ত্র কায়েম হলো। নির্বাচন না থাকায় এই পরিবারতন্ত্রকে জবাবদিহির মধ্য দিয়ে যেতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়েছে। অনেক সময় কর্তৃত্ববাদী সরকারের অনেক কিছু নিয়মের মধ্যে হতে দেয়। কিন্তু আমরা কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই নিয়মবহির্ভূত কার্যক্রম হতে দেখলাম। সংসদ একেবারে অকেজো একটা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হলো। মানবাধিকার কমিশনের কোনো ভূমিকা আমরা দেখিনি। প্রধানমন্ত্রী যা বলেন, সে অনুযায়ীই চলল কমিশন। দুর্নীতি দূর করা এবং নিয়মতান্ত্রিকতা বহাল রাখার প্রতিষ্ঠান দুদকে যে লোকবল দেওয়া হলো তারা সেই পরিবারতন্ত্রের আজ্ঞাবহ। যাকে ধরা দরকার তাকে আর ধরা হলো না।

ভালো অর্থনীতির পূর্বশর্ত ভালো রাজনীতি। তার বদলে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা এক ধরনের দুর্নীতিগ্রস্ত সিদ্ধান্ত পেলাম। সম্প্রতি শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, এটা আর ক্রনি ক্যাপিটালিজমও [স্বজনতোষী পুঁজিবাদ] থাকল না, চোরতন্ত্রে পরিণত হলো। একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকে ব্যাংকগুলোকে ভেঙে ফেলা হলো। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন দেখালেন, ১৬ বছরের প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার আমাদের ব্যাংকগুলো থেকে পাচার হয়ে গেছে। এই দেশের অর্থনীতি তাহলে চলবে কী করে?

অন্যদিকে একটা মিথ্যাতন্ত্র কায়েম করা হলো। ধারণা দেওয়া হলো, আমরা দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরিত হয়ে গেছি। শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি অল্প কিছুদিন কাজ না থাকে তাহলে এখন যে পরিমাণ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে, এর দ্বিগুণ হয়ে যাবে। অর্থাৎ টোকা দিলেই পড়ে যাবে, এমন একটা দারিদ্র্যসীমা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। এনার্জি সেক্টরে কাউকে কাউকে টাকা তৈরির জন্য সুযোগ করে দেওযা হয়েছে। যা হওয়ার কথা ছিল সাময়িক ব্যবস্থা, তাকে চিরস্থায়ী করে নেওয়া হয়েছে। এতে রাতারাতি বহু লোক বিরাট টাকাওয়ালা ও বিরাট ব্যবসায়ী বনে গেল। এরা কারা? সবাই এই রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি। এই সেক্টরকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেন বৈধভাবেই দুর্নীতি করা যায়। এসবের মধ্য দিয়ে অর্থনীতিকে একটা ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে গেছে পরিবারতন্ত্র। ব্যাংকগুলোকে একেবারে খারাপ একটা জায়গায় নিয়ে গেছে। আরেকটা বড় কাজ নৈতিকতার অবক্ষয় সৃষ্টি। এটি মানুষের মধ্যে এমনভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে এখন মানুষ বলতে পারেরাজনীতিবিদরা পারলে আমরাও পারি।

এইসবের মধ্য দিয়ে এমন একটা ব্যবস্থার দিকে আমরা চলে গেছি যে মানুষের মানসিকতা বদলে আবার গণতন্ত্রমনা করা বা গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির দিকে নিয়ে আসা কঠিন হবে। মানুষ গণতন্ত্র চায়, কিন্তু গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো চর্চা করানোর যে সংস্কৃতি, সেটাই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যা হয়েছে তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। কিন্তু কোনো অবস্থায়ই সেনাশাসন চাই না। আমরা চাই, দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতার বদল হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা চলতে চলতে পরিণত হোক। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজসব ক্ষেত্রে যে অবক্ষয় আমরা পেলাম, এর জন্য শুধু নির্বাচন না করে ১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে যাওয়া দায়ী। পাঁচ বছর পর ক্ষমতার বদল হলে আওয়ামী লীগের জন্যই হয়তো ভালো হতো। অপরাজনীতি করে আওয়ামী লীগ নিজেই তার অস্তিত্ব ধ্বংস করেছে।

আইনের শাসন, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আওয়ামী লীগের পতনের এই আন্দোলন শুধু ছাত্রদের নয়। ছাত্ররা বেরিয়ে এসেছে, সবাই তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। এই আন্দোলন এক ব্যক্তির শাসন চায় না। স্বৈরতন্ত্র চায় না। মানুষ গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা চায় না। এ কারণেই মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পথে বেরিয়ে এসেছে। এতগুলো প্রাণ আমরা বলি দিয়েছি গণতন্ত্রকে ফেরত আনার জন্য। বুঝতে হবে, এই অন্তর্বর্তী সরকার আগে থেকে পরিকল্পিত কিছু নয়। যার ফলে এরা জানে না কতটুকু কী করতে হবে। এরা কেউ আগে থেকে গুছিয়ে আসেনি। আমাদের চাহিদা গণতন্ত্র, আর কেউ যেন এ রকম স্বৈরতান্ত্রিক হতে না পারে, নির্বাচন যেন সময়মতো হয়। এই চাহিদাগুলো মেটানোর জন্য কাজ অনেক।

আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারকে মৌলিক সংস্কারের কাজ করে যেতে হবে। এর পরে নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, অনেক রকম সংস্কার তার স্বার্থের অনুকূলে যাবে না। তবু রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে স্থায়ী করতে চাইলে কিছু সংস্কারে যেতেই হবে। সংস্কার বাতাস থেকে হবে না। গভীর পাঠের মধ্য দিয়ে সমস্যা বের করে আনতে হবে। সরকার সংস্কারের জন্য কয়েকটি কমিশন করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। শুরুতেই আমরা দুটি বিতর্ক এমনভাবে সামনে এনেছি যে এটা থেকে ফলাফল বের করে আনা কঠিন হবে। একদিকে আমরা বলছি, যে অন্যায়গুলো ঢোকানো হয়েছে, একেবারে নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গিয়ে আমরা সেগুলোর পরিবর্তন করব এবং সংবিধানের ধারাবাহিকতা রক্ষা করব। অন্যদিকে আমরা বলছি, সংবিধানকে কেটেছিঁড়ে এমন করেছে যে এটা বাদ দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরি করব। এই যে দ্বন্দ্বটা তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, এটা একদিক থেকে বিপজ্জনক। এতগুলো প্রাণ গেছে, সংস্কারে আমাদের যেতেই হবে। নয়তো কোনো লাভ হবে না। কিন্তু দুটির কোন দিকে যেতে হবে, এ ব্যাপারে কোনো মতৈক্য নেই। আমাদের একাডেমিকরাও অনেক ক্ষেত্রে এই মতানৈক্য তৈরিতে সহায়তা করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে কত দিন থাকা সম্ভব এবং কতটুকু করা সম্ভব, এটুকু চিন্তা করেই বিতর্কটা করা দরকার ছিল। বিতর্কটা এখন একটু ঘোলাটে অবস্থায় আছে। তবে যা-ই হোক, কিছু সংস্কার তো করতেই হবে। যেমনকোনো দলের কারো নেতৃত্বে পর পর দুইবারের বেশি নির্বাচন হবে না। দুইবারের পর সরে দাঁড়িয়ে দলের অন্য কাউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সাংবিধানিকভাবে এই নিয়ম করে দিতে হবে যে দলের প্রধান, সংসদের প্রধান এবং সরকারের প্রধান একজন হতে পারবেন না। আমরা দেখেছি, এই আন্দোলনে মেয়েরা কিভাবে অংশ নিয়েছে। নারীরা এখন এগিয়েছে। সংসদে নারীর জন্য ৫০ আসন সংরক্ষিত থাকুক, এটা আর চাই না। নারীর এখন সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ দরকার। এ জন্য জাতিসংঘের নিয়ম অনুযায়ী ৩৩ শতাংশ আসনে প্রতিটি দলকে নারী প্রতিনিধি মনোনয়ন দিতে বাধ্য থাকতে হবে। ৫০টি সোনার হারের মতো সংরক্ষিত আসনের নারী সংসদ সদস্যদের আমরা দেখেছি, যে দলের হয়ে তাঁরা আসেন সেই দলের হয়ে কথা বলেন, তাঁদের স্বাধীন-স্বতন্ত্র মতামত থাকে না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে গেছে, এখন নারী অবলা নয়; নারী শক্তিশালী। নারীকে যে দল থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয় না সেই মনোনয়ন চাইবার সময় এখন। এটাই হবে দারুণ সংস্কার।

বিচারিক ক্ষমতা যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে সেটিকে আবার আগের জায়গায় ফেরত নিতে হবে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন দরকার। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। আমার ধারণা, যাঁদের হাতে নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তাঁরা এ বিষয়ে অত্যন্ত বিজ্ঞ। আরো যে কমিশনগুলো হয়েছে, সেগুলোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশ যে এক ব্যক্তির শাসনে চলে গিয়েছিল, তার জন্য শুধু ব্যবসায়ীদের না, মিডিয়াকেও দায়ভার নিতে হবে। কোনো মুক্ত-স্বাধীন মিডিয়া আমরা পাইনি।

আমাদের স্বপ্নটা খুব বেশি না। আমাদের স্বপ্ন হচ্ছে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকার বদল হবে, প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে চলবে, একজনের কাজের ওপর আরেকজন এসে হস্তক্ষেপ করবে না। আমি আশা করি, অন্তর্বর্তী সরকার এটুকু আমাদের দিতে পারবে। তবে এগুলো দিতে হলে শক্ত মানুষ প্রয়োজন। আমার মনে হয়, এই সরকারের মধ্যে মধ্যবয়সী লোকজনের একটা অভাব রয়েছে। সরকারে এই ধরনের মানুষকে নিয়ে আসার এখনো সময় আছে। গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ আমাদের ঘটাতেই হবে। আমি আশাবাদী, এই উত্তরণ ঘটবে।

আমার আগামীর প্রত্যাশা হলো, নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশ নেবে, লড়বে, নির্বাচিত হয়ে সগৌরবে সংসদে বসবে। আমরা যে গুম-খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গেলাম, সেগুলো আমরা জাদুঘর করে করে সংরক্ষণ করব, যেন আগামীতে আর কোনো দিন বিচারবহির্ভূত হত্যা ঘটতে না পারে। প্রত্যেকে স্বাধীনভাবে স্বাধীন মত নিয়ে এগিয়ে যাবে। সেখানে কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না।

শ্রুতলিখন : সালেহ ফুয়াদ

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

তরুণরা বাংলাদেশকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে

    নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
শেয়ার
তরুণরা বাংলাদেশকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে
গ্রাফিতি : রাজশাহী ছবি : সালাহ উদ্দিন

পূর্ববর্তী যেকোনো অভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এই গণ-অভ্যুত্থানে নাগরিকরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমবেত হয়েছে। শিক্ষার্থী, শ্রমিকসহ প্রান্তিক মানুষের প্রচুর উপস্থিতি দেখা গেছে, যা অন্য কোনো সময়ের অভিজ্ঞতার তুলনায় আলাদা। রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে শহীদদের স্মরণে স্থাপিত স্মৃতিফলকে শ্রমিক, রিকশাচালক, মজুরসহ বিভিন্ন পেশার মানুষের নাম এর প্রমাণ।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী,শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘদিন সরকার পতনের সংগ্রাম করে গেলেও সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের দাবি প্রতিষ্ঠা পায়। ওই ব্যবস্থার বিলোপের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের প্রকৃত উন্নয়নের লক্ষ্যে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনা হবে। গত ৫৩ বছরের অন্যায় শাসন ও শোষণের জঞ্জাল থেকে মুক্তির দিশা দেখিয়েছে এই গণ-অভ্যুত্থান।

ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপের দাবিটি প্রমাণ করে, সমগ্র দেশের মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছে।

প্রান্তিক মানুষের এমন দাবিগুলো এবং তাদের ভাষা যেন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিফলিত হয়, এমন একটি উদ্যোগ থেকে আমরা জাতীয় নাগরিক কমিটি গঠন করেছিলাম। বিভিন্ন জনপরিসর, পেশাজীবী গোষ্ঠী থেকে মানুষের বক্তব্য ও দাবি নিয়ে আমরা রাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা ও সমাধানের চেষ্টা করেছি।

অতীতে যেসব অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেগুলো ছিল সংগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে পরিচালিত। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মাহুতির মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ জন্মগ্রহণের পরই একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনের কবলে পতিত হয়।

প্রায় ২০ বছর পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেও বিগত ১৫ বছর আমাদের ফ্যাসিবাদী শাসন ভোগ করতে হলো। তাই আমরা চব্বিশের অভ্যুত্থানের গণদাবি নয়া-রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে দেশের সাধারণ নাগরিকদের বিবেচনা করতে চাই। জনগণের হিস্যা জনগণের হাতে বুঝিয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। মানুষের দাবি এবং তাদের হিস্যা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য গণমানুষের একটি পক্ষ এবং একটি রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন, যে দলের মধ্য দিয়ে জনগণের দাবি ও ভাষ্য রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রতিফলিত হবে। আমরা রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশবাসীকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি, একাত্তর ও নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি এবার আর হবে না।

আমরা স্পষ্ট করে আরেকটি বার্তা দিতে চাই, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার হত্যাকারীদের বিচার করার আগে আমরা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে না। কারণ এই বিচারটিকে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকার হতে না দেওয়ার লক্ষ্যে আমরা সর্বোচ্চ সক্রিয় থাকব। ফ্যাসিবাদের পতনের পর জনবান্ধব রাজনীতির তাগিদ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উন্মেষ। এ জন্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে বুঝতে হবে, জনগণের দাবি ও আহবানকে উপেক্ষা করার আর কোনো সুযোগ নেই। গত ৫৩ বছরে যে সংবিধান দেশের মানুষকে শোষণ করেছে এবং বিগত ১৫ বছরে যে সংবিধানের আশ্রয়ে ফ্যাসিবাদের জন্ম হয়েছে, আমরা তার পরিবর্তন চাই। এই সংবিধানটি প্রণয়নের সময় একাত্তরের চেতনাকে বাদ দিয়ে একটিমাত্র দলের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের আকাঙ্ক্ষাকে এই সংবিধান ধারণ করেনি। অন্তর্বর্তী সরকার নতুন সংবিধানের জন্য একটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তারা এই সংবিধান সংস্কার করতে না পারলে হয়তো একদিন জনগণের সরকার গঠনের পর এই সংবিধান বাদ দেওয়া হবে। বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এ বিষয়ে মত দিয়েছে, সংবিধান সংস্কার করতে পারে নির্বাচিত সরকার, এটি গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা জন-আকাঙ্ক্ষার বিপরীত। এই বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আগের যে সংবিধান ছিল, সেটা জনগণের প্রত্যাশার মাধ্যমে বাতিল হয়ে গেছে। জনগণ একটি নতুন সংবিধানের জন্য প্রয়োজনে আবার মাঠে নেমে আসবে। এই লড়াই জনগণ আগেও জিতেছে এবং ভবিষ্যতেও জিতবে।

নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী,বিভিন্ন ভাষা বা ধারার যে মানুষগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছিল, তাদের দাবির মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে, আমরা নতুন একটি সংবিধান চাই। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নাগরিক কমিটির পক্ষে নতুন সংবিধানের রূপরেখা বিষয়ক ৬৯টি প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা বলেছি, সংসদ, রাজনৈতিক দল এবং সরকারের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হবে। ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে ঘনীভূত হয়ে যাওয়া বিদ্যমান সংবিধানের সবচেয়ে বড় সমস্যা, এই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ এবং দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা এই বিকেন্দ্রীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

নির্বাচনের মাধ্যমেই জনগণের মতের প্রতিফলন হবে। ২০২২ সালে প্রণীত আইনের মাধ্যমে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন সম্ভব নয়। এটি নিয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক দলগুলোসহ সব স্তরের মানুষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আইনের বলে যদি একটি নির্বাচন হয়েও যায়, এর মাধ্যমে গঠিত সংসদ জন-আকাঙক্ষা বাস্তাবায়ন করতে পারবে না। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী সাধারণ মানুষের সঙ্গে বেঈমানি করা হবে।

গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তরুণ প্রজন্মের ওপর সাধারণ মানুষের গভীর আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে। কারণ জনগণ ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক প্রবীণ চিন্তা ও ব্যক্তিদের পরিত্যাগ করেছে। নতুন পরিবর্তন এবং পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে এগিয়ে যেতে যারা অপারগতা প্রকাশ করছে তাদেরও পরিত্যাগ করবে। জনগণ বিশ্বাস করে, তরুণরা বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারবে। সে জায়গা থেকে তরুণদের নতুন একটি রাজনৈতিক দল আসার আকাঙ্ক্ষাও সৃষ্টি হয়েছে। তরুণদের রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পরস্ফুটিত হবে, এটি মানুষের প্রত্যাশা।

আমরা এমন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া রাখব, যার মাধ্যমে এই গণ-অভ্যুত্থানের সব অংশীজন তরুণদের দলে উঠে আসবেন। দলীয় ও মতাদর্শিক লড়াইয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাংলাদেশের জন্য কাজ করবে, এমন রাজনৈতিক শক্তি আমরা গঠন করব, যেন জনগণের পক্ষে লড়াইকারী একটি শক্তি নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারি। জাতীয় নাগরিক কমিটি এই দল গঠনে মানুষের বোঝাপড়া, দাবি ও ভাষ্যকে একত্রীকরণের কাজ করে যাচ্ছে। জনগণের ওপর আমাদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে, তারা তাদের পক্ষের শক্তিকে চিনে নিতে পারবে।

মন্তব্য

আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের প্রতিভা ও কর্মে উদ্ভাসিত

    আলো আক্তার, চতুর্থ বর্ষ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের প্রতিভা ও কর্মে উদ্ভাসিত

বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনাময় দেশ। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের দক্ষতানির্ভর বাংলাদেশ, যেখানে তরুণরা তাদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে রাষ্ট্রকে নিয়ে যাবে এক অনন্য উচ্চতায়। তরুণদের নেতৃত্বেই গড়ে উঠবে স্বপ্নের বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী তরুণদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়েও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছে। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে তরুণরাই। কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণে তা ব্যাপক রূপ ধারণ করে।
বৈষম্যবিরোধী কোটা আন্দোলন রূপ নেয় গণ-আন্দোলনে। যার ফলাফল স্বৈরাচারের পতন এবং নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ। পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ তরুণ। ফলে আগামীর বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতিসবই নির্ভর করছে তরুণসমাজের ওপর।
তারুণ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে গড়ে তুলতে হবে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ।

জাতির মেরুদণ্ড হলো শিক্ষা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা দরকার। মুখস্থ ও চাকরিনির্ভর পড়াশোনা থেকে বেরিয়ে এসে বুদ্ধিদীপ্ত, সৃজনশীল ও উদ্ভাবনী শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা এখন সময়ের দাবি।

পূর্ণাঙ্গভাবে মনোযোগ দিতে হবে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায়। প্রণোদনা বাড়াতে হবে গবেষণা খাতে। আগামীর বাংলাদেশের সমাজ হতে হবে পুরোপুরি জ্ঞানভিত্তিক ও তথ্যভিত্তিক। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ তৈরিতে এগিয়ে আসতে হবে তরুণদের।

আলো আক্তারআগামীর বাংলাদেশ হবে মাদকমুক্ত, সন্ত্রাসমুক্ত এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিমুক্ত। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস। ফলে জনগণের জন্য হবে সংবিধান; সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। সমতার ভিত্তিতে একটি প্রগতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিটি ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে একটি স্বচ্ছ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, যার মূলে থাকবে জনগণের কল্যাণ। সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে সুধীসমাজকে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ সামাজিক সমস্যা সমাধান এবং জনমত সংহত করার ভূমিকা পালন করতে হবে সুধীসমাজকে। আগামীর বাংলাদেশ হতে হবে সবার জন্য নিরাপদ। দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর দ্রুত সমাধানে কাজ করতে হবে।

 দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। আগামী নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় কোনো দল বা ব্যক্তির হস্তক্ষেপ হতে দেওয়া যাবে না। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। ভোট প্রয়োগের অধিকার জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের হাতিয়ার। ফলে নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক। এর গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে জবাবদিহিমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদ্যমান সংবিধানে পরিবর্তন প্রয়োজন, যেন সংবিধান ব্যবহার করে স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সুযোগ না থাকে। সংবিধানকে শুধু জনগণের করে তুলতে হবে, যেখানে থাকবে শুধুই জনগণের কল্যাণ। ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে সংবিধান সংস্কারের বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষমতা এমনভাবে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা করতে হবে, যেন ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না থাকে। তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নজর দেওয়া প্রয়োজন। রাজস্বনীতি, করনীতি, ব্যাংকিং খাত থেকে শুরু করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও সংস্কার প্রযোজন। পোশাকশিল্পের বাজার সম্প্রসারণ এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আয়ের পথ উন্মুক্ত রাখতে হবে। দেশের বিপুল জনসংখ্যাকে প্রযুক্তিতে দক্ষ করে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা মাথায় রেখে দারিদ্র্যমুক্ত, বৈষম্যহীন দেশ গড়ে তুলতে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনকে বিবেচনায় রেখে পরিবেশবান্ধব কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

আগামীর বাংলাদেশ হবে শান্তি ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ। আগামীর বাংলাদেশে থাকবে না কোনো অসাম্য ও বৈষম্য, যেখানে প্রত্যেক মানুষ তার মৌলিক অধিকার তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ পাবে। প্রত্যেকে তার উদ্ভাবনী শক্তি ও সৃজনশীলতা দিয়ে দেশ গঠনে অবদান রাখবে। আগামীর বাংলাদেশ হবে তারুণ্যের প্রতিভা ও কর্মে উদ্ভাসিত।

 

মন্তব্য

বাংলাদেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ

    মো. আলমগীর ইসলাম, শিক্ষার্থী, ইলেট্রিক্যাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
শেয়ার
বাংলাদেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ

আমরা শিক্ষার্থীরা জাতির ভবিষ্যত। আজকে আমাদের চিন্তা ও মতামত আগামী দিনের বাংলাদেশের রূপ গঠনে প্রভাব ফেলবে। তাই আমি স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশের যেখানে উন্নয়ন, সুশাসন এবং মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। এই বাংলাদেশ হবে সুখী, সমৃদ্ধ এবং শান্তিপূর্ণ; যেখানে সকল নাগরিকের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত থাকবে।

প্রথমত, রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। আমাদের দেশের রাজনীতি এখনও অনেকাংশে ব্যক্তিপূজায় আবদ্ধ এবং দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আমি চাই, আগামী দিনে রাষ্ট্রক্ষমতার পুঙ্খানুপুঙ্খ সংস্কার হোক। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের প্রকৃত সেবক হয়ে উঠুক এবং ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করা হোক।

এক্ষেত্রে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনগণ যেন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে এবং তারা যেন সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের সংবিধানেও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। বর্তমান সংবিধান অনেক ক্ষেত্রে আধুনিক যুগের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম নয়।

বিশেষ করে, মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে আরও সুস্পষ্ট নির্দেশনা ও অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সংবিধানে এমন কিছু সংশোধনী আনা উচিত, যার মাধ্যমে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সাধারণ জনগণের মতামত আরও গুরুত্ব পায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলির মধ্যে স্বচ্ছতা এবং কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধানে নতুন ধারাও সংযোজন করা দরকার।মো. আলমগীর ইসলাম

তৃতীয়ত, নির্বাচন ব্যবস্থা একটি শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনের সময় অনিয়ম, জাল ভোট, ভীতি প্রদর্শন এবং দলীয় প্রতিহিংসা এখনো প্রাধান্য পাচ্ছে; যা গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।

আমি চাই, নির্বাচন ব্যবস্থায় ব্যাপক সংস্কার হোক। নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করা উচিত, যাতে নির্বাচন কমিশনাররা কোনও ধরনের রাজনৈতিক চাপ ছাড়াই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করতে পারে। জনগণ যাতে নির্বিঘ্নে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং প্রতিটি ভোটের যেন মূল্যবান বিবেচিত হয় সেই ব্যবস্থা করা উচিত।

আগামীর বাংলাদেশ হবে এমন একটি দেশ, যেখানে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি, বাসস্থান এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। জনগণের প্রতি শ্রদ্ধা, মানবাধিকার এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধতা থাকবে রাষ্ট্রের। একটি আধুনিক, প্রযুক্তি নির্ভর এবং পরিবেশবান্ধব দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।

পরিবর্তন শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও হতে হবে। ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা সমপ্রদায় ভেদে কোনো বৈষম্য থাকবে না এবং সবাই একসঙ্গে দেশ গড়তে এগিয়ে আসবে- সেই বাংলাদেশ আমরা দেখতে চাই।

এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব যদি আমরা সবাই একযোগে কাজ করি এবং আমাদের রাষ্ট্রের কাঠামোকে আরও গণতান্ত্রিক, সুশাসিত এবং মানবিক করে তুলি।

মন্তব্য

স্বপ্ন এখন নতুন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের

    রাকিন মোনতাসিম, শিক্ষার্থী, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
শেয়ার
স্বপ্ন এখন নতুন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের

দেশে দীর্ঘ ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে আসা শাসনের নামে অপশাসন, শোষণ ও নিষ্পেষণের অবসান হয় জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পলায়নের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ মুক্তি পায় এক ভীষণ দুর্দশা  থেকে। বাংলাদেশের মানুষ আবারও হাসতে শেখে। আবারও স্বপ্ন দেখার সাহস পায়।

সেই স্বপ্ন নতুন এক বাংলাদেশের। সংস্কার হওয়া একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশের।

স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশের রাজনীতির দিকে তাকালে দেখা যায়, কয়েক বছর পর পরই আমাদের ওপর স্বৈরশাসনের বোঝা জেঁকে বসেছে বা বসার চেষ্টা করেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় সংবিধানের পরস্পরবিরোধী কিছু অনুচ্ছেদ ও ধারাকে।

সংবিধানের তৃতীয় ভাগে (মৌলিক অধিকার) ৩৯ নম্বর অনুচ্ছেদের ১ নম্বর উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। এই অনুচ্ছেদেরই ২(ক) উপ-অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হইল। কিন্তু তার সম্পূর্ণ বিপরীত বর্ণনা আছে সংবিধানের পঞ্চম ভাগের (আইনসভা) ১ম পরিচ্ছেদে। ৭০(খ) অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদিসংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোট দান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে।
অর্থাৎ সংসদে যদি কোনো বিল বা আইন পাস করা নিয়ে ভোটাভুটির আয়োজন করা হয়, তাহলে একটি নির্দিষ্ট দলের সব সংসদ সদস্যকে একই ভোট দিতে হবে। তা না হলে বাতিল হবে তাঁর সংসদ সদস্য পদ, যা মূলত সংসদ সদস্যদের ভোটাধিকার ও নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করে। এই অনুচ্ছেদের জন্য ভিন্নমত থাকা সত্ত্বেও সব ক্ষেত্রেই সংসদ সদস্যরা দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে বা দলের অধিকাংশের মতের সঙ্গে সহমত জ্ঞাপন করতে বাধ্য হন। এই অনুচ্ছেদ মূলত স্বৈরাচার গঠনে প্রধান সহায়ক।

শিক্ষার্থীএকটি দেশে জনগণের ভোটে একজন নির্বাচিত সংসদ সদস্যের যদি নিজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকে, তাঁর ওপর যদি অন্যের মত চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেই দেশের সাধারণ জনগণের মত প্রকাশ তো আরও অনেক তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তাই সংবিধানের এই ধারার সংস্কার করা এবং সব সংসদ সদস্যের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত অবশ্যই করতে হবে। একই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে, একই ব্যক্তি যেন দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না হতে পারেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা যুগ যুগ ধরে পরিবারকেন্দ্রিক হয়ে আসছে। এর পরিবর্তন ঘটা জরুরি। রাষ্ট্রের ক্ষমতা যদি পরিবারকেন্দ্রিকই হয়, তাহলে বাংলাদেশ আসলে গণতান্ত্রিক দেশ নাকি প্রকৃতপক্ষে প্রকারান্তরে রাজতন্ত্র, তা নিয়ে ভাবনার উদ্রেক হয়। রাষ্ট্রক্ষমতাকে পরিবারতন্ত্রের প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে হবে। দেশের প্রধানমন্ত্রিত্ব যেন কেউ জন্মসূত্রে না পায়। বরং নিজের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এবং দেশের মানুষের আস্থা অর্জন করে যেন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারে।

নতুন বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কোনো পক্ষই যেন নির্বাচনী এলাকা মর্জিমাফিক পরিবর্তন করে অবৈধ সুবিধা ভোগ করতে না পারে, সে বিষয়ে তীক্ষ নজর রাখতে হবে। নির্বাচনের আগ দিয়ে টাকার বিনিময়ে ভোট কেনার নোংরা রাজনীতিকে বিদায় জানাতে হবে।  কোনো পক্ষই যেন এভাবে ভোট বাগাতে না পারে, তা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। নতুন বাংলাদেশে আমরা অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য লোককে ক্ষমতায় দেখতে চাই না। দুর্নীতি করেই যদি কেউ ক্ষমতায় আসে, তাহলে দেশের অন্য সব দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার আওয়াজ কিভাবে পাওয়া যাবে? তার লক্ষ্য হবে দুর্নীতি থামানো নয়, বরং দুর্নীতির প্রসার। ক্ষমতায় বসা প্রতিটি মানুষ হোক নীতিমান, শিক্ষিত, মার্জিত ও দেশপ্রেমিক। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব-পরবর্তী বাংলাদেশ উন্নতি করুক সব সেক্টরে। বিশ্বের দরবারে সুউচ্চ হোক আমাদের জাতীয় পতাকা।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ