’ তিনি বলেন, ‘দুদক সব সময় বৈধ সম্পদ এবং সম্পদের উৎস দেখবে। আয়কর নথিতে যত সম্পদই থাকুক না কেন তা দুদকের বিবেচ্য বিষয় নয়। আয়কর নথিতে শুধু অর্থ দেখালেই চলবে না। সেসব অর্থের উৎস ও বৈধতার প্রমাণও দুদককে দেখাতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যদি সম্পদ অবৈধ হয় তাহলে আদালত রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন। এ জন্য অনুসন্ধান পর্যায়ে তাঁর (বেনজীর) সম্পদ ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়েছে। কারণ ফ্রিজ না করলে এসব সম্পদ হস্তান্তর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার বলেন, ‘আমরা তথ্য-উপাত্তগুলো সংগ্রহ করছি। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শুধু তথ্য সংগ্রহ করলেই চলবে না। আমরা তাঁর (বেনজীর আহমেদ) কথাও শুনব। তাঁরও তো বক্তব্য থাকতে পারে। সম্পদ বৈধ হলে তা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পাবেন।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, স্ত্রীর ও সন্তানদের মৎস্য ব্যবসা দেখিয়ে আয়কর নথিতে অনেক অর্থ-সম্পদ দেখিয়েছেন বেনজীর। কর দিয়ে বিপুল সম্পদ আয়কর নথিতে দেখালেও এসব সম্পদের উৎসর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আর বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে তথ্য দিতে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সোর্সের মাধ্যমে কমিশনের অনুসন্ধান টিম সিঙ্গাপুর, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় থাকা অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাব্বির বিকাশ। সেই সাব্বির বিকাশের মাধ্যমেই দেশের টাকা কৌশলে বিদেশে পাচার করেছেন বেনজীর আহমেদ। অবৈধ সম্পদের বিষয়ে কালের কণ্ঠে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বেনজীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাব্বির বিকাশ।
বেনজীরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বসহকারে আমলে নিচ্ছে দুদক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নানা তথ্য দুদকে আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের অনুসন্ধান টিম দেশের সব মিডিয়ায় প্রকাশিত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে। ওই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক ভুক্তভোগী দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ধীরে ধীরে বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা আরো ভারী হচ্ছে।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গত ২৪ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), ক্রেডিট কার্ড চারটি ও বিও অ্যাকাউন্ট ছয়টি অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।
এরপর গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাটও জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের মধ্যে। আদালতের আদেশের পর এরই মধ্যে ক্রোক ও ফ্রিজ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই দফা মিলিয়ে আদালত বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ৬২১ বিঘা জমি জব্দের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জমির মালিক বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা। তাঁর নামে প্রায় ৫১২.৫৭ বিঘা জমি খুঁজে পেয়েছে দুদক। বাকি ১০০ বিঘার মতো জমি রয়েছে বেনজীর, তাঁর দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর এবং বেনজীর আহমেদের স্বাক্ষরে নাবালিকা মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর ও জনৈক আবু সাঈদ মো. খালেদের নামে।
নতুন করে যে ২৭৬ বিঘা জমি পাওয়া গেছে, তার পুরোটাই বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে। জমিগুলো মাদারীপুরের সাতপাড় ডুমুরিয়া মৌজায়। ২০২১ ও ২০২২ সালের বিভিন্ন সময় ১১৩টি দলিলে এসব জমি কেনা হয়। দলিল মূল্য দেখানো হয় মোট ১০ কোটি ২২ লাখ টাকা। এ হিসাবে প্রতি শতাংশের দাম পড়েছে গড়ে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার টাকা। বিঘা পড়েছে তিন লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এর আগে খোঁজ পাওয়া ৩৪৫ বিঘা জমির দলিল মূল্য দেখানো হয়েছিল প্রায় ১৬ কোটি টাকা।
বেনজীর আহমেদের পরিবারের সদস্যদের নামে গুলশানে যে চারটি ফ্ল্যাটের খোঁজ পাওয়া গেছে, ২০২৩ সালের ৫ মার্চ গুলশান সবরেজিস্ট্রি অফিসে চারটি দলিলে ৯ হাজার ১৯২.৭৮ স্কয়ার ফিট (বর্গফুট) ফ্ল্যাট ক্রয় করে বেনজীর আহমেদের পরিবার। এর মধ্যে দলিল মূল্য দেখানো হয়েছে দুই কোটি ১৯ লাখ টাকা।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঢাকার কোথাও এই দামে ফ্ল্যাট কেনা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (আরআইইউ) বরাত দিয়ে গত বছর দেশের আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব জানায়, রাজধানীতে ফ্ল্যাটের দাম সবচেয়ে বেশি গুলশানে, প্রতি বর্গফুট ১৬৬ মার্কিন ডলার, যা বর্তমানে ১৯ হাজার ৪২২ টাকার সমান।
বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে জব্দ হওয়া জমি বিক্রি, হস্তান্তর বন্ধে আদালতের আদেশের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রার ও সংশ্লিষ্ট সাবরেজিস্ট্রারের কাছে পাঠানো হয়েছে। জমি অন্য কারো নামে যাতে নামজারি না করা হয় সে জন্য আদালতের রায়ের কপি সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক ও সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড অফিসে পাঠানো হয়। এ ছাড়া কম্পানির মালিকানা হস্তান্তর বন্ধে যৌথমূলধনী কম্পানি ও ফার্মসমূহের পরিদপ্তরে আদালতের ওই আদেশ পাঠানো হয়। একই সঙ্গে ব্যাংকে জমা থাকা টাকা উত্তোলন বন্ধে অবরুদ্ধের আদেশ সোনালী ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। ওই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডকে (সিডিবিএল) বেনজীর আহমেদের নামের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট বা বিও হিসাব অবরুদ্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। পাশাপাশি বেনজীর আহমেদের স্ত্রী, তাঁর বড় মেয়ে ও মেজো মেয়ের নামে সব বিও হিসাব অবরুদ্ধ রাখতে নির্দেশ দেয় সংস্থাটি।
বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে
কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২১ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। পরদিন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানান।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাব এবং র্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাঁদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।