বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের টেপার বিলে জ্বলতে থাকা আগুন নেভার আগেই নতুন করে শাপলার বিল এলাকা আগুনে পুড়ছে। নতুন স্থানে আগুনের ভয়াবহতা অনেক বেশি।
গতকাল রবিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাগেরহাট জেলাধীন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর টহল ফাঁড়ির শাপলার বিল এলাকায় গহিন বনে আগুন দেখতে পায় বন বিভাগ। কলমতেজি ক্যাম্পের টেপার বিল এলাকায় যেখানে শনিবার সকালে আগুন দেখা গেছে, সেখান থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে এই শাপলার বিল এলাকা।
তবে টেপার বিল এলাকায় জ্বলতে থাকা আগুন সম্পূর্ণ নির্বাপণ করা হয়েছে বলে বন বিভাগ এবং ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা জানান। এক দিনের ব্যবধানে সুন্দরবনের সাত কিলোমিটারের মধ্যে পৃথক স্থানে আগুনের ঘটনায় নাশকতা আছে কি না তা খতিয়ে দেখছে বন অধিদপ্তর।
১৯ বছরে ৩০ বার আগুন
বন বিভাগের তথ্যমতে, সুন্দরবনে গত ১৯ বছরে ৩০ বার আগুনের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় পুড়েছে প্রায় ৯০ একর বনভূমি।
এর আগে ২০২৪ সালের ৪ মে চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া ফরেস্ট ক্যাম্পের লতিফের ছিলা নামক স্থানে আগুনে ৭.৯৮ একর বনভূমি পুড়ে যায। তখনকার কমিটি আগুন লাগার সুনির্দিষ্ট কারণ বলতে পারেনি। ২০২১ সালের ৩ মে দাসের ভারানি এলাকায় আগুন লাগে। ২০১৭ সালের ২৬ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ফরেস্ট ক্যাম্পের আবদুল্লাহর ছিলায় আগুনে প্রায় পাঁচ একর বনভূমির ছোট গাছপালা, লতাগুল্ম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
সুন্দরবনে আগুনের ঘটনায় প্রতিবারই বন বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। কিন্তু কমিটির প্রতিবেদন সুপারিশ কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ থাকে, কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। গত ২০২৪ সালের মে মাসের আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি সুন্দরবনের ২৪, ২৫ এবং ২৭ নম্বর কম্পার্টমেন্টে মধু আহরণের পাস (অনুমতি) বন্ধ রাখার জন্য সুপারিশ করেছে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে সুন্দরবনে মধু আহরণ মৌসুম শুরু হবে।
এবারও টেপার বিল এলাকায় আগুনের পর গতকাল তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বন বিভাগ।
এই কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভায়ীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও)।
গত দুই দিনের দুটি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে বন অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হবে বলে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী জানিয়েছেন।
শাপলার বিলে আগুন
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, আগুন যাতে বনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে না পারে এ জন্য ফায়ার লাইন কাটা হচ্ছে। কাছাকাছি পানির উৎস না থাকায় প্রায় তিন কিলোমিটার দূরের ভোলা নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি এনে আগুন নেভানো হবে।
চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপেন চন্দ্র দাস জানান, আগুনের খবর পাওয়ার পর ড্রোনের মাধ্যমে বনের গহিনে তারা আগুন দেখতে পান। এরপর তাঁরা দ্রুত ফায়ার লেন কাটতে থাকেন। কিন্তু এর মধ্যেই কয়েকটি স্থানে আগুন ফায়ার লেন অতিক্রম করে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ফায়ার লেন কাটার কাজ চলছে। লেন কাটা শেষ হলেই ভোলা নদী থেকে পানি এনে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হবে। কিভাবে আগুন লেগেছে তার কারণ জানাতে পারেননি তিনি।
বাগেরহাট ফায়ার স্টেশনের ডিএডি সাকরিয়া হায়দার জানান, আগুন নেভানোর কাজে অংশ নিতে তাঁরা সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত তাঁরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারেননি। খুলনা, বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ, মোল্লাহাট এবং শরণখোলার ফায়ার স্টেশনের কর্মীরা আগুন নেভানোর কাজে অংশ নেবেন বলে জানা গেছে।
টেপার বিলের আগুন নির্বাপণ
বাগেরহাট জেলার শরণখোলায় সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজি ক্যাম্পের টেপার বিল এলাকার আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপণ করা হয়েছে। ভোলা নদী থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে পানি নিয়ে আগুন নেভানোর আগেই ওই এলাকায় প্রায় চার একর বনভূমি পুড়ে গেছে।
বাগেরহাট ফায়ার স্টেশনের ডিএডি সাকরিয়া হায়দার জানান, গতকাল দুপুর সোয়া ১২টার দিকে আগুন সম্পূর্ণভাবে নির্বাপণ করা হয়।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করিম জানান, সুন্দরবনের টেপার বিলে এখন আগুনের অস্তিত্ব নেই। কোথাও ধোঁয়াও দেখা যাচ্ছে না। এর পরও বন বিভাগের স্টাফরা আগামী ২৪ ঘণ্টা সেখানে পর্যবেক্ষণে থাকবেন। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আগুনের সূত্রপাত এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
ডিএফও নুরুল করিমের ধারণা, মৌসুম শুরুর আগেই অবৈধভাবে কোনো মৌয়াল সুন্দরবনে প্রবেশ করতে পারেন। মৌয়ালের মশাল অথবা বিড়ি-সিগারেটের অংশ থেকে সুন্দরবনে আগুন ধরতে পারে। এ ছাড়া আইন ভঙ্গ করে কোনো কোনো রাখাল ভোলা নদী পাড়ি দিয়ে তাদের গবাদি পশু নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। ওই রাখালদের ফেলে রাখা বিড়ি-সিগারেটের আগুন থেকেও সুন্দরবনে আগুনের ঘটনা ঘটতে পারে।
নাশকতার আশঙ্কা
প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, এক দিনের ব্যবধানে দুটি পৃথক স্থানে আগুনের ঘটনায় নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। নাশকতামূলকভাবে কেউ সুন্দরবনে আগুন দিয়েছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।