একটি রাষ্ট্র পরিচালনায় কিছু পদ ও প্রতিষ্ঠান থাকে, যেসব পদ আর প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে হয়। এটাই রাষ্ট্র পরিচালনার শিষ্টাচার। যদি প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান আর স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ পদকে বিতর্কিত করে ফেলা হয়, তাহলে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রই দুর্বল হয়ে যায়। বাংলাদেশে এখন সেই প্রচেষ্টা চলছে কি না তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে সাত মাস ধরে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। নানা দোষত্রুটি আর ভালো-মন্দ মিলিয়ে এই সরকার কাজ করছে। ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের মতো একটি সরকারকে সরানোর পর একটি ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে নতুন বাংলাদেশ বির্নিমাণের কাজ অনেক জটিল এবং কঠিন। সেই কাজটি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার করার চেষ্টা করছে।
নানা রকম জটিলতা এবং সমস্যার পরও শুধু ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা থাকার কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এই সরকারের ওপর আস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বে একজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। সৌভাগ্য যে ঁতার মতো একজন খ্যাতিসম্পন্ন এবং আন্তর্জাতিকভাবে সম্মানিত ব্যক্তি এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। ফলত এখনো মানুষ নানা রকম টানাপড়েনের পরও এই সরকারের প্রতি আস্থাশীল।
সে জন্যই তাঁর ওপর আমাদের আস্থা রাখতে হবে। তাঁকে কাজ করতে দিতে হবে। দেশের সামনে এখন প্রধান কাজ গণতান্ত্রিক উত্তরণ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন।
মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কী রকম হবে, সেটা শুধু এ দেশের জনগণের বিষয় নয়, আন্তর্জাতিক মহল এ নিয়ে আগ্রহী এবং তাকিয়ে আছে।
অস্বীকার করা যাবে না যে সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন এবং সহযোগিতা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ কারণেই বাংলাদেশ তার ইচ্ছামতো যখন খুশি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে পারবে না। এই নির্বাচন করতে হবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সময়ে ও পদ্ধতিতে। সেটি নিয়েই ড. মুহাম্মদ ইউনূস কাজ করছেন। এরই মধ্যে তিনি ঘোষণা করেছেন যে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কোনো অবস্থাতেই পেছানো হবে না। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু অতি উৎসাহী মহল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে, এমনকি সবশেষ প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকেও প্রশ্নবিদ্ধ এবং বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। তাঁর বক্তব্যের সমালোচনা করছেন, প্রতিবাদে মাঠে নামছেন। এ ধরনের প্রতিক্রিয়া অনভিপ্রেত।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সম্প্রতি সাক্ষাৎ করতে এসেছিল ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের ড. কমফোর্ট ইরোর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল। এই প্রতিনিধিদলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দীর্ঘ বৈঠক হয়। মূলত ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না এবং গণতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রাপথ কেমন হবে ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার জন্যই প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। সেখানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দুটি বিষয়ে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার করেন।
প্রথমত, তিনি বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। তিনি নির্বাচনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান। দ্বিতীয় যে বিষয়টি নিয়ে ক্রাইসিস গ্রুপ জানতে চাইছিল যে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না। অর্থাৎ সব রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি না। এই প্রশ্নে ক্রাইসিস গ্রুপ আরো সুনির্দিষ্ট করে জানতে চেয়েছিল যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে কি না বা সরকার আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করবে কি না। তার জবাবে ড. ইউনূস বলেছেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তিনি বলেছেন, ওই দলটির যেসব নেতার বিরুদ্ধে হত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধসহ অন্যান্য অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, তাদের বাংলাদেশের আদালতে বিচার হবে। উল্লেখ্য, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই বক্তব্যটি এবারই প্রথম নয়। এর আগেও একাধিক সাক্ষাৎকারে এবং বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলাপচারিতার সময় তিনি একই রকম বক্তব্য দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের ব্যাপারে তাঁর সুস্পষ্ট অবস্থান তিনটি। প্রথমত, আওয়ামী লীগের ভেতর যেসব নেতা ও ব্যক্তি গণহত্যা, দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত, তাঁদের বিচার হতে হবে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ নির্বাচন করবে, কী করবে না সেটা তাদের দলীয় সিদ্ধান্ত। তৃতীয়ত, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ করা বা না-করা ইত্যাদি কাজ অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যটিকে ঘিরে পানিঘোলা করা হচ্ছে। এর ফলে দেশে একটি অস্থিতিশীল পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন।
গত শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতীয় নাগরিক পার্টির সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচারের ধীরগতির ব্যাপারে নিন্দা জানানো হয় এবং আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে এখন অপ্রাসঙ্গিক বলেও জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে ওই সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করা হয়। একটি রাজনৈতিক দল এ ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতেই পারে এবং সেখানে তাদের মতামত আসতে পারে। কিন্তু সেখানে প্রধান উপদেষ্টাকে সমালোচনা করা বা প্রশ্নবিদ্ধ করা এই নাজুক সময়ে কোনোভাবেই সমীচীন নয়। একইভাবে এই সময় আমরা দেখছি যে সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধানকে নিয়েও অনভিপ্রেত, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং জনগণের আস্থার প্রতীক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করলে বা সেনাবাহিনীকে অবমাননা করে বক্তব্য দিলে রাষ্ট্রই দুর্বল হয়ে পড়ে। বিপন্ন হয় আমাদের সার্বভৌমত্ব। এই বোধ এবং উপলদ্ধি আমাদের প্রত্যেকের থাকা উচিত। এখন যাঁরা রাজনীতিতে সক্রিয় কিংবা ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে যাঁরা সফলভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের এখন দেশ গড়ার কাজে শামিল হতে হবে। মনে রাখতে হবে, ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর গত সাত মাসে বাংলাদেশকে ঘিরে নানা রকম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হচ্ছে। এখানে এই ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত মোকাবেলা করার জন্য সবাইকে দায়িত্বশীল, সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা পালন করতে হবে। এখন কাদা ছোড়াছুড়ির সময় নয়। দোষারোপের চর্চা করে পরিবেশ দূষণ এখন কাম্য নয়।
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের পর ছাত্রদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু সংবেদনশীল এবং স্পর্শকাতর বক্তব্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির অন্যতম নেতা এবং দক্ষিণাঞ্চলের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়েছেন গত বৃহস্পতিবার (২০ মার্চ) রাতে। ওই ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি দাবি করেন যে ১১ মার্চ সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গে আরো কয়েকজনকে ডেকে নিয়েছিলেন। সেখানে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণ এবং আসন ভাগাভাগি নিয়ে একটি দরকষাকষি করেন। সেখানে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে আনতেই হবে—এ রকম একটি বক্তব্য দিয়ে ঁতারা রীতিমতো চাপ সৃষ্টি করেন।
অনেকেই বলছেন, হাসানাত আবদুল্লাহ এই স্ট্যাটাস ২০ মার্চ দিলেন কেন? ধারণা করা হয়, প্রধান উপদেষ্টা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের সঙ্গে তাঁর বক্তব্যের পর পরই হাসনাত আবদুল্লাহ এই বক্তব্যটি দিয়েছেন। কিন্তু এই ধরনের বক্তব্য দেওয়াটা তাঁর কতটুকু সমীচীন হয়েছে, সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কারণ হাসনাত আবদুল্লাহ এখন ৫ আগস্টের পূর্বের অবস্থায় নেই যে তিনি রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন। বরং তিনি এখন একটা দায়িত্বশীল অবস্থানে রয়েছেন। তিনি একজন গণ-অভ্যুত্থানের নেতা। কাজেই গ-অভ্যুত্থানকে সফল করা, সংহত করা এবং একটি স্থিতিশীল অবস্থায় দেশকে রাখা তাঁর দায়িত্ব। তিনি যদি এখন আন্দোলনের ঢংয়ে বক্তব্য-বিবৃতি দেন, সেটা কতটুকু সমীচীন হবে তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। কারণ তাঁর এই বক্তব্যের পর কিছু কিছু মহল বুঝে না বুঝে সেনাবাহিনী এবং সেনাপ্রধান সম্বন্ধে নানা রকম উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছে। হাসনাত আবদুল্লাহ ২০ মার্চ বক্তব্যের পর গত শুক্রবার বলেছেন যে রাজনীতির বিষয়টি রাজনীতিবিদদেরই থাকা উচিত, সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। তাঁর বক্তব্য যদি আমরা মেনে নিই, তাহলে প্রশ্ন করতেই হয় যে ৫ আগস্ট দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সব রাজনৈতিক দল কেন সেনাবাহিনীর দিকে তাকিয়ে ছিল? বাংলাদেশে যে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ, তা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ওপর কেন ছাত্র-জনতা সবাই নির্ভর করেছিল? ছাত্র প্রতিনিধি এবং গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী অনেকেই সেনা সদরে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৈঠক করেছেন, সেনাপ্রধানের মধ্যস্থতায় আসলে সেদিন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। আমরা আরো দেখলাম, আরেকজন সমন্বয়ক এবং বর্তমানে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. ইউনূসকে নেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি করেছিলেন সেনাপ্রধান। একটি রাজনৈতিক সংকটের সময় নানা রকম বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় এবং নানা রকম মতভিন্নতা সেই আলোচনায় থাকতেই পারে। তর্ক-বিতর্ক হতেই পারে। সেগুলো একান্তই গোপনীয় বিষয়। শেষ পর্যস্ত কী সিদ্ধান্ত হলো সেটাই প্রকাশ্যে আসে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিতর্ক সাত মাস পর একজন দায়িত্বশীল উপদেষ্টা কেন সামনে আনলেন? এই মুহূর্তে সেনাপ্রধানকে বিতর্কিত করলে দেশ অস্থিতিশীল ও অনিশ্চয়তার পথে যাত্রা করবে। সেই ঝুঁকি কেন নেওয়া হলো? আমরা যদি অতীত টেনে ধরে এত দিন পর এ ধরনের কথা বলে কাউকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা করি বা ব্লেইম গেইম শুরু করি, তাহলে দেশ অস্থিতিশীল হবে। গণতন্ত্র বিপন্ন হবে। আগামী দিনের গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বাধাগ্রস্ত হবে। এই বোধটুকু নিশ্চয়ই সবার রয়েছে। যাঁরা এখন রাজপথে ক্রিয়াশীল এবং যাঁরা প্রধান উপদেষ্টা বা সেনাবাহিনী বা সেনাপ্রধান সম্পর্কে বিষোদগার করছেন, সমালোচনা করছেন, তাঁদের একবার ভেবে দেখতে হবে যে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার চলে যাওয়ার পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেখান থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী, সেনাপ্রধান এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস কিভাবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন। তাঁরা দেশটিকে একটি অনিবার্য বিপর্যয়ের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। এখন তাঁরা আন্তর্জাতিক পরিমণণ্ডলে নিয়মিত যোগাযোগ করছেন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মনোভাব এবং প্রত্যাশাগুলো সম্পর্কে তাঁরা জানেন। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় দরকার গণতান্ত্রিক উত্তরণ। সেই গণতান্ত্রিক উত্তরণের গ্রহণযোগ্য রোডম্যাপ ড. ইউনূস এবং সেনাপ্রধান সবচেয়ে ভালো জানেন। কাজেই সবার বুঝতে হবে, তাঁদের বক্তব্যের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য অনুধাবন না করেই উত্তেজনা ছড়ালে ক্ষতি হবে বিপ্লবের। অযাচিত, অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টায় বরং বাংলাদেশে গণতন্ত্রের যাত্রাপথ বাধাগ্রস্ত হবে। আমাদের বোঝা দরকার, আমরা যদি অতিরিক্ত আবেগের বশবর্তী হই, তাতে নিজের ক্ষতি নিজেই করে ফেলার অবস্থা হতে পারে।
ষড়যন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। দেশবাসীকে পবিত্র ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা জানিয়ে গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে তিনি এ আহ্বান জানান।
জামায়াতের আমির বলেন, ‘এক মাস পবিত্র সিয়াম সাধনার পরে আনন্দের বার্তা নিয়ে পবিত্র ঈদুল ফিতর আমাদের দুয়ারে সমাগত। জাতি এমন এক মুহূর্তে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করতে যাচ্ছে, যখন দেশ ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরের জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসা জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়ে দেশের মানুষ মুক্ত পরিবেশে শ্বাস নিতে পারছে। দেশের মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে এবং শান্তিতে-স্বস্তিতে চলাফেরা করতে পারছে।’
জামায়াতের আমির আরো বলেন, ‘যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতি শান্তি-স্বস্তির দেশ পেয়েছে এবং কথা বলার সুযোগ পেয়েছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদের শহীদ হিসেবে কবুল করুন। আর যারা পঙ্গুত্ববরণ করেছেন ও আহত হয়েছেন আমরা তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করছি।
’
জামায়াতের আমির বলেন, দেশ থেকে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার পালিয়ে গেলেও তারা বিদেশে বসে এবং দেশে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা তাদের দোসরদের দিয়ে দেশে নানাভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেই যাচ্ছে। দেশে যাতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হতে পারে, সে জন্য নানাভাবে বিতর্ক এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে। এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে সরকারকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, মানুষের মধ্যে আল্লাহর ভয় তথা তাকওয়ার গুণাবলি সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আল্লাহর বিধান মেনে চলার দীর্ঘ প্রশিক্ষণ শেষে আমাদের মাঝে আগমন করছে পবিত্র ঈদুল ফিতর।
মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতর মুসলমানদের জীবনে শান্তি ও আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। পবিত্র ঈদুল ফিতর ধনী-গরিব সব শ্রেণির মুসলমানের মধ্যে নিবিড় ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে।
তিনি বলেন, ‘পবিত্র ঈদের এই দিনে আমরা সব ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানুষে মানুষে দয়া, সৌভ্রাতৃত্ব, সাম্য, ঐক্য ও ভালোবাসার এক মহা সেতুবন্ধ তৈরি করি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে একটি হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত সমাজ গঠনে তৎপর হই এবং সমাজের অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসি এবং একে অপরের সুখানন্দ ও দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নিই।’
জামায়াতের আমির সবার সুখ-শান্তি, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ জীবন কামনা করেন।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। কিন্তু আমরা এখন পর্যন্ত গণতন্ত্র ফিরে পাইনি এবং আমরা নির্বাচন পাইনি। নির্বাচন পেতে হলে আমাদের মধ্যে ঐক্যকে আরো অটুট রাখতে হবে।’
গতকাল শুক্রবার বিকেলে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার রুহিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দল আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ভার্চুয়ালি বক্তব্যে মির্জা ফখরুল এসব কথা বলেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে ফখরুল বলেন, ‘আমাদের জনগণের কাছে যেতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে।’
এ সময় আরো বক্তব্য দেন বিএনপির রংপুর বিভাগীয় পর্যবেক্ষণ টিমের সহসভাপতি মফিদুল আলম খান, কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইনবিষয়ক সম্পাদক জাকির হোসেন, ঠাকুরগাঁও স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক মাসুদুল ইসলাম, সদস্যসচিব কামরুজ্জামান প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রুহিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মোহাম্মদ বেলাল হোসেন এবং সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক জিল্লুুর রহমান।
জগন্নাথ হলে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধির সামনে মোহন রায়। ছবি : কালের কণ্ঠ
তখনো সূর্যের আলো ফোটেনি। দূর থেকে আসছে কান্নার শব্দ। এ যেন স্বজন হারানোর বেদনা। জগন্নাথ হলের গণসমাধির দিক থেকে আসছে কান্নার আওয়াজ।
কাছে গিয়ে দেখা গেল, ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ও গণসমাধি’র নিচে ঘাসের ওপর বসে কাঁদছেন এক ভদ্রলোক। পরনে নীল ফুলহাতা শার্ট, কালো প্যান্ট। একবার হাত দিয়ে গণসমাধি ছুঁয়ে দেখছেন, আরেকবার সবুজ ঘাস। চোখের জল যেন কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
মিনিট দুয়েক পর পিঠে হাত দিলাম—‘দাদা কাঁদছেন কেন?’
পেছন ফিরে তাকালেন। শার্টের হাতায় চোখ মুছে বললেন, ‘ভাই, আজ ২৫ মার্চ। দিনটা এলে নিজেকে কিছুতেই স্থির রাখতে পারি না। একাত্তরের এই দিনে এই সবুজ চত্বর রাঙা হয়েছিল আমার স্বজনদের রক্তে।
কত যে লাশ টেনেছিলাম!’
বলতে বলতে গলা ধরে আসে তাঁর। শুধু যে স্বজন বা পরিচিতদের হারিয়েছেন তা নয়, সেদিন নিজেও মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন।
নাম তাঁর মোহন রায়। পেশায় মালি। এখন ঢাকার বাংলামোটরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।
থাকেন আজিমপুর। বয়স সত্তরের ঘরে। কিন্তু দেখলে বোঝার উপায় নেই। এই বয়সেও নিয়মিত সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করেন।
২৫ মার্চ জগন্নাথ হল ও তত্সংলগ্ন এলাকায় গণহত্যার শিকার লাশগুলো জগন্নাথ হলের মাঠে জড়ো করার পর সবার সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মোহন। পায়ে গুলি লাগলেও বেঁচে যান। জীবন-মৃত্যুর সংকটময় সময়ে মানবতার ডাকে সহযোদ্ধাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন।
স্কুলে যাওয়া হয়নি : মোহনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। অভাব মোহনদের সংসারে বারো মাসের গল্প। স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি। তবে নাম-ঠিকানা লিখতে পারেন। তাঁর বাবা বাসু রাজভর ফজলুল হক হলের মালি ছিলেন। মোহন ঢাকা ক্লাবে টেনিস বয় হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর। সেই সুবাদে কাজ চালানোর মতো উর্দু বলতে পারতেন। পরে চাকরি পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে।
সেদিন জ্বর ছিল তাঁর : জগন্নাথ হলে রবীন্দ্রভবনের পেছনের পূর্ব পাশটায় ছিল মোহনদের বাসা। একাত্তরে তিনি ২০ বছরের তরুণ। ঢাকার রাজপথ উত্তপ্ত। মোহনরা টের পাচ্ছিলেন বড় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণও শুনেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে বসে। ২৫ মার্চ দুপুর থেকেই জ্বর ছিল তাঁর। শরীরটাও ছিল ক্লান্ত। সন্ধ্যার একটু পর ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙে গোলাগুলির শব্দে। উঠে দেখেন লাল আলো এবং ধোঁয়া। হলের পাশের মেইন রোডে পাক সেনাদের অনেক গাড়ি। হলের ভেতরে দলে দলে সেনারা প্রবেশ করছে। অনবরত গুলির আওয়াজ। বাড়ির সবাই মিলে চৌকির নিচে আশ্রয় নিলেন। আক্রমণটা শুরু হলো রাত ১২টার দিকে। চারদিকে শুধু ‘বাঁচাও-বাঁচাও’ শব্দ। হানাদারদের একটা গাড়ি তাঁদের বাসার সামনে রাখল। আর্মিরা দরজা খুলতে বলল। বাসু রাজভর উঠে দরজা খুলে দিলেন। ওরা সবাইকে বের হতে বলল। মোহন উর্দুতে বলেছিলেন, ‘হাম লোক কৈ কাছর নেই হ্যায়, হাম লোককা উপর ক্যা জুলুমছে আয়া।’ ওরা বলল, ‘তুম লোক উর্দুমে বাত চিতকে বাতায়া সামাজ মে নেহি তো হাম মেজর সাব কো বোলায়া।’
জি সি দেব পড়ে ছিলেন মেঝেতে : মোহন মাঠে এসে দেখেন, টিনশেডের ছাত্রাবাস, সোনালি ব্যাংক জ্বলছে। মেজরের সামনে থেকে সেনারা মোহনদের ডেকে নিয়ে গেল লাশ টানার জন্য। বাংলা এবং উর্দু বলতে পারে যারা—দুটো দলে ভাগ করল তাদের। দুই গ্রুপ সৈন্য ভার নিল কাজ করানোর। বাংলাভাষী গ্রুপ কাজ শুরু করল হলের ভেতর, আর অন্য গ্রুপকে নিয়ে গেল শিববাড়ীর দিকে।
মোহন বলেন, ‘আমরা সামনে, পেছনে সেনারা। রাইফেল তাক করা—যেন পালাতে না পারি। বুধিরাম, মিস্ত্রি, জহরলালসহ আমার সঙ্গে আরো পাঁচজন ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব। থাকতেন শিববাড়ীসংলগ্ন শিক্ষক কোয়ার্টারে। মোহনরা গিয়ে দেখেন ঘরের দরজা বন্ধ। পাক সেনারা লাথি মেরে ভাঙল। মোহন বলেন, ‘ঘরের ভেতরে আর কেউ ছিল না। বাইরে থেকে জানালা দিয়ে দেব বাবুকে ওরা গুলি করেছে। ঘরে ঢুকে দেখি, দেববাবু মেঝেতে পড়ে আছেন। আমরা তাঁর লাশ টেনে নিয়ে বর্তমান জগন্নাথ হল শহীদ মিনারের কাছে রাখি। রক্তমাখা ভারী শরীর। আনার সময় তাঁর পরনের ধুতিটা খুলে গিয়েছিল। তখন লাশটা মাটিতে রেখে ধুতিটা ঠিক করে দিচ্ছিলাম। এর মধ্যেই ঘাড়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে মারল এক পাক সেনা। গালিও দিল—‘তুম ইয়ে লাশকো কিউ রাখতা হ্যায়, এক সাথমে টেনে চল।’
মধুদা তখনো বেঁচে ছিলেন : চারদিক থেকে লাশ টেনে আনা হচ্ছে। মৃত ভেবে মধুদার লাশ আনতে যখন তাঁর বাসায় গেলেন, তখনো তিনি জীবিত ছিলেন বলে জানালেন মোহন। বললেন, ‘আহত লোকটাকে নিয়ে আসতে হলো সেনাদের হুকুমে। তাঁর দেহটা রাখলাম মাঠে লাশের স্তূপে। রাখার পর গুলি করল সেনারা। গুলি করেই ক্ষান্ত হয়নি, বুট দিয়ে মুখটা থেঁতলে দিল।’
জগন্নাথ হল থেকে যেসব লাশ টেনেছিলেন—ততক্ষণে সবার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। উত্তরবাড়ি থেকে, পুকুর পার থেকেও বহু ছাত্রের লাশ এনেছেন। যেসব ছাত্রের সঙ্গে ফুটবল খেলেছেন তাঁদের অনেকের লাশও টানতে হয়েছে।
লাশ টানতে টানতে প্রায় ভোর হয়ে গেল। পরে উর্দু জানা সবাইকে নেওয়া হলো মেজরের কাছে। এদের মধ্যে মোহনের এক স্বজনও ছিলেন। তিনি উর্দুতে পাক সেনাদের সঙ্গে বাতচিত করলেন। অন্যদের কাতর প্রার্থনা। কিন্তু মন গলল না।
মরার মতো পড়ে রইলেন : যারা লাশ টেনেছে, সবাইকে নিয়ে আসা হলো হলের শহীদ মিনারের সামনে। কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন সবাই। কিন্তু তাঁদের লাইন ধরে দাঁড়াতে বলা হলো। মোহন ছিলেন একেবারে প্রথমে। উর্দুতে নিজেকে বিহারি বলে পরিচয় দিয়ে প্রাণভিক্ষা চাইলেন তিনি। মেজর বলল, ‘ওর লুঙ্গি উঁচিয়ে দেখ’। একজন সৈনিক সজোরে মোহনের গালে থাপ্পড় মারল। ঘুরে কয়েকজনের পেছনে চলে গেলেন তিনি। এরপর লাইনে দাঁড় করানো লোকগুলোকে গুলি করলে গুলিবিদ্ধ লোকগুলো পড়ল মোহনের ওপর। রক্তে গা ভেসে গেল।
মোহন বলেন, ‘ওরা মনে করল আমিও মারা গেছি। তবে কিছু সময় পর আমার পা নড়ে উঠলে পায়ে গুলি করল। গুলি খেয়েও মাটি কামড়ে পড়ে থাকলাম। একটা গুলি ডান পায়ের ঊরুতে এবং অপরটা বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে লাগে।’
অনেকক্ষণ গুলির শব্দ না পেয়ে মোহন চোখ খুলে দেখলেন, পাক সেনাদের দেখা যাচ্ছে না। তাঁর শরীর থেকে রক্ত ঝরছে, পা ফুলে গেছে। কাছেই দেখলেন বুধিরামকে। বোনাই (দুলাইভাই) বলে ডাক দিলেন। পেটে গুলি লেগেছে তাঁর। খুব কষ্টে পেট চেপে ধরে রেখেছেন। বুধিরামের খুব রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তাঁকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
আবার হলে ফেরা : স্বাধীন দেশে আবার হলে ফেরেন মোহন। আবার শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগানে ফুল ফোটানো। একসময় বিয়েও করেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি তিন ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ২০১০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।
২৫ মার্চের সেই বিভীষিকা আর ভুলতে পারেননি। পায়ে এখনো গুলির ক্ষত রয়ে গেছে। সাইকেল চালালে ব্যথামুক্ত থাকেন। হাঁটতে গেলে এখনো ব্যথা পান বলে জানালেন মোহন।
বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়ে প্রস্তাবনা পাস অস্ট্রেলিয়ার সংসদে
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক
শেয়ার
বাংলাদেশে দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সংসদে প্রস্তাবনা পাস হয়েছে। দেশটির তিনটি রাজনৈতিক দল—লেবার, লিবারেল ও গ্রিন পার্টির সংসদ সদস্যরা এই বিল প্রস্তাব করেন, যা সংসদে পাস হয়।
গত বুধবার বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশটির সংসদের অধিবেশনে এই আহ্বান জানানো হয়। বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ কমিউনিটির প্রেসিডেন্ট মো. রাশেদুল হক এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো এবং নির্বাচনী সততা ও জবাবদিহির আহ্বান জানিয়েছেন। একই সঙ্গে শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে রূপান্তর; জরুরি ভিত্তিতে নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার সংসদ সদস্যরা।
সংসদে লিখিত বক্তব্য দেন এনএসডব্লিউয়ের সদস্য এবিগেইল বয়েড। তিনি বলেন, ‘এই হাউস উল্লেখ করে যে—ক. ২৬ মার্চ ২০২৫ হচ্ছে বাংলাদেশের ৫৫তম স্বাধীনতা দিবস, যা বাংলাদেশের একটি স্বাধীন, সার্বভৌম জাতি হিসেবে ৫৫ বছর পূর্তি এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দিনটিকে স্মরণ করে; খ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস জাতীয় সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, মুক্তি, ন্যায়বিচার, ঐক্য, সাম্য এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুষ্ঠু ভবিষ্যতের জন্য সংগ্রামে বাংলাদেশি জনগণের শক্তি ও স্থিতিস্থাপকতা উদযাপন করে; গ. ২৩ মার্চ বাংলাদেশ কমিউনিটি কাউন্সিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য লাকেম্বা লাইব্রেরি হলে দোয়া ও ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে অনেক সম্প্রদায়ের সদস্য এবং অতিথিরা উপস্থিত ছিলেন, যাঁরা স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের জন্য একত্র হয়েছিলেন, যা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশি-অস্ট্রেলীয় সম্প্রদায়সহ বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশি জনগণের জন্য একটি চিরন্তন গর্বের; ঘ. সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সাবেক শাসনব্যবস্থার পতনের পর বাংলাদেশের জনগণ গুরুতর চ্যালেঞ্জ, দুর্নীতি, হুমকি এবং অস্থিতিশীলতার মুখোমুখি হচ্ছে। এই সংকটময় সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন এবং পদ্ধতিগতভাবে দুর্নীতি ভেঙে ফেলা, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ওপর জনসাধারণের আস্থা পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি করার নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে। এই সংসদ গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতার জন্য বাংলাদেশি জনগণের চলমান লড়াইয়ের সঙ্গে তার সংহতি নিশ্চিত করে।
’
এবিগেইল বয়েড আরো বলেন, ‘এই সংসদ অস্ট্রেলিয়ান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর এবং নির্বাচনী সততা, জবাবদিহি ও শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তর এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়নের জন্য আহ্বান জানাচ্ছে।’