<p>ইসলাম ধর্মের প্রধান গ্রন্থ আল-কোরআনের অনুবাদ, ভাষ্য তৈরি, মুদ্রণ ও বিতরণের উদ্দেশ্যে এক বিশাল প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে মদিনায়। এর সরকারি নাম কিং ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স—এটি বাণিজ্যিক প্রকল্প নয়। সম্পূর্ণ দাওয়াতি কাজের জন্য উৎসর্গীকৃত একটি মিশনারি প্রকল্প। এটি পঞ্চম আব্বাসীয় শাসক বাদশাহ হারুনুর রশিদ (৭৬৩-৮০৯) কর্তৃক বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত ‘বায়তুল হিকমাহ’-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বিশ্বব্যাপী পবিত্র কোরআনের বিশুদ্ধ তিলাওয়াত, চর্চা ও অনুশীলন ছড়িয়ে দেওয়ার এক মহৎ ব্রত নিয়ে সৌদি আরবের বাদশাহ ফাহাদ ১৯৮৫ সালে মদিনায় এ কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠা করেন। ৩০ জন বিদেশিসহ এক হাজার ৭০০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী এ কমপ্লেক্সের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। একই ভাষার স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য বিভিন্ন মুফাসসিরের অনুবাদ ও তাফসির প্রকাশ করা হয়। নানা ভাষার জন্য রয়েছে উচ্চপর্যায়ের শক্তিশালী সম্পাদনা বোর্ড। দুনিয়াব্যাপী কোরআনের দাওয়াত প্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম এই কমপ্লেক্স।</p> <p>এ পর্যন্ত পৃথিবীর জীবন্ত ৩৯টি ভাষায় অনুবাদসহ কোরআনের তাফসির প্রকাশ করা হয়। একই ভাষায় একাধিক অনুবাদ ও তাফসির রয়েছে। প্রকাশিত ৫৫টি ভাষায় কোরআনের অনুবাদ ও তাফসিরের মধ্যে এশীয় ভাষায় ২৪টি, ইউরোপীয় ভাষায় ১২টি এবং আফ্রিকান ভাষায় ১৪টি। উল্লেখযোগ্য ভাষাগুলো হচ্ছে—ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি, জাপানি, আলবেনীয়, ইন্দোনেশীয়, উর্দু, বাংলা, তুর্কি, সোমালীয়, চীনা, রুশ, জার্মান, স্প্যানিশ, কোরীয়, ফারসি, গ্রিক, ভিয়েতনামি, পর্তুগিজ, সুুইডিশ ও তেলেগু। বাংলা ভাষায় এক খণ্ডে প্রকাশিত হয় আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ.)-এর মা‘আরিফ আল কোরআন, যার অনুবাদক ও সম্পাদক হচ্ছেন বরেণ্য ইসলামী স্কলার মাওলানা মুহীউদ্দীন খান (রহ.)। উপমহাদেশের খ্যাতনামা মুহাদ্দিস আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী (রহ.) কর্তৃক উর্দু ভাষায় লিখিত ‘তাফসিরে উসমানি’ এই কমপ্লেক্স থেকে ছাপা হয়।</p> <p>কিং ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্স অনুবাদসহ ও অনুবাদবিহীন দুই ধরনের কোরআন বিশ্বব্যাপী বিনা মূল্যে বিতরণ করে। কোরআনের আয়াতগুলো সিরীয় বংশোদ্ভূত বিশ্ববিখ্যাত ক্যালিগ্রাফার উসমান তাহা লিখিত। ১৮ বছর ধরে এ কমপ্লেক্সে কোরআন লিখন বিভাগে তিনি কর্মরত। তাঁর হস্তলিপি ও অলংকরণ দৃষ্টিনন্দন, স্পষ্ট ও শিল্পসমৃদ্ধ। তাঁর পরিচালনায় রয়েছেন এক দল চৌকস ক্যালিগ্রাফার। পবিত্র কোরআন ছাড়াও এ পর্যন্ত এই কমপ্লেক্স থেকে অনুবাদিত তাফসির, হাদিস, সিরাতুন্নবী গ্রন্থ বেরিয়েছে ১৬০ ধরনের। এ কমপ্লেক্সের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ছয় কোটি কপি গ্রন্থ। মুদ্রণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ যন্ত্রপাতির ব্যবহার বিস্ময়ের উদ্রেক করে।</p> <p>আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন সিম্পোজিয়ামে পঠিত ৬০টিরও বেশি গবেষণা নিবন্ধ কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হয়। হাফসসহ কোরআনের পাঁচ কিরাতের পাণ্ডুলিপি এখানে জমা আছে, যা বিশেষজ্ঞ কমিটির তত্ত্বাবধানে ক্যালিগ্রাফারদের মাধ্যমে লিখিত হয়। দুই লাখ ৫০ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে মদিনা নগরীতে অবস্থিত এ প্রকল্পে মসজিদ, মুদ্রণ, প্রশাসনিক, পরিবহন, পাঠাগার, মিলনায়তন, রক্ষণাবেক্ষণ, মার্কেটিং, ক্যাফেটেরিয়া, ফার্মেসি, প্রকৌশল বিভাগ রয়েছে। বাদশাহ আবদুল্লাহ ইবনে আবদুল আজিজের নির্দেশে হজ পালন শেষে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনকালে প্রত্যেক হাজিকে এক কপি কোরআন হাদিয়া প্রদান করা হয়। ১৪২৪-১৪২৫ হিজরি বর্ষে দুই কোটি কপি কোরআন বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া হারামাইনসহ সৌদি আরবের সব মসজিদ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী, বিদেশি অতিথি এবং সৌদি দূতাবাসের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে কোরআনের কপি সরবরাহ করা হয়।</p> <p>প্রকল্প পরিদর্শনে আসা অতিথিদের প্রজেক্টরের মাধ্যমে প্রাচীন থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত পবিত্র কোরআন চর্চা ও সংরক্ষণের ইতিহাস প্রদর্শন করা হয়। তিলাওয়াতের একটি সিডি ও সৌদি আলেমদের তত্ত্বাবধানে রচিত একটি তাফসিরসহ দুটি কোরআন অতিথিদের উপঢৌকন প্রদান করা হয়। এ প্রকল্পে বিশুদ্ধ তিলাওয়াতের অডিও ও ভিডিও ফরমে কোরআনের সিডি, ডিভিডি তৈরি ও সরবরাহ করা হয়। এ পর্যন্ত ২০ লাখ মানুষ এ প্রকল্প পরিদর্শন করেছে।</p> <p>অন্ধ ব্যক্তিরা যাতে কোরআন তিলাওয়াত করতে পারে সে জন্য প্রকাশ করা হয় ইত্ধরষষব ভাষার সংস্করণ। হজ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৩ কোটি ৬১ লাখ ৪৫ হাজার ৫৩৩ কপি কোরআন, ২৫ লাখ ২০ হাজার ৮৭৫ কপি ক্যাসেট, দুই কোটি ৭৫ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৭ কপি অনুবাদ, দুই লাখ ২০ হাজার কপি সিরাতুন্নবী, ৫০ লাখ ৪৫ হাজার অন্যান্য ধর্ম গ্রন্থ এ কমপ্লেক্স থেকে প্রকাশিত হয়। অতি সম্প্রতি কিং ফাহাদ কোরআন প্রিন্টিং কমপ্লেক্সের বিশেষজ্ঞরা মোবাইল ফোন অ্যাপস উদ্ভাবন করেন। এটি Apple Store/Google Play থেকে  Android/iOS মোবাইল ভার্সনে ডাউনলোড করা যায়। এই অ্যাপসের মাধ্যমে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীরা পৃথিবীর ১২টি ভাষায় পবিত্র কোরআনের আয়াত, তরজমা ও তাফসির অধ্যয়ন করতে পারবে।</p> <p>লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক</p> <p>বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ</p> <p>ওমর গণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম</p>