মুসাফির ব্যক্তির রোজা ও রমজান

মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
শেয়ার
মুসাফির ব্যক্তির রোজা ও রমজান
ছবি : কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি

মুসলিম উম্মাহর সর্বসম্মতিক্রমে মুসাফিরের জন্য রোজা না রাখা জায়েজ। ওই মুসাফির রোজা রাখতে সক্ষম হোক অথবা অক্ষম, রোজা তার জন্য কষ্টদায়ক হোক অথবা না হোকসর্বাবস্থায় তার জন্য রোজা না রাখা বৈধ। মহান আল্লাহ বলেন, ...কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ বা মুসাফির হলে সে অন্য কোনো দিন (রোজা) গণনা করবে। (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৮৪)

সফরে রোজা না রাখা বৈধ হওয়ার শর্ত হলো, সফর পরিমাণ মতো দূরত্বের হতে হবে।

শরয়ি সফরের দূরত্ব ৪৮ মাইল তথা ৭৭-৭৮ কিলোমিটার।

যদি কোনো ব্যক্তি সফরে বা ভ্রমণে থাকা অবস্থায়ও রোজা পালন করেন, সেটা উত্তম। তবে বেশি কষ্ট হলে বা ইচ্ছা করলে তিনি রোজা ছাড়তে পারবেন। এই রোজা পরে সুবিধামতো নিকটতম সময়ে কাজা আদায় করে নিতে হবে।

ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) রমজান মাসে মদিনা থেকে (মক্কা অভিযানে) রওনা হন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ১০ হাজার সাহাবি। তখন হিজরত করে চলে আসার সাড়ে আট বছর পার হয়ে গিয়েছিল। তিনি ও তাঁর সঙ্গী মুসলমানরা রোজা অবস্থায় মক্কা অভিমুখে রওনা হন।
অবশেষে তিনি যখন উসফান ও কুদাইদ স্থানদ্বয়ের মধ্যবর্তী কাদিদ নামক জায়গায় ঝরনার কাছে পৌঁছলেন তখন তিনি ও তাঁর সঙ্গী মুসলমানরা ইফতার করেন। (বুখারি, হাদিস : ৪২৭৬)

স্মরণ রাখতে হবে যে মুসাফিরের জন্য সফর অবস্থায় দিনের শুরু থেকেই রোজা না রাখার অনুমতি আছে। সুতরাং কোনো মুসাফির রোজা না রাখার ইচ্ছা করলে রোজা না রাখা অবস্থায় দিন শুরু করবে। কিন্তু যদি এই ছাড়ের ওপর আমল না করে রোজা শুরু করে দেয়, তাহলে বিনা ওজরে তার জন্য তা ভঙ্গ করা জায়েজ নয়; বরং ওই রোজা পুরো করা তার ওপর জরুরি হয়ে যায়। এতদসত্ত্বেও কেউ যদি এ রোজা ভেঙে ফেলে তাহলে এর কারণে তার ওপর কাফফারা ওয়াজিব হবে না।

পরবর্তী সময়ে শুধু কাজা করে নিলেই চলবে।

(মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবা : ২/৪৩২,

কিতাবুল আছল : ২/২০৬, ফাতহুল কাদিস : ২/২৮৪)

মাসআলা : হানাফি মাজহাব মতে, সফর অবস্থায় নিয়ত করে রোজা রাখা শুরু করলে, তা ভাঙা জায়েজ নয়। কেউ ভেঙে ফেললে গুনাহগার হবে। তবে কাফফারা দিতে হবে না। শুধু কাজা করবে। (রদ্দুল মুহতার : ২/৪৩১)

মাসআলা : যে ব্যক্তি মুকিম (স্থায়ী বাসিন্দা) অবস্থায় সাহরি খেয়ে সফর শুরু করেছেন, তাঁর জন্য সফরের অজুহাতে রোজা ভাঙা জায়েজ নয়। ভাঙলে গুনাহগার হবেন, তবে শুধু রোজার কাজা ওয়াজিব হবে।

(ফাতাওয়া হিন্দিয়া : ১/২০৬)

মাসআলা : সফর অবস্থায় রোজা রাখা জায়েজ এবং সওয়াবও আছে। তবে যদি না রাখে, তাহলে সেটা বৈধ। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৩/৭৩)

এক দিনের ভ্রমণেও কি রোজা রাখা যায়?

প্রশ্ন : এক দিনের ভ্রমণের জন্যও কি রোজা না রাখতে পারবে?

উত্তর : যদি ৪৮ মাইলের ভ্রমণ হয়, তখন রোজা ভাঙা জায়েজ আছে। সেটি এক দিনের ভ্রমণ হলেও। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৪৭৩,

রাদ্দুল মুহতার : ২/১০৮)

১৫ দিন বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য সফরে রোজার বিধান

যদি রাস্তার মধ্যে ১৫ দিন থাকার নিয়তে অবস্থান করে, তাহলে আর রোজা ভাঙা জায়েজ নেই। কেননা শরিয়তের মধ্যে এখন সে মুসাফির নয়। ১৫ দিন বা তার চেয়ে বেশি সময়ের জন্য সফর করলে সফরকারী মুকিম হয়ে যায়। সুতরাং যদি ১৫ দিনের কম অবস্থান করার নিয়ত করে সফর করে থাকে, তাহলে রোজা না রাখা জায়েজ আছে। এই রোজাগুলো পরে কাজা করে নেবে।

(বেহেশতি জেওর : ৩/১৯, শামি : ২/১৬৮)

দ্বিপ্রহরের আগে ঘরে পৌঁছে যাওয়া

কারো ভ্রমণে রোজা না রাখার নিয়ত ছিল, কিন্তু দ্বিপ্রহরের এক ঘণ্টা আগেই স্বীয় ঘরে পৌঁছে গেল, তাহলে তখন রোজার নিয়ত করে নেবে।

(বেহেশতি জেওর : ৩/১৯, হিদায়া : ১/২০৩)

সফরে তীব্র গরম হওয়ায় রোজা ভেঙে ফেলা

প্রশ্ন : যদি কোনো ব্যক্তি রমজান মাসে এ ধরনের ভ্রমণের সম্মুখীন হয়, যে সফরের দ্বারা শরিয়ত অনুযায়ী মুসাফির হয় না। এ কারণে রোজা অবস্থায় ভ্রমণ করে আর দ্বিপ্রহরে মারাত্মক রোদ ও তীব্র গরম হওয়ায় অসহ্য হয়ে রোজা ভেঙে দিয়েছে, তাহলে তার ওপর কাজা ওয়াজিব হবে, নাকি কাফফারাও আবশ্যক হবে?

উত্তর : এ অবস্থায় এই ব্যক্তির ওপর কাফফারা আবশ্যক হবে না। শুধু কাজা আবশ্যক। (ফাতাওয়ায়ে দারুল

উলুম : ৬/৪৪৪, রাদ্দুল মুহতার : ২/১৫৮)

তৃষ্ণার কষ্ট অথবা সফরে রোজা ভেঙে ফেলা

প্রশ্ন: রোজাদার ব্যক্তি মারাত্মক তৃষ্ণার কারণে রোজা ভেঙে ফেলল অথবা ভ্রমণের মধ্যে রোজা ভেঙে ফেলল, তখন তার জন্য কী বিধান?

উত্তর : তৃষ্ণা যদি এত মারাত্মক হয় যে প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয় অথবা অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, তাহলে এ অবস্থায় রোজার কাজা আবশ্যক। একইভাবে ভ্রমণের মধ্যে ভ্রমণের দিন রোজা ভাঙা উচিত নয়। কিন্তু যদি ভেঙে ফেলে তাহলে কাজা আবশ্যক হবে। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৪৪০,

রাদ্দুল মুহতার : ২/১৫৮)

সফরে ছুটে যাওয়া রোজার বিধান

সফর অবস্থায় ছুটে যাওয়া রোজা পরে কাজা করা আবশ্যক। আর যদি মৃত্যুর আগে কাজা না করে থাকে, তাহলে ফিদিয়া দেওয়ার অসিয়ত করা আবশ্যক। শর্ত হলো, সম্পদ রেখে যাওয়া। আর যদি ভ্রমণ অবস্থায় মৃত্যু হয়ে থাকে অথবা মুকিম হয়ে মারা যায়; কিন্তু রোজা কাজা রাখার সময় পায়নি, তাহলে ফিদিয়া দেওয়ার অসিয়ত আবশ্যক নয়। আর যদি কিছু রোজা কাজা রাখার সময় পায় তাহলে সে রোজাগুলোর কাজা আবশ্যক। আর যদি কাজা করতে না পারে, তাহলে সেসব দিনের ফিদিয়া দেওয়ার অসিয়ত করা আবশ্যক।

(ফাতাওয়ায়ে রহিমিয়াহ : ২/৩৪, শামি : ২/১৬০)

মাসআলা : যদি মুসাফির ভ্রমণ থেকে ফিরে আসার পর অথবা অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর কাজা আদায় করার মতো সময় না পায়, তাহলে তার কাজা আবশ্যক নয়। ভ্রমণ থেকে ফিরে অথবা অসুস্থ থেকে সুস্থ হওয়ার পর, যত দিন পায় তত দিনের কাজা আবশ্যক।

(জাওয়াহিরুল ফিকহ : ১/৩৮১)

রোজাদার মুসাফিরের ভ্রমণে মৃত্যু হয়ে যাওয়া

প্রশ্ন : এক ব্যক্তি রমজানে মুসাফির হলো। সে রোজা রাখেনি। সফরে তার মৃত্যু হয়ে গেল, তখন তার রোজার বিধান কী?

উত্তর : তার দায়িত্বে রোজার কাজা আবশ্যক নয় এবং ফিদিয়ার অসিয়তও আবশ্যক হবে না। (ফাতাওয়ায়ে দারুল উলুম : ৬/৪৩২, দুররে মুখতার : ২/১৬০)

 

 

 

 

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

কোরআন থেকে শিক্ষা

    পর্ব : ৭২৯
শেয়ার
কোরআন থেকে শিক্ষা

আয়াতের অর্থ : তোমাদের মধ্যে যারা আইয়িম (জীবনসঙ্গীহীন) তাদের বিয়ে সম্পাদন কোরো এবং তোমাদের দাস ও দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ। যাদের বিয়ের সামর্থ্য নেই, আল্লাহ তাদের নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে এবং তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসীদের মধ্যে কেউ তার মুক্তির জন্য লিখিত চুক্তি চাইলে তাদের সঙ্গে চুক্তিতে আবদ্ধ হও... (সুরা : নুর, আয়াত : ৩২-৩৩)

আয়াতদ্বয়ে বিয়েতে অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

 

শিক্ষা ও বিধান

১. হানাফি মাজহাব অনুসারে সাবালক নারী ও পুরুষ নিজে নিজে বিয়ে করলে তা বৈধ। যদিও তা অপছন্দনীয়।

২. ইসলামের শিক্ষা হলো নারী ও পুরুষ উভয়ে অভিভাবকের মাধ্যমে বিয়ে করবে। সাবালক ব্যক্তিও যদি অভিভাবক ছাড়া বিয়ে করে, তবে তাকে তিরস্কার করা হবে।

৩. বিয়ের সব ধরনের সক্ষমতা আছে এমন ব্যক্তি যদি বিয়ে না করলে গুনাহে লিপ্ত হওয়ার ভয় করে, তবে তার জন্য বিয়ে করা ওয়াজিব।

৪.  বিয়ের চাহিদা অনুভব করে অথচ তার আর্থিক সামর্থ্য নেই এমন ব্যক্তি রোজা রাখবে।

৫. আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, অধীন ব্যক্তিদের বিয়ের উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা অভিভাবকদের দ্বিনি দায়িত্ব। (মাআরেফুল কোরআন : ৬/৪০২)

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

তারাবিতে কোরআনের বার্তা

    পর্ব : ২২
শেয়ার
তারাবিতে কোরআনের বার্তা

সুরা : আহজাব

এই সুরায় সামাজিক জীবনের বিভিন্ন শিষ্টাচার, আহজাব যুদ্ধ ও বনি কুরাইজা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। শুরুর দিকে দত্তক নেওয়া শিশুর বিধান সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মহানবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের বিশেষ মর্যাদার কথা তুলে ধরা হয়েছে। পর্দার বিধান বর্ণনা করা হয়েছে।

জাহেলি যুগের মতো উদ্দাম চলাফেলা করতে নিষেধ করা হয়েছে। তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দত পালনের বিধান বর্ণনা করা হয়েছে। নবীপরিবারের মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। ভালো কাজে তাঁদের প্রতিদান দ্বিগুণ আর মন্দ কাজে শাস্তিও দ্বিগুণ দেওয়ার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. ওহির অনুসরণ করো। (আয়াত : ২)

২. মুমিনের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। (আ. : ৩)

৩. মানুষকে পিতৃপরিচয়ে ডাকো। (আ. : ৫)

৪. পৃষ্ঠপ্রদর্শন কোরো না।

(আয়াত : ১৫)

৫. রাসুল (সা.)-এর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (আয়াত : ২১)

৬. রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যে দ্বিগুণ পুরস্কার। (আয়াত : ৩১)

৭. পরপুরুষের সঙ্গে কোমল ভাষায় কথ বোলো না। (আয়াত : ৩২)

৮. তোমরা ঘরে অবস্থান কোরো। (আ. : ৩৩)

৯. মুহাম্মদ (সা.) শেষ নবী।

(আয়াত : ৪০)

১০. সকাল-সন্ধ্যা আল্লাহর জিকির কোরো। (আয়াত : ৪১-৪২)

১১. আমন্ত্রণকারীর অনুমতি ছাড়া ঘরে প্রবেশ কোরো না। (আয়াত : ৫৩)

১২. নারীদের কাছে চাইতে হবে আড়াল থেকে। (আয়াত : ৫৩)

১৩. রাসুল (সা.)-এর প্রতি দরুদ পাঠ কোরো। (আয়াত : ৫৬)

১৪. মানুষকে কষ্ট দিয়ো না। গুজব রটিয়ো না। (আয়াত : ৫৮ ও ৬০)

১৫. সদা সত্য কথা বলো। (আয়াত : ৭০)

সুরা : সাবা

মহান আল্লাহর হামদ পাঠের মাধ্যমে এই সুরা শুরু করা হয়েছে। এরপর এ কথার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে কিয়ামত অবশ্যই কায়েম হবে। তারপর দাউদ ও সুলায়মান (আ.)-এর ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। পাখি ও পাহাড় দাউদ (আ.)-এর সঙ্গে মহান আল্লাহর তাসবিহ পাঠ করত। আর বাতাস সুলায়মান (আ.)-এর অধীন ছিল। এরপর ইয়েমেনের সাবা নগরীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। মুশরিকদের ঈমানের দাওয়াত দিয়ে সুরাটি শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. আল্লাহর আয়াত মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টা কোরো না। (আয়াত : ৫)

২. জ্ঞানীরা কোরআনের সত্যতা নিয়ে সংশয় রাখে না। (আয়াত : ৬)

৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ আল্লাহর অবাধ্যতার ফল। (আয়াত : ১৬)

৪. কারো পাপের দায় কেউ বহন করবে না। (আয়াত : ২৫)

৫. মহানবী (সা.) মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা। (আয়াত : ২৮)

৬. মানুষের জীবনকাল নির্ধারিত। (আয়াত : ৩০)

৭. বিত্তশালীরাই দ্বিন থেকে বেশি বিমুখ। (আয়াত : ৩৪)

৮. আল্লাহ সত্যের দ্বারা অসত্যের বিলোপ ঘটান। (আয়াত : ৪৮)

সুরা : ফাতির

এই সুরায় সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন বস্তু উল্লেখ করে আল্লাহর একত্ববাদের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। ওহি নিয়ে ফেরেশতাদের আগমন বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীদের অন্ধ ও চক্ষুষ্মানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। বৃষ্টি, ফল-ফসল, কয়েক স্তরে মানবসৃষ্টি, নোনা পানি থেকে সাগরের মিঠা পানি পৃথক করা, রাত-দিনের একের পর এক আগমন, চন্দ্র-সূর্যের নির্দিষ্ট নিয়মের অধীন হওয়া, হরেক রকম বৃক্ষ ও প্রাণী ইত্যাদি বর্ণনা করে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ দেওয়া হয়েছে। এই সুরায় মহানবী (সা.)-কে বাশির ও নাজির তথা সুসংবাদদানকারী ও সতর্ককারী ঘোষণা করা হয়েছে। মূর্তিপূজার অসারতা বর্ণনা করে সুরা শেষ করা হয়েছে।

আদেশ-নিষেধ-হিদায়াত

১. আল্লাহর অনুগ্রহ স্বীকার কোরো। (আয়াত : ৩)

২. সন্তান আল্লাহর অনুগ্রহ। (আয়াত : ১১)

৩. সমুদ্রে আল্লাহর অনুগ্রহ অনুসন্ধান কোরো। (আয়াত : ১২)

৪. আলো আর আঁধার কখনো সমান নয়। (আয়াত : ১৯-২১)

৫. জ্ঞানীরাই আল্লাহকে বেশি ভয় করে। (আয়াত : ২৮)

৬. দান করলে সম্পদ বৃদ্ধি পায়। (আয়াত : ৩০)

৭. কুফরি আল্লাহর ক্রোধ বৃদ্ধি করে। (আয়াত : ৩৯)

৮. আল্লাহ পাপীদের অবকাশ দেন, তবে তা নির্ধারিত কালের জন্য। (আয়াত : ৪৫)

গ্রন্থনা : মুফতি আতাউর রহমান

মন্তব্য

রোজাদারের মানসিক প্রশান্তি

আলেমা হাবিবা আক্তার
আলেমা হাবিবা আক্তার
শেয়ার
রোজাদারের মানসিক প্রশান্তি

যেকোনো ইবাদত মুমিনের হৃদয়ে প্রশান্তি বয়ে আনে। তবে রোজা রেখে মুমিন অন্য সব ইবাদতের তুলনায় অধিক প্রশান্তি খুঁজে পায়। কেননা রোজাদারের জন্য আল্লাহ যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন তা যেমন প্রেমময়, তেমনি অতি সম্মানের। যেমন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, মানুষের প্রতিটি কাজ তার নিজের জন্যইরোজা ছাড়া।

তা আমার জন্য, আমি নিজেই তার পুরস্কার দেব। আর রোজাদারদের মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মিসকের ঘ্রাণের চেয়ে বেশি সুগন্ধযুক্ত। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫৯২৭)

রোজাকে আল্লাহ নিজের দিকে সম্বোধন করে বলেছেন, রোজা আমার জন্য। যা একজন আল্লাহপ্রেমী মুমিনের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

মুহাদ্দিসরা বলেন, রোজা রিয়া বা প্রদর্শনপ্রিয়তামুক্ত হওয়ার কারণেই আল্লাহ তাকে নিজের দিকে সম্বোধন করেছেন। ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, অন্যান্য ইবাদতে রিয়া (অন্যকে দেখানোর আগ্রহ) থাকলেও রোজার ক্ষেত্রে তা নেই। রোজা সম্পর্কে শুধু আল্লাহই জানেন। এ জন্য আল্লাহ রোজাকে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছেন।
আর ইবনুল জাওঝি (রহ.) বলেন, প্রায় সব আমলই কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় এবং কাজগুলোর খুব কমই অন্যকে দেখানোর মোহ থেকে মুক্ত থাকে। কিন্তু রোজা এর বিপরীত। আল্লামা ইবনু আবদিল বার (রহ.) বলেন, অন্য সব ইবাদতের ওপর রোজার মর্যাদা প্রমাণের জন্য আল্লাহ বলেছেন, রোজা আমার জন্য। আবু উমামা (রা.)-কে রাসুলুল্লাহ (সা.) যেমনটি বলেছিলেন, তুমি রোজাকে আঁকড়ে ধরো, যেহেতু এর কোনো বিকল্প নেই। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২২২০)

পৃথিবীর ভালো কাজের প্রতিদান ও মন্দ কাজের শাস্তি আল্লাহ নিজে দেন।

তার পরও উল্লিখিত হাদিসে আল্লাহর ভাষ্যে বলা হয়েছে, আমি তার পুরস্কার দিই। হাদিসের ব্যাখ্যাকাররা বলেন, নিজে দেওয়ার দ্বারা রোজা বিশেষ মর্যাদা ও প্রতিদান প্রদান উদ্দেশ্য। ইমাম কুরতুবি (রহ.) বলেন, আমলের সাধারণ হিসাব আল্লাহ মানুষের সামনে প্রকাশ করে দিয়েছেন। আল্লাহ নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী আমলের প্রতিদান ১০ থেকে সাত শ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। রোজা এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ রোজাদারের জন্য সীমাহীন প্রতিদান রেখেছেন। এক বর্ণনা অনুসারে আল্লাহ বলেছেন, আমিই রোজার প্রতিদান হয়ে যাই। একজন মুমিনের জন্য এর থেকে প্রশান্তি ও পরিতৃপ্তির কথা কী হতে পারে যে আল্লাহ তার জন্য হয়ে যাবেন!

শায়খ ইবনে উসাইমিন (রহ.) বলেন, হাদিসটি নানাভাবে রোজার মর্যাদা প্রমাণ করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব আমলের মধ্যে রোজাকে নিজের জন্য বিশেষায়িত করেছেন। কেননা রোজার মাধ্যমে আল্লাহর জন্য বান্দার নিষ্ঠা প্রকাশ পায়। এ আমলের রহস্য আল্লাহ ও তাঁর বান্দা ছাড়া অন্যরা জানে না। সুতরাং আল্লাহর ভয়ে ও তাঁর প্রতিদান লাভের জন্য সে তা পরিহার করে। বান্দার এই নিষ্ঠার পুরস্কার হিসেবে আল্লাহ সব ইবাদতের মধ্যে নিজের বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ সবাইকে রোজার প্রশান্তি অর্জনের তাওফিক দিন।

মন্তব্য
রমজান ঐতিহ্য

মেসিডোনিয়ায় রমজানে সোনালি যুগের স্মৃতিচারণা

মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
মো. আবদুল মজিদ মোল্লা
শেয়ার
মেসিডোনিয়ায় রমজানে সোনালি যুগের স্মৃতিচারণা

পূর্ব ইউরোপের দেশ মেসিডোনিয়ার জনসংখ্যা তিন কোটি। যার ৪০ ভাগই মুসলিম। ইউরোপের অমুসলিম দেশগুলোর মধ্যে মেসিডোনিয়ায়ই মুসলিম জনসংখ্যার হার সবচেয়ে বেশি। স্পেনে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইউরোপের নানা দেশে মুসলিম ধর্মপ্রচারক ও জ্ঞানান্বেষীরা ছড়িয়ে পড়েন।

তাঁদের মাধ্যমে মেসিডোনিয়া সর্বপ্রথম ইসলামের পরিচয় লাভ করে। মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা সেখানে মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।

১৩৮২ খ্রিস্টাব্দে উসমানীয় শাসকরা মেসিডোনিয়া বিজয় করেন এবং তাঁদের সহযোগিতায় সেখানে দ্রুত ইসলাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত প্রথম বলকান যুদ্ধ পর্যন্ত তুর্কিরাই কার্যত মেসিডোনিয়া শাসন করে।

উসমানীয় শাসকরা মেসিডোনিয়ায় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। উসমানীয় শাসনামলে গড়ে তোলা পাঁচ শতাধিক মসজিদ এখনো মেসিডোনিয়ায় টিকে আছে।

মুসলিম শাসন অবসানের পর মেসিডোনিয়ার মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমেই কমতে থাকে। ১৯২১ থেকে ১৯৬১ সাল পর্যন্ত মুসলিম জনসংখ্যা ৩১ ভাগ থেকে ২৪ ভাগে নেমে আসে।

১৯৭১ সাল থেকে মুসলিম জনসংখ্যা আবারও বাড়তে থাকে। বর্তমানে মেসিডোনিয়ার মুসলিম জনসংখ্যার হার ৪০ ভাগ, যা ২০৫০ সাল নাগাদ ৫৬ ভাগে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। মেসিডোনিয়ার মুসলিম জনগণের বেশির ভাগই আলবেনীয় ও তুর্কি বংশোদ্ভূত। বাকিরা বসনিক ও স্থানীয়।

মেসিডোনিয়া ইউরোপিয়ান দেশ হলেও এখানকার মুসলিম জীবনে তুর্কি সংস্কৃতির প্রভাবই বেশি।

খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ধর্মীয় উদযাপন পর্যন্ত সব কিছুতেই তারা তুর্কি সংস্কৃতির অনুসারী। দীর্ঘদিন তুর্কি শাসনাধীন থাকায় এর প্রধান কারণ। মূলত তুর্কি রীতি রমজান উদযাপন করে মেসিডোনিয়ার মুসলিমরা তাদের সোনালি অতীতকেই স্মরণ করে থাকে।

বলকান অঞ্চলের মুসলিমদের মধ্যে মেসিডোনিয়ান মুসলিমরাই রমজানের আগমনে সবচেয়ে বেশি উল্লসিত হয়। মেসিডোনিয়ার সর্বস্তরের মুসলিম; এমনকি ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব ও পণ্ডিতরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিলে রমজানকে স্বাগত জানায়। সাধারণ মানুষের মাঝে উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদে মসজিদে ধর্মীয় আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। মসজিদে অনুষ্ঠিত আলোচনাসভায় বিশেষ অতিথিদের উপস্থিত করা হয়। কখনো কখনো বলকান অঞ্চলের অন্যান্য মুসলিম দেশ থেকে ইসলামিক স্কলারদের আমন্ত্রণ করা হয়।

বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমদের মতো রমজানে মেসিডোনিয়ান মুসলিমরাও ইবাদতে মনোযোগী হন। দিনরাতের দীর্ঘ সময় মসজিদে কাটায়। প্রতিটি মসজিদে তারতিলের সঙ্গে কোরআন খতম করা হয়। রমজান মাসে মেসিডোনিয়ার মুসলিমরা পারস্পরিক সম্পর্ক জোরালো করে। তারা পরস্পরের সঙ্গে দেখা করে উপহার দেয়। ধনীরা দরিদ্রদের মাঝে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে। তারা তুর্কিদের মতো তোপধ্বনিতে রমজানকে স্বাগত জানায় এবং মসজিদগুলোয় আলোকসজ্জা করে। বর্ণিল আলোয় সাজিয়ে তোলে মসজিদগুলোকে। শেষ রাতে সাহরির জন্য পরস্পর জাগিয়ে দেওয়াও একটি মেসিডোনিয়ান মুসলিম সংস্কৃতি।

মেসিডোনিয়ার মুসলিমরা সম্মিলিতভাবে ইফতার করতেই পছন্দ করে। তারা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ইফতারের আয়োজন করেন। প্রত্যেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী তাতে অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি ইফতারস্থলে শতাধিক মানুষ একত্র হয়। এসব ইফতার অনুষ্ঠানেই ধনীরা দরিদ্র ব্যক্তিদের হাতে তাঁদের জাকাত ও ফিতরার অর্থ তুলে দেন। রমজানের শুরু থেকেই তাঁরা জাকাত আদায় শুরু করেন। যেন দরিদ্র মুসলিমরা জাকাতের অর্থ পেয়ে স্বস্তির সঙ্গে রমজান কাটাতে পারে।

ইসলাম ওয়েব ডটনেক অবলম্বনে

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ