ঢাকা, শুক্রবার ১১ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, শুক্রবার ১১ এপ্রিল ২০২৫
২৭ চৈত্র ১৪৩১, ১১ শাওয়াল ১৪৪৬

বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা বিদেশি

সনৎ বাবলা
সনৎ বাবলা
শেয়ার
বাংলাদেশের ইতিহাসের সেরা বিদেশি

আফ্রিকান ফুটবলারের চোরাস্রোতে ভেসে যেতে বসেছিল ঢাকার ফুটবল। তাঁদের সর্বনাশা মিছিল যেন অতি দ্রুত গ্রাস করে নিচ্ছিল দেশের ফুটবলে বিদেশি ঝলকের ঐতিহ্যটা। আফ্রিকানদের সেই মিছিলে নীরবে ঢুকে পড়েছিলেন এক ফুটবল রাজপুত্র। কৃষ্ণবর্ণে আফ্রিকানদের সঙ্গে ভীষণ মেলে এই হাইতিয়ানের।

মেলে না মাঠের খেলায়, সেখানে সনি নর্দে আলাদা ফুটবলের সব ঐশ্বর্য নিয়ে। বোকা জুনিয়র একাডেমিতে আট বছরের ফুটবল বিদ্যা নিয়ে ঢাকায় আসা এই ফরোয়ার্ড। এক মৌসুম ঢাকা মাতিয়েছেন, এরপর কলকাতা সফরে গিয়ে এবার আলোড়ন তুলেছেন। সবুজ মাঠে ফুটবল শিল্পীর আঁকিবুঁকি দেখে জেগে উঠেছে তাদের সুপ্ত আকাঙ্ক্ষাটা, যেন রক্তশূন্য ফুটবলে শিল্পীর জিন সঞ্জীবন করতে হবে।
তাতে ঢাকা-কলকাতায় টানাটানি লেগেছে তাঁকে নিয়ে। এত বিদেশির ভিড়ে একজনকে নিয়েই যখন এত হুল্লোড়, দুই বঙ্গে এত সমাদর- তখন সনি নর্দেকে ঢাকার ফুটবলের বিদেশি রাজপুত্র বলাই যায়।

হালের ফুটবলে এ নিয়ে বোধ করি কারো দ্বিধা নেই। অন্তত ওপার বাংলার দুই পরাশক্তি মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের 'দাদাগিরি'র দম্ভচূর্ণ করার পর সনির ক্ষমতা নিয়ে আর সন্দেহ নেই।

ঘানার ওসেই মরিসন গত লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হলেও এ হাইতিয়ানের মহিমা অন্য। গোল হারজিতের নির্ণায়ক, সঙ্গে কিছু দুর্লভ মুহূর্তের যোগফলে ফুটবলটা হয়ে ওঠে মহার্ঘ্য বিনোদন আর তারই ফেরিওয়ালা সনি নর্দে। গভীর রাতে মেসি-জাদুতে মোহাবিষ্ট হলে পরের সন্ধ্যায় সনির আবেশ। 'সনি টিভিতে' মেসি দর্শন হয়ে যেতে পারে! এ তরুণ সবুজ মাঠে রং ছড়াতে ছড়াতে এগিয়ে যাচ্ছেন আর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন ঐতিহাসিক এক উচ্চতায়। ঢাকা মাঠের সেরা বিদেশির আসনখানি যে এরই মধ্যে তাঁর জন্য বরাদ্দ করেছেন অনেকে।
এই শুনে কেউ কেউ আবার অতীত পানে চান। স্মৃতি থেকে তুলে আনেন আশির দশকের এমেকা-জুকভ-নালজেগার-রহিমভ-করিম মোহাম্মদ-সামির শাকিরদের। তাঁদের জায়গা কোথায় হবে? সত্যিই তো, এত দিন এসব নামেই জাবর কাটত দেশের ফুটবলাঙ্গন, তাঁদের মাঠ রাঙানো পারফরম্যান্স সোনালি অতীতের একটি অংশ। কিন্তু সেই অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুল্যমূল্য বিচারটা করবে কে? যাঁরা সোনালি অতীতের সাক্ষী, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে সেসব বিদেশির মাঠের সতীর্থ তাঁরা এখন মাঠমুখী নন। হালের ফুটবলে নাক সিটকান। উপায় হলো, ফুটবল ক্যারিয়ার শেষে যাঁরা কোচ হয়ে বর্তমানকে দেখছেন, বিচার-বিশ্লেষণের ভার তাঁদের ওপরই।

মুক্তিযোদ্ধার কোচ শফিকুল ইসলাম মানিকের বিশ্লেষণে তাঁর সাদাকালো সতীর্থ এমেকা ইউজিগো সবার ওপরে। আশির দশকে এ নাইজেরিয়ানসহ অনেক বিদেশির সঙ্গে ও বিপক্ষে খেলেছেন তিনি। সেই সুবাদে বলছেন, 'আমার কাছে এমেকাই সেরা। তাঁর গতি ও মাঠজুড়ে খেলাটা দলের চেহারা পাল্টে দিত। মাঠে তাঁর উপস্থিতিই পুরো মোহামেডানকে উজ্জীবিত করত। ওই মানের না হলে তিনি নাইজেরিয়ার অলিম্পিক দল ও জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেতেন না।' প্রতিপক্ষ শিবিরের কোচ হিসেবে সনি-দর্শনেও তাঁর মুগ্ধতা আছে, 'পাঁচ সেরা বিদেশির তালিকা করলে অবশ্যই সনি থাকবেন। সেখানে করিম মোহাম্মদ, সামির শাকির, নালজেগারও থাকবে।'

ঢাকার ফুটবল শুরু থেকেই বিদেশিপুষ্ট। লঙ্কান-নেপালিদের এনে বিদেশির প্রচলন শুরু হলেও আশির দশকে দুর্দান্ত কয়েকজন বিদেশি ফুটবলার নতুন মাত্রা যোগ করেছিলেন ঘরোয়া ফুটবলে। '৮৭ থেকে '৮৯ পর্যন্ত মোহামেডানে খেলে গেছেন ইরানি নালজেগার ও বোরহানজাদে ও নাইজেরিয়ান এমেকা। আছেন ভিজেন তাহিরিসহ অনেকেই। প্রতিদ্বন্দ্বিরা ইরানে গেলে আবাহনী ঝুঁকে ইরাকে, নিয়ে আসে স্ট্রাইকার করিম মোহাম্মদ ও ডিফেন্ডার সামির শাকিরকে। '৮৭ সালে এক মৌসুমের কয়েকটি ম্যাচ খেলেই মাত করে দিয়েছিলেন ১৯৮৬ বিশ্বকাপ খেলা এই দুই ইরাকি। '৮৯ সালে বিদেশি ফুটবলারের দুয়ার রুদ্ধ করার পরের বছর থেকেই আবার অবারিত হয় এবং উজবেকিস্তানের রহিমভ (মোহামেডান) রুশ জুকভ-আরফিয়েভ (আবাহনী) জমে নতুন লড়াই। বলা হয়, জুকভের সঙ্গে খেলেই জাকিরের খেলায় শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে। ওই সোনালি সময়ের দর্শক মারুফুল হক এখন দেশের ফুটবলে সবচেয়ে সফল কোচ। শেখ রাসেলের এই কোচের বিচারে সোনালি অতীতকে ছাড়িয়ে সনি এগিয়ে, 'এমেকা-রহিমভ-সামির শাকির-করিম মোহাম্মদের খেলা আমি দেখেছি। তাঁরা ভালো, তবে সনির মতো একক নৈপুণ্যে ম্যাচ জেতানোর ক্ষমতা আমি দেখিনি। তখন আমাদের ভালো ফুটবলারের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি, তাঁদের সহযোগিতায় বিদেশিদের কাজটা সহজ হয়ে যেত। অথচ গত মৌসুমে আমরা চার-পাঁচটা কঠিন ম্যাচ জিতেছি শুধু সনির কৃতিত্বে, তাঁর একক নৈপুণ্যে।' হঠাৎ বল নিয়ে তার ভোঁ দৌড়ের অনেক নজির আছে ঢাকা মাঠে। চারদিক তেড়েফুঁড়ে গিয়ে শেষ পর্যন্ত গোল করেই থামেন। গত লিগে শেখ রাসেলের হয়ে ওরকম এক দৌড়ে প্রায় শূন্য ডিগ্রি থেকে বুটের ডগা দিয়ে বল তুলে দিয়েছেন বিজেএমসির জালে। তাঁর ফ্রি-কিকে কী বিধ্বংসী ক্ষমতা, সেটা মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে ভালো কে জানে। পাশে থেকে গত মৌসুমে তাঁর এমন সব কীর্তি দেখেছেন মামুনুল ইসলাম। জানেন রাসেলের ট্রেবল জয়ে এই বিদেশির ভূমিকা। দুজনই আবার একসঙ্গে দল বদল করে এবার শেখ জামাল ধানমণ্ডিতে, তবে সনি গেছেন সর্বোচ্চ ৭৩ হাজার ডলারে। বিনিময়ে নতুন মৌসুমের প্রথম টুর্নামেন্ট ফেডারেশন কাপ শিরোপা উপহার দিয়েছেন দলকে ও সাত গোল করে নিজে হয়েছেন টুর্নামেন্টসেরা। এরপর আইএফএ শিল্ডে সনি-দর্শন শেষে শেখ জামাল অধিনায়ক মামুনুল ইসলামের বিস্ময় আরো বেড়েছে, 'সনি মাঝেমধ্যে বল নিয়ে এমন সব কাণ্ড করেন যা আমরা কখনোই পারব না। আমাদের সৌভাগ্য তাঁর মতো ফুটবলারের সঙ্গে খেলার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের বিদেশি ফুটবলারদের ইতিহাসে তিনিই সেরা বিদেশি।' আইএফএ শিল্ডে চার গোল করে টুর্নামেন্টসেরা এই হাইতিয়ান ফরোয়ার্ডের ক্ষমতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই শেখ জামাল কোচ যোশেফ আফুসির মনে। তিনি বলেন, 'ভারতের বিদেশিদের দেখেছি। ভারত-বাংলাদেশ মেলালে এখন তিনিই সেরা বিদেশি। তিনি আসলে ঈশ্বর-প্রদত্ত ফুটবলার, তাঁর ক্লাস অনেক অনেক ওপরে।'

এমন ফুটবলার কী বুঝে যে ঢাকায় এসেছিলেন, কে জানে। তবে শেখ রাসেলকে ধন্যবাদ এরকম এক ফুটবল শিল্পীকে এনে নতুন উন্মাদনা তৈরি করার জন্য। গত দেড় মৌসুমে ২৩ গোল করা ২৪ বছর বয়সী এ ফরোয়ার্ডকে সেরার আসনে রাখতে গিয়ে কোচ সাইফুল বারী দ্বিধায় পড়েছেন। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিদেশির সঙ্গে খেলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা তাঁর আবাহনীর সামির শাকিরে। আর হালের সনিও তার কাছে ফুটবল প্রাচুর্যের প্রতীক। কিন্তু কোচ হিসাবে তিনি দুটি সময়ের তারকাদের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারছেন না। সময় যেমন আলাদা, সামগ্রিক ফুটবল মান এবং ট্যাকটিকসও আলাদা। তাই সেরা বিদেশি বাছাইয়ের বিতর্কে না গিয়ে জাতীয় দলের সাবেক কোচ বলেছেন মেসির সঙ্গে সনির খেলার সাযুজ্যের কথা, 'মেসির খেলার একটা ধরন হলো, হঠাৎ গতি বাড়ানো। খেলছে খেলেছে কিন্তু হঠাৎ অ্যাটাকিং থার্ডে তীব্র গতিতে ছুটে ফিনিশ করে আসে। সনির খেলার মধ্যেও এই জিনিসটা আছে, পরের কয়েক সেকেন্ডে কী করবে সেটা যেন আগে থেকেই বুঝতে পারে। নিঃসন্দেহে এই সময়ের সেরা বিদেশি।' কোচিং লাইনে সাইফুলের উত্তরসূরি জুলফিকার মাহমুদ মিন্টুও পারেননি একজনকে সেরার স্বীকৃতি দিতে। জাতীয় দলের সাবেক এ ফুটবলার কঠিন ডিফেন্ডারদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে চান হাইতিয়ান ফরোয়ার্ডকে, 'এখনকার ফুটবলে মুন্না ভাই কিংবা কায়সার ভাইদের মতো ডিফেন্ডার নেই। তাদের সঙ্গে পরীক্ষায় সনি উত্তীর্ণ হলে ...।' তখন হয়তো চোখ বন্ধ করে সনিকে এগিয়ে রাখতে পারতেন।

আবাহনীর কোচ অমলেশ সেনের মনেও দ্বিধা আছে এ হাইতিয়ানকে সেরাদের সেরার স্বীকৃতি দিতে। নিজে সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলেছেন, পাশাপাশি কোচিং করিয়েছেন দলকে। পক্ষে-বিপক্ষে অনেক বিদেশিকে দেখেছেন তবে মনটা ঘুরপাক খাচ্ছে জুকভ-সামির শাকিরদের বৃত্তে। সেই '৯১-'৯২ মৌসুমে আবাহনীতে আসা জুকভের মঝামাঠের সঙ্গী জাকির হোসেনের বিশ্লেষণে, 'সনিকে বড় জোর অ্যাটাকিং পজিশনের সেরা বিদেশি বলা যায়। আগে তার চেয়েও ভালো বিদেশি এসেছে, কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের এখনকার ফুটবল মানের ফারাক বড় হওয়ায় তার খেলাটা খুব বেশি চোখে পড়ছে।'

এরকম ব্যাখ্যায় গেলে ম্যারাডোনার কীর্তিও চাপা পড়ে যায়! সতীর্থদের কারণে এই কিংবদন্তিকে বেশি করে চোখে পড়েছিল! আবার পেলের সময়ে ঠিক উল্টো। ব্রাজিলের দলটি ছিল গোলাপের বাগান, তার মধ্যেও সবচেয়ে মোহনীয় রূপে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যাওয়া মতো খেলেছেন তিনি। কিন্তু সেটাকেও তো ক্ষুণ্ন করা যায় সতীর্থদের কারিগরি সহযোগিতার দোহাই দিয়ে। এসব আসলে কোনো ফুটবল জাদুকরের গভীরতা মাপার মাপকাঠি নয়। শেষ কথা হলো দর্শক মনোরঞ্জন- প্রত্যাশার চেয়েও বেশি দিয়ে মানুষের মনকে অদ্ভুত ভালো লাগায় আচ্ছন্ন করে দেওয়া। এখানেই দুর্ভাগা সনি নর্দে, তাঁর রূপের আগুনের আঁচ নেওয়ার দর্শক নেই ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে।

নাম : সনি নর্দে

দেশ : হাইতি

জন্ম : ২৭ জুলাই ১৯৮৯

ক্যারিয়ার : বোকা জুনিয়র্স একাডেমি (আর্জেন্টিনা, ২০০৮),

স্যান লুইস (মেক্সিকাে, ২০০৯-১০), এস্তুদিয়ান্তেস দ্য আলতামিরা (২০১১-১২), শেখ রাসেল (২০১২-১৩), শেখ জামাল (২০১৩-)

অর্জন :

* ট্রেবল জিতিয়েছেন শেখ রাসেলকে

* শেখ জামালের হয়ে জিতেছেন ফেডারেশন কাপ

* ৭ গোল করে হয়েছেন ফেডারেশন কাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা

* জিতেছেন আইএফএ শিল্ডের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

সর্বশেষ সংবাদ