অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকার বেশি ব্যয় ধরে সাত প্রকল্প অনুমোদনের পর এ খাতে আরো আটটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।
দেশীয় গ্যাসের ব্যবহার বাড়িয়ে আমদানিনির্ভরতা কমানোর লক্ষ্যে প্রস্তাবিত এসব প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার বেশি।
এসব প্রকল্পের মাধ্যমে জরিপ, অনুসন্ধানমূলক কূপ খনন ও গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি রিগ ক্রয়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়ানো ও গ্যাস ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া হবে। জ্বালানি সম্পদ বিভাগের প্রস্তাবগুলো অনুমোদনের সুবিধার্থে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) অননুমোদিত প্রকল্পের তালিকায় রেখেছে পরিকল্পনা কমিশন।
এর মধ্যে কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগে পাঠানো হয়েছে। যেগুলো অনুমোদনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি প্রকল্পেগু চার হাজার ৯৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে জরিপ ও অনুসন্ধানের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
আর দুটি প্রকল্পে ৮৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ও বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের অনুসন্ধান সক্ষমতা বাড়ানো হবে।
এ ছাড়া ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও আশপাশের এলাকায় গ্যাস সরবরাহের নেটওয়ার্ক উন্নত করতে এবং লিকেজ প্রতিরোধ করতে সাত হাজার ৯০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানি লিমিটেডের অবকাঠামো উন্নয়নে একটি প্রকল্পও নেওয়া হবে।
মূলত অর্থনৈতিক সংকটের এই সময় অন্তর্বর্তী সরকার প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলনে জোর দিয়েছে। টানা বিদ্যুৎ সরবরাহ না পাওয়ায় দেশের বেশির ভাগ কারখানায় দিন দিন গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। আবাসিক সরবরাহ ছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার কারখানা, শিল্পসহ সব খাতে বেড়েছে গ্যাসের চাহিদা।
এই ঘাটতি মেটানোর নামে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকে ঝোঁকে আওয়ামী লীগ সরকার। ছয় বছরের ব্যবধানে দেশে দ্বিগুণ হয়েছে গ্যাসের চাহিদা। কিন্তু গ্যাস উৎপাদন সেভাবে নেই। তাই আমদানি কমাতে দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে জোর দিচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানান, চলমান জ্বালানি সংকটের মধ্যে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এর মধ্যে ১৫টি কূপ খনন করে ১৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট প্রতিদিন উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মিলেছে। তবে পাইপলাইন না থাকায় এখন ৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট দেওয়া হয়েছে জাতীয় গ্রিডে। তিনি বলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে আরো ৩৫টি কূপ খনন করা হবে। ২০২৮ সালের মধ্যে ১০০টি গ্যাসকূপ খনন করা হবে।
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা এসব প্রকল্পকে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান বাড়ানোর ইতিবাচক উদ্যোগ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা বলছেন, এসব প্রকল্প আমদানি ব্যয় ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাবে। তা ছাড়া দেশীয় গ্যাসের মজুদ ব্যবহার নিশ্চিত হলে সরকারের আর্থিক সক্ষমতাও বাড়বে। তবে তাঁরা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে সরকারি অর্থের অপচয় রোধ করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে তিনটি সিসমিক জরিপ, ছয়টি অনুসন্ধানমূলক কূপ, দুটি গভীর অনুসন্ধানমূলক কূপ এবং পাঁচটি মূল্যায়নমূলক কূপ খনন করা হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আটটি প্রকল্পের জন্য ৯ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা (৬৯ শতাংশ) দেশীয় উৎস থেকে এবং বাকি চার হাজার ২০৪ কোটি টাকা বিদেশি ঋণ থেকে সংগ্রহ করা হবে।
গত আগস্ট থেকে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) অন্তত সাতটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে, যার মোট ব্যয় তিন হাজার ৮২৭ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এক দশক ধরে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ রেখে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির দিকে ঝুঁকেছিল। নতুন সরকার দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি বাপেক্সকে শক্তিশালী করতে চায়, যাতে বিদেশি কম্পানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়।
কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি অধ্যাপক এম শামসুল আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, গত এক দশকে দেশীয় সম্পদ কাজে না লাগিয়ে আমদানিনির্ভরতা বাড়ানোর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন গ্যাস অনুসন্ধান বাড়াতে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও দক্ষতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, দুর্নীতির কারণে অনেক প্রকল্পেগু ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। তাই প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রস্তাবিত হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা ফিল্ডে ৩-ডি সিসমিক সার্ভে শীর্ষক প্রকল্পে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৫৪ কোটি টাকা। এর আওতায় ২০২৭ সালের জুন মাসের মধ্যে তিনটি সার্ভে পরিচালনা করা হবে।
তিতাস ও বাখরাবাদ ফিল্ডে দুটি গভীর অনুসন্ধান কূপ খনন প্রকল্পে মোট ৭৯৮ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। চারটি মূল্যায়ন-কাম-উন্নয়ন কূপ (শাহবাজপুর ৫, ৭, ভোলা নর্থ ৩, ৪) এবং একটি অনুসন্ধান কূপ (শাহবাজপুর নর্থ ইস্ট ১) খনন প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। এক হাজার ২৬৮ কোটি টাকা ব্যয় করে তিনটি অনুসন্ধান কূপ (শ্রীকাইল ডিপ ১, মোবারকপুর ডিপ ১ এবং ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ ১) খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে।
একটি মূল্যায়ন-কাম-উন্নয়ন কূপ (বেগমগঞ্জ ৫) এবং দুটি অনুসন্ধান কূপ (বেগমগঞ্জ ৬ ও সুনেত্র ২) খনন প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ৮৬০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের শিল্প ও শক্তি বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমদানি ব্যয় কমাতে সরকার প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন ও এ ধরনের প্রকল্পকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। পরবর্তী একনেকে তিনটি প্রকল্প তোলা হচ্ছে। আরো কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে পর্যালোচনা চলছে। যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলোও একনেকের জন্য সুপারিশ করা হবে।
গত ছয় অর্থবছরে এক লাখ ৬৪ হাজার ২৭৫ কোটি টাকার ৫৭.৮২ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে যেখানে ১০.১৫ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে। করোনার ধাক্কার পর মাত্র এক মিলিয়ন বেশি এলএনজি আমদানিতে তিন গুণ বেশি সাড়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা খরচ করতে হয়েছে।
গত অর্থবছরে ১১.৬৭ মিলিয়ন ঘনমিটার এলএনজি আমদানিতে ৪২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অর্থাৎ সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ শুধু এলএনজি আমদানিতেই চলে যাচ্ছে। গত ছয় বছরে ২৬ হাজার ২১৫ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে এ খাতে। বাকি এক লাখ ৩৮ হাজার ৬০ কোটি টাকা ব্যয় মেটানো হয়েছে গ্যাসের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে।