ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মীরা গতকাল সোমবার কর্মবিরতি পালনকালে প্রায় আড়াই ঘণ্টা যাত্রীরা বিনা ভাড়ায় মেট্রো রেলে ভ্রমণ করেছে। ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) পুলিশ সদস্যদের দ্বারা মৌখিক ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়ার প্রতিবাদে গতকাল পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, ছয় দফা দাবিতে সকাল ৭টা থেকে কর্মবিরতি শুরু করেন কর্মীরা। পরে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা কাজে ফেরেন।
কর্মসূচি স্থগিতের বিষয়ে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক জানান, অভিযোগ ওঠা এমআরটি পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ ছয়টি দাবিতে এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
ঘটনা তদন্তে মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই সঙ্গে একজন এসআইসহ সংশ্লিষ্ট দুজনকে সাময়িক বরখাস্তের চিঠি দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে কর্মস্থলে ফিরেছেন ডিএমটিসিএলের কর্মীরা।
জানা যায়, কর্মীদের কর্মবিরতির কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকার কথা ছিল।
তবে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে সকাল থেকে ট্রেন চললেও স্টেশনগুলোতে দায়িত্ব পালন করেননি মেট্রো রেলের কর্মীরা। এতে সকাল থেকে যাত্রীরা অনেকে বিনা টিকিটে মেট্রো রেলের ট্রেনে ভ্রমণ করে।
এর আগে গত রবিবার রাত ৩টার দিকে ‘ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেডের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের’ ব্যানারে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনা তুলে ধরে ছয়টি দাবি জানানো হয়।
মেট্রো রেলকর্মীরা বলেন, ‘রাতে আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল সকাল থেকে ট্রেন চালাব না।
কিন্তু কর্তৃপক্ষ রাতভর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। এ ছাড়া রোজার সময় যাত্রীদের আমরা কষ্ট দিতে চাইনি। তাই সকাল থেকে আমরা ট্রেন চালিয়েছি। আমরা জানতে পেরেছি, দোষী পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
কর্মীদের দাবিগুলোর মধ্যে ছিল এক কার্যদিবসের মধ্যে ঘটনার মূল হোতা পুলিশ সদস্যকে (এসআই মাসুদ) স্থায়ীভাবে বরখাস্ত করা এবং ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত সব পুলিশ সদস্যকে (কনস্টেবল রেজনুল, ইন্সপেক্টর রঞ্জিত) শাস্তি প্রদান এবং তাঁদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে; মেট্রো রেল, মেট্রো স্টাফ ও যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য নিজস্ব সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে হবে; এমআরটি পুলিশকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে; স্টেশনে দায়িত্বরত সিআরএ টিএমও, স্টেশন কন্ট্রোলারসহ অন্য সব কর্মীর শতভাগ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; অফিশিয়াল পরিচয়পত্র ছাড়া ও অনুমতি ব্যতীত কোনো ব্যক্তি যেন স্টেশনের পেইড জোনে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং আহত কর্মীর সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়, রবিবার বিকেল সোয়া ৫টায় দুজন নারী পরিচয়পত্র না দেখিয়ে সিভিল ড্রেসে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করে এসে ইএফও অফিসের পাশে থাকা সুইং গেট ব্যবহার করে পেইড জোন থেকে বের হতে চান। যেহেতু তারা নির্ধারিত ইউনিফর্মে ছিলেন না এবং তাঁদের পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি, তাই দায়িত্বপ্রাপ্ত সিআরএ নিয়ম অনুযায়ী তাঁদের সেখান থেকে পিজি গেট ছাড়া সুইং গেট দিয়ে বের হওয়ার কারণ জানতে চান।
সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা এতে উত্তেজিত হয়ে তর্কে লিপ্ত হন এবং এক পর্যায়ে এমআরটি পুলিশের কন্ট্রোলরুমে চলে যান।
পরে একইভাবে দুজন এপিবিএন সদস্য সুইং গেট ব্যবহার করে গেট না লাগিয়ে চলে যান। তাঁদের কাছে এর কারণ জানতে চাওয়া হলে তাঁরা আগের ঘটনার জের ধরে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিছুক্ষণ পর পুলিশ কন্ট্রোলরুম থেকে আরো কয়েকজন পুলিশ এসে দায়িত্বে থাকা সিআরএর সঙ্গে ইএফওতে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এবং ইএফও থেকে বের হওয়ার সময় কর্মরত সিআরএ এর কাঁধে বন্ধুক দিয়ে আঘাত করেন এবং কর্মরত আরেকজন টিএমওর শার্টের কলার ধরে জোরপূর্বক এমআরটি পুলিশ বক্সে নিয়ে গিয়ে মারধর করে গুলি করার জন্য বন্দুক তাক করেন।
উপস্থিত স্টেশন স্টাফ ও যাত্রীরা কর্মরত টিএমওকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। আহত সিআরএকে তাত্ক্ষণিক চিকিৎসা প্রদান করার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং টিএমও (যাকে পুলিশ কন্ট্রোলরুমে হেনস্তা করা হয়) এ ঘটনার বিবৃতি দেওয়ার পর বাসায় যাওয়ার পথে জ্ঞান হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আংশিক কর্মবিরতি পালন, বিনা ভাড়ায় মেট্রো রেল ভ্রমণ কর্মীদের আংশিক কর্মবিরতি পালন করার কারণে গতকাল অনেক যাত্রী বিনা ভাড়ায় মেট্রো রেল ভ্রমণের সুযোগ নিয়েছেন। সকাল থেকে মেট্রো রেলের সব স্টেশনে প্যাসেঞ্জার গেটে (পিজি গেট) এমআরটি বা র্যাপিড পাস ব্যবহার করতে পারেনি যাত্রীরা। গেটগুলোতে মেট্রো রেলের কোনো কর্মী ছিলেন না। কয়েক জায়গায় শুধু আনসার সদস্যদের দেখা যায়।
সকাল ৭টা ১০ মিনিটে পল্লবী স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, তখনো কলাপসিবল গেটগুলো বন্ধ। টিকিট কাউন্টারও ফাঁকা। প্রবেশ ও বহির্গমন গেটগুলো উন্মুক্ত। তবে কর্মবিরতি পালন করলেও কর্মস্থলে হাজির ছিলেন ডিএমটিসিএল কর্মীরা। কর্মস্থলের পাশে দাঁড়িয়েই তাঁরা কর্মসূচি পালন করছিলেন। টিকিট কাউন্টার বন্ধ থাকায় এ সময় এমআরটি পাস ছাড়া যাত্রীদের প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে প্রবেশপথগুলো উন্মুক্ত থাকার কারণে এ সময় অনেক যাত্রীকে টিকিট ছাড়াই মেট্রো রেলে ভ্রমণ করতে দেখা গেছে। এমআরটি পাস কার্ড থাকলেও অনেক যাত্রী তা ব্যবহার করেননি।
সরকারি চাকরিজীবী জালিজ মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, মতিঝিলে যাওয়ার উদ্দেশে পল্লবী স্টেশনে এসেছি। এ সময় মেট্রো রেলের কর্মীদের উপস্থিতি দেখা গেলেও তাঁদের কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি। এই সুযোগে অনেকে টিকিট ছাড়াই ভ্রমণ করেন। আবার অনেকে প্রবেশের সময় কার্ড পাঞ্চ করলেও বের হওয়ার সময় পাঞ্চ করার সুযোগ পাননি।
ডিএমটিসিএলের পরিচালক (প্রশাসন) এ কে এম খায়রুল আলম বলেন, ঘটনার পর ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুক আহমেদ ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রউফ (বর্তমানে সেতু সচিব) সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগে কথা বলেছেন। তারা পুরো বিষয়টি দেখভাল করছেন। বিষয়টির সুরাহা করা যাবে।