ভোলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া একসময়ের খরস্রোতা বেতুয়া নদীই আজ ভোলা খাল নামে পরিচিত। আগে প্রমত্তা মেঘনা ও পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদীর সংযোগকারী বেতুয়ার বুকজুড়ে গড়ে উঠেছিল ভোলা শহর। গত কয়েক দশকে এ খালটি দখল ও দূষণের কারণে বর্তমানে ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খোদ ভোলা পৌরসভা সরকারি এ খালটি দখল করে অবৈধভাবে শতাধিক দোকান করে ভাড়া দিয়েছে।
পৌরসভা সর্বশেষ স্থানীয় একটি এনজিওকে খালটিকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছে। ওই সংস্থাটি রক্ষণাবেক্ষণের নামে খালের ওপর একটি ভাসমান রেস্টুরেন্ট করেছে। রেস্টুরেন্টটি গত ৫ আগস্টের পর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে উদ্বোধন করা হয়েছে। এদিকে খালটি দখলমুক্ত করে খননের দাবিতে গত বৃহস্পতিবার সকালে ভোলা প্রেস ক্লাবের সামনে সচেতন মহলের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়।
স্থানীয় বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, খালটির এ অবস্থার পেছনে প্রধানত দায়ী ভোলা পৌরসভা। পৌরসভার সাবেক মেয়র মনিরুজ্জামান ২০১২ সালে মেয়র নির্বাচিত হয়ে শহরের কাঁচাবাজার এলাকায় খালের পশ্চিম পার দখল করে পৌরসভার অর্থায়নে প্রায় শতাধিক আধাপাকা দোকান করে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ভাড়া দিয়েছেন। এর বেশির ভাগ টাকা ঢুকেছে মেয়রের পকেটে। এ ছাড়া তিনি শহরের নতুন বাজার এলাকায় খালের ওপর থাকা উঁচু সিঁড়ি ব্রিজ ভেঙে একটি নিচু কালভার্ট তৈরি করে খালটিতে নৌকা চলাচল একেবারে বন্ধ করে দিয়েছেন।
পরবর্তী সময়ে একে একে খালটির ওপরে থাকা তিনটি উঁচু সেতু ভেঙে আরো তিনটি নিচু সেতু নির্মাণ করেছেন। খাল খনন ও দুই পাশে সড়ক নির্মাণের নামে খালটিকে ড্রেনে পরিণত করেছেন। বিদেশি বিভিন্ন প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা খরচ করে খালটি খনন ও সৌন্দর্য বর্ধনের নামে লুটপাট করেছেন।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) ভোলা খাল রক্ষায় ভূমি মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব, নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান, পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী পরিচালকসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠানের প্রধানের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন। আদালত ২০১৫ সালের ৪ মে ভোলা পৌরসভাসহ ১৪টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে খালটি দখল ও দূষণমুক্ত করার নির্দেশ দেন।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে কয়েকটি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে অন্যগুলো আর উচ্ছেদ করা হয়নি।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, খালটির সর্বমোট দৈর্ঘ্য ১২ কিলোমিটার। সিএস জরিপে খালটির প্রস্থ ছিল ৫০ ফুট। এসএস জরিপে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে সর্বোচ্চ ৬৫ ফুট ও সর্বনিম্ন ৩০ ফুট। বর্তমানে খালটি আছে সর্বোচ্চ ৪০ ফুট ও সর্বনিম্ন ১৮ ফুট। এটি মেঘনা থেকে শিবপুর, রতনপুর, ভোলা পৌরসভার চরজংলা, বাপ্তা, চরনাপ্তা, চরনোয়াবাদ, সদুরচর ও পূর্বচরকালী মৌজা হয়ে খেয়াঘাট নদে মিশেছে। জেলা প্রশাসকের নির্দেশে ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) অবৈধ দখলদারের একটি তালিকা করেন। তখন ২৫৫ জন দখলদার ছিলেন। সেই সংখ্যা এখন আরো বেড়েছে।
ভোলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জিয়া উদ্দিন আরিফ জানান, ভোলা খালটি খননের জন্য এরই মধ্যে সার্ভে করা হয়েছে। সার্ভে করা ডেটা প্রসেসিং চলছে। এটি শেষ হলে ডিজাইনের জন্য পাঠানো হবে। আর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যাপারে জেলা প্রশাসন থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ভোলার স্থানীয় সরকার শাখার উপপরিচালক ও ভোলা পৌরসভার প্রশাসক মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘খালটি যাতে সচল হয় সে জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, প্রধান উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছি। সেই সঙ্গে অবৈধ দখলদারদের তালিকাও দিয়েছি। পানি উন্নয়ন বোর্ড খালটি নিয়ে কাজ করছে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগেই খালটি খনন করা হবে।’
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান জানান, খালটি দখলমুক্ত করে এরই মধ্যে দখলদারদের তালিকাসহ সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। খুব শিগগির খালটি দখলমুক্ত করে খনন করা হবে।