বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২-এর বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে—‘‘Our planet, our health’, যা বাংলায় ‘আমাদের গ্রহ, আমাদের স্বাস্থ্য’। যখন জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক মহামারিতে গোটা পৃথিবী বিপর্যস্ত তখন এই প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও জরুরি।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার এক বছর পর ১৯৪৬ সালে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রূপরেখা তৈরির জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিশন গঠন করা হয়। অন্তর্বর্তীকালীন এই কমিশনের মতামতের আলোকে ১৯৪৮ সালের ৭ এপ্রিল গঠন করা হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও)।
মানুষের সুস্থতা নিশ্চিত করা এবং জীবন রক্ষার শপথে পরিচালিত হতে থাকে সংস্থাটি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম সম্মেলনটি হয়েছিল প্রতিষ্ঠার দুই মাসের মাথায়, ১৯৪৮ সালের ২৪ জুন। নির্ধারিত দিনে জেনেভায় সংস্থাটির প্রথম সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ৪৬টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। উপস্থিত প্রতিনিধিদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়।
সেই সম্মেলন থেকেই সিদ্ধান্ত হয় বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসচেতনতা তৈরিতে ১৯৫০ সালের ৭ এপ্রিল থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হবে। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠা দিনের সঙ্গে মিল রেখেই ৭ এপ্রিল নির্ধারণ করা হয়।
প্রতিবছর সংস্থাটি পৃথিবীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বাস্থ্য ইস্যু বেছে নেয়, যার মাধ্যমে সেদিন স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয় দিবসটি। ১৯৫০ সালের প্রথম স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল—‘নো ইওর হেলথ সার্ভিসেস’ অর্থাত্ ‘নিজের স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে সচেতন হোন।
’ এভাবে এখন পর্যন্ত ৭ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। বাংলাদেশেও সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে থাকে। সেই ১৯৫০ সাল থেকেই সারা বিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বার্তা নিয়ে প্রতিবছর পালিত হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস।
একটি ভয়ংকর বৈশ্বিক মহামারির মধ্যে আমদের প্রিয় গ্রহ পৃথিবীতে ক্যান্সার, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, হূদরোগের মতো রোগ বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২২-এ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা গ্রহকে সুস্থ রাখার জন্য প্রয়োজনীয় জরুরি পদক্ষেপগুলোর ওপর বিশ্বব্যাপী মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করবে এবং সমাজ গঠনের জন্য একটি আন্দোলন গড়ে তুলবে, যাতে সুস্থতার ওপর সবার দৃষ্টি নিবন্ধিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মৃত্যু পরিহারযোগ্য পরিবেশগত কারণে হয়। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু সংকট, যা মানবতার মুখোমুখি একক বৃহত্তম স্বাস্থ্য হুমকি। মনে রাখতে হবে, জলবায়ু সংকটও একটি স্বাস্থ্য সংকট।
আমাদের অনেক রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিক সিদ্ধান্ত জলবায়ু ও স্বাস্থ্য সংকটকে প্রভাবিত করছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর ফলে ৯০ শতাংশেরও বেশি মানুষ অস্বাস্থ্যকর বাতাসে শ্বাস নেয়। একটি উত্তপ্ত বিশ্ব দেখছে যে মশা আগের চেয়ে অনেক বেশি এবং দ্রুত রোগ ছড়াচ্ছে। চরম আবহাওয়ার ঘটনা, জমির ক্ষয়, পানির অভাব মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে এবং তাদের স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিকদূষণ আমাদের গভীরতম মহাসাগর এবং সর্বোচ্চ পর্বতমালার জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। আমাদের খাদ্য শিকলেও দূষণ পথ তৈরি করেছে। যে ব্যবস্থায় প্রক্রিয়াজাত, অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয় উত্পাদন করা হচ্ছে, তাতে স্থূলতা বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের এক-তৃতীয়াংশ তৈরি করে ক্যান্সার এবং হূদরোগ বাড়াচ্ছে।
কভিড-১৯ মহামারি আমাদের বিজ্ঞানের নিরাময় শক্তি দেখিয়েছে, পাশাপাশি আমাদের বিশ্বের বৈষম্যগুলোও তুলে ধরেছে। মহামারিটি সমাজের সব দুর্বলতা প্রকাশ করেছে এবং টেকসই সুস্বাস্থ্যের সমাজ গঠন যে জরুরি, তা প্রকাশ করেছে। এখন ভবিষ্যত্ প্রজন্মের জন্য ন্যায়সংগত সুস্বাস্থ্য অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। অর্থনীতির বর্তমান কাঠামো আয়, সম্পদ ও ক্ষমতার অসম বণ্টনের দিকে পরিচালিত হচ্ছে, যেখানে অনেক মানুষ এখনো দারিদ্র্য ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে বসবাস করছে। একটি সুস্বাস্থ্যের অর্থনীতির লক্ষ্য হিসেবে মানুষের কল্যাণ, সমতা ও পরিবেশগত স্থায়িত্ব থাকে। এই লক্ষ্যগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, কল্যাণ বাজেট, সামাজিক সুরক্ষা এবং আইনি ও আর্থিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। গ্রহ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ধ্বংসের এই চক্রগুলো ভাঙার জন্য আইনি পদক্ষেপ, করপোরেট সংস্কার এবং ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর পছন্দ করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ ও উত্সাহিত করা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তন কেন হলো? শিল্পায়ন ও জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহারের ফলে অতিমাত্রায় কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস নির্গমনের কারণে গ্রিনহাউস গাসের ঘনত্ব বেড়ে যায়। এ কারণে জলবায়ু পরিবর্তন হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবগুলোর মধ্যে রয়েছে—১. বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, ২. চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া, ৩. সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ৪. উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চল ও হিমবাহের বরফ, ৫. বিশ্বে তাপপ্রবাহ, ৬. দাবানল, ৭. বন্যা, ৮. ভূমিধস, ৯. বিস্তীর্ণ এলাকায় প্লাবন, ১০. স্বাস্থ্যঝুঁকি বৃদ্ধি, ১১. ৬৩ কোটি মানুষের বাস্তুচ্যুতির সম্ভাবনা। পাশাপাশি উজাড় হয়েছে বন এবং ধ্বংস হয়েছে পরিবেশ। বন ও সমুদ্র মিলে বেশির ভাগ কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে। গ্রিনহাউস গ্যাসের প্রধান উপাদান হচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও মিথেন গ্যাস।
জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে করণীয়—বন রক্ষা করতে হবে, কার্বন ও মিথেন গ্যাস নিঃসরণ কমাতে হবে। এ ছাড়া বৈশ্বিক তাপমাত্রার বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত রাখতে হবে। বন্ধ করতে হবে কয়লার ব্যবহার। বন উজাড় বন্ধ করে নতুন বনায়ন করতে হবে। তেল-গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে ব্যবহার করতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। পূর্বাভাসব্যবস্থা, জলবায়ুসহিষ্ণু অবকাঠামো, শুষ্ক এলাকায় চাষাবাদ এবং পানি ব্যবস্থাপনায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগের মাধ্যমে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উল্লিখিত কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত তহবিল। দায়ী উন্নত দেশগুলো প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদান করতে হবে। জাতীয়ভাবে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা (এনডিসি) নির্ধারণ এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে।
‘আমাদের গ্রহ, আমাদের স্বাস্থ্য’ রক্ষা করতে হলে দেশের সরকার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, সামাজিক শক্তি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আমাদের গ্রহে সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে—১. সব রাষ্ট্রীয় নীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি মানবকল্যাণ এবং পরিবেশগত স্থিতিশীলতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। ২. তেল-গ্যাসের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে ব্যবহার করতে হবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি। ৩.
WHO-র বায়ু মানের নির্দেশিকা বাস্তবায়ন করতে হবে। ৪. শরীরচর্চা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করে এমন সবুজ স্থান তৈরি করতে হবে। ৫.
WHO-র সবুজ ঘোষণাপত্র গ্রহণ এবং অঙ্গীকার করতে হবে। ৬. সব পরিবেশ ধূমপানমুক্ত করতে হবে। ৭. বর্জ্য ও প্লাস্টিক হ্রাস নীতি তৈরি করে দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। ৮. শ্রমিকদের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে হবে। ৯. পাবলিক স্পেসে অস্বাস্থ্যকর খাবার ও পানীয়ের বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ১০. স্থানীয় উত্পাদকদের কাছ থেকে তাজা পণ্য কিনতে হবে এবং উচ্চ প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলতে হবে। ১১. প্লাস্টিকের বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে।
আমরা এমন একটি বিশ্বের স্বপ্ন দেখতে চাই এবং যার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বাস্তবায়ন করতে চাই যেখানে নির্মল বাতাস, পানি ও খাবার সবার জন্য সহজপ্রাপ্য হবে। আমরা এমন একটি অর্থনীতি দেখতে চাই, যা হবে স্বাস্থ্য ও মানুষের কল্যাণনির্ভর। আমরা সব শহর বাসযোগ্য দেখতে চাই, যেখানে মানুষ তাদের স্বাস্থ্য এবং গ্রহের স্বাস্থ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সরকারি উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন
লেখক : অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
kamrulkhn@gmail.com