পতিত হাসিনা সরকারের দীর্ঘ শাসনকালের একটা সময়ে, সম্ভবত শুরু থেকে মাঝামাঝি কোনো অবস্থায়, দেশের কোনো একটি গণমাধ্যমে একটি চমৎকার স্লোগান দেখতে পেতাম। সেটি হচ্ছে : ‘আপনি বদলে যান, সমাজ বদলে যাবে।’ চারিত্রিক দিক থেকে আমরা সবাই যদি পরিশুদ্ধ হতে পারি, তাহলে সমাজ, জাতি বা দেশ স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বদলে যাবে। এটি আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনের একটি উল্লেখযোগ্য দিকও।
দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই তাদের প্রত্যাশিত নির্বাচনটি সম্পন্ন করতে চায়। সেই লক্ষ্যে তারা নির্বাচনের একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে। সে লক্ষ্যে আগামী ১৬ এপ্রিল বিএনপি নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার একটি সাক্ষাৎ বা আলোচনার দিন ধার্য করা হয়েছে। এর আগে প্রধান উপদেষ্টা কয়েকবারই বলেছেন, চলমান সংস্কারের পরিসর সীমিত হলে ডিসেম্বরে নির্বাচন অসম্ভব নয়। আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে অর্থাৎ অন্য সব ‘স্টেকহোল্ডার’ বা এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত ক্রিয়াশীল অংশগুলোর সঙ্গে কথা বলে সেটি নির্ধারণ করা হবে। আর কাঙ্ক্ষিত কিংবা অতি আবশ্যকীয়ভাবে সংস্কারের পরিসর কিছুটা বাড়লে আগামী জুনে নির্বাচন হতে পারে। সে আভাস অতীতে বহুবার দেওয়া হয়েছে এবং এখনো সে ঘোষণার পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে। কিন্তু এর মধ্যে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নিয়ে নানা মহলে একটি ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।’ সে কারণেই তারা (বিএনপি) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চায়। এখানেও আবার একই কথা। ডিম আগে, না মুরগি আগে। কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সংস্কার আগে, না নির্বাচন আগে। তা ছাড়া এখানে আরো একটি প্রত্যাশিত বিষয় কাজ করছে। আর তা হচ্ছে, জরুরি সংস্কারগুলো আলোর মুখ না দেখলে জুলাই-আগস্ট বিপ্লব বা অভ্যুত্থান সম্পূর্ণ বিফলে যাবে। দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠন কিংবা নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় মাঠে মারা যাবে। সম্প্রতি নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতাদের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের নেতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে গণবিপ্লব বা অভ্যুত্থান-উত্তর আওয়ামী লীগকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারে এই দুটি দল একমত হয়েছে। মোটামুটি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে তারা। আর তা হচ্ছে, গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগের বিচার নিশ্চিত করা, বিচার না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করা, এ পর্যায়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম স্থগিত রাখা এবং নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগের বিচারের পদক্ষেপ দৃশ্যমান করতে হবে। তা ছাড়া অন্যান্য সংস্কার নিয়েও পারস্পরিক প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করা হয়েছে।
মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনী রাজনীতি দ্রুত এগোনো সম্ভব না হলেও জনগণের পর্যায়ে রাজনৈতিক কথোপকথন এগোচ্ছে আশাতীতভাবে। এখানে উল্লেখ্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি জাতীয় সরকারের রূপ দেওয়ার দাবি জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। সেই প্রস্তাবিত সরকারের অধীনেই সংস্কার ও সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ। তা ছাড়া এ পর্যন্ত ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দল বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের ব্যাপারে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। এগুলো অবশ্যই পর্যালোচনার দাবি রাখে। এগুলো বিভিন্ন অজুহাতে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নির্বাচনের দিকে ধাবিত হলে যেমন জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানকে অবহেলা কিংবা অগ্রাহ্য করা হবে, তেমনি বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নগুলোকেও ঝুলিয়ে রাখা সমীচীন হবে না। তাহলে আমরা ক্রমে ক্রমে নিজের অজান্তেই আমাদের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাব। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান অধ্যাপক ইউনূসের জন্য এটি একটি ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ পরিস্থিতি, তবু তিনি একজন দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন বিজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। তাঁর কাছে মানুষ কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থোদ্ধারের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাক, সেটি চায় না; চায় বৃহত্তরভাবে জাতীয় স্বার্থ অর্জনের ক্ষেত্রে আপসহীন ও সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত। এতে তাঁর নীতি-নৈতিকতার দিকটিই অভ্রান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। নতুবা জাতি হিসেবে আমরা আবার আগের অবস্থানেই ফিরে যাব। এতে বর্তমান জটিল বিশ্বপরিস্থিতিতে আমরা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রেও পরিণত হতে পারি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্ধিত কর আরোপের (ট্যারিফ) প্রক্রিয়া যেমন আমাদের অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি সংকট সৃষ্টি করবে, তেমনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধাদি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণাও আমাদের জন্য একটি অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে ভারতের ভূমি ব্যবহার করে আমরা নেপাল ও ভুটানে আমাদের পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করতে পারব না। এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এখানে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে, না জুনে সম্পন্ন হবে, সেগুলো প্রয়োজনীয় হলেও জরুরি কোনো জাতি বিধ্বংসীমূলক সংকট নয়।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অত্যন্ত হুঁশিয়ার ও বিচক্ষণ। অতীতে বিভিন্ন সময় আধিপত্যবাদ কিংবা স্বৈরশাসনের কারণে তারা যথাসময়ে অনেক কাজে এগিয়ে আসতে সক্ষম হয়নি, কিন্তু সুযোগ পেলে তারা কোনো ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকে না। তারা এগিয়ে আসতে পিছপা হয় না। বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক নিঃস্বার্থ মানুষ রাজনীতিকদের তুলনায় চিন্তা-ভাবনার জগতে অনেক এগিয়ে থাকে। এর মূল কারণ তারা বেশির ভাগ রাজনীতিকের তুলনায় ব্যক্তি কিংবা কায়েমি স্বার্থে কাজ করে না। তারা সর্বাগ্রে ভাবে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ নিয়ে। এমন একটি অবস্থার প্রেক্ষাপটে জনগণের বিভিন্ন অংশ থেকে সম্প্রতি একটি কথা চাউর হয়েছে। এখনো সে বক্তব্যটি বেগবান বা তেমনভাবে সমর্থন লাভ না করলেও প্রস্তাব করা হয়েছে, দেশে অদূর ভবিষ্যতে একটি গণভোট অনুষ্ঠান করা যায় কি না? আমাদের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন কিংবা আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল করার লক্ষ্যে আমরা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ভবিষ্যতে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য একটি সরকার চাই কি না? যেভাবে বা যে পদ্ধতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কিংবা পরবর্তী সময়ে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনের বৈধতা দিতে গণভোট সংঘটিত করা হয়েছিল, বর্তমানে অধ্যাপক ইউনূসের শাসনকালকে বৈধভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তেমন একটি জনমত নেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কি না? উল্লিখিত বিষয়াবলির সব কিছুই এখনো মানুষের ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার বহিঃপ্রকাশের মধ্যে রয়েছে, শক্তপোক্তভাবে রাজনৈতিক মহলে এখনো ঠাঁই পায়নি। দানা বেঁধে ওঠেনি একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব হিসেবে। তবে এই বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ যে ভাবছে না, তেমন নয়। তা ছাড়া পূর্বনির্ধারিত সময়ে নির্বাচন করা সম্ভব হলেও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও তথ্যাভিজ্ঞ মহল অধ্যাপক ইউনূসকে দেশ গঠন বা পরিচালনায় সম্পৃক্ত করতে যথেষ্ট আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। সবার ধারণার ভিত্তি হচ্ছে, অধ্যাপক ইউনূস নিজ দেশ এবং আন্তর্জাতিক দিক থেকে সবার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের সামনে যে সমস্ত সংকট বা চ্যালেঞ্জ ধেয়ে আসছে, সেগুলো মোকাবেলা করতে অধ্যাপক ইউনূসের মতো শক্তপোক্ত অবস্থানে থাকা একজন সর্বজনগ্রাহ্য ব্যক্তির প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অধ্যাপক ইউনূস কিংবা তাঁর শুভানুধ্যায়ীমহল থেকে কোনো প্রচারাভিযান চালানো হয়নি, এগুলো সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনা থেকে উৎসারিত অভিব্যক্তি বলে মনে করা হচ্ছে।
পরিশেষে যে বিষয়টি শুধু আমাকে নয়, দেশের আপামর জনসাধারণকে ভাবিয়ে তুলছে, তা হচ্ছে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের একটি ঐকমত্যে পৌঁছা। বর্তমানে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে তাদের মধ্যে বিশাল ফারাক বা ব্যবধান লক্ষ করা যাচ্ছে। বিএনপি ছাড়া জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি কিংবা অন্য অনেকের কাছে সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া রয়েছে আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব ও গণহত্যার দায়ে তাদের নেতা-নেত্রীদের বিচারের প্রশ্নগুলো। এগুলো অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এগুলো এখনই সুরাহা না হলে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবিরোধকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝরতে পারে। বেড়ে যেতে পারে অন্তর্দলীয় রাজনৈতিক সহিংসতা। বিভিন্ন সংস্কার ও দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠান সংক্রান্ত বিএনপির বিভিন্ন বক্তব্য তাদের প্রতিপক্ষের মধ্যে যথেষ্ট বিতর্ক ও আস্থার অভাব সৃষ্টি করেছে। কেউ কাউকে কাঙ্ক্ষিতভাবে আস্থায় নিতে পারছে না। এই অবস্থায় সংস্কার কিংবা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে নানা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হওয়া অসম্ভব নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কারো কোনো ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় বসেনি। বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী ছাত্র-জনতা, যারা অন্তর্বর্তী সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাদের কাছে প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণ করা বর্তমান শাসকদের একটি নৈতিক দায়িত্ব বলে মানুষ মনে করে। সুতরাং তার প্রদত্ত অঙ্গীকার পূরণের ব্যাপারে সরকারকে হুঁশিয়ার হতে হবে। এ কথা ঠিক যে বর্তমান দ্বিমুখী চাপের মুখে একটি অস্থায়ী সরকার কতটুকু করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের আগের রূপরেখায় অধ্যাপক ইউনূসের সরকার ক্ষমতায় আসেনি। এটি একটি গণবিপ্লব বা অভ্যুত্থান-উত্তর সরকার। এতে শিশু, নারী, ছাত্র-জনতাসহ প্রায় দুই হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই আত্মত্যাগ নিছক একটি নির্বাচনের মাধ্যমে অন্য কারো ক্ষমতায় আসার জন্য নয়। সুতরাং এই লোমহর্ষক ও অমানবিক ঘটনার ভবিষ্যতে যাতে আর পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং এই হত্যাকাণ্ডের যাতে সুষ্ঠু বিচার হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। সে কারণে প্রয়োজন হলে বিভিন্ন দলকে অন্তর্দলীয়ভাবে আলোচনায় বসতে হবে। নির্বাচনের আগেই তাদের অমীমাংসিত বিষয়াদি নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। তাদের মধ্যে বিরাজিত ব্যবধান ঘোচাতে হবে। নতুবা কোনো নির্বাচনই শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে না। নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যেই রাজপথে নামবে সরকারবিরোধীরা। সেদিনের সেই দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও রক্তপাত ঠেকাতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই উদ্যোগ নিতে হবে সম্ভাব্য ব্যবধান ঘুচিয়ে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com