তুরস্ক, পাকিস্তানসহ পৃথিবীতে যতগুলো অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে, সেগুলোর মূল কারণ ছিল তাদের স্থানীয় মুদ্রার মূল্য হারানো। যেসব দেশকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির মোকাবেলা করতে হয়েছে, সেগুলোর মূল কারণ হচ্ছে ডলারের বিপরীতে বা রিজার্ভ কারেন্সির বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রার মূল্য হারানো। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি অনেক দিন ছয়-সাড়ে ছয়ের মধ্যে ছিল এবং তখন ইউএস ডলারের মূল্য ছিল ৮৫-৮৬ টাকা। বহুদিন ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক এই এক্সচেঞ্জ রেটটা সফলতার সঙ্গে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
ভিন্নমত
মূল্যস্ফীতি এবং টাকার বিনিময় হার
- আবু আহমেদ

এটার মূল কারণ হচ্ছে যে আমাদের ডলারের সরবরাহ যা আছে, তার তুলনায় পেমেন্ট অবলিগেশন বেশি। ডলারের সরবরাহ যে খুব বেশি কমছে তা নয়, কিন্তু বাংলাদেশের দেনা বেশি বেড়ে গেছে। আরেকটু সহজ করে বলি, বিদেশি মুদ্রায় দেনাটা বেড়ে গেছে।
অন্যদিকে বিদেশ থেকে বৈধ চ্যানেলে আমাদের রেমিট্যান্স আসা কমে গেছে।
আমি মনে করি, মূল্যস্ফীতিটা বিনিয়োগের জন্য খারাপ। কারণ বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য খুব ক্ষতিকর। যারা বেতননির্ভর অথবা যাদের বেতন নেই, যাদের উপার্জন নেই, মজুরিভিত্তিক ইনকাম করে, সপ্তাহভিত্তিক ইনকাম করে, যারা বেকার—তাদের সমস্যা অনেক বেশি হবে। বাংলাদেশে এ ধরনের লোকসংখ্যা কম না। পাঁচ কোটিরও বেশি হবে। কিন্তু যারা মানিয়ে নিতে পারে—মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশ হলো, তার ইনকাম ১০ শতাংশ বেড়ে গেল, তার জন্য কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু যারা মানিয়ে নিতে অক্ষম, তাদের জন্য খুব ক্ষতিকর। তাদের মূল আয় কমে যাচ্ছে।
এখন কথাটা হচ্ছে যে আমাদের এক ডলার সমান কত টাকা হওয়া উচিত—এটা একটা বিরাট প্রশ্ন। এটা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে। কেউ বলছেন, এটা ফ্রি মার্কেটের ওপর ছেড়ে দেওয়া হোক। আমি মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংক আগে যেভাবে হিসাব করে একটা রেট ঠিক করে দিত, সেটা গ্রহণযোগ্য। কারণ বাংলাদেশের মতো ছোট অর্থনীতিতে মাফিয়া স্টাইলের কিছু লোক আছে, তারা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আমাদের টাকা ফেলে দিতে পারে। টাকার বিপরীতে ডলারের রেট বাড়তে থাকবে, এটা এখানে ঘটতে দেওয়া অসম্ভব। ওদের হাতে এক্সচেঞ্জ রেট ছেড়ে না দিয়ে, ফ্লেক্সিবল এক্সচেঞ্জ রেট, যেটা বাংলাদেশের টাকায় কারেন্ট অ্যাকাউন্টে বিনিময়যোগ্য—ওটা বাংলাদেশ ব্যাংক এত দিন ধরে মনিটর করে একটা মোটামুটি জায়গায় রাখছিল। রিয়াল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট বলে একটা কথা আছে। আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ ব্যাংক রিয়াল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট কনসেপ্ট চালু করেছিল। অর্থাৎ স্থানীয় মুদ্রার বিনিময় মূল্য হার বাংলাদেশ ব্যাংক ঠিক করে দিত। ওটা থেকে এক টাকা, দুই টাকার মধ্যে ব্যাংকগুলো বেচাকেনা করত। এটা সঠিক ছিল বলে আমি মনে করি। এখনো সঠিক হবে। বিনিময় মূল্য হার ১০৫ টাকা হবে, নাকি ১০৮ টাকা হবে—এটা বাংলাদেশ ব্যাংককে ওই রিয়াল অ্যাফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট হিসাব করে ওটা ঠিক করে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ে যতই শোরগোল করি না কেন, কোনো লাভ হবে না, যদি এক্সচেঞ্জ রেট ঠিক না রাখা যায়। তুরস্কে মূল্যস্ফীতি হয়েছে, ওদের লিরা পড়ে গেছে। পাকিস্তানে রুপি পড়ে গেছে। ভারতে যদিও আমাদের থেকে কম, তবে ওদেরও ১১৭ টাকা ছিল ডলার, এখন সম্ভবত ৮২ বা ৮৩ টাকায় এসেছে। গত এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশি টাকা ৩০ শতাংশের মতো মূল্য হারিয়েছে। ওটা আমাদের জন্য দুঃখজনক।
এখন এটাকে ধরে রাখার উপায় কী—এটাই বড় প্রশ্ন। একমাত্র উপায় হচ্ছে, বাংলাদেশ সরকারকে কম ব্যয় করতে হবে। বাইরে থেকে কম কেনাকাটা করতে হবে। বৈদেশিক ঋণ যেন আর বৃদ্ধি না পায়। খুব অসুবিধায় পড়ে যেতে হবে তখন। রপ্তানি যদি না বাড়ে, রেমিট্যান্স যদি না বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের এই ডলার সংকট আরো প্রকট হবে। কারণ এই মুহূর্তে কেউ আমাদের এখানে বিনিয়োগ করবে না। বিদেশি বিনিয়োগ যেসব অর্থনীতিতে বৃদ্ধি পায়, সেসব অর্থনীতিতে ফরেন এক্সচেঞ্জ বা রিজার্ভ কারেন্সির ক্রাইসিস অতটা হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু আমরা একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, মুডিস রেটিং এজেন্সি আমাদের ডাউনগ্রেড করে দিয়েছে এবং একটা রাজনৈতিক সংকটও আছে, সব কিছু মিলিয়ে এখানে বিদেশি বিনিয়োগ হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক এখন জ্বালানি কেনার জন্য অর্থ ছাড় করছে না। বাংলাদেশ ব্যাংক ২৮-২৯ বিলিয়ন রিজার্ভ ধরে রাখতে চাচ্ছে। এতে যুক্তি আছে। এটা যদি আরো নিচের দিকে নেমে যায়, তখন চারদিকে অস্থিরতা দেখা দেবে। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক জ্বালানি তেল বা অন্যান্য বড় খাতে ছাড় করতে অসুবিধা বোধ করছে। পুরোটা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর ছেড়ে দিলে, ওটা যদি ১৫ বিলিয়ন ডলারে চলে আসে, তখন আমাদের টাকার মূল্য কী হবে? ওখানে ইনফ্লেশন হবে। সমাজ এক অস্থিরতার মধ্যে চলে যাবে। সরকারকে অনুরোধ করব সরকারি ও পাবলিক সেক্টরে কেনাকাটা কম করুন। বিদেশ থেকে নতুন করে আর ঋণ নেবেন না। পুরনো ঋণগুলো ধীরে ধীরে শোধ করার চেষ্টা করুন। কোনো কোনোটা পরে দেওয়ার কথা বলে ঋণ সমঝোতা করা যেতে পারে। দর-কষাকষিতে যাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইউয়ান সীমিত ব্যবহার করা যাবে। ভারতীয় রুপিও সীমিত ব্যবহার করা যাবে। আমরা ওদের কাছে বিক্রি করি দুই বিলিয়ন ডলার। আমাদের অ্যাকাউন্টসে ভারতীয় রুপি দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ থাকবে, যেটা আমরা বিক্রি করি ওদের কাছে। ওরা কি রাজি হবে? কারণ ওরা ১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশের কাছে। সেখানেও রুপি এবং টাকায় যদি বাণিজ্য করতে হয়, এটা করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা হবে সীমিত আকারে। কারণ ওরা এখানে বিক্রি করে বেশি, আমরা করি কম। আমি মনে করি, ভারত সহজে রাজি না-ও হতে পারে। তবে বাংলাদেশ সীমিত আকারে রাজি হলে আমি এটাতে ক্ষতি কিছু দেখি না। এতে টাকার বিনিময় হারটা ডলারের সঙ্গে টাই আপ থাকবে। ওদের রুপিও ডলারের সঙ্গে টাই আপ থাকবে। রেফারেন্স রেট থাকবে ডলারের সঙ্গে। এটা সব দেশের রেফারেন্স ভ্যালু থাকবে ডলারের এক্সচেঞ্জের রেটের ভেতরে। সেটা সীমিতভাবে হতেই পারে। ভারত রাজি না-ও হতে পারে। কারণ ওদের হাতে অনেক টাকা জমে যাবে, যদিও ওরা উৎসাহ দেখাচ্ছে। কারণ ভারত ওদের মুদ্রার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি চাচ্ছে। রিজার্ভ কারেন্সিতে ভারতীয় রুপি নেই, আছে চায়নিজ ইউয়ান। চীন আমাদের কাছে বেশি বেচে। চীন যদি আমাদের ক্রেডিট দেয়, ঋণ দেয়, তাহলে আমরা ডলার বাদ দিয়ে ইউয়ানে কিনতে পারব; যেটা অন্যান্য দেশের সঙ্গে চীন এখন করছে। বাংলাদেশ সেদিকে চিন্তা করতে পারে।
বাংলাদেশ এই অর্থনৈতিক সংকট থেকে শিগগিরই মুক্তি পাবে, এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কারণ সিগন্যালগুলো আমাদের বিপক্ষে যাচ্ছে এখন। মূল্যস্ফীতি একটা বড় কারণ। স্থানীয়ভাবে ডিমান্ডের মাধ্যমে এটা হয়। কিন্তু আপনি বিদেশ থেকে যেসব মাল আনছেন, টাকা মূল্য হারানোর কারণে সেসবের দাম যদি বাড়ে, তাহলে যেগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়, সেগুলোর দামও তো বাড়তে বাধ্য। কারণ হচ্ছে, মূল্যগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। যখন জ্বালানি তেলের মূল্য এক ধাপে ৫০ শতাংশ বাড়ানো হলো, তখন আমরা বলেছিলাম, এতে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি হবে। মূল্যস্ফীতি হলে আমাদের টাকার বিনিময় হার চাপে পড়বে।
যখন জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হলো, তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল, এটা খুব খারাপ একটা সিদ্ধান্ত। একসময় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ছিল ১৪০ ডলার। এখন এটা ৮০ ডলারে চলে এসেছে। এখন তো নিচের দিকে অ্যাডজাস্ট করছে না। বিপিসির কখন কী লোকসান হয়েছে, সিস্টেম লস হয়েছে—তার খেসারত তো ভোক্তাদের দিতে হচ্ছে।
সব কিছু মিলিয়ে আমি মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনাটা আগে যেখানে ছিল, তার থেকে অনেক বেশি দুর্বল অবস্থানে চলে গেছে। এই দায়িত্বটা প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, সরকারকে সাপোর্ট দিতে হবে। সরকার যদি নিজেই বড় রকমের ঋণ করতে থাকে—ধরে নিলাম টাকাতেই ঋণ করল—তাহলেও মূল্যস্ফীতি হবে। আর মূল্যস্ফীতি হলে ডলার আর টাকার মান ঠিক রাখা যাবে না।
সরকার যদি ঘাটতি বাজেট মেটানো বা মোকাবেলা করার জন্য ঋণ করতে থাকে, বিশেষ করে যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করতে থাকে, তাহলে মূল্যস্ফীতি হতে বাধ্য। আর মূল্যস্ফীতি হলে ডলার আর টাকার মান স্থিতিশীল রাখা যাবে না। তখন একটা মূল্যস্ফীতিকে আরেকটা মূল্যস্ফীতি তাড়া করতে থাকবে। তখন বাংলাদেশ একটা মূল্যস্ফীতির ফাঁদে পড়ে যাবে। তখন চারদিকে একটা বিরাট অস্থিরতা হবে।
আগামী কয়েক মাস আমাদের দেখার বিষয়, আমরা বিদেশি ঋণ কত হারে, কী পরিমাণ ফেরত দিচ্ছি। একটা হচ্ছে রেমিট্যান্সের আন্তঃপ্রবাহ। আরেকটা হচ্ছে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি—এটা যেকোনো অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। এগুলো যদি কোনোটাই আমাদের পক্ষে না থাকে, বাংলাদেশ গরিব হয়ে যাবে।
বিদেশি দেনা যদি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখা যায়, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি যদি আমাদের পক্ষে না থাকে, রেমিট্যান্সের আন্তঃপ্রবাহ যদি আমাদের পক্ষে না যায়, তাহলে বাংলাদেশকে বড় ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। সামনে আমাদের মেগাপ্রজেক্টগুলো ফান্ডিং করা মুশকিল হতে পারে। সুতরাং এখন থেকে সরকারি ব্যয় যেখানে যেখানে সম্ভব কমাতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক আজ মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়, সেটাও এক্সপানশনারি হবে না। মূল্যস্ফীতি যদি দমিয়ে রাখতে হয়, তাহলে সংকোচনশীল মনিটারি পলিসির দিকে যেতে হবে। সেটা বোধ হয় সামনে আসছে।
মূল্যস্ফীতির লাগাম যদি টেনে ধরা না যায়, তাহলে সুদের হার বাড়তে বাধ্য। সুদের হার বাড়লে বিনিয়োগ ব্যাহত হবে। বিনিয়োগ না হলে কর্মসৃজন হবে না। বিনিয়োগ না হলে অর্থনীতি আরো খারাপ অবস্থার দিকে যাবে। তখন রাজস্ব সংগ্রহ হবে না। বাজেট ঘাটতি আরো বাড়তে থাকবে। আমরা একটা সমস্যার মধ্যে পড়ে যাব। একটা সমস্যা আরেকটা সমস্যা ডেকে আনবে।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : রায়হান রাশেদ
সম্পর্কিত খবর

তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের বরপুত্র পিটার হিগস
ড. কানন পুরকায়স্থ

তাত্ত্বিক কণা পদার্থবিজ্ঞানী ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক পিটার হিগস ৮ এপ্রিল ২০২৪ সালে ৯৪ বছর বয়সে এডিনবরায় তাঁর নিজ বাসভবনে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তাঁর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি প্রায় ছয় দশক এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেন। হিগস গাণিতিকভাবে দেখান, কোনো কণা একটি নতুন ধরনের ক্ষেত্রের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে ভর অর্জন করে।
এই আবিষ্কারের পেছনের ইতিহাস একটু জানা যাক।
বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তবতার সূত্র অনুসন্ধান করার একটি পদ্ধতি এবং এই অনুসন্ধানের জন্য বিজ্ঞানী পরীক্ষণপদ্ধতি ব্যবহার করেন। কিন্তু হিগসের প্রশ্ন, একজন বিজ্ঞানী কিভাবে নিশ্চিত হন যে তিনি যা পর্যবেক্ষণ করছেন, তা-ই সত্য। আমরা কি নিশ্চিত যে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো এই বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের সঠিক ধারণা দেয়? যদি আমরা বিশ্বাস করি যে হ্যাঁ, সঠিক কাজ করছে, তবে হিগসের মতে এটি বিশ্বাসের বিষয়, যুক্তির বিষয় নয়। হিগস বস্তুত বলতে চেয়েছেন যেহেতু বিষয়টি বিশ্বাসের, সেহেতু এটি বিজ্ঞান নয়। প্রকৃতির স্বভাব নিরূপণ করতে গিয়ে আমরা যে বাস্তবতাকে দেখি, তা কল্পনাপ্রসূত হতে পারে।
হিগসের এই জিজ্ঞাসা দার্শনিকদের কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। সপ্তদশ শতাব্দীতে দার্শনিক রেঁনে দেকার্ত দর্শনের দুটি সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। একটি হলো—আমরা কী জানতে পারি? এবং অন্যটি হলো—আমরা কিভাবে তা জানতে পারি? দেকার্ত তাঁর যুক্তি বিনির্মাণে কল্পনার সাহায্য নিয়েছিলেন এভাবে যে এক দৈত্য তাঁকে বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। যদি তা-ই হয়, তাহলে কি জানা যাবে দৈত্য যা বলছে, তা প্রকৃত সত্য কি না। দেকার্ত চিন্তা করলেন দৈত্য কোন বিষয়টি তাকে বিশ্বাস করানোর মাধ্যমে বোকা বানাতে পারবে না। দেকার্ত তার উত্তর দিলেন এভাবে, ‘একটিমাত্র বিষয় আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে যদি আমি চিন্তা করি, তাহলেই আমার অস্তিত্ব আছে।’ দার্শনিক দেকার্তের ভাষায়, ‘cogito ergo sum’ বা ইংরেজিতে বলা যায়,
‘I think, therefore I am.’ দেকার্ত এ কথা বলেই থেমে যাননি। তিনি সমস্যাটি অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেন। দেকার্ত উল্লেখ করেন, আমরা যদি কোনো সদাশয় ঈশ্বরের কাছ থেকে আমাদের ইন্দ্রিয় পেয়ে থাকি, তাহলে এই ইন্দ্রিয় দ্বারা আমরা যে বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষ করব, তা সত্যি হবে। প্রশ্ন হলো, ঈশ্বর যদি সদাশয় না হন, যদি তিনি বোকা বানানোর চেষ্টা করেন, তাহলে আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতার পর্যবেক্ষণ সত্য না-ও হতে পারে। এভাবে পর্যবেক্ষণের উভয়সংকটের মধ্যে পিটার হিগস যেতে চাননি। তাই তিনি তাঁর অধ্যয়ন ও গবেষণার জন্য তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানকে বেছে নেন।
১৯৬০ সালে হিগস এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। হিগস সেখানে একাডেমিক জার্নাল রক্ষণাবেক্ষণের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। ১৯৬১ সালের বসন্তকালে হিগস ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত পদার্থবিদ ইওশিরো নামবুর অতি পরিবাহী তত্ত্ব (super conductivity) দিয়ে মৌলিক কণার ভর পরিমাপ সংশ্লিষ্ট গবেষণাপত্র দেখতে পান। এই গবেষণাপত্রই হিগসের গবেষণার মূল বীজমন্ত্র। সাধারণ পরিবাহক; যেমন—তামার তার ও অতিপরিবাহকের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। অতিপরিবাহককে ১৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে ফেলে ঠাণ্ডা করলে তার বিদ্যুৎ রোধের ক্ষমতা লোপ পায়। এই ধর্মের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখেন যে অতি নিম্ন তাপমাত্রায় অতিপরিবাহক পদার্থের মধ্যে ইলেকট্রন কণা জোড়ায় অবস্থান করে। এই অবস্থায় অতিপরিবাহক পদার্থে কোনো ল্যাটিস (lattice) নেই বলে মনে হয়। এই অবস্থায় পদার্থ অধিফ্লুয়িডের (superfluid) মতো আচরণ করে। এই আচরণের কারণে শক্তির ক্ষয় না করে পদার্থ এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে। অতিপরিবাহকের মধ্যে রোধের ক্ষমতা লোপ পাওয়াকে পদার্থবিজ্ঞানীরা বলেন ভগ্ন প্রতিসাম্য। নামবু তাঁর গবেষণাপত্রে দেখান যে এই ভগ্ন প্রতিসাম্যই মহাবিশ্বে ভরশূন্য বস্তুকে ভর দান করে।
ইওশিরো নামবু তাঁর অতিপরিবাহী তত্ত্বের জন্য ২০০৮ সালে নোবেল পুরস্কার পান। হিগস অতি দ্রুত অনুধাবন করেন যে কণা পদার্থবিজ্ঞান এই ভগ্ন প্রতিসাম্যের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে কোনো কণার ভরের কারণ ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
১৯৬৪ সালে গ্রীষ্মকালে অবকাশযাপন শেষে ফিরে এসে তাঁর এক ছাত্র লক্ষ করে যে তাঁর ডেস্কে রয়েছে একটি নোট, যাতে লেখা রয়েছে ‘This summer I have discovered something that is totally useless.’ এর নিচে পিটার হিগসের স্বাক্ষর। ১৯৬৪ সালের জুলাই মাসে হিগস ফিজিকস লেটার জার্নালে ৭৯ লাইনের একটি গবেষণাপত্রে ভগ্ন প্রতিসাম্যের বিষয়টি গাণিতিকভাবে প্রমাণ করেন। এভাবেই তাত্ত্বিকভাবে হিগস বোসন ও হিগস ক্ষেত্রের (Higgs field) জন্ম হয়। এই বোসনের সঙ্গে ফার্মিয়ন কণার পার্থক্য হচ্ছে ঘূর্ণন মানের। যেমন—ইলেকট্রনের ঘূর্ণন মান ১/২, ফোটন কণার ঘূর্ণন মান ১ এবং হিগস বোসন কণার ঘূর্ণন মান শূন্য।
এই গবেষণাপত্র প্রকাশের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর ৪ জুলাই ২০১২ সালে সার্নের বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেন যে তাঁরা পৃথিবীর শক্তিশালী ত্বরকযন্ত্র বৃহৎ হেড্রন কলাইডারে এক নতুন কণার সন্ধান পেয়েছেন, যার সঙ্গে পিটার হিগসের ‘ঁংবষবংং’ ধারণার মিল রয়েছে। সার্নের মহাপরিচালক রল্ফ ডিটার হিউয়ার ঘোষণা দেন যে ‘ we have now found the last missing cornerstone of the standard model.’ হিউয়ার আরো জানালেন যে হিগস বোসন কণার ভর ১২৫ বিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি, যা প্রোটনের ভরের প্রায় ১৩৩ গুণ। সার্ন দুটি পরীক্ষা দ্বারা হিগস কণাকে শনাক্ত করে। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে তাঁদের প্রাপ্ত ফলাফল অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য। কয়েক বছর আগে রয়াল ইনস্টিটিউশনে প্রদত্ত বক্তৃতায় (যেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম) হিগস বলেছিলেন যে সম্ভবত আমার জীবদ্দশায় এই কণার সন্ধান মিলবে না। কারণ এর জন্য প্রয়োজন অত্যন্ত শক্তিশালী ত্বরকযন্ত্র, যার অর্থায়নে রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব রয়েছে।
কণা পদার্থবিজ্ঞানে হিগস বোসন আবিষ্কার অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এই কণার আবিষ্কার প্রমাণ করে হিগসের ক্ষেত্রের অস্তিত্ব। এই ক্ষেত্র ব্যাখ্যা করে ভগ্ন প্রতিসাম্যের কলাকৌশল, যা থেকে পাওয়া যায় কোনো কণার ভর। সার্নের সামনে দাঁড়িয়ে সার্নের একদল বিজ্ঞানীকে (আমাদের গাইড) প্রশ্ন করেছিলাম, ‘হিগস বোসন কি কণা, না ক্ষেত্র?’ উত্তরে হিগস বললেন, ‘হিগস ক্ষেত্রকে যখন ঝাঁকুনি দেওয়া হয়, তখন তা থেকে বেরিয়ে আসে হিগস বোসন কণা।’ পিটার হিগস আজ আর আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর গাণিতিক ভাবনা কণা পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণায় বলিষ্ঠ অবদান রেখে চলেছে।
লেখক : অধ্যাপক এবং বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক উপদেষ্টা, যুক্তরাজ্য

আমেরিকার পারস্পরিক শুল্ক এবং বাংলাদেশ
- আব্দুল বায়েস

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় বসা মানে যেন পৃথিবীতে ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া। এরই মধ্যে তাঁর কিছু পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী, এমনকি খোদ আমেরিকায়ও নিন্দিত হয়েছে। তবে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ প্রতিপাদ্যের প্রবর্তক ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাঁর আগ্রাসী মনোভাবের ইঙ্গিত আগেরবার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে আঁচ করা গিয়েছিল।
দুই
আন্তর্জাতিক পণ্য প্রবাহে কোনো একটি দেশ কর্তৃক শুল্ক আরোপ (আমদানি কর) কিভাবে আরোপকারী দেশের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলে, তা অর্থশাস্ত্রে সুন্দরভাবে বিধৃত আছে। প্রথমত, শুল্ক বসালে বা বৃদ্ধি করলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পায়। বস্তুত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে বাংলাদেশসহ অনেক দেশ শুল্কপ্রাচীর সৃষ্টি করে। অন্যভাবেও রাজস্ব আদায় করা যায়, তবে তা রাজনৈতিক লাভালাভে সুবিধাজনক নয় বলে এই ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত, শুল্কের ফলে দেশীয় শিল্প সুরক্ষা পায়।
তিন
তবে ট্রাম্প বলছেন, যেসব দেশের ওপর তিনি শুল্ক বাড়িয়ে দিলেন, সেসব দেশ আমেরিকায় উৎপাদিত পণ্য যত কেনে, তার চেয়ে তারা আমেরিকায় তাদের পণ্য বেশি বিক্রি করে অর্থাৎ আমেরিকার সঙ্গে এই প্রতিটি দেশ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করছে। দেশগুলো আমেরিকার পণ্যের ওপর অনেক বেশি হারে শুল্ক আরোপ করে ওই সব দেশে আমেরিকার পণ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অথচ আমেরিকার শুল্কের হার কম বিধায় অবাধে তাদের পণ্য আমেরিকায় ঢুকে আমেরিকার জন্য বাণিজ্য ঘাটতি সৃষ্টি করছে। এবং তা বছরের পর বছর, এমনকি যুগের পর যুগ। কাঁহাতক এই বৈষম্য! সুতরাং ‘দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়া’ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শুল্ক-বোমাটি ফাটালেন এবং বলতে হয় হাটে হাঁড়িও ভাঙলেন।
চার
বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন। আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে শুল্ক ছিল ১৫ শতাংশ, এর বিপরীতে বুধবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক বসিয়েছেন। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল আনুমানিক ১০.৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২.২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে বাংলাদেশে আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলারের মতো। ধারণা করা যায়, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব পণ্য রপ্তানি হয়, তার মধ্যে রয়েছে কৃষিপণ্য (খাদ্যশস্য, বীজ, সয়াবিন, তুলা, গম ও ভুট্টা), যন্ত্রপাতি, লোহা ও ইস্পাত পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি পণ্যের মধ্যে আছে তৈরি পোশাক, জুতা, টেক্সটাইল সামগ্রী, কৃষিপণ্য ইত্যাদি।
তবে কেবল বাংলাদেশই আঘাতপ্রাপ্ত নয় নয়া শুল্ক ব্যবস্থায়। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন নতুন শুল্ক পরিকল্পনায় এশিয়ার দেশগুলোর পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্র সর্বনিম্ন ১০ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। যেমন—চীন ৩৪ শতাংশ, ভিয়েতনাম ৪৬ শতাংশ, তাইওয়ান ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়া ৩২ শতাংশ, জাপান ২৪ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়া ২৫ শতাংশ, থাইল্যান্ড ৩৬ শতাংশ, মালয়েশিয়া ২৪ শতাংশ, কম্বোডিয়া ৪৯ শতাংশ, বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ, ভারত ২৬ শতাংশ, পাকিস্তান ২৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুর ১০ শতাংশ, নেপাল ১০ শতাংশ, ফিলিপাইন ১৭ শতাংশ, শ্রীলঙ্কা ৪৪ শতাংশ, মায়ানমার ৪৪ শতাংশ, লাওস ৪৮ শতাংশ। মনে রাখা দরকার, আমেরিকার সঙ্গে উল্লেখিত দেশগুলোর বাণিজ্য উদ্বৃত্ত বিদ্যমান।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম শুল্ক আরোপ করা হয়েছে ভারতের ওপর, যার পরিমাণ ২৬ শতাংশ। এ ছাড়া বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর শুল্কের হার কম বলে মনে হয়। আর এই কম শুল্কের ফায়দা নিয়ে বাংলাদেশকে হটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাকের বাজার ধরতে চায় কম শুল্কের দেশগুলো। এর মধ্যে অন্যতম দেশ নাকি ভারত—এমন অভিযোগ করছে অনেকে। তবে মনে রাখা দরকার যে ভারত, পাকিস্তান ও তুরস্কের ওপর আগেই শুল্কের হার অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল বলে সম্ভবত এবার কম।
পাঁচ
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ বা পাল্টা শুল্ক আরোপ করার প্রভাব নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বিস্তর মূল্যায়ন প্রকাশিত হচ্ছে। কেউ বলছে ইতিবাচক দিকের কথা, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন পাল্টাপাল্টি শুল্ককাঠামো বাণিজ্য অংশীদারদের মধ্যে একটি ন্যায্য প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির লক্ষ্যে করা হয়েছে। এটি মাঝারি থেকে দীর্ঘমেয়াদি সুযোগ তৈরি করবে। বিশেষ করে ভারতীয় অর্থনীতিবিদ কেউ কেউ ভাবেন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় টেক্সটাইল ও পোশাক রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে।
তবে পর্যবেক্ষণের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মার্কিন ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া। তাদের মনোভাব ও ভোগের আচরণ স্বল্পমেয়াদি রপ্তানিপ্রবণতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সম্পূর্ণভাবে শুল্ক কার্যকর করা হলে খুচরা পর্যায়ে কিছু অস্থিরতা দেখা যেতে পারে, যা প্রত্যাশিত। প্রতিটি দেশ যেভাবে এর প্রতিশোধ নেবে এবং প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা-ও বাণিজ্য গতিশীলতার পরবর্তী পর্যায়কে প্রভাবিত করবে বলে বলছেন কেউ কেউ।
এ ছাড়া পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মার্কিন ভোক্তারা এমনিতেই কিনবে কম; এর জেরে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে শুল্কের হিসাবে ফাঁকি আছে। যেমন একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশ থেকে কোনো একটি শার্ট আগে ১০ ডলার দিয়ে ক্রয় করত মার্কিন ক্রেতারা। সেটি ক্রয়মূল্য কম দেখিয়ে শুল্কের ভারসাম্য সমন্বয় করবে। অথবা আগের ১০ ডলারের শার্টে শুল্ক দুই ডলার আসত। বর্তমানে আসবে চার ডলার। আগের চেয়ে দুই ডলার বেশি। ফলে শার্টের দাম ১২ ডলার করে সমন্বয় করবে। এর কারণ শুল্ক আরোপ করা হয় বন্দরে আমদানির সময়ের ক্রয়মূল্যের ওপর, বাজারমূল্যের ওপর নয়। আরেকটি সুবিধা হলো, বাংলাদেশ মূলত মধ্যম ও কম দামের পণ্য রপ্তানি করে। এসব পণ্যের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০ থেকে ৬০ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম, চীন বা এমনকি ভারত এখন উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানি করছে। ফলে তারা যতটা আক্রান্ত হবে, বাংলাদেশ ততটা হবে না বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ছয়
বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, ট্রাম্পের এই পাল্টা শুল্ক বিশ্বকে বাণিজ্যযুদ্ধের দিকেও ঠেলে দিতে পারে। এই শুল্ক যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে একাধিক বিশেষজ্ঞ ও বাজার সমীক্ষা সংস্থা। এরই মধ্যে তার লক্ষণ দেখা গেছে। ট্রাম্প যখনই শুল্ক নিয়ে কিছু বলেছেন বা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছেন, তাত্ক্ষণিকভাবে মার্কিন শেয়ারবাজারে তার প্রভাব পড়ছে, সোনার দামের ওপর ঊর্ধ্বমুখী এবং ডলারের দামের ওপর নিম্নমুখী প্রভাবের কথা আগেই বলা হয়েছে।
তার পরও আমরা মনে করি, বাংলাদেশের উচিত হবে মার্কিন পণ্যের ওপর প্রচলিত শুল্কের হার ৭৪ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা এবং আলোচনার বা দর-কষাকষির ক্ষেত্র তৈরি করা। এর ফলে বাংলাদেশি পণ্যে মার্কিন শুল্ক হবে ১৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমাদের আমদানি এবং বাংলাদেশ থেকে সেখানে রপ্তানি যোগ-বিয়োগ এবং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার দিকে তাকালে দেখা যাবে, এই প্রক্রিয়ায় আমরা লাভবান হব। এমনটি মনে করছে অনেকেই।
সাত
আমেরিকা ফার্স্ট বা জাতীয়তাবাদী স্লোগানের ওপর ভর করে পাল্টা শুল্ক বসানো আমেরিকাকে হয়তো স্বল্পকালীন স্বস্তি দেবে। এমনও হতে পারে যে অতি উৎসাহী ট্রাম্প সমর্থক তাঁকে গাধার পিঠে উল্টো বসিয়ে আনন্দ উপভোগ করবেন এবং পরবর্তী সময়ে হাসাহাসি হবে এ নিয়ে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা আমেরিকা কিংবা বিশ্ব কারো জন্যই কল্যাণকর নয়। পৃথিবীর সব দেশের উচিত হবে তাদের শুল্কের কাঠামো যৌক্তিক করা। বাংলাদেশ যেসব পণ্য রপ্তানি করে, তা কম মূল্য সংযোজক এবং এর চাহিদা স্থিতিস্থাপকতাও অপেক্ষাকৃত কম। সুতরাং ২০ ডলারের শার্ট খুচরা বাজারে ২৩ ডলার হলে আমেরিকার নিম্নবিত্ত শ্রেণি ‘পালাই পালাই’ বলবে তেমনটি নয়, আবার ভারত, চীন কিংবা ভিয়েতনাম মূলত উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য (হাই ভ্যালু প্রডাক্ট) রপ্তানি করে বিধায় বাংলাদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা কম বলে মনে হয়। আখেরে নিজের দ্রব্য প্রতিযোগী করার বিকল্প নেই—‘সেই দিন নাইরে নাতি গাবুতগুবুত খাতি।’
লেখক : অর্থনীতিবিদ, সাবেক উপাচার্য
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ষষ্ঠ বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন ও ইউনূস-মোদি বৈঠক
- ড. সুজিত কুমার দত্ত

গত ৩ ও ৪ এপ্রিল ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ বিমসটেক (বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন) শীর্ষ সম্মেলন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই সম্মেলনে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার নেতারা অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ করে সম্মেলনের পার্শ্বক্রমে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যকার বৈঠক আঞ্চলিক কূটনীতিতে নতুন সমীকরণ সৃষ্টি করেছে। সম্মেলনে সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য ও পরিবহন সহযোগিতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দেয়।
ব্যাঙ্ককে অনুষ্ঠিত শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে অনুষ্ঠিত আধাঘণ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি আঞ্চলিক কূটনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই বৈঠকটি এমন এক সময়ে অনুষ্ঠিত হলো, যখন ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বেশ টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর থেকে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক যোগাযোগ অনেকটাই সীমিত হয়ে পড়েছিল।
এই পরিস্থিতিতে ইউনূস-মোদি বৈঠকটি নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে নতুন সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বৈঠকের পর বাংলাদেশের প্রেস সচিবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই সরকারপ্রধানের মধ্যে পারস্পারিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ। এ ছাড়া সীমান্ত হত্যা, তিস্তা নদীর পানিবণ্টনসহ অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। প্রেস সচিবের মতে, বৈঠকটি অত্যন্ত গঠনমূলক ও ফলপ্রসূ ছিল এবং দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর এই বৈঠকের প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বৈঠকে হাসিনার প্রত্যর্পণের বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এই বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অত্যন্ত সংবেদনশীল। সীমান্ত হত্যা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সীমান্ত হত্যা বন্ধে এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এই বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তিস্তা নদীর পানিবণ্টন দুই দেশের মধ্যে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। বৈঠকে এই বিষয়ে আলোচনা হওয়ায় সমস্যা সমাধানে নতুন করে আলোচনার পথ খুলেছে। তবে এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সমাধান না হলে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে।
বিমসটেক আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোরাম। এই শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ইউনূস-মোদি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ায় এই ফোরামের গুরুত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিমসটেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল এবং এর প্রভাব আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। এই বৈঠকের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে পুনরায় কূটনৈতিক যোগাযোগের পথ খুলেছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন করে আলোচনার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তবে এই আলোচনার ফলাফল নির্ভর করবে দুই দেশের সরকারপ্রধানদের সদিচ্ছার ওপর। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।
বিমসটেক সদস্য দেশগুলো বাণিজ্য, পরিবহন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশের চেয়ারম্যানশিপে এই উদ্যোগগুলো বাস্তবায়নে নতুন গতি আসবে বলে আশা করা যায়। তবে মায়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অন্যান্য দ্বিপক্ষীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাও জরুরি। ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির বৈঠক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। মায়ানমারের ভূমিকম্প ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে বিমসটেক সদস্য দেশগুলো উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে এগিয়ে যেতে পারে।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
datta.ir@cu.ac.bd

ড. ইউনূসের আরো স্থায়িত্বের প্রশ্নে কিছু কথা
- গাজীউল হাসান খান

আজকাল কোনো রাজনৈতিক কথা বলা কিংবা লেখার ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা সংকট দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। কোনো ব্যাপারে বক্তা কিংবা লেখকের নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটি পক্ষ নির্ধারণের প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে। অর্থাৎ বক্তা বা লেখক রাজনীতিগতভাবে কোন পক্ষের লোক, সেটি নির্ধারণের একটি প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এটি আমাদের পারস্পরিক সমঝোতা কিংবা বৃহত্তরভাবে বোঝাপড়ার অভাবেও হতে পারে।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দেড় দশক ধরে যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে গেছে, তাদের মধ্যে বর্তমানে একটি সুস্পষ্ট মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এই মতবিরোধ দেশের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র মেরামত বা প্রয়োজনীয় সংস্কারকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর মূল লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আগামী জাতীয় নির্বাচন। দুই দিন আগে হোক আর পরেই হোক, গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে দেশ পরিচালনার জন্য জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের কোনো বিকল্প পথ নেই।
নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় এসে যদি সব কিছু অর্থাৎ গণবিরোধী সব আইনকানুন বদলে ফেলতে পারতেন, তাহলে বিগত বছরগুলোতে এ দেশে ফ্যাসিবাদী শাসন, দুর্নীতি এবং সম্পদ পাচারসহ একটি জাতি বিধ্বংসকারী অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
অর্থ-বিত্ত কিংবা সম্পদের মালিকরাই রাজনীতি করবেন, আর কেউ নয়—সেটি আর চলতে দেওয়া যেতে পারে না। আজ যাঁরা দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং একটি বৃহত্তর সমঝোতার মাধ্যমে দেশের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। মতবিরোধ, দ্বন্দ্ব কিংবা সংঘাত কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে না। সে জন্য বিভিন্ন সংকট নিরসনে এখনই বিভিন্ন দল ও নেতার মধ্যে ঘন ঘন অন্তর্দলীয় আলোচনা শুরু করতে হবে এবং গড়ে তুলতে হবে একটি সর্বদলীয় ঐক্য ও সমঝোতা। ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি একটি ন্যূনতম ঐক্য, সমঝোতা ও সংহতি গড়ে না ওঠে, তাহলে বৈদেশিক শক্তি, যারা আমাদের পদানত করে শোষণ করতে চায়, তারা আবার অবাধে আমাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ইন্ধন জোগাতেই থাকবে। সে কারণেই দেশের অত্যাবশ্যকীয় সংস্কার এবং ভবিষ্যৎ নির্বাচন নিয়ে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য ও সমঝোতা গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। তা না করে নিজ নিজ অবস্থান থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান চলমান বিভেদ ও অনৈক্যকে আরো ব্যাপক এবং আত্মঘাতী করে তুলবে। এ দেশে রাজনীতি করতে হলে সবাইকে নিয়েই করতে হবে। কাউকে বাদ দেওয়া যাবে না। সুতরাং সে জাতি গঠনমূলক এবং জাতীয় স্বার্থের রাজনীতিতে সবাইকে ‘একদলীয় রাজনীতির মনোভাব’ দূর করতে হবে।
ওপরে উল্লিখিত বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে স্বদেশ থেকে পাঁচ হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমান বহুদিন ধরে অনেক গঠনমূলক কথাবার্তা বলেছেন। অনেকে সেগুলোকে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখেছে আবার কেউ কেউ বিভিন্ন ব্যক্তিস্বার্থ বা নেতৃত্বের টোপ হিসেবেও উল্লেখ করেছে। কিন্তু এই বিষয়টিকে গঠনমূলকভাবে জাতীয় স্বার্থের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করাই অত্যন্ত সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি। আমি একজন সাংবাদিক, লেখক ও কলামিস্ট। সুতরাং এ ক্ষেত্রে আমি আমার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়ে একটি কথাই বলতে চাই—সব দল একসঙ্গে ক্ষমতায় যায় না। তবে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে দেশের ছোট-বড় সব দল একসঙ্গে কাজ করতে পারে। তাহলেই রাজনীতির ক্ষেত্রে সাফল্য আসে। দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যায়। ফিরে আসি তারেক রহমানের সাম্প্রতিক বক্তব্যে। তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তিনি একটি সর্বদলীয় সরকার (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য) গঠন করতে চান, যাতে শুরুতেই জাতীয় ঐক্য ও স্বার্থ বিনষ্ট না হয়। উপরন্তু আগামী নির্বাচনে তারেক রহমান নবগঠিত নাগরিক পার্টির সঙ্গে একটি জোট গঠনেরও বাসনা প্রকাশ করেছেন।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক রাজনৈতিক প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে। এতে বিরোধিতা থাকবে না এমন নয়। জাতীয় স্বার্থে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ কিংবা কর্মসূচির গঠনমূলক সমালোচনা থাকতেই পারে। কেউ না কেউ সরকারি পদক্ষেপ বা কর্মসূচির বিকল্প লাভজনক পথও দেখাতে পারে। এতে জাতীয় স্বার্থে ঐক্য, সংহতি কিংবা সমঝোতা বিনষ্ট হবে না। তা ছাড়া নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টির কয়েকজন নেতা নির্বাচনের পর দেশে রাজনীতির কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থার এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়ে সফল উত্তরণের জন্য অর্থাৎ মধ্যবর্তী সময়ের জন্য একটি ‘ট্রানজিশনাল সরকার’ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। গভীরে তলিয়ে দেখতে গেলে সে প্রস্তাব তারেক রহমানের প্রস্তাব থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে কোনো মতবিরোধ আছে বলে মনে হয় না। মতবিরোধ যা-ই আছে, তা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছা অসম্ভব নয়। তা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠার সূচনায় রাষ্ট্র মেরামতের প্রশ্নে তারেক রহমান তাঁর একটি সংস্কার প্রস্তাব সংবলিত ৩১ দফা ঘোষণা করেছিলেন, যার মধ্যে বিবেচনা করার মতো যথেষ্ট বিষয়বস্তু রয়েছে। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। যত দিন কোনো জাতি বা রাষ্ট্র থাকবে, তত দিনই এই প্রক্রিয়া চলমান থাকবে। তবে কথা হচ্ছে, অগণতান্ত্রিক ও ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে বর্তমানে রাষ্ট্র মেরামত বা জরুরি সংস্কারের যে বিষয়গুলো রয়েছে, সেগুলোকে তো অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এটি বিবেচনা করার সময় যাঁদের হাতে নেই, তাঁরা দীর্ঘ ১৮ বছর কোথায় ছিলেন?
দেশের আপামর জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যোগ্য নেতৃত্বের অবস্থান কামনা করে। সে কারণেই অনেকে মনে করে, রাষ্ট্রক্ষমতায় অধ্যাপক ইউনূসের আরো কিছুটা সময় থাকা আবশ্যক। তাহলে দেশ ও জাতি একটি কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারবে। এটি কোনো অযৌক্তিক দাবি বা আকাঙ্ক্ষা নয়। কারণ ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তি, যাঁর প্রতি দেশের জনগণ এবং প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মহলের আস্থা রয়েছে। অন্যরা এই মুহূর্তে ক্ষমতায় আসীন হলে পতিত ফ্যাসিবাদীদের দোসর এবং আধিপত্যবাদী আন্তর্জাতিক মহলের চাপ নেওয়ার মতো শক্তি দেখাতে সক্ষম না-ও হতে পারে। এই কথাটি কি সার্বিকভাবে অস্বীকার করা যায়? যায় না। সুতরাং যাঁরা ড. ইউসূসের প্রতি আস্থা দেখাচ্ছেন, তাঁদের অপরাধটা কী? একাত্তর-পরবর্তী দেশীয় রাজনীতিতে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া ছাড়া কেউ তো তেমনভাবে কোনো আশার আলো দেখাতে পারেননি। এ ক্ষেত্রে বিএনপির কেউ কেউ যদি মনে করেন, তাঁরা অনেকেই শহীদ জিয়া কিংবা খালেদা জিয়ার মতো পরীক্ষিত নেতা হয়ে গেছেন, তাহলে সেটি হবে একটি দিবাস্বপ্নের মতো। তাঁদের প্রতি জনগণের তেমন আস্থা থাকলে তো বহু আগেই শেখ হাসিনার পতন ঘটত। সুতরাং সমালোচকের মুখে কথা তুলে না দিয়ে বাস্তববাদী হওয়া অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। এ ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে দিব্যদৃষ্টি ও বাস্তববাদিতা। একটি অপেক্ষাকৃত দুর্বল টিমকে মাঠে নামিয়ে খেলায় হেরে যাওয়ার চেয়ে বাছাইকৃত শক্তিশালী একটি টিমকে মাঠে নামিয়ে প্রতিপক্ষকে হারিয়ে দেওয়াই প্রকৃত ক্রীড়ামোদীদের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে দেশপ্রেমিক জনগণের লক্ষ্যও একটিই। বাংলাদেশকে জেতাতে হবে। সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধন করতে হবে। শত্রুর সব অপকৌশল ঠেকাতে হবে। দেশের অভাবনীয় উন্নয়ন সাধন করতে হবে। বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও সমৃদ্ধির গতি বেগবান করতে হবে। তরুণদের দিয়ে সেটি সম্ভব। জরাগ্রস্ত বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের দিয়ে সেটি কতটুকু অর্জিত হতে পারে? এ কথা দেশপ্রেমিক জনগণ যতটা ভাবে, ক্ষমতালোভী দলীয় নেতাদের অনেকে মনকে সেটি বোঝাতে পারেন না।
এসব কারণে তরুণ নেতা তারেক রহমান চান জাতীয় ভিত্তিতে একটি বৃহত্তর ঐক্য, যা তাঁকে এবং দেশের তরুণ নেতৃত্বকে একটি বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আসনে সমাসীন করবে। লুকোছাপার কিছু নেই। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অনেকেই চায় অতি প্রয়োজনীয় বা আবশ্যকীয় সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে অধ্যাপক ইউনূসের উল্লিখিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়া হোক। তা থেকে বাছাইকৃত তরুণ নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে (দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কিংবা প্রাপ্ত ভোটের হিসাবে) একটি মধ্যবর্তী কিংবা Transitional Governmentগঠন করা হোক, যার নেতৃত্বে থাকবেন ড. ইউনূস। তাঁকে যেকোনো একটি আসন খালি করে পাস করিয়ে আনা সম্ভব হবে। তা ছাড়া সেই সরকারের নেতৃত্বে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবেন তরুণ নেতা তারেক রহমান। তাঁকে রাষ্ট্র পরিচালনায় সাহায্য করবেন তরুণ নেতারা, যাঁদের দিনে দিনে যোগ্য রাজনীতিক ও নেতা হিসেবে গড়ে (প্রশিক্ষিত) তোলা যাবে। জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যদের মধ্যে কেউ ইচ্ছা করলে বিরোধী দলের আসন অলংকৃত করতেও বাধা থাকবে না। দেশের বৃহত্তর বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবী মহলের একটি বিশাল অংশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন ও সরকার গঠন নিয়ে চিন্তা-চেতনা এমনই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষককুল কিংবা শহর-নগরে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের ধ্যান-ধারণাও এখন এভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। এগুলো আমার কোনো ব্যক্তিগত অভিলাষ নয়।
লেখক, সাংবাদিক কিংবা বিশেষ করে কলাম লেখকরা যা শোনেন, যা দেখেন, সেটি নিয়েই লিখে থাকেন। এতে কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই। এর পেছনে দেশপ্রেম বা দেশের বৃহত্তর স্বার্থ ছাড়া আর যা-ই থাক, কোনো চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্র নেই। দেশের সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই রাজনীতিকদের চেয়ে আগে ভেবে থাকে। তারা দেশের স্বার্থ, উন্নতি ও সমৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই চায় না। অন্যদিকে দেশের চিন্তাশীল মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা চান দেশের আর্থ-রাজনৈতিক সমৃদ্ধি ও মুক্তি। আধিপত্য কিংবা সম্প্রসারণবাদীদের প্রভাব কিংবা নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি দেশ, যেখানে থাকবে মানুষের গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার। এবং ঘটবে অর্থনৈতিক মুক্তি কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ ও ছাত্র-জনতার।
লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com