ঘন কুয়াশার ধূসর রং গায়ে মেখে মাঘের শীত নেমেছে ধরণিতে। পলিস্টারের শার্টের ওপর একটা হাফ স্লিভ পশমি সোয়েটার গায়ে দিয়ে দুই নম্বর গুলশানের বাস ছাউনিতে অপেক্ষা করছিল সবুজ। কনকনে শীতসন্ধ্যায় রাস্তা ফাঁকা। ফুটপাতে দু-একটা নেড়ি কুকুর শুয়ে ছিল লেজ গুটিয়ে।
ঘন কুয়াশার ধূসর রং গায়ে মেখে মাঘের শীত নেমেছে ধরণিতে। পলিস্টারের শার্টের ওপর একটা হাফ স্লিভ পশমি সোয়েটার গায়ে দিয়ে দুই নম্বর গুলশানের বাস ছাউনিতে অপেক্ষা করছিল সবুজ। কনকনে শীতসন্ধ্যায় রাস্তা ফাঁকা। ফুটপাতে দু-একটা নেড়ি কুকুর শুয়ে ছিল লেজ গুটিয়ে।
সুপারস্টার নায়ক রাজুর আজ জন্মদিন। নায়ক/নায়িকা-তারকাদের কোনো পার্টিতে আজকেই প্রথম আমন্ত্রণ পেয়েছে সবুজ। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে ও একটা সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বিষয়ক ম্যাগাজিনে কাজ পায় নবিশ বা অ্যাপ্রেনটিস হিসেবে। সে আটাত্তর সালের গোড়ায়।
বাংলা ভাষার ছাত্র বলে ওদের আশি শতাংশই ছিল মেয়ে। সবুজরা ছিল ক্লাসে হংস মাঝে বক যথা। তো, এই বেতনে তো আর রিকশায় ওঠার মতো বিলাসিতা ওর সাজে না, তাই হেঁটেই দিনে গোটা ঢাকা শহর চক্কর দিয়েছে। মাস্টার্সের পর কোনো ছাত্রীর তো আর আইবুড়ো থাকার কথা নয়।
সেই দীপালি সেনগুপ্ত একদিন হেলালের সামনেই সবুজের একটি হাত ধরে টেনে হিড়হিড় করে নিয়ে গেল করিডরের ওপাশে। হেলাল ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না—এটা কী ঘটল! ও তো হাত বাড়িয়েই আছে—ওর হাত না ধরে একটা বেঁটেখাটো লিকলিকে ছেলের হাত ধরল! মানলাম ছেলেটার ভালো ছাত্র হিসেবে সুনাম আছে, কিন্তু ও মেনেই নিতে পারে না, সেটা কি ওর হাত ধরার যোগ্যতা হলো! ওর মন বলে, নিশ্চয়ই ও ওকে নিয়ে ফান করছে। আর যদি ফান না হয়েই থাকে তাহলে ব্যবস্থা আছে। একদিন শালার লিকলিকেকে দোতলা থেকে ফেলে দেব নিচে। ব্যস, প্রেমের কবর হয়ে গেল বলে দুই হাত একত্র করে কিছু ঝাড়ার ভঙ্গি করে।
দীপালি সবুজের হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নেমে নিচে নিয়ে যায়। দীপালি সবুজের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। সবুজ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। দীপালি সবুজের হাত ধরেই ছিল। বলে, ক্লাস ছুটি হয়ে গেলে তুমি কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যাও—বলো তো! তোমাকে ডিপার্টমেন্ট, লাইব্রেরি, টিএসসি—সবখানেই খুঁজি, পাই না। তোমার এই রহস্যজনক অন্তর্ধানের রহস্য কী? সবুজের মুখটা অত ভরাট না আবার মুখের সামনের দুটি হাড়ও প্রকাশ্যে আসেনি—তবে চোখ দুটিতে মায়া আছে। সেই মায়াডোরেই ও বাঁধা পড়েছে কি না কে জানে! ভাবছিল। দীপালি বলে, আমি তোমাকে একটি প্রশ্ন শুধিয়েছিলাম—জবাবটা কিন্তু পাইনি...
সবুজ মুখে কিছুটা স্মিত হাসির রেখা টেনে উত্তর দিতে চাইলেও হাসির বদলে মুখটা মলিন ও কিছুটা কঠিন দেখায়। বলে, আমার কাছে তো পূর্ণিমার চাঁদকে মনে হয় ঝলসানো রুটি...
দীপালি মোটেই এ রকম একটি উত্তরের জন্য তৈরি ছিল না। হঠাৎ ব্যথা পেলে মানুষ যেমন ককিয়ে ওঠে—তেমনি দীপালিও একটা আর্তচিৎকারের ভঙ্গি করে। বলে, কথাটা আমি নিতান্ত কৌতূহল থেকেই বলেছিলাম কিন্তু...
দীপালিকে বোঝানোর ভঙ্গিতে সবুজ বলে, বিষয়টা এত সিরিয়াস নয়। আমি একা নই—আমার মতো অনেকেই আয় করে পড়ে। তা ছাড়া তোমার মতো একজন অতীব সুন্দরী, খ্যাতনাম্নী মেয়ে আমাকে নিয়ে ভাবে—এটা তো স্বপ্নের নাগালে থাকার কথা নয়। তোমাকে আকর্ষণ করবে—এমন তো কিছুই আমার নেই।
দীপালির মুখ দেখে মনে হলো সে কিছুটা বিরক্ত। সবুজের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলে, জীবন হচ্ছে একটা সুন্দর পছন্দ—লাইভ ইজ আ বিউটিফুল চয়েস, সেটাকে উপভোগ করার মানসিকতা থাকাটাও অপরিহার্য...
সবুজ বলে, জীবন মানেই তো একটা প্রবহমান নদী, আমরা সেই নদীর স্রোতে শেওলার মতো ভেসে চলেছি—সেই স্রোতই আমাদের আটকে দেয় কোনো কোনো ঘাটে। ক্ষণিকের তরে আমাদের জীবনটা স্তব্ধ হয়ে যায়। আবার প্রবল জলোচ্ছ্বাসে সেই শেওলা ভেসে যায়। বেঁচে থাকে অস্তিত্বে, নয়তো মিলিয়ে যায় কোথাও।
জীবন সম্পর্কে ব্যাখ্যাটা দীপালির মনে ধরল কি না তা ওর মুখ দেখে সবুজ ঠিক বুঝতে পারল না। নারীর মন তো দেবতারাই বুঝতে পারে না, আর মানুষ তো ছাড়। অবশ্য সবুজের মেয়েভাগ্য খারাপ না। ভালো সুন্দরী মেয়েরা ওর সঙ্গে যেচে কথা বলেছে। ঠারেঠুরে কিছু বলার চেষ্টাও করেছে। কিন্তু সবুজ ছিল নির্মোহ। বাবার একটা উপদেশ ও শিরোধার্য করেছে জীবনের তরে। ‘জীবনে দাঁড়াতে হবে, কোনো কিছু যদি তোমার ভাগ্যে থেকে থাকে তা তোমার মাঝেই ঘুরে ঘুরে আসবে।’ সে ধারণা ও জীবন থেকেই পেয়েছে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার মতো কোনো সামর্থ্যই ওর ছিল না। দরিদ্র বাবার সংসার মানেই নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তার পরেও ও এখানে পড়ছে!
দীপালি মুখ ভার করে বলে, আজ এ অবধিই। রেডিওতে আমার একটা রিহার্সাল আছে। বলে হনহন করে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাঁকে মিলিয়ে যায়। একটা অস্বস্তি ওর মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। বিষয়টাকে তেমন একটা আমল না দিয়ে ডিপার্টমেন্টেই আবার ফিরে যায়। হেলাল যেন ওর আগমনের অপেক্ষায়ই ছিল। ওর কাঁধে হাত রেখে উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, তোর ভালোর জন্যই বলছি, ওর হাতটা ছেড়ে দে। সবুজ ঠিক বুঝতে পারে না হেলাল ঠিক কী বলতে চাইছে! হেলালের চোখে চোখ রেখে পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, কার হাত ধরলাম? হেলাল তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলে, ওই যে আম্রপালি নাকি তোকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গেল! ও আসলে ভুলে তোর হাত ধরেছে...ধরার কথা ছিল—ওর একটা হাত দেখিয়ে বলে, আমারটা! লেকচার দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, একবার নিজেকে প্রশ্ন কর—কী চার্ম আছে তোর? একটা সুন্দরী মেয়ে কেন তোকে দেখে মজবে! সবুজ আর নিজেকে সংযত করতে পারে না। অধৈর্য ভঙ্গিতে বলে, তোর কথা শেষ হয়েছে? সবুজের বলার ভঙ্গিতে কিছুটা ঔদ্ধত্য প্রকাশ পায়। একটা ছোটখাটো ভিড় জমে গিয়েছিল। তাতে ছেলেও আছে, দু-তিনজন মেয়েও ছিল। তারা মুখ টিপে টিপে হাসছিল। হেলাল সবুজের ওপর খেপে গিয়ে বলে, এর পরেও যদি আম্রপালির হাত ধরিস—
সবুজ নামের সংশোধনের ভঙ্গিতে বলে, ওর নাম আম্রপালি নয়—দীপালি, দীপালি সেনগুপ্ত। হেলাল আরো খেপে যায়। বলে, আমার ওপর কথা! তোরে ধইরা ফিকা ফালাইয়া দিমু নিচে...হাড্ডিগুড্ডি ভাঙব...আমিই তোরে অবশ্য রিকশায় করে মেডিক্যালে নিয়া যামু...কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে হেলাল বলে, আফটার অল, আমি তো ইনসান...
সবুজ বিদ্রুপ করে বলে, ইনসান! তোর মতো ইনসানের যদি কাজ হয় মানুষকে ফিকে ফেলার...আমিও তো তোর মতোই ইনসান...আমিও জানি কিভাবে তোকে সাইজ করতে হয়...তোর ভুঁড়িটা ফেড়ে দেব, ফ্লোরেই পড়ে থাকবি...মেডিক্যালে যাওনের আগেই ফুস। হেলাল ওর শার্টের হাতা গুটিয়ে ওর দিকে তেড়ে আসার সময় কোত্থেকে যেন দীপালি ছুটে এসে ছোঁ মেরে ইগল পাখির মতো সবুজকে উঠিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে গেল। হেলাল দেখল—সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখমুখ লাল হয়ে উঠল। পরাজিত সৈনিকের মতোই সে রণে ভঙ্গ দিল।
হঠাৎ প্রচণ্ড শীতের কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়ায় সবুজের সংবিৎ ফিরে এলো। জন্মদিনের পার্টিতে এসেছে। গুলশানের বাসে করে এসেছে, তখন ঘড়িতে বাজে সাতটা। আটটার আগে কী করে যায়। তা ছাড়া তারা ঝিলমিল সিনেমা সাপ্তাহিকীতে যোগ দিয়েছে মাত্র মাস তিনেক হবে। ও মূলত স্পোর্টস আর ফিচার পাতাই দেখত। একদিন নির্বাহী সম্পাদক সারওয়ার ভাই বললেন, রোমে এসেছেন, রোমানদের মতো বিহেভ করবেন না—তা কী করে হয়! এটা তো সিনেমার কাগজ...আপনি একজন সিনে জার্নালিস্ট। নায়ক/নায়িকাদের ইন্টারভিউ আর তাঁদের খোঁজখবর করবেন, এটাই হবে আপনার মূল উপজীব্য বিষয়। মাইন্ড দ্যাট। এবারের কাভার স্টোরির অ্যাসাইনমেন্ট আপনাকেই দিলাম। ঈদ সংখ্যায় নায়িকা ববির ইন্টারভিউতে কিছুটা কন্ট্রোভার্সির সৃষ্টি হয়েছে। আপনি নতুন তো! বলবেন, আপনি এর কিছুই জানেন না। ট্যাক্টফুলি তাঁর বক্তব্যটা নিয়ে আসবেন। বলবেন, অবশ্যই আপনার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আছে।
সবুজ ঠিক বুঝতে পারেনি—বিষয়টা কত জটিল। ইন্টাভিউয়ের আগে ঈদ সংখ্যাটা পড়ে দেখল। যেভাবে নায়িকাকে পোর্ট্রে করা হয়েছে—তা ঠিক সুবিচার করা হয়নি। যে সাংবাদিক এটা লিখেছে সে এক নায়িকার ভক্ত। তাকে তুষ্ট করার জন্যই এটা করেছে। চিত্র সাংবাদিকতার এই ঘোরপ্যাঁচে সে অভ্যস্ত নয়। খোঁজখবর নিয়ে সবুজ জানল, পত্রিকায় ববির ভক্ত সাংবাদিকও আছে। নতুন বলে সে তাদের সাহায্য চাইল। তারা জানাল—তাদের অ্যাসাইনমেন্ট না দিয়ে যেহেতু তাকেই দিয়েছে—অতএব প্রোবলেম তাকেই সল্ভ করতে হবে। এবং এ সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতেও তারা তাদের অপারগতার কথা জানায়। সবুজ বুঝতে পারে, প্রফেশনাল জেলাসির গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছে। ওর একটা জেদও চেপে বসেছে। সন্ধ্যা নাগাদ এফডিসিতে গিয়ে নায়িকা ববিকে খুঁজে পেল একটি ফ্লোরে শুটিংরত অবস্থায়। ব্রেক হতেই সবুজ ওর পরিচয় দিয়ে বলল, এ সপ্তাহের কাভারে তার ছবি যাচ্ছে। তার একটা ইন্টারভিউয়ের জন্য সময় চাইতে এসেছে। নায়িকা ববি ততোধিক নিস্পৃহ কণ্ঠে বললেন, আপনার সম্পাদককে গিয়ে বলবেন, আমি আর কক্ষনোই আপনাদের পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেব না। কাভারেও আর আমার ছবি ছাপতে বলবেন না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক নায়িকাই তো আছেন। তাঁদের ছবিই না হয় ছাপবেন। আমার ছবি না ছাপলেও আপনাদের কোনো ক্ষতি হবে না।
সবুজ বলে, ক্ষতি হবে না কেন! আপনি তো একজন পপুলার হিরোইন...
আপনার এডিটর তো তা মনে করেন না।
কিছুটা মিনতির ভঙ্গিতে সবুজ বলে, দেখুন, আমি তো নতুন...অ্যাসাইনমেন্ট ফেল করলে ঝামেলায় পড়ে যাব। মুখে স্মিত হাসির রেখা টেনে নায়িকা বললেন, কোনো ঝামেলাতেই পড়বেন না। আপনি নতুন, তাই অ্যাট লিস্ট আপনার সঙ্গে কথা বললাম। ঘটনাটা কে ঘটিয়েছে, কেন ঘটিয়েছে, এ ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা নেই। কাজ করলে ধীরে ধীরে আপনারও ধারণা হবে। দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ইন্টারভিউ আমি দেব না। বলে শট দিতে চলে গেলেন।
পরের দিন অফিসে এসে সবুজ সম্পাদককে সব বলল। সম্পাদক সাহেব একটা পার্সোনালিটির ট্যাবলেট খেয়ে বললেন, ইটস ইওর অ্যাসাইনমেন্ট। ইওর জব গেট ইট ডান। সবুজ একটু ভয় পেয়ে গেল। ওর প্রবেশনারি পিরিয়ড এখনো শেষ হয়নি। তাই ছুটে গেল এফডিসিতে। শুনল, নায়িকা ভোরেই চলে গেছে সোনারগাঁয় আউটডোর শুটিংয়ে। তার পরও সবুজ ঠিক বিশ্বাস করতে পারে না। অন্যান্য ফ্লোরেও ঢু মেরে সবুজ নিশ্চিত হয়, নায়িকা ঢাকায় নেই। সবুজের পা দুটি আর চলতে চায় না। পায়ে পায়ে চলতে চলতে ও এফডিসির শহীদ মিনারের বেদিতে বসে পড়ে। দুশ্চিন্তা আর অবসাদে মুখটাও তেতো হয়ে আছে। সিগ্রেট ধরিয়েও টানতে ইচ্ছা করে না। বিমর্ষ মুখে বেদিতে হেলান দিয়ে চোখ বুজে চুপচাপ বসে ছিল। হঠাৎ একটি হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করে। চমকে ওঠে ও। দেখে রহমান আর জামান দুই চিত্র সাংবাদিক—আবার হরিহর আত্মাও! সবুজের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। রহমানের শরীরে একরত্তি মাংস নেই, শুধু হাড়—শার্ট-প্যান্টের বদলে সব সময় পাজামা-পাঞ্জাবিতে অভ্যস্ত। আর জামানের শরীর আয়েশি—বাউল নয়, তবু বাউলের ঢঙে কাঁধ অবধি চুল নোয়ানো। যখন কথা বলে, মনে হয় একজন মানবতাবাদী অ্যাক্টিভিস্টের সঙ্গে কথা বলছি। সিনেমার নায়িকা আর এক্সট্রা—সবার জন্যই ওর সমান মায়া। আর রহমান কথা বলে বেশ গুছিয়ে। কোনো সমস্যাই ওর কাছে সমস্যা নয়। ও আস্ত একটা মুশকিল আসান। ওরা দুজনেই টোয়েন্টিফোর আওয়ার্স এ ডে আর সেভেন ডেজ এ উইকই চিত্রশিল্পের সংবাদ সংগ্রহের কাজে নিজেদের ব্যতিব্যস্ত রাখে। এফডিসি, নায়ক-নায়িকা, এমনকি এক্সট্রাদের বাড়িতে ঢু মারা ওদের নিত্যদিনের রুটিন। সবুজের দুই সহকর্মীও আছে এই দলে। একজন লম্বু, আরেকজন বাটকু—ইন্ডাস্ট্রির লোকজন ওদের নাম দিয়েছে লরেল অ্যান্ড হার্ডলি। শুনেছে ওরা সকালে বেরোয় আর বাড়ি ফেরে অনেক রাতে। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স হলেও বাটকু ভদ্রলোক এখনো বিয়ের পিঁড়িতে বসেনি। কারণ তার পাত্রীকে হতে হবে ববির মতো একহারা গড়নের স্লিম আর মুখটা হতে হবে নায়িকা শবরীর মতো মিষ্টি। তার এই পছন্দের কথা চাউর হতেই নায়িকা শবরী আর নায়িকা ববি দুজনেই তাঁদের বেস্ট উইশের কথা জানিয়েছেন। এ লাইনে শত্রুর তো অভাব নেই। কেউ হয়তো সাংবাদিকের এই আকিঞ্চনের কথা তাদের জানিয়ে থাকবে। নায়িকা সুচিতার ঠোঁটকাটা বলে সর্বজনের কাছে সুবিদিত। সব শুনে তার মন্তব্য ছিল, উনি কি দেখতে নায়ক রাজুর মতো নাকি! মনে হচ্ছে, ঢাকায় ও পাবনা মেন্টালের একটা বেঞ্চ খোলাটা এখন সময়ের দাবি। একবার নির্ভরযোগ্য সূত্রে লরেল অ্যান্ড হার্ডলি খবর পেল, জনৈক ব্যাচেলর ও হ্যান্ডসাম প্রোডিউসার ধানমণ্ডি পনেরো নম্বরের আশপাশে বাস করে এমন এক নায়িকার বাড়িতে মধ্যযামিনীতে অভিসারে যাবে। তারা রাত এগারোটা নাগাদ ওই নায়িকার বাড়ির আশপাশে অবস্থান নেয়। ধানমণ্ডির লোকজন ধনী—ভালোমন্দ খায় আবার তাদের রক্ত চুষে এই এলাকার মশারাও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। এখানকার মশারা কখনো ভুলেও বস্তি এলাকায় যায় না। বস্তিবাসীদের রক্তে আর রক্ত থাকে না। পানিতে ছয়লাব।
লরেল অ্যান্ড হার্ডলি সাহেবদের তথ্য সঠিক। ঠিক রাত পৌনে বারোটায় প্রোডিওসারের ওদের অতি পরিচিত লাল রঙের টয়োটা গাড়িটা নায়িকার বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকল। উত্তেজনায় তাদের দুজনারই রক্ত টগবগ করে ফুটছে। এই সুযোগে মশারাও ওদের হুল ফুটিয়ে নির্বিঘ্নে ডিনার সারার ব্যস্ত সময় পার করছে। এবার লম্বুজন বলে, দেখলাম তো! এবার চলেন। আমার তো আবার ফ্যামিলি আছে। বাটকুজন তেড়ে ওঠে, হ্যাঁ, আপনারই তো ফ্যামিলি আছে, আর তো কারো নেই। লম্বুও ফোড়ন কাটতে ছাড়ে না। বলে, আর কারো আছে নিশ্চয়ই, তবে আপনার তো নেই। এটা তো ফ্যাক্ট। বাটকু খেপে যায়, অত পিন মারেন ক্যান। হইব তো। লম্বুজন হতাশার সুরে বলে, আর হইছে! তো একজনকে ছেড়ে আরেকজন তো যেতে পারে না। লম্বুজন অধৈর্য হয়ে বলে, খবরের সত্যতা তো মিলেছে। আর অপেক্ষা কেন! বাটকুজন হাসি হাসি মুখ করে বলে, রাখেন না ভাই, একটু হ্যালো করে যাই। শালার রাতের ঘুমটা হারাম করে দিয়ে যাই। ওরা দুজনে স্থান বদল করে বাড়ির গেটের কাছে পজিশন নেয়। যেন ভদ্রলোক গাড়িতে ওঠার সময় ওদের দেখে।
রাতটা দেড়টা নাগাদ ভদ্রলোক বেরিয়ে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই এই মূর্তিমান দুই চিত্র সাংবাদিককে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে ওঠে। বলে, এত রাতে আপনারা এখানে? বাটকুজন এক্সটেম্পো মিথ্যা বলতে পারে। বলল, এই পথ দিয়েই যাচ্ছিলাম, দেখলাম আপনার গাড়িটা গেট দিয়ে ঢুকল। আমরা সাংবাদিক তো, সত্যতা যাচাই না করে যাই কী করে! ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, তাই বলে এতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মশার কামড় খাচ্ছেন! বলে ভদ্রলোক তাঁর মানিব্যাগ থেকে এক শ টাকার নোট লম্বুজনের হাতে দিয়ে বলেন, নেক্সট টাইম একটা এরোসল কিনে আনবেন। হাসতে হাসতে বলেন, মজা মারে খজা ভাই, মাঝখান থেকে ঘুম কামাই! ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দেয়।
রহমান সবুজকে শুধায়, জুম্মায় জুম্মায় সাত দিন চিত্র সাংবাদিকতায় এসেছেন—এর মধ্যেই কাউকে মন দিয়ে বসে আছেন নাকি! সবুজ কাষ্ঠ হাসি হেসে তার দুঃখের কথা বলে। রহমান হাতে তুড়ি দিয়ে বলে, এটা একটা প্রবলেম হলো নাকি! সোনারগাঁয় আমার চাচা থাকে। চলেন সোনারগাঁ। নায়িকা ইন্টারভিউ দেবে না বললেই হলো! আপনার চাকরি টিকিয়ে রাখার স্বার্থে যা যা করণীয় সবই আমরা করব। আমরা তো আপনাকে আমাদের গ্রুপে পেয়ে হেভি খুশি। সিনিয়র সাংবাদিকরা তো এত দিন খুবই পাউলি মারছে। এবার তাদের চোখা নাক ভোঁতা করতে হবে না!
ঢাকা থেকে সোনারগাঁয় পৌঁছতে পৌঁছতে ওদের বেশ রাত হয়ে গেল। শহরে শীতটা টের পাওয়া যায় না। আর গ্রামে সন্ধ্যা নামে কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে। শরীরে কোনো গরম কাপড় না থাকায় ওরা বেশ শীত অনুভব করছে। ভারী কুয়াশায় চাঁদের আলো তার দ্যুতি ছড়াতে না পারলেও তার আলোতে কুয়াশার রূপটা প্রকৃতিতে ধরে রেখেছে। প্রকৃতির রূপে সবুজ এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে যায় যে ওর অস্তিত্বই ভুলে যায়। পরে নিজেকে আবিষ্কার করে একটি সুন্দর দোতলা বাড়ির একটি কক্ষে, যেখানে নায়িকা ববি ওর দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছিল। রহমান আর জামান তাঁর যে খুব প্রিয় তা তাঁর কথায়ই বোঝা গেল। জামান তাঁকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল, ওর পত্রিকা তো আপনার চিরপ্রতিদ্বন্ধী নায়িকা মানে ওই ময়দার বস্তার দখলে...ববি খুব সুন্দর করে হাসির ভঙ্গি করেন, কিন্তু হাসেন না। জামান বলে, এখন আমাদের সবুজ ওখানে জয়েন করেছে...ওখানে আপনার ক্যাম্প গাড়তে হবে না?
হাসতে হাসতে ববি বলেন, দেখুন, আমি ওসব ক্যাম্পট্যাম্পে তো বিশ্বাসী নই...তবে আমার কিছু অ্যাডমায়ার তো আছে... আপনাদেরকে আমার অ্যাডমায়ার বলব না...আমিই বরং আপনাদের অ্যাডমায়ার...এই যেমন আপনারা ফিল্ম পলিটিকসের বিরুদ্ধে সোচ্চার...রিয়েলি আপনাদের এই ভূমিকা আমি অ্যাপ্রিশিয়েট করি।
এই ফাঁকে রহমান বলে, ম্যাডাম, সিঙ্গাপুর থেকে আপনি যে আমাকে পারফিউম এনে দিয়েছেন, তার গন্ধে একটা আবেশ জড়ানো ভাব আছে। জামানের মুখটা একটু ভার হয়। তা নায়িকার দৃষ্টি এড়ায় না। তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলেন, নেক্সট উইকে আমার বাসায় আসছেন তো! জামান ইঙ্গিতটা বুঝে যায়। বলে, অবশ্যই। অনেক খবর আছে। নায়িকা মিটিমিটি হাসেন। তিনজনের দিকেই তাকিয়ে নায়িকা বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই টায়ার্ড। হিরোর সঙ্গে মানে রাজু ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন?
রহমান বলে, না, ডাইরেক্ট আপনার কাছেই এসেছি। মুখে কিছুটা ব্যক্তিত্ব এনে নায়িকা বলেন, নায়ক/নায়িকার কাছে সাংবাদিকরা আসবে সেটা ইনডোর হোক আউটডোর হোক, এটাই স্বাভাবিক। তবু আমরা যখন আউটডোর লোকেশনে আসি তখন সময়টা খুবই প্রেসাস—স্যরি টু টেল ইউ, প্রযোজকরা খুব একটা হ্যাপি হন না। সেটা একটু ম্যানেজ করে চলবেন প্লিজ। আমার হাউসে আপনারা অলওয়েজ ওয়েলকাম...এনি টাইম...নো প্রবলেম...
ওরা আর কথা না বাড়িয়ে কেটে পড়ে।
ওরা রুম থেকে বেরিয়ে দেখে, নায়ক রাজু একটা ছোট্ট ঘরে একটা ডিভিডি প্লেয়ারে মুভি দেখছেন। তাঁর চারপাশ ঘিরে আছে শিল্পী-কলাকুশলীরা। নায়ক রাজু এই ছবির নায়ক, পরিচালক ও প্রযোজক। ওদের তিনজনকে দেখে নায়ক উল্লসিত হয়ে বলেন, এই যে তরুণ তুর্কির দল এসে গেছে। সবুজ তার পরিচয় দিয়ে বলে, একটু ঝামেলায় পড়ে এসেছি। আপনার সময় নষ্ট করার জন্য দুঃখিত। নায়ক রাজু হেসে ফেলেন। বলেন, এখন তো আমার শুটিং নেই। আজকেই ক্যাম্প গেড়েছি। বেশ শীত পড়েছে। ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। সবকিছুই নিঝুম নিঃস্তব্দ। তাই অ্যাকশন ছবি দেখছি। সবুজকে অভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে নায়ক বলেন, নতুন এসেছেন তো, বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই—এ সাংবাদিকতা গতানুগতিক নয়। আলো-ঝলমলে তারার জগৎ—তার মধ্যে আঁধারেরও একটা রেখা আছে। নায়কের কথাগুলো সবুজের মনে বেশ ধরে। সপ্রশংস দৃষ্টিতে বলে, আপনার ওয়ে অব টকিং তো খুব সুন্দর! নায়ক সবুজের কমপ্লিমেন্টটা রিসিভ করার ভঙ্গিতে বলে, থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট। বললেন, এই রাতে আপনাদের কী অফার করতে পারি...রাতের খাবার তৈরি হচ্ছে...ওরা তিনজনেই সমস্বরে বলে ওঠে...নো নো থ্যাংকস...নায়ক বলেন, ওকে দেন। বললেন, পাশে বিশাল ক্ষেত দেখছেন না, ওখানেই সকালে গানের শুটিং হবে...ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
ওরা তিনজনেই বাংলোবাড়ি থেকে বেরিয়ে ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে শুনতে আর জোনাকির নীল-সবুজাভ আলো দেখতে দেখতে অন্ধকারে মেঠো পথে পথ করে নেয়।
ছোট্ট পাড়াগাঁয় সূর্য যেন তার সোনার থালাটা ধরে রেখে শীতের কুয়াশাকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ওরা ঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু যেন না ভাঙে সেভাবে পা ফেলে এগোয়। দূর মাঠে দেখতে পায় সিনেমার শুটিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। কুয়াশার ওশ ভেসে যাচ্ছে। সেই হালকা হাওয়ায় ধনেপাতার গন্ধ পাচ্ছে ওরা। টাটকা সতেজ সবুজ ধনেপাতা। পাশে শিশির মাখানো সরষে ফুল দুলছে একটু একটু করে। অফিসে গিয়েই লেখাটা দিতে হবে। সবুজ মনে মনে লেখার একটা খসড়া তৈরি করে ফেলে। কাব্য, নিসর্গ, টাটকা সবুজ ধনেপাতা আর নায়িকার মিনি ইন্টারভিউ...ফার্স্ট ক্লাস!
নারায়ণগঞ্জের অদূরে পাগলা স্টুডিওতে শুটিং করছিলেন নায়ক রাজু। সবুজের পত্রিকার ফটোগ্রাফার চারু ছবি তুলতে গিয়েছিল। তাকে দেখে নায়ক উচ্ছ্বসিত—এই চারুকে চা দে। চারু তো অবাক। নায়কই বললেন, তোমাদের ওই নতুন রিপোর্টারটা তো বেশ ভালো। ও আমাদের ওখানে গিয়ে একটা রিপোর্ট লিখেছে...ভেরি নাইস। আমার কথা বোলো ওকে।
চারু পরের দিন অফিসে এসে সবুজকে বলে, তুমি তো মিয়া হেভি দেখাইছ...কাল হিরো তো তোমার প্রশংসা করলই, আমাকেও রাইড দিল। বললাম, আমাকে রাস্তার পাশেই নামাইয়া দেন...হিরো বলে, না তোমার বাসার সামনে নামিয়ে দেব। এত দূর এলাম আর তোমার বাসা অবধি যেতে পারব না!
চারু বলে, আর কী কবা মিয়া...আশপাশে তো ভিড় জইমা গেল...বউ তো আছেই পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে, কত ইজ্জত বাইড়া গেল...বলে অফিস সহকারীকে ডেকে বলে, সবুজকে চা খাওয়া, শিঙাড়া খাওয়া...
দুই
সবুজ তার হাতঘড়িতে দেখে আটটা বেজে দশ। সে ভাবে, এখন যাওয়া যেতে পারে। পায়ে পায়ে নায়ক রাজুর বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়ায়। রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে কেউ কেউ ভেতরে ঢুকছে। দারোয়ান ওকে চেনে না। তাই অবশ্যই ওকে ঢুকতে দেবে না। তাই চেনাজানা কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। পেছন থেকে একজন ওর কাঁধে চাপড় মেরে বলে, আরে সম্বাদিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন যে, ভেতরে ঢুকবেন না? ভদ্রলোককে নায়ক রাজুর শুটিং লোকেশনে দেখেছিল মনে পড়ে। বলে, আমি হিরোর ফ্রেন্ড কাম প্রোডিউসার। আমার নাম মজনু। চলেন, একবারে হিরোর কাছে নিয়ে যাই।
ভেতরে ঢুকে দেখে, একটা একতলা বাড়ি। বাড়ির দক্ষিণ পাশে একটা সাদা কাঠের ব্রিজ। তার পরেই একটা সুইমিংপুল। মজনু বলল, এই সাদা ব্রিজটা—আমরা নাম দিয়েছি লাভ ব্রিজ বা ভালোবাসার সেতু। একটা ধবধবে সাদা শাল গায়ে চাপিয়ে হিরো সুইমিংপুলের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটা বড় কাচের জারে পানীয় ঢালা হচ্ছিল। মজনু সবুজের হাত ধরে নিয়ে এসে হিরোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, তোমার মেহমান নিয়ে এলাম। হিরো তাঁর মুখে স্বভাবসুলভ হাসি ফুটিয়ে বললেন, খুব খুশি হয়েছি আপনি এসেছেন। আপনার লেখার ধনেপাতার গন্ধ যেন আমি এখনো পাই। এযাবৎ সবুজ মাত্র দুজনকে চেনে—একজন নায়িকা ববি আর হিরো। সুইমিংপুলের আশপাশে থাকা অভ্যাগতরা অবাক হয়ে দেখে, এক তরুণকে হিরো খুব সমাদর করে কথা বলছেন। সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। হিরো তা অনুধাবন করে সবাইকে ডাকলেন এবং সবুজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবুজ দেখে, অনেক সুন্দরী মহিলাই এসেছেন—তাঁরা হয়তো নায়িকা কিংবা সহ-নায়িকা হবেন। কিন্তু ওর ডিপার্টমেন্টে ওর সহপাঠিনীরা ছিল এঁদের চেয়ে অনেক সুন্দর। ওরা ন্যাচারাল বিউটি আর এঁরা বিউটি উইথ মেকআপ। পানীয়র গুণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা সব বন্ধু হয়ে যায়। সুইমিংপুলের পাশে খোলা মাঠে শুরুতে যে রকম ঠাণ্ডা লাগছিল—এখন ঠিক গরম না—একটা উষ্ণতা অনুভব করছে। হিরোর কাছে এসে কেউ কেউ বলে, তোমার এই নতুন রিপোর্টার বেশ জমিয়ে দিয়েছে। সবুজ অনুভব করে, কে যেন ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সাদা পপলিনের পাজামা, খদ্দেরের পাঞ্জাবি আর সাদা খদ্দেরের চাদর গায়ে আব্দুর ভাই। কথা বলতে পারছেন না। একতলার বারন্দায় সব মহিলা বসে বসে পুরুষদের কাণ্ড দেখছিল। একমাত্র চেনা নায়িকা ববিকে দেখে সবুজ হাত নাড়ে। ববিও হাত নাড়েন। ইশারায় কাছে ডাকেন। সবুজ কাছে যেতেই নায়িকা বারান্দা থেকে নিচে নেমে আসেন। তাঁর গায়ে চাপানো হালকা সবুজ রঙের একটা শাল। শালটা পেছনে কাঁধ অবধি ছড়িয়ে দিয়ে দুহাতে শালের বাকি অংশ ধরে রেখেছেন। একটা সিডাকটিভ পারফিউমের গন্ধ বাতাসটা ভারী করে রেখেছে। সবুজের মুখে এখন আর কোনো ডায়ালগই আটকানোর কথা নয়। যা মনে আসছে তা-ই বলছে। সবুজ বলে, শালটার রং খুব সুন্দর আর পারফিউমের গন্ধটা আপনার চারপাশ ঘিরে রেখেছে। আর যেটা মুখে আসছে তা চেপে যাচ্ছি। নায়িকা কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। বলেন, কেন, চেপে যাচ্ছেন কেন? কিছুই চেপে যাবেন না। আপনি প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে আমি তো সীমারেখা অতিক্রম করে আপনাকে ছুঁতে পারি না।
নায়িকা প্রশ্রয়ের ভঙ্গিতে বলেন, এই পার্টির মধ্যে আমাকে আপনার ছুঁতে যাওয়াটা হয়তো শোভন হবে না...
সবুজ নায়িকার কথা কেড়ে নিয়ে বলে, হাত দিয়ে না ছুঁয়েও তো ছোঁয়া যায়।
নায়িকা মিটিমিটি হেসে বলে, ভেরি ইন্টারেস্টিং...হাউ ইটস পসিবল!
সবুজ নায়িকার দিকে তাকিয়ে বলে, হালকা সবুজ শালে আপনাকে খুব সেক্সি লাগছে—হাউ অ্যাবাউট দ্যাট। নায়িকার মুখ থেকে হাসি নিভে গেল। নিজেকে সামলে নিয়ে নায়িকা বললেন, থ্যাংকস ফর ইওর কমপ্লিমেন্ট। নায়িকা আর সবুজের এনকাউন্টারের মধুরেণ সমাপয়েৎ যে হলো না—এটা অনেকেই বুঝতে পারল। সবুজের মনে হলো, এখান থেকে ওর চলে যাওয়াটাই সমীচীন। এখনো জ্ঞানের নাড়িটা টনটনেই আছে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে যায়।
তিন
হঠাৎ কোথা থেকে দীপালি আবির্ভূত হলো এবং মারমুখো হেলালের ছোবল থেকে ওকে ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়টিতে এখনো একটা স্বপ্নের ঘোর লেগে রয়েছে সবুজের চোখে। তখনো দীপালি ওর একটা হাত ধরে রেখেছে। সবুজ ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। ওরা টিএসসির ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছে। খাবারের জন্যে দীপালি তার পার্টস থেকে টাকা বের করে টোকেন কেনে। খেতে বসে সবুজ মুখ খোলে। বলে, তুমি কেমন করে ইগল পাখির মতো ছোঁ মেরে আমাকে নিয়ে এলে! তুমি না রেডিও অফিসে গেলে...তো হঠাৎ ফিরলে কেন?
দীপালি বলে. আমরা মেয়েরা অনেকটা পরিত্যক্ত সম্পত্তির মতো। যে কেউ ভোগদখল করতে চায়। সে জন্য শৈশব থেকেই মেয়েদের চোখটা শাণিত করতে হয় শত্রুর হাত থেকে নিজেকে সুরক্ষার জন্য। সেই কলেজে পড়ার সময় থেকেই তো আমি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত। হোস্টেলে থেকে মানুষ। এখন আমি ছেলেদের চোখ দেখলেই বুঝতে পারি—ওই চোখে ওর মনের কী কথা আছে! আমি ডিপার্টমেন্টে আসার পর থেকেই ও আমার পিছু নিয়েছে। তুমি চুপচাপ থাকো, কথা বলো না। ও তোমাকে কোনোভাবেই কাউন্ট করে না। তুমি যে একটা ভালো রেজাল্ট করবে, এটা ডিপার্টমেন্টের অনেকেই জানে। অভিনয় নিয়ে আমাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই তোমার সঙ্গে কিছুটা বন্ধুতা হলে...মাঝেমধ্যে নোটটোট নিতে পারব। জানো, সেটা জানলাম কী করে? একদিন সন্ধ্যায় দেখি ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরির নিচের বারান্দায় বিমল বসে আছে একা। কিছুটা অবাক লাগল। ওকে শুধালাম, বান্ধবী ছ্যাঁকা দিয়েছে নাকি! আসি আসি করে ময়না আসেনি!
বিমল একগাল হেসে বলে, না, সে রকম কিছু না। বসে আছি ওস্তাদের জন্য।
— ওস্তাদটা কে?
— সবুজ।
— লাইব্রেরিতে। পড়ছে।
দীপালি ফিক করে হেসে ফেলে। বলে, ওস্তাদ ওপরে পড়ছে আর তুমি নিচে তালপাখা নিয়ে বসে আছ!
বিমল দাঁতে দাঁত চেপে ঠোঁট দুটি ফাঁক করে বলে, এই রে, তোমাকে সত্যি কথা বলে ফেললাম। আমাকে আর খুব একটা কষ্ট করতে হচ্ছে না...তার নোটগুলো পাচ্ছি। ওস্তাদ একটা টিউশনি করে পেট চালাত। বলেছি খাওয়ার দায়িত্ব আমার—শুধু নোটগুলো যেন পাই। এইতো এখন জগাবাবুর ক্যান্টিনে যাব, ওস্তাদ আর আমি পেট ভরে রুটি আর ঘণ্ট খাব।
দীপালি বলে, তার পর থেকে তোমাকে চোখে চোখে রেখেছি। তাই বলে মনে কোরো না নোটের জন্য তোমাকে খাওয়াচ্ছি। বিমলের কাছে তোমার কষ্টের কথা শুনেছি। টিউশনি করে পড়া খুব কষ্টের। আমিও তো নিজেই আয় করে পড়ি। তুমিও তো রেডিওতে কথিকা লিখতে পারো। রেডিওতে রাত নটায় উত্তরণ বলে একটা প্রোগ্রাম হয়। মাঝেমধ্যে আমি তাতে কথিকা পাঠ করি। আমি তাতে তোমার কাজের সুযোগ করে দিতে পারি। টিভিতেও নাটক লিখতে পারো। আমি এসবের প্রবেশপথে তোমাকে ঢুকতে সাহায্য করতে পারি। যদি তোমার ট্যালেন্ট থাকে তাহলে তোমাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।
সবুজ মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিল। বলে, তুমি একহারা গড়নের সুশ্রী, তোমার পেছনে ছেলেরা ঘুরঘুর করবে এটাই স্বাভাবিক। একজন সুন্দরী মেয়েকে আকর্ষণ করবে এমন কিছু আমার আছে বলে আমি মনে করি না। তার পরও আমি তোমার সঙ্গ পাচ্ছি, এটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য! তার পরও আমার মতো একজন পুওর ম্যানকে হেল্প করার জন্য তুমি যে হাতটা বাড়িয়েছ, হ্যাটস আপ টু ইউ। মাস্টার্স করাটা আমার জন্য খুবই জরুরি। মফস্বলের কোনো কলেজে অধ্যাপনার চাকরি তো পেয়ে যাবই।
দীপালি সবুজের দিকে চোখ তুলে দুষ্টুমির হাসি হেসে বলে, মফস্বলে থাকতে পারবে! ঢাকা ভার্সিটিতে পড়ছ...
সবুজ কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলে, আই হ্যাভ নো চয়েস। বাংলায় পড়ি, পত্রিকা কিংবা রেডিও-টিভিতে কাজটাজ পেলে সে ক্ষেত্রে একটা ব্যবস্থা হতে পারে। কিন্তু সে রকম তো কোনো সম্ভাবনা দেখি না। আমার এক ভাই আছে, সে মাঝেমধ্যে অনুবাদের কাজটাজ পাইয়ে দেয়। লেখাটা দিতে যখন পত্রিকায় যাই—অফিসের ভাবগম্ভীর পরিবেশ দেখে আমার ভয় লাগে। আর লোকগুলো যেভাবে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে—তা দেখে আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।
ওর কথা বলার ধরন দেখে দীপালি হো হো করে হেসে ফেলে। হাসি থামিয়ে বলে, আমার দাদু ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। তাঁর রিডিংরুমের আলমারিগুলো ঠাসা ছিল সব ইংরেজি বইয়ে। শেকসপিয়ার, তলস্তয়, দস্তয়েভস্কিসহ সব ক্লাসিক বই। ধীরে ধীরে আমি ইংরেজি বইয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। তলস্তয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ পড়তে গিয়ে একটা বিষয় আমার মাথায় গেঁথেছে—‘শেষ হাসিটা হাসে ঈশ্বর’। ফরাসি জেনারেল নেপোলিয়ন লাখ লাখ সৈন্য নিয়ে রাশিয়া আক্রমণ করে মাত্র হাজার পঞ্চাশেক সৈন্যসমেত প্যারিসে ফিরতে পেরেছিল। তার ডিটারমিনেশন ছিল, কিন্তু ভুল ছিল প্ল্যানিংয়ে। তাই যুদ্ধে তার পরাজয় ছিল অনিবার্য। ঢাকা ছেড়ে মফস্বলে গিয়ে তুমি কী জীবন পাবে জানি না। দ্যাটস আপ টু ইউ। কিন্তু জীবনের তো একটা প্ল্যানিং থাকতে হবে। লেখাপড়ায় যারা ভালো, তারা তো ক্রিয়েটিভও। ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে নোট বিতরণ করে ভালো ছাত্র সাজার বদলে নিজের দিকে তাকাও। মফস্বলে গিয়ে অধ্যাপনা করবে। এসব ভাবছ। কিন্তু বাস্তবতা তো অন্য রকম। লোকজন মফস্বল থেকে ঢাকায় আসে জীবন ও জীবিকার সন্ধানে, আর তুমি ঢাকা ছাড়তে চাইছ! যখন ঢাকা ছেড়ে যাবে, তখন দেখবে কেমন লাগে! একটা শূন্যতা পেয়ে বসবে...তখন বেঁচে থাকার কোনো মানে খুঁজে পাবে না।
সবুজ মুগ্ধ হয়ে ওর কথা শুনছিল। হতাশার সুরে সবুজ বলে, কিন্তু কিভাবে এখানে থাকব?
দীপালি ওকে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলে, ঢাকার সঙ্গে একটা ইনভলভমেন্ট ডেভেলপ করো। অন্তত লেখালেখিতে। তখন এমনও হতে পারে, তুমি ঢাকা ছাড়তে চাইছ অথচ ঢাকা তোমাকে ছাড়ছে না! দীপালির কথাগুলো সবুজের খুব মনে ধরে। সে তো সুদূরের পথ। অনেকটা দূরে আলেয়ার মতো একটু আলো জ্বলে উঠে তা আবার নিমেষেই মিলিয়ে গেল।
মানুষ তো সত্যি জানে না তার নিয়তি। ডেসটিনি। এমএ পরীক্ষা দেওয়ার পর অনিবার্যভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে দিতে হলো সবুজের। ওর এক ডাক্তার বন্ধুর বদান্যতায় বকশীবাজারে বসবাসের একটা ব্যবস্থা হলো। তাই সবুজের আর ঢাকা ছাড়তে হলো না। নতুন প্রকাশিত একটা সাপ্তাহিকীতে অলৌকিকভাবে একটা চাকরি জুটে গেল। কিন্তু মাইনে খুব কম। বকশীবাজার থেকে নয়াপল্টনের জোনাকী সিনেমা হলের পাশেই পত্রিকার অফিস। অনেকটাই পথ। হেঁটেই আসা-যাওয়া করে। পত্রিকা অফিসে রেডিও-টিভি ও সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় কাজ করে এমন অনেকেই আসে। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে একটা সখ্যও গড়ে ওঠে। ওর যে খেয়ে না খেয়ে জীবন চলে যাচ্ছে, কাউকে বুঝতে দেয় না। অফিসে মাঝে মাঝে আসেন কবি আনোয়ার ভাই। ‘ক্ষুর’ নামের একটি কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে। অন্তর্মুখী মানুষ। চুপচাপ থাকেন। আর সবুজের দিকে মাঝে মাঝে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকেন। একদিন অফিসে কেউ নেই, আনোয়ার ভাই এলেন। ছেলেটাকে বললেন, চা আর ডালপুরি নিয়ে এসো। মানিব্যাগ থেকে এক শ টাকার একটা নোট বের করে ছেলেটার হাতে দিলেন।
গরম গরম চা আর ডালপুরি এনে ছেলেটি টেবিলে রাখে। সে আনোয়ার ভাইকে ভাংতি ফিরিয়ে দিলে আনোয়ার ভাই তাকে পাঁচ টাকার একটা নোট দেন। বাকিটা মানিব্যাগে না পুরে হাতেই রেখে দেন। ছেলেটি চলে যেতেই বাকি টাকাটা সবুজের হাতে দিয়ে বলেন, এই যে নীলকণ্ঠ, এটা রাখো। তোমাকে দেখেই আমি বুঝতে পারি...কী কষ্টেই না থাকো তুমি! এক কাজ করো। রেডিওতে ‘উত্তরণ’ বলে রাত নটায় একটা প্রোগ্রাম হয় আমার আন্ডারে। তুমি ওখানে স্পোর্টসের ওপরে পাঁচ মিনিটের একটা রাইট আপ দেবে। আনোয়ার ভাই বলেন, কখনো শুনেছ এই প্রোগ্রাম? সবুজ বলে—না, শোনা হয়নি, তবে আমার এক সহপাঠিনী একবার এখানে লেখার পরামর্শ দিয়েছিল। আনোয়ার ভাই কৌতূহলী হয়ে ওঠেন, কে সে?
সবুজ বলে, দীপালি, দীপালি সেনগুপ্ত।
আনোয়ার ভাইয়ের চোখটা চকচকে হয়ে ওঠে। দীপালি তোমার সহপাঠিনী? তুমি তো খুব ভাগ্যবান। সে তো খুবই সুন্দরী...পটানোর অনেক চেষ্টা করেছি... টু বি ফ্র্যাংক...পাত্তাই দেয় না। তোমাকে একটা কথা বলি, হিন্দু ছেলে বলো আর মেয়ে বলো...দে আর ভেরি ডেভোটেড...সাফল্য ছুঁয়ে দেখবেই, সে ক্ষেত্রে আমাদের অনেক ল্যাকিং আছে। আমরা লেগে থাকতে পারি না। কিন্তু তোমাকে দেখছি লেগে আছ। সাফল্য তোমাকে ধরা দেবেই, এ আমি বলে দিলাম।
অনেক দিন দীপালির সঙ্গে দেখা হয় না। সবুজ অনেক কষ্ট করে নিজেকে সংযত করে বলে, দীপালি কি এখনো আসে?
— আসে। তবে বলেছে সামনের মাস থেকে আর আসতে পারবে না। টিভির একটি সিরিয়ালে নিয়মিত হচ্ছে।
হঠাৎ আনোয়ার ভাই প্রশ্ন করেন, দীপালির সঙ্গে তোমার কিসের সম্পর্ক? স্যরি, কেমন সম্পর্ক?
সহসা সবুজের মুখে কথা জোগায় না।
আনোয়ার ভাই হাসতে হাসতে বলেন, সুন্দরী মেয়েদের একটা ম্যাগনেটিক পাওয়ার আছে। সেই ক্ষমতা দিয়ে সবাইকে টানে, কিন্তু ধরা দেয় না। বলতে পারো, তাদের সেই অ্যাটিটিউডটা অনেকটাই ভিলেনিস। তার পরও পতঙ্গের পাখা গজালে সে আগুনে ঝাঁপ দেবেই—বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন আনোয়ার ভাই।
হালকা নীল রঙের একটা তাঁতের শাড়িতে দীপালিকে অপরূপা লাগছিল। দীপালি ঠিক বিশ্বাস করতেই পারছিল না সবুজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। সহসা কথা বলতে পারছিল না। কিছুটা আবেগে বোঝা যাচ্ছিল, চোখের কোনায় জমে থাকা সজল মেঘ চেপে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবুজের হাত ধরে দীপালি ওকে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে। বলে, যা ইচ্ছা খাও। দোহাই তোমার, পালিয়ে যেয়ো না।
সবুজ হাসতে চেষ্টা করে। সে হাসি হয়ে যায় কাষ্ঠহাসি। বলে, আনোয়ার ভাই বললেন, তুমি এ মাসটাই আছ। তাই এলাম।
দীপালি নিজেকে সামলে নিয়েছে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে, আনোয়ার ভাইকে চেনো?
সবুজ বলে, উনি তো নিয়মিত আমাদের অফিসে যান। তিনিই তো এখানে লিখতে বললেন। দীপালি সবুজের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, মনে নেই তারও আগে তোমাকে আমি বলেছিলাম। দীপালি তার হাতের ঘড়ি দেখে বলে, বসো। আমার হাতে সময় নেই। ঠিক সাড়ে নটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে আসব। বলেই ছুটতে ছুটতে স্টুডিওর দিকে চলে যায়।
দীপালির সঙ্গে পাশাপাশি হেঁটেছে। কিন্তু কখনো একত্রে রিকশায় ওঠেনি। দীপালি পরম আদরে সবুজের একটা হাত ধরে। বলে, তোমার মতো নিষ্ঠুর মানুষ আমি আর দেখিনি। কতজনের কাছে তোমার কথা শুধালাম, কেউ তোমার সম্পর্কে কিছুই জানে না।
সবুজ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। কার কার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল?
দীপালি সবার নাম বলে। সবুজ হাসে। দীপালি রেগে যায়। বলে, কেন, আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না?
— তুমি যাদের কথা বললে, তারা সবাই জানে আমি পত্রিকায় কাজ পেয়েছি। এবং ওরা সবাই ক্ষুব্ধ আমি কাজ পেয়েছি বলে!
দীপালি হাসতে হাসতে বলে, শালারা তোমার ব্যাপারে এত জেলাস!
সবুজ ওর সুন্দর মুখে ‘শালা’ শব্দ শুনে চমকে ওঠে।
দীপালি বুঝতে পারে। বলে, ওয়ার্কার্স উইমেন হোস্টেলে থাকি তো! উইমেন কিংডম।
দীপালি বলে, হোস্টেলের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। পত্রিকা দেখে তোমার নম্বর আমি পেয়ে যাব। সেই সকালে বেরিয়েছি। বেশ টায়ার্ড। একটা পুরো দিন তোমাকে দেব। সকালে একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করব, লাঞ্চ করব। পুরান ঢাকায় গিয়ে বুড়িগঙ্গার পার দিয়ে হাঁটব দুজনে হাত ধরাধরি করে। তুমি ঢাকায় থেকে যেতে পেরেছ...খবরটা শুনে এত যে ভালো লাগছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। একদিন তুমি অনেক নাম করবে। তোমার ভেতরের আগুন আমি দেখতে পেয়েছিলাম। ভালো থেকো—বলে দীপালি চলে যায়।
চার
দীপালির সঙ্গে আর দেখা হলো না। বার কয়েক ফোন করেছে অফিসে। সবুজকে পায়নি। তারপর একদিন অফিসেও এসেছিল। সবুজ তখন ছিল ঢাকার বাইরে। সবুজ দীপালির খোঁজে হোস্টেলেও গেছে। দীপালি হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছে।
পত্রিকায় কাজ শুরু করেছিল ও আর একজন কবি। হঠাৎ কবি কাজ ছেড়ে দেওয়ায় তার জায়গায় এক চটপটে যুবা, নাম নওফেল, বদলে এখন ড্যানিয়েল। সে একাধারে অ্যাম্বিশাস ও অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। তার মুখে নাসিকার ঠিক নিচে একটা সমস্যা আছে। কিন্তু তাতে খুব একটা অসুবিধা হয় না। মেয়ে পটানোর একটা সহজাত প্রতিভা নিয়েই সে জন্মেছে। তবে বেশি অ্যাডভেঞ্চারিস্ট হওয়ায় কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। সম্ভবত সে কারণেই নামি এক প্রতিষ্ঠিত সাপ্তাহিকীর কাজ ছেড়ে এখানে যোগ দিয়েছে। ড্যানিয়েলও বাংলায় পড়েছে। সবুজের এক ক্লাস জুনিয়র। প্রায়ই ড্যানিয়েল সবুজকে বলে, ডিপার্টমেন্টে কেন আপনাকে আমার চোখে পড়ল না! সবুজ নিজেকে দেখিয়ে বলে, আমি চোখে পড়ার মতো কি!
ড্যানিয়েল বলে, চোখে না পড়লেও ভেতরে তো ছাইচাপা আগুন আছে। সে আগুন একদিন দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে।
সবুজ হতাশার সুরে বলে, আগুন! আগুন থাকলে তো জ্বলবে, সব ছাই হয়ে গেছে।
যেকোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠালগ্নে কিছু মেধাবী ব্যক্তি মিলেমিশে একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করায়। ধীরে ধীরে যখন প্রতিষ্ঠানটি দাঁড়িয়ে যায়, তখনই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। তখন কাউকে বিদায় নিতে হয় কিংবা কেউ স্বেচ্ছায় চলে যায়। সব্যসাচী লেখকের বেলায়ও তা-ই ঘটল। তিনি অনেকটা নীরবে প্রস্থান করলেন। কিন্তু সবুজ আর ড্যানিয়েলের কথা তার মাথায় ছিল।
একদিন জোনাকী সিনেমা হলের উল্টো দিকে সাপ্তাহিক তারা ঝিলমিলের এক রিপোর্টারকে দেখল তার কাহিল হোন্ডা পার্ক করে পান-সিগ্রেট কিনছে। সবুজ কাছে যেতেই বলল, হোন্ডাটা গরম হয়ে গেছে। কিছু সময় লাগবে ঠাণ্ডা হতে। এই ফাঁকে পান-সিগ্রেট খাই। এক পাতা নিউজপ্রিন্টের শিট বের করে একটা তালিকা দেখাল। তাতে আটাশটা আইটেম আছে। বলল, কাল সকালেই রিপোর্ট জমা দিতে হবে। মাথায় কুলাচ্ছে না। কিভাবে কী করব! বলল, রিপোর্টার নান্নু মিয়া ফরেনে চলে গেছে। এখন প্রাণ যায় উলুখাগড়ার!
হোন্ডায় স্টার্ট নিতে নিতে সে বলল, আমরা রিপোর্টার খুঁজছি। আসেন না। সারওয়ার ভাই তো আপনাকে চেনেন। অনেকেই লাক ট্রাই করছে। কিন্তু কেউই তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না।
পরের দিন সকালে সবুজ হাজির হলো সাপ্তাহিক তারা ঝিলমিল অফিসে। সম্পাদক সাহেব কিছু ফিচার লিখে জমা দিতে বললেন। সবুজ বেশ খেটেখুটে কয়েকটা ফিচার লিখে জমা দিল। পর পর কয়েক সংখ্যায় তা ছাপাও হলো। কিন্তু চাকরির ব্যাপারে সম্পাদক সাহেব কিছু বলেন না। সবুজও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর ওমুখো হয় না। এর মধ্যে ড্যানিয়েলের ব্যাপারে পত্রিকায় একটা অস্বস্তির পরিবেশ তৈরি হলো। সব্যসাচী লেখকের পুরনো পত্রিকা সাপ্তাহিক তারার মেলায় তার কাজ ঠিক করে দিলেন।
সবুজরা ঈদ সংখ্যা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে সব্যসাচী লেখক ঈদ সংখ্যায় এই পত্রিকায় নিয়মিত উপন্যাস লিখতেন। এখন আর লেখেন না। এমনকি এদিকে ঢুও মারেন না। সবুজকে বেশ স্নেহ করতেন। সকালে এসে সবুজের লেখা দেখে প্রেসে পাঠাতেন। তখন তিনি এখানে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছেন। একদিন সবুজকে তাঁর উপন্যাসের একটি চরিত্রের কথা বললেন, তাকে কেমন লাগছে? সবুজ ঠিক বুঝতে পারে না উনি কার কথা বলছেন! সব্যসাচী লেখক মুখ কিছুটা গোমড়া করে বললেন, ও, তাহলে আমার উপন্যাসটা ঠিকমতো পড়া হচ্ছে না! এ নিয়ে আর কথা বাড়ালেন না।
অফিসে সবুজরা বেশ ব্যস্ত ছিল। এর মধ্যে হন্তদন্ত হয়ে সব্যসাচী লেখক এলেন। তাঁকে দেখে সবাই শশব্যস্ত হয়ে ওঠে। সব্যসাচী লেখক সবুজকে সরাসরি প্রশ্ন করে বলেন, আপনি ঝিলমিলে লেখা দেওয়া বন্ধ করলেন কেন? সবুজ কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলে, তার সিনে জার্নালিস্ট হওয়ার ইচ্ছা নেই। বললেন, আমিও তো একদা সিনে জার্নালিস্টই ছিলাম। একটা বড় হাউসের পত্রিকা, ঢুকলেই মাইনে হাজার পঞ্চাশ, তা-ও প্রবেশনারি পিরিয়ডে। তারপর নিয়মিত হলে এর কয়েক গুণ বেতন, বোনাস...কত সুবিধা! পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক বেলাল ভাইকে উদ্দেশ করে বললেন, বেলাল, ওকে প্রহার করো...ছেলেটা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে না। যা হোক, আমি সম্পাদককে বড় মুখ করে বলে এসেছি, আপনি যাবেন। কালই যাবেন। বলে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। বেলাল ভাই তো অবাক। বললেন, তুমি ওখানে যাচ্ছ, আমাকে তো একবারও বলোনি। এক মালিকের সঙ্গে আমার তো খুব ভালো সম্পর্ক। কাছেই বাসা। কাল সকালে আমার বাসায় চলে এসো। যাবক্ষণ।
সেই পত্রিকার মালিক সাহেবের রুলস হচ্ছে সকালের ব্রেকফাস্টে অতিথি অভ্যাগতদের ডাকেন। বললেন, কেমন বুঝছেন দেশের হাল-হকিকত? সেপাইরা কোদাল ঠেলে দেশ চালাবে!
বেলাল ভাই আর রাজনৈতিক ক্যাচালে জড়ালেন না। কোন কথা তাঁর মনঃপূত হবে ঠিক বুঝতে পারলেন না। সরাসরি কাজের কথায় এলেন। মালিক সাহেব বললেন, ওটা তো মস্কোপন্থীদের কাগজ। আমাদের ওই পন্থীদের ব্যাপারে কোনো আগ্রহ নেই। বেলাল ভাই একবারে হায় হায় করে উঠলেন—না না, ও কোনো পন্থীটন্থী নয়। নির্ভেজাল সাংবাদিক।
মালিক সাহেব বললেন, তা-ই যদি হয়, আমি সম্পাদককে জিজ্ঞেস করব। যদি তার সম্পর্কে ভালো বলে, তাহলে চাকরি হতে তো কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবে আমরা নিজের থেকে কাউকে অন্তত পত্রিকায় চাকরি দিই না। সাংবাদিকের চাকরির রিকমেন্ডটা আসতে হবে সম্পাদকের পক্ষ থেকে। সবুজের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোনেন, আপনি আজ সকাল এগারোটার দিকে আমার অফিসে আসেন। আমি আপনার সম্পর্কে জেনে রাখব।
বেলাল ভাই বললেন, শোনো, তুমি এখনই গিয়ে পত্রিকার আশপাশের এলাকায় গিয়ে পজিশন নিয়ে বসে থাকো। যেই এগারোটা বাজবে, অমনি তাঁর অফিসের দরজা খুলে কল্লাটা বাড়িয়ে দেবে। বলে, হাসলেন।
বেলাল ভাইয়ের কথামতো দরজা খুলতেই মালিক সাহেব বললেন, আপনার সম্পর্কে সম্পাদকের ওপিনিয়ন ভালো। এটা তো আশির ডিসেম্বর, সামনের বছর একাশির জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমার পিএর কাছে চাকরির দরখাস্ত দিয়ে যাবেন। হবে, আপনার কাজ হবে। বলে মুখ নামিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
চাকরি হওয়ার পর সবুজ যত না খুশি হলো, তার চেয়ে বেশি খুশি হলো ড্যানিয়েল। বলল, হোয়াট আ গ্রেট নিউজ! দুটি সিনেমা সাপ্তাহিকী আমাদের দখলে! নায়িকা ওঠাব-নামাব। আমি মনে করেন, ছোট্ট করে এক নায়িকার কাভারেজ দিলাম। দুই সপ্তাহ পর আপনি তাঁকে নিয়ে কাভার স্টোরি করলেন। আবার আপনি কোনো প্রতিভার সন্ধান পেলেন, আমিও সেটা ফলোআপ দেব। আমাদের আর পায় কে! অবশ্য আমাদের পেছনে শত্রু লাগবে, তাই আমাদের মাঝে চমৎকার আন্ডারস্ট্যান্ডিং থাকতে হবে। কিছুটা অবিশ্বাসীর ভঙ্গিতে সবুজের উদ্দেশে ড্যানিয়েল বলে, আপনি আবার ভাই আমার সঙ্গে গাদ্দারি কইরেন না। মেয়েলোকের ব্যাপারস্যাপার তো...ওরা তো একেকটা সাপ, সাপ মানে মাদি গোখরা। পটাইয়ামটাইয়া টাইমলি ছোবল মাইরা দেবে। কোনো বিশ্বাস নাই। নাউ ইউ ক্যান আন্ডারস্ট্যান্ড হাউ টাফ ইট ইজ টু হ্যান্ডল। তবে এটা গ্যারান্টি দিচ্ছি, আমার দিক থেকে কোনো গাদ্দারি পাইবেন না। আমি আপনাকে অবশ্য টু বি ফ্র্যাংক অতটা ট্রাস্ট করি না, তার পরও বিজনেস ইজ বিজনেস।
সবুজ ড্যানিয়েলের কথা গিলছিল। তারপর হতাশার সুরে বলে, সম্পাদক সাহেব আমাকে তো মনে হয় ফিল্মের রিপোর্টিংয়ে দেবেন না।
ড্যানিয়েল সবুজের কথা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে, আপনি তো আপনার সম্পর্কে কোনো খবরই রাখেন না। আপনার এডিটর আমাদের এডিটরকে বলেছেন, আমরা একটি ভালো ছেলে পেয়েছি। ওকে স্টারদের ইন্টারভিউ আর ফিল্ম রিপোর্টিংয়ে এনগেজ করব।
সবুজ বলে, আমি তো এসবের কিছুই জানি না।
ড্যানিয়েল হাসতে হাসতে বলে, জানবেন তখনই, যখন বন্দুকটা আপনার হাতে দিয়ে বলবে, ফায়ার!
পাঁচ
তখন বিশেষ করে পুরান ঢাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে এবং লালবাগ এলাকায় ডিভিডি শো চালু হয়। এতে ইন্ডিয়ান হিন্দি ছবি ছাড়াও অবাধে নীল ছবির প্রদর্শনীর একটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ড্যানিয়েল সবুজকে টেলিফোনে বলল, আজ রাত থেকেই আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার শুরু করা যেতে পারে, যদি আপনি ব্যস্ত না থাকেন। সবুজ বলে, রাতে আবার কী ব্যস্ততা! ড্যানিয়েল উল্লাসে ফেটে পড়ে বলে, নাইট ইজ সুইট নাইট। দেখবেন, আমাদের রাত হবে কত মধুর! শোনেন, লালবাগ এলাকার এক মাস্তান বেশ মালকড়ি কামিয়েছে—এখন সে নায়ক কাম প্রযোজক হতে চায়। সে আবার টিভি শো চালু করেছে। আমি আপনার কথা বলা মাত্রই সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। বলে, আজ রাতেই আসুন টুয়েলভ টু সিক্স-এর শোতে। সবাই ফরাসে বসলেও আপনাদের জন্য চেয়ার থাকবে। দুই প্যাকেট স্পেশাল কাচ্চিও রেখে দেব। সিগ্রেট-চা তো থাকবেই।
পৌনে বারোটা নাগাদ সবুজ আর ড্যানিয়েল পৌঁছে যায় ভবিষ্যতের নায়ক কাম প্রযোজকের বাড়িতে। প্রযোজক শুধু হ্যান্ড শেক নয়, কোলাকুলিও করে ছাড়ল। মুখে একগাল হাসি ছড়িয়ে বলল, আপনারা আসায় আমি যে কী খুশি হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। লাজুক মুখে ড্যানিয়েলের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে নায়ক বলল, ও এসেছিল। ড্যানিয়েল বুঝতে পারে না ও কে! নায়ক বলে, রানু। সবুজ বলে, রানু কে? ড্যানিয়েল এক জনপ্রিয় নায়িকার নাম বলে। বলে, এটা তার নিক নেম। সবুজ ফোড়ন কাটে, এই জনপ্রিয় নায়িকা কি আপনাকে তার ডাকনাম ধরে ডাকার জন্য সবিনয় অনুরোধ করেছে? নায়ক হেসে বলে, ঠিক তা নয়, বলেছে এই নামে ডাকলে সে খুশি হবে। কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলে, এই তাকে খুশি করা আর কি! বুঝলেন না, সে এখন বেশ ব্যস্ত। আমাকে কথা দিয়েছে, শিডিউল নিয়ে কোনো প্রবলেম হবে না। আপনারা আসবেন এটা তাকে বলিনি, সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওই হুয়োরের পুত আমার কাজের লোকটা সব ভণ্ডুল করে দিল। ওরা হলো বনের পাখির মতো অতি চালাক! ফাঁদের বিষয়টা টের পেলেই যেমন উড়াল দেয়, ওরাও তো তেমনই। আমাকে কথা দিয়েছিল, সকালে শুটিং আছে, বিকেলে ফ্রি। প্রোগ্রাম সেট হলো একসঙ্গে বসে ‘ডিসকো ড্যান্সার’টা দেখব। ও এলো। ছবিও ছাড়লাম আর হুয়োরের পুত এসে বলে কিনা সম্বাদিকদের জন্য কাচ্চি না আনতে কইছিলেন—যামু...নায়ক সাব রেগে বলে, মনে হইলো হুয়োরের পুতের মুখে একটা উষ্টা মারি। অনেক কষ্টে নিজেকে সমঝাইয়া শুধু বললাম, যা হুয়োরের পো এখান থাইকা। আমার দিকে ঘুরে রানু মিষ্টি করে বলল, কারা আসছেন? বললাম, দুই পত্রিকার দুই চিত্র সাংবাদিক। ব্যস, পাখি উড়াল দিল। বলল, দেখেন ভাই, কাল সকালে একটা পার্টি আসবে। নতুন ছবির ব্যাপারে কথা বলতে। আরেক পার্টির কিছু প্যাচ-আপ শুটিং আছে, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। বলে পড়ি-মরি করে ছুটল। ওরে যদি এখানে পাইতাম, তাহলে কী রকম একটা হেডলাইন পাইতাম! ছবি শুরুর আগেই হেডলাইন, নিউজের কী একটা মওকা পাইছিলাম! কাজের ছেলেটার দিকে নায়ক সাহেব তেড়ে যায়। বলে, হুয়োরের পো, তোরে আমি খাইছি। ড্যানিয়েল ছেলেটির পক্ষ নিয়ে বলে, না ভাই, খাইয়েন না। সে যে এখানে এসেছিল এটাই তো আমাদের জন্য যথেষ্ট। সবুজ বলে, তার গায়ের পারফিউমের গন্ধ যেন পাচ্ছি। তাকে পেলাম না, শুধু তার মধুর ঘ্রাণটাই পেলাম। নায়ক খুব খুশি হলো। বলল, আপনারা দুজনই মনে হয় বিষ, পয়জন। আপনারা যদি আমাকে ব্যাক করেন, তাইলে কইলাম আমি সুপারহিট। সে তার কাজের লোককে আর গালি দিল না, বাবা শুক্কুর, বিরানি আনছিলা। শুক্কুর মাথা নাড়ে। নায়ক বলে, দুইডা প্লেট সুন্দর কইরা ধুইয়া উনাদের বিরানির প্যাকেট দিয়া বসাইয়া দাও। পরে আমার ঘর থেকে দুইডা চেয়ার টিভিরুমে দিয়া আসো।
ছোট্ট একটা রুম। তাতে টিভির নীলাভ আলো ছাড়া আর কোনো আলো নেই। মানুষজনে ঠাসা। পেছনে দুটি চেয়ার পাতা। দর্শকদের মধ্য থেকে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে, সিভিল ড্রেসে পুলিশ নাকি! আরেকজন বলে, না সম্বাদিক। সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে ওরা মুচকি হাসে। সবুজ একটু অস্বস্তি অনুভব করে। ড্যানিয়েল সবুজের হাত টিপে দেয়। বলে, ওদিকে তাকাবেন না। হঠাৎ টিভি বন্ধ হয়ে যায়। দর্শকরা খেপে গিয়ে বলে, এই, পয়সা ফেরত দাও। একজন ষণ্ডামতো লোক এসে বলে, এই পয়সার কথা কে বলল? কেউ কোনো কথা বলল না। লোকটি বলল, টিভির মাথা গরম হয়ে গেছে। টাওয়েল ভিজিয়ে মাথায় দশ মিনিট রাখলেই আর ডিস্টার্ব দিব না। ঠিক আছে। কেউ আর প্রতিবাদ করে না।
ওরা দুজনেই বাইরে এসে দাঁড়ায়। দেখে লুঙ্গি পরা এক ছেলে এসে সবুজকে বলে, ভাই কেমন আছেন? সবুজ তাকে চিনতে পারে। কিছুদিন আগে ও একটা শর্ট ফিল্ম বানিয়েছে। বলল, আপনাগো দেখছি। চেয়ারে বসে আছেন। আপনারা ফ্রি আর আমরা টিকিট কেটেছি এক শ টাকা দিয়ে। তা বুঝলেন না, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এসেছি। সবুজ তার কথায় সায় জানিয়ে বলে, আমরাও তাই।
সবুজের একটু ঝিমুনি ধরেছিল। ড্যানিয়েলকে বলে, আমি যাই। ড্যানিয়েল বলে, এই হিন্দি ছবি শেষ হলেই তো আসল ছবি শুরু হবে। সবুজ বলে, হোক, আমি যাচ্ছি।
ও থাকে আজিমপুরের শেখ সাহেব বাজারের দিকে। সুনসান রাস্তা। সবুজের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায়ই ভোর হয়ে যায়। এখানে-সেখানে আড্ডা, পানাহার—মাঝেমধ্যে মনে হয়, নাইট ইজ টু ইয়াং। এই এত দিন ধরে রাতবিরাতে চলাফেরা করছে সবুজ, কোনো দিন ছিনতাইকারীর কবলে পড়েনি। রাস্তায় দল বেঁধে নেড়ি কুত্তাদের হল্লা করতে দেখেছে। মোড়ে মোড়ে পুলিশ থাকে। কিছু বলে না। একদিন অনেক রাতে গুলশান থেকে ফিরছিল সবুজ স্কুটার নিয়ে। আসার সময় হোস্টের বাড়ির লনে দেখে সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটে আছে। হোস্টকে বলল, এত সুন্দর গোলাপ কে ফুটিয়েছে? মালি তো নিশ্চয়ই নয়। মনে হয় কোমল হাতের ছোঁয়া লেগে আছে যেন। পানের পরে সবুজের ভাষা হয়ে ওঠে কাব্যময়। হোস্ট খুশি হলেন। বললেন, ঠিক ধরেছেন, আমার স্ত্রী। সুদূর ইরান থেকে চারা এনে লাগিয়েছে। মহিলা হাসেন মিষ্টি করে। সবুজ বলে, যদি অনুমতি করেন, তাহলে দুটি গোলাপ নিয়ে যাই। গোলাপের ঘ্রাণে মুখের ঘ্রাণ মিলিয়ে যাবে। মহিলা হাসলেন। বললেন, নিশ্চয়ই। কাঁচি এনে সুন্দর দুটি টাটকা গোলাপ কেটে সবুজের হাতে দিয়ে উইশ করার ভঙ্গিতে বললেন, আপনার জীবন গোলাপময় হয়ে উঠুক। সবুজ গদগদ হয়ে বলে, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।
প্রতি রাতের মতো আজ রাতেও দেখল, দুজন পুলিশ ভাই দাঁড়িয়ে আছে। আর তাদের পাহারায় আছে কয়েকটা নেড়ি। এক পুলিশ আরেক পুলিশকে বলে, দেখ হালায় কেমন পাগল, গোলাপ শুঁকতে শুঁকতে বাড়ি যাইতাছে। আরেক পুলিশ বলে, কেন যে ফুল নাকের কাছে নিয়া যাইতেছে যদি বুঝতি তাইলে এদ্দিন তুই কনস্টেবল হইয়া যাইতি। সেও কম যায় না। বলে, আর তুমি বুইঝা ওসি হইয়া গেছ নাকি! পুলিশ খেপে গিয়ে বলে, দূর ব্যাটা, তোর সঙ্গে কোনো কথাই কওন যায় না, খালি উতুরি করস।
সবুজ রিকশাঅলাকে বলেছিল, অন্য পথ না ধরে আজিমপুরের মোড় হয়ে যেতে। গলি-ঘুপচিতে না গিয়ে মেইন রোড ধরে যাওয়াই ভালো। অন্যান্য দিন স্বাভাবিক থাকলেও আজ সবুজ ঠিক স্বাভাবিক থাকতে পারছিল না। বোঝা যাচ্ছিল, আজ সে প্রকৃতিস্থ নয়।
বুদ্ধির দোষে আজ সে কনস্টেবল না হয়ে পুলিশই আছে, এই খোঁচাটা সে ঠিক হজম করতে পারছিল না। তাই সবুজের রিকশা দেখে সে ডিউটি করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। রিকশাঅলাকে তেড়ে ওঠার ভঙ্গিতে বলে, হল্ট। সবুজ সংবিৎ ফিরে পায়। জড়িত কণ্ঠে বলে, কী হয়েছে ভাই!
সে এখন ডিউটিতে আছে, কাউকে কোনো ছাড় নয়। বলে, এত রাতে কোথা হইতে আসিতেছেন?
সবুজ হেসে হেসে বলে, আমি তো ভাই সাংবাদিক।
পুলিশও দমার পাত্র নয়, বলে, সম্বাদিক তাতে কি, খাইছেন তো চুরচুর হইয়া...
সবুজ হেসে হেসে বলে, সাংবাদিক-পুলিশ ভাই-ভাই..তাই আপনাগো উপরি নিয়াও কোনো কথা নাই...
এবার অন্য পুলিশ মাঝে এসে বলে, যান ভাই, বাড়ি যান। সবুজের রিকশা চলতে শুরু করে। সবুজ শুনতে পায়, আরেক পুলিশ তাকে ধমকের সুরে বলছে, আর কাম পাও না, সম্বাদিকের সঙ্গে ফাইট করো।
পরের রাতেও যথারীতি সবুজ বাড়ি ফেরে গভীর রাতে। তাকে প্রকৃতিস্থ দেখায়। সেই দুই পুলিশই ডিউটিতে ছিল। সবুজকে দেখে তারা হাসে। বলে, আইজ ভাইরে দেখছি ভালা মানুষ। সবুজ হাসে। বলে, ভালো হওয়ার চেষ্টা করছি। ওরা বলে, আমরা তো ভাই ভালোই আছি। আরো ভালো হওন যায় কি না সেই চেষ্টায় আছি।
সবুজ বলে, করেন, চেষ্টা করেন।
ছয়
ড্যানিয়েলের কথাই সত্য হলো। সম্পাদক সাহেব বললেন, এখন থেকে নায়িকাদের কাভার স্টোরি করবেন আপনি। এ সপ্তাহে চিত্রনায়িকা শবরীর ইন্টারভিউ করবেন। সবুজ আমতা আমতা করে বলে, তাকে তো চিনি না। সম্পাদক বললেন, চেনেন না চেনে নেবেন। নায়িকা ববিকেও তো চিনতেন না। এখন নিশ্চয়ই আলাপ-পরিচয় হয়েছে। তবে নায়িকা শবরী কিন্তু খুবই ঠোঁটকাটা। ইন্টারভিউ তাঁর মনঃপূত না হলে আপনার মুখের ওপর বলে দেবেন ভালো হয়নি। আর ভালো হলে সবাইকে ডেকে ডেকে আপনার প্রশংসা করবেন। সর্বোপরি তাঁর ইন্টারভিউ পেতেও আর কোনো বেগ পেতে হবে না। মাইন্ড ইট।
সকালে রিপোর্টারদের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে সম্পাদক সাহেব প্রেস ক্লাবে গিয়ে যোগ দেন মোনাজাত পার্টিতে। শবরীর ভক্ত সিনিয়র রিপোর্টার সবুজের টেবিলের সামনে এসে বসেন। বলেন, শবরীর বাড়িতে আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। খোঁজখবর নিয়ে দেখি তিনি ঢাকায় আছেন কি না! থাকলে দুই ভাই গুলশানের ছয় নম্বর বাসে চলে গেলাম আর কি! সবুজ কোনো কথা বলে না। সে ফিল্মফেয়ার, স্টারডাস্ট আর আনন্দলোকের ফাইল নিয়ে বসে যায়। ফাইল দেখতে দেখতে হঠাৎ সবুজের চোখ যায় সহকর্মীদের দিকে। দেখে ওরা সবাই মুখ টিপে হাসছে। মাথায় তার শ্বেতশুভ্র কেশরাজি। শীত নেই গ্রীষ্ম নেই—সব সময় খাদি চাদর, খাদি পাঞ্জাবি, পপলিনের পাজামা আর পায়ে চপ্পল—এই শেখ ভাই। যখন পত্রিকার পাতায় চোখ বোলায়, তখন চোখের চশমাটা কপালের ওপর তুলে নেয়। সেও সবার সঙ্গে চোখের ইশারায় মুচকি মুচকি হেসে সায় জানাচ্ছে। সবুজকে উদ্দেশ করে বলে, মশা মারতে কামান দাগাচ্ছ নাকি! এত প্রস্তুতি কাজে লাগত যদি সুচিত্রা সেনের ইন্টারভিউ করতে যেতে...সবুজ কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়ে বলে, ঈশ্বর গুপ্তের কবিতা পড়েননি? ‘বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া আমি দেশের কুকুর ধরি’...সবুজ দেখে তার সহকর্মীদের মুখের আলো নিভে গেছে।
কথা ছিল, নায়িকা শবরী সন্ধ্যায় বাসায় থাকবেন। সবুজ আর তার সিনিয়র সহকর্মী গিয়ে জানল, তিনি বাসায় নেই। সবুজের সহকর্মী বেশ ডাটের সঙ্গেই বলল, দরজা খোলো। আমরা ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসব। দারোয়ান পাত্তা না দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, দরজা খোলার হুকুম নাই। সে তখন রেগে গিয়ে বলল, জানো আমরা কে? দারোয়ানও বলে, আপনারা কে তা আমার জানার দরকার নেই। আপনারা আমার অপরিচিত—চোর না ডাকাত তা তো জানি না। সে খুব অপমানিত বোধ করে। বলে, তুমি আমাকে আগে দেখোনি? দরোয়ান বলে, মনে নাই। সহকর্মী রেগে গিয়ে বলে, তুমি এমন বেয়াদব, ম্যাডাম আসুক, তোমার চাকরি খাব। সেও বেয়াড়া ভঙ্গিতে বলে, তা খাইয়েন।
সবুজ বলে, সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও ছেলেটা এত বেয়াদবি করল! ম্যাডামের হুকুম নাই মানে কি? এরা কি আমাদের মিনিমাম রেসপেক্টও করে না?
সহকর্মী বলল, ওই যে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি। কাক কাকের মাংস খায় না, কিন্তু সাংবাদিকরা সাংবাদিকদের মাংস খায়।
সবুজ বলে, কিন্তু আপনি যে তাঁর গুণগ্রাহী সেটা তো তিনি জানেন। এবং তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে কথাও বলেছেন। সে ক্ষেত্রে তিনি কি দারোয়ানকে বলে যাবেন না! সহকর্মী বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার ভঙ্গিতে বলে, বাদ দেন ওসব। ওরা বাইরে দাঁড়িয়ে নায়িকার আগমনের অপেক্ষা করে। মশা তো মশাই, সে তো আর সাংবাদিক চেনে না। সে চেনে রক্ত। দুই সাংবাদিকের গায়েই হুল ফুটিয়ে রক্ত চুষতে থাকে।
ঘণ্টাখানেক পরে নায়িকা এলেন।
ওরা দুজনই নায়িকার কাছে এগিয়ে যায়। সবুজের সহকর্মী নায়িকার উদ্দেশে বলে, মশার কামড় খেতে খেতে কাহিল অবস্থা। নায়িকা সায় জানিয়ে বলেন, আর বলবেন না, মশা এত বেড়েছে যে...
সহকর্মী বলে, আপনার দারোয়ানটা এত বেয়াদব যে বললাম দরজা খুলে দিতে, সে বলে হুকুম নাই। আমাদের পরিচয় দেওয়ার পরও সে আমাদের অনার করল না।
নায়িকা তাঁর দারোয়ানকে সমর্থন জানানোর ভঙ্গিতে বললেন, যা দিনকাল পড়েছে...চুরি-ডাকাতিও বেড়েছে...বেচারা বিশ্বাস করে যে কাউকে ঘরে বসাবে—সে যে কিছু করে বসবে না তার নিশ্চয়তা কি!
সহকর্মীও নাছোড়বান্দা, বলে, আপনার সঙ্গে কথা হলো যে আমরা আসছি। নায়িকা অকপটে বললেন, স্যরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম। সবুজের দিকে তাকিয়ে বলে, আপনি নতুন যোগ দিয়েছেন বুঝি? সবুজ মাথা নাড়ে।
নায়িকা বলেন, আমার হাতে সময় নেই। রাত দশটায় কয়েকজন গেস্ট আসবে। সহকর্মীর দিকে তাকিয়ে বললেন, এত কষ্ট করে এখানে আসার কী দরকার ছিল! আপনি তো আমার সম্পর্কে সব জানেন, তাকে ব্রিফ করলেই পারতেন। সে বলে, বলেছিলাম, নতুন তো, উৎসাহ খুব বেশি।
সবুজ তার হ্যান্ডব্যাগ থেকে কোশ্চেনিয়ার বের করে। সেটা দেখে নায়িকা হাসতে হাসতে বলে, আমার প্রশ্ন উনাকে করবেন। তিনি সুন্দর করে সব উত্তর দিয়ে দেবেন।
সবুজ কিছুটা শ্লেষ মিশিয়ে ভদ্র ভাষায় বলে, একজনের কথা আরেকজন বলবেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। নায়িকা শবরীর মনের মাঝে কী আছে তা-ই বা উনি জানবেন কী করে! তা ছাড়া আপনার কথা বা ডায়ালগ আমি যদি আমার ইন্টারভিউতে অ্যাডাপ্ট করতে না পারি তাহলে এই ইন্টারভিউ তো প্রাণবন্ত হবে না—ইট উইল বি আ ডাল ওয়ান...কোনো রসকষ থাকবে না। তা ছাড়া এখনকার ছবিতে বেশ পরিবর্তন আসছে...জনপ্রিয় জুটি দানা বাঁধছে না...তাতে ছবিও আগের মতো ব্যবসাসফল হচ্ছে না। চলচ্চিত্র ছেড়ে আপনি এখন টিভিতে অভিনয় করতে আগ্রহী হচ্ছেন...
নায়িকা কিছুটা রুষ্ট হয়ে বললেন, এ কথা ঠিক, আগের মতো জনপ্রিয় জুটি হচ্ছে না। দর্শকরা জনপ্রিয় জুটির ছবি দেখতে হলে যায়। কিন্তু এটা ঠিক নয় যে আমার মার্কেট পড়ে যাওয়ায় আমি টিভিতে অভিনয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছি। মধ্যবিত্ত পরিবারে টিভি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই এই মিডিয়ায় কাজ করার ব্যাপারে আমি উৎসাহী হয়েছি। মধ্যবিত্ত মানেই তো শিক্ষিত সম্প্রদায়। এরা অ্যাপ্রিশিয়েট করতে জানে। এবং এরা ক্রমেই চলচ্চিত্রবিমুখ হয়ে উঠেছে। এটাও তো ভাবতে হবে।
তিনি ইন্টারভিউতে হস্তক্ষেপ করার ভঙ্গিতে বললেন, আপনাদের চা দিতে বলি। সহকর্মী বলল, আমি তো চা খাই না, ও যদি খায়। সবুজ জানায়, চা পানে তার কোনো আগ্রহ নেই।
নায়িকা উঠতে উঠতে বললেন, তাহলে আজ এ পর্যন্তই। আমার হাতে একদম সময় নেই। সবুজ বলে, আমারও তো সময় নেই। কালই লেখাটা প্রেসে দিতে হবে। নায়িকা হাসলেন। বললেন, কথা তো হলোই, বাকিটা উনি বলে দেবেন। সহকর্মী সবুজকে বলল, যা বলেছেন, ইনাফ। বাকিটা বাসে যেতে যেতে আপনাকে বলে দেব। নায়িকা আর কথা না বাড়িয়ে ভেতরে চলে গেলেন। বিষয়টা সবুজের ঠিক মনঃপূত হলো না।
বাসে যেতে যেতে সবুজের সহকর্মী অনেক ভ্যানরভ্যানর করল। সবুজের কানে কিছুই গেল না। সবুজ ইন্টারভিউ লেখার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সকালে ঘুম থেকে উঠে চা খেয়ে সবুজ লিখতে বসে। লেখা শেষ করে তারপর দুপুর নাগাদ ব্রেকফাস্ট সারে। তার মানে সকালে ও কিছুই খেতে পারে না। লেখাটা নামিয়েই স্বস্তি। নায়িকার ইন্টারভিউয়ের শুরুটা ভালোই হলো। অর্ধেক লেখা হয়ে গেছে। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে বাড়িওয়ালি এলেন। বললেন, তুমি এখনো লিখছ! প্রেসিডেন্ট জিয়া তো নেই...চিটাগংয়ে তাঁকে মেরে ফেলেছে। সবুজের লেখার মুডটা চলে গেল। কাপড়চোপড় পরে বাইরে চলে এলো। রাস্তায় বেশ উত্তেজনা দেখা গেল। কিন্তু কাউকে মারমুখো হতে দেখা গেল না। সবুজ অফিসে গেলে ঘটনা জানতে পারবে। নিউজ রুমে আওয়ামীপন্থী আর বিএনপিপন্থীদের মধ্যে হট ডিবেট হচ্ছে। নিউজ এডিটর পিওনকে বলে দিলেন, সিকিউরিটিকে বলো গেট বন্ধ করে দিতে। আমাদের স্টাফ ছাড়া বাইরের কেউ যেন ঢুকতে না পারে।
নায়িকার ইন্টারভিউটা যথারীতি ছাপা হলো। নায়িকা যদি নেতিবাচক কিছু বলেন, সবুজ তার জবাবও মাথায় তৈরি করে রেখেছে। সবুজ সকাল সকালই অফিসে যায়। বাকিরা আসে দুপুরের আগে কিংবা পরে। সবুজ অফিসে এলেই সহকর্মী জাহাঙ্গীর মিয়া এক কাপ চা এনে দেবে। সবুজের টেবিলে সিগ্রেটের প্যাকেট না দেখে জাহাঙ্গীর মিয়া বলে, এখানে বাকিতে সিগ্রেট কেনার ব্যবস্থা আছে।
চা পান করতে করতে সবুজ হেসে বলে, গেটের বাইরে ওই সিগ্রেটের দোকানের কথা বলছ? জাহাঙ্গীর মাথা নাড়ে। কিন্তু ও যে ওর সিগ্রেট বক্সে বড় বড় করে লিখে রেখেছে ‘বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না’। জাহাঙ্গীর মিয়া বলে, কিছু আছে ছ্যাঁচড়া...সিগ্রেট নিব, পয়সা দিব না। আপনি তো বেশ ভদ্র ভালোমানুষ...আপনার কোনো সমস্যা হইব না।
এ সময় টেলিফোন বেজে ওঠে। জাহাঙ্গীর মিয়া টেলিফোন ধরে। বলে, স্যার আপনার ফোন। একজন মহিলা।
সবুজ অবাক হয়। মহিলা!
টেলিফোন ধরতেই অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে এলো—আমি নায়িকা শবরী বলছি। আর কেউ আসেনি?
সবুজ বলে, না, কেউ আসেনি। কারো জন্য আপনার কোনো মেসেজ থাকে তো বলেন। শবরী বলে, কারো জন্য কোনো মেসেজ নেই। মেসেজ আছে আপনার জন্য। আপনার লেখাটা খুব ভালো হয়েছে। কাউকে বলবেন না, আমি আপনাকে ফোন করেছিলাম। বিকেলে আসুন না আমার বাড়িতে চা খেতে। এবং এ কথাও কাউকে বলবেন না। দেখা হবে। বলেই টেলিফোন ছেড়ে দিলেন।
লেখাটার ব্যাপারে অফিসের কেউ কিছু বলল না। শুধু সম্পাদক সাহেব বললেন, ইট ওয়াজ আ গুড রাইট আপ। বললেন, পাকিস্তান থেকে শবনম এসেছেন। নেক্সট উইকে তাঁকে আমরা কাভার করছি। দরকার হলে অর্ধেক পাতা তাঁর জন্য ছেড়ে দিতে পারি। বুঝলেন?
সবুজ মাথা নাড়ে।
শবরী সুতির ওপরে চমৎকার প্রিন্টের একটা শাড়ি পরেছেন। চুলটা ব্যাক ব্রাশ করে টাইট করে বেঁধে রেখেছেন। শাড়িটা এমন কায়দা করে বুকটা ঢেকে রেখেছেন যে পেটের দুপাশ খোলা। তাতে সুন্দর নাভিটাও দৃশ্যমান। সবুজ যে তাঁকে ভালো করে দেখছে, এটা তাঁর দৃষ্টি এড়ায় না। মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, শাড়ির প্রিন্টটা খুব সুন্দর, তাই না? আপনার জন্যই বেছে বেছে এই শাড়িটা পরেছি। আপনার চোখ ভালো। তাই আপনার চোখে যেন ভালো লাগে তার জন্য এই সাজগোজ। সবুজ ঠিক বুঝতে পারে না। এই রকম একজন জনপ্রিয় নায়িকা তার কেন এত স্তুতি গাইছে। অথচ কদিন আগে তার চেহারায় এই মাধুর্য ছিল না।
শবরী ওর মনের ভাষা পড়ে ফেললেন। বললেন, খুব অবাক হচ্ছেন, আমার কথা শুনে? আপনার সিনিয়র ভাইয়েরা যে আছে, তারা এর-ওর সঙ্গে লাগিয়ে দিতেই সিদ্ধহস্ত। সে জন্য তাদের লেখার ব্যাপারে শুধু আমি কেন, অনেকেরই উৎসাহ নেই। তাই সেদিন তেমন একটা আগ্রহ দেখাইনি। কিন্তু আপনার লেখাটা পড়ে মনে হলো, একটা আর্ট আছে। সেই জন্য আপনাকে কল দিলাম। আমি যে আপনাকে কল করেছি, এটা জানলে বা শুনলে আপনার জান কয়লা করে ছাড়বে। যেহেতু আপনি নতুন, আপনার লেখার হাত ভালো—অন্যরা সেই সুযোগ নিতে পারে।
সবুজ ঠিক বুঝতে পারে না, তিনি কিসের ইঙ্গিত করছেন। বললেন, আপনি ইয়াং এবং আনম্যারেড।
সবুজ হেসে বলে, কে বলেছে আমি আনম্যারেড। আমি রীতিমতো ম্যারেড।
শবরী হাসলেন, বললেন, ওসব চাপাবাজি করে কোনো লাভ নেই। আপনার সম্পর্কে সব খোঁজখবর আমি পেয়েছি। এখানকার ইন্ডাস্ট্রি সম্পর্কে আপনাকে ছোটখাটো একটা ধারণা দিতে চাই। প্রথমত এখানে কারো প্রতি কোনো প্রত্যাশা রাখবেন না। একটা মেয়ের কাছে একটা ছেলের কী প্রত্যাশা থাকতে পারে, সেটা তো আর বিশদভাবে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। উই আর অ্যাডাল্ট ইনাফ। এই যে আপনাকে ভালো বললাম—ভেতরে ভেতরে আপনার একটা প্রত্যাশা জন্ম নিল। যদি আপনার প্রত্যাশা আমি পূরণ করি, সে ক্ষেত্রে আপনার প্রতি আমারও একটা প্রত্যাশা থাকবে। কিন্তু আপনি সব সময় সেটা পূরণ করতে পারবেন না। সম্পাদক যদি বুঝতে পারেন আপনি কারো প্রতি ফ্যাসিনেটেড, তখন ঝামেলায় পড়তে পারেন। আমরা শো বিজে আছি তো, আমরাও পাবলিসিটি মঙ্গার। তবে সব সময় যে সাত্ত্বিক থাকতে পারবেন না, সেটাও বোধ করি যুক্তিযুক্ত নয়। যারা আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে, তারা সাংবাদিক হিসেবে করবে না। করবে তাদের পছন্দ অনুযায়ী। তারা সেই বন্ধুত্বটা অবশ্যই রক্ষা করবে। আমাদের নায়িকাদের কথাই বলি, কিছু নায়িকা আছে তাদের ভেতরটা একেকটা নর্দমা। ওপরে সিলভার প্লেট দিয়ে ঢেকে রেখেছে। আমি একবার বিদেশে এক ফিল্ম ফেস্টিভালে গেছি। তখন আই ওয়াজ ক্যারিং। কিন্তু সেটা বোঝা যায় না। কেউ না বলে দিলে। আমাদের গ্রুপে আরেক নায়িকা ছিল। কথাটা সে সবাইকে বলে দিল। ব্যস, সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। সেই হলো মধ্যমণি। তারপর আরো অনেক কথা হলো। সবুজকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানালেন। সবুজ বলল, বেশ ভারী নাশতা খেয়েছি তো...আর এত জিনিস একবারে পড়লে ডাইজেশনের প্রবলেম হতে পারে। নায়িকা হাসলেন অনেকক্ষণ। তারপর সবুজের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন।
সাত
ইস্কাটনের গলি দিয়ে ঢুকতেই লোকজন শবনমের বাড়ি দেখিয়ে দিল। অন্য নায়ক-নায়িকাদের বাড়ির সামনে একটা জটলা থাকে কিংবা দারোয়ানের কড়াকড়ি, শবনমের বাড়িতে এসব নেই। দরজা খোলা পেয়ে ওপরে উঠে গেল সবুজ। ড্রয়িংরুমে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই তিনি এলেন। লম্বা, দোহারা গড়ন, পুরুষ্টু ওষ্ঠদ্বয়, পরনে থ্রি-পিস। দায়সারা গোছের একটা ওড়না গলায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। বেশ রিলাক্স ভঙ্গিতে এসে বসলেন। এই যে আমাকে প্রথম দেখলেন, তাঁর কথায় তা বোঝা গেল না। যেন অনেক দিনের চেনা। কথায় কিছুটা উর্দুর মিশেল আছে। সে কথা তাঁকে বলতেই মুখে হাসি মেখে বললেন, তা অনেক সাল হয়ে গেল না। ওখানে তো আর বাংলা বলা হয় না।
— পাকিস্তান থেকে তো নায়ক রহমান চলে এসেছেন। আপনি কি ওখানে থেকে যাবেন, নাকি ফিরবেন?
— এখন তো আর থাকা যাবে না। ফিরব। প্রস্তুতি নিচ্ছি।
— এসে কি এখানে অভিনয় করবেন?
চোখের ভ্রু দুটি ওপরে টেনে তুলে বললেন, একি বলছেন আপনি! এখনই কি আমার রিটায়ার করার সময় হয়ে গেছে! যাঁদের সঙ্গে এখানে কাজ করতাম, মানে অভিনয়, তাঁরা কি রিটায়ার করে গেছেন? আপনি এ কথা কেন বলছেন?
— না মানে, বলতে চাইছিলাম, আপনার পরিকল্পনার কথা...
পরিস্থিতি সামলে নিয়ে একগাল হাসি দিয়ে বললেন, তাই বলুন। অভিনয় তো ছাড়ব না। হলিউডে, বম্বেতে, এখানে আমার দেশে অ্যাক্টর ওল্ড হয়ে গেলে তাঁরা ক্যারেক্টারে চলে যান। তাঁরা ছবির ভিত হিসেবে কাজ করেন।
— আপনি পাকিস্তানে পাড়ি জমালেন কেন?
— তখন তো এক দেশ, দুই খণ্ড। আমার এবং রহমান ভাই, নাসিমা খানের একটা ডিমান্ড সৃষ্টি হয়। আমরা তো শিল্পী। আমাদের তো কোনো নির্দিষ্ট টেরিটরি নেই। বাংলা ছবির পাশাপাশি এখানেও তখন উর্দু ছবি তৈরি হতে থাকল। ক্যাপ্টেন (এহেতশাম) আতা ভাই, এমনকি জহির রায়হানও তো উর্দু ছবি বানিয়েছেন।
— আপনার অভিনীত ‘রাজা সন্নাসী’ ছবিটা আমি দেখেছিলাম। সকালের স্নান সেরে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পিঠজুড়ে ঘন কালো চুল ছড়িয়ে। তার থেকে মুক্তোদানার মতো ফোঁটায় ফোঁটায় জল ঝরছে, সত্যি আপনাকে অপরূপা লাগছিল...
— আপনি বলছেন! আপনার ভালো লেগেছিল...আপনার মতো ওই দৃশ্যটা আমারও ভালো লেগেছিল। হাসতে হাসতে বললেন, এই দেখেন, মনে মনে মিলে গেল। আতা ভাই বানিয়েছিলেন। হি ইজ আ জিনিয়াস। অভিনয়, গীতিকার, সুরকার, পরিচালক—এমন ভার্সাটাইল জিনিয়াস কোথায় পাবেন! এত ব্যস্ততার মধ্যেও উনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়েন। এই ইন্টারভিউটা ছাপা হলে উনি পড়বেন এবং কল করবেন। মানুষ তো এমনি এমনি বড় হয় না। তার অনেক গুণ থাকে। বললেন, কথা বলে যাচ্ছি। আপনার জন্য কিছু খাবার নিয়ে আসি। সবুজ বলে, তার কোনো প্রয়োজন নেই। হেসে হেসে বললেন, আমাদের গাঁয়ে কথায় বলে না, গৃহস্থের বাড়িতে এসে কিছু মুখে না দিলে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। আপনি নিশ্চয়ই আমার অকল্যাণ চান না। বলে উঠে গেলেন। ফিরে এলেন একটা ট্রেতে করে ফল, মিষ্টি, বিস্কুট নিয়ে। বসলেন একেবারে সবুজের পাশে। অনেকটা ঘেঁষে। একটা প্লেটে সব তুলে দিয়ে বললেন, নিন। চা হচ্ছে। তাঁর গা থেকে পারফিউম গন্ধ ছড়াচ্ছিল। সবুজ বলে, গন্ধটা খুবই পরিমার্জিত, নিশ্চয়ই ফরাসি। শবনম নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে বললেন, ফ্রান্স ছাড়া এ রকম সেন্ট কোথায় পাবেন। হঠাৎ সবুজের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন, আপনি নিশ্চয়ই ম্যারেড নন।
সবুজ অবাক হয়। বলে, বুঝলেন কী করে!
শবনম রহস্যের হাসি হেসে বলেন, বোঝা যায়। তা গার্লফ্রেন্ড আছে নিশ্চয়ই।
সবুজ মাথা নাড়ে।
— ইয়ং হিরোইনদের সঙ্গেও ভাব হয়নি?
সবুজ বলে, খুব বেশিদিন হয়নি এখানে কাজ করছি। এসেই সব প্রতিষ্ঠিত নায়িকার ইন্টারভিউ নিচ্ছি। ইয়াংদের সঙ্গে এখনো মেশার সুযোগ হয়নি।
— উইশ ইউ গুড লাক দেন। তাদের সঙ্গে মিশবেন হাঁসের মতো। হাঁস সারা দিন পানিতেই থাকে, কিন্তু তাদের পালক কখনোই ভেজে না। বলে হো হো করে হাসলেন। বললেন, জাস্ট জোকিং, কিছু মনে কইরেন না।
বললাম, আমার শেষ প্রশ্ন—
শবনম কৌতূহলী হলেন। বললেন, যত খুশি প্রশ্ন করতে পারেন। আমি এখন ফ্রি। আমার বর রবিনের ফ্যামিলি থাকে বারিধারায়। বিকেলে ওখানে চলে যাই। আড্ডা হয়, তাস খেলা হয়, পার্টি হয়। কাজের কোনো তাড়া নেই, বুঝলেন না। আর এবাড়ি-ওবাড়ি দাওয়াত তো আছেই।
— অনেক দিন তো হয়ে গেল এ লাইনে আছেন। কিন্তু আপনি শবনম শিশিরবিন্দুর মতোই এই তাজা থাকার গোপন রহস্য কী?
— রহস্য কিছুই নেই। মনের মধ্যে তো কোনো কুটিলতা নেই। সবার সঙ্গে মিশি। গড অনেককেই কিছু ন্যাচারাল গিফট দিয়ে পাঠান। আমিও কিছু পেয়ে থাকব হয়তো...অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও গাছ যেমন থাকে অবিচল, এ অনেকটা তাই। বুঝলেন, মাই ডিয়ার।
রাস্তায় নেমে একবার পেছন ফিরে তাকাল সবুজ। দেখল, জানালার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছেন শবনম। ডান হাতটা একবার নাড়লেন, তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না।
আট
এক সকালে ড্যানিয়েলের ফোন আসে অফিসে। বলে, মাইকেলের কাজিন বলছি। মাইকেল পাড়ি জমিয়েছিল ইংল্যান্ডে আর আমি নর্থ আমেরিকায়। কানাডা কিংবা আমেরিকায়। বেশিদিন আমি নেই আপনাদের মাঝে। তাই অসম্পূর্ণ কাজগুলো সেরে ফেলতে হবে দ্রুত। আপনার খোঁজখবর আমি রাখছি, খুব দ্রুত এগোচ্ছেন। বস যদি হেল্প করে তাহলে আর ঠেকায় কে! যাকগে, ওই যে আমাদের জয়েন্ট ভেঞ্চার, ওটা তো শুরুতেই নদী মরুতে হলো হারা।
সবুজ বলে, নদীই তো হলো না, আবার মরু এলো কোত্থেকে?
ড্যানিয়েল বলে, সেই নদীর ব্যবস্থাই করছি। আজ যদি আপনি ফ্রি থাকেন তো আজ, নইলে কালও হতে পারে। সেইভাবে আমি কথা বলে রেখেছি। মোহাম্মদপুরেই দুজনে থাকে। একজন উঠতি নায়িকা। আরেকজন অভিনেত্রী। দুপুরে নায়িকা আর বিকেলে অভিনেত্রী। এই আলাপ-পরিচয় করা আর কি! দুই জনপ্রিয় পত্রিকার দুই চিত্র সাংবাদিকের কথা শুনে অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফিল্ম লাইনের কেউ না, আমাদের সহকর্মীরাই কিন্তু আমাদের বড় শত্রু। মাইন্ড দ্যাট। আমাদের এই ভেঞ্চারের কথা কাকপক্ষীও যেন না জানে।
ড্যানিয়েল বলে, টাইমসের ফখরু ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে? সবুজ বলে, না তো! ড্যানিয়েল বলে, ফখরু ভাই অবাঙালি। ভেরি ইন্টারেস্টিং পারসন। নায়িকাদের যত অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে, সবাই তার বোজম ফ্রেন্ড। তাদের কাছ থেকে সব খবরাখবর নিয়ে সে নায়িকাদের বিপাকে ফেলার চেষ্টা করে। তার মতো আরো কিছু চিত্র সাংবাদিক আছে, যারা নায়িকাদের ব্ল্যাকমেইল করে। আমাদের পথ হবে বকুল বিছানো ভালোবাসায়। মাইন্ড দ্যাট। ড্যানিয়েল শুধায়, ব্যস্ত নাকি? সবুজ বলে, না। তবে আমার সহকর্মীরা ভাবছে, কোনো মহিলা আমাকে কল করেছে।
ড্যানিয়েল বলে, শালারা আপনার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে, না?
সবুজ বলে, আপনি জানলেন কী করে?
ড্যানিয়েল বলে, শালারা তাকাচ্ছে আর ভেতরে ভেতরে জ্বলছে। শালাদের পুটকিতে আগুন...ওখানে দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে দিন...দাউদাউ করে জ্বলে উঠবে। ড্যানিয়েল বলে, তাহলে তিনটায় চলে আসুন। নিচে এসে দাঁড়াবেন, আমাদের কাকদের দেখলে আড়ালে চলে যাবেন। রিকশা নেব না। বাসে করে যাব। রিকশায় গেলে কেউ না কেউ দেখে ফেলবে।
জিপিওর সামনে থেকে ওরা মোহাম্মদপুরের বাস নেয়। যেতে যেতে ড্যানিয়েল বলে, ফখরু ভাইয়ের একটা ঘটনা বলি, তাহলেই বুঝবেন, আমাদের মার্কেটটা কী রকম গরম! ফখরু ভাই একবার কক্সবাজারে এক লোকেশনে গেছে কাভার করতে। দেখে এক সহশিল্পী বারান্দায় একা বসে আছে। সেই সহশিল্পীর সঙ্গে আগের রাতে ফখরু ভাইয়ের পরিচয় হয়েছে। জানে ফখরু ভাই সাংবাদিক, কিন্তু কোন পত্রিকার তা জানে না। ফখরু ভাই তার কাছে গিয়ে খুব মোলায়েম করে বলে, হ্যায় না, কেমন চলছে, তা একা কেন? শুটিং নেহি হ্যায়!
সহশিল্পী তার দিকে বিস্ময় ভরা মুখে তাকায়। বলে, আপনে মাউড়া?
ফখরু ভাই বলে, মাউড়া হয়েছি তো কী হয়েছে! জাভেদ ভাই হ্যায় না, ও তো আমার ভাষায় কথা বলে, তাতে তো তাঁর কোনো সমস্যা নাই। দেখেন এই যে শাবানা কালা ছিল, তাকে আমি লিখিয়া লিখিয়া ফরসা বানাইছি। নায়িকা ববি আছে না, সে তো বম্বের রেখার মতো মোটা ছিল, তাকে লিখিয়া লিখিয়া চিকনা বানাইয়া দিছি। এখন তো সে সুপারহিট আছে না! আপনাকেও লিখিয়া লিখিয়া এমন সুন্দরী বানাইয়া দিব, সব প্রোডিউসার-ডিরেক্টর আপনার বাড়িতে ভিড় জমাইবে।
সহশিল্পী বলে, আপনি সত্যি পারবেন?
ফখরু ভাই বলে, আপনি নায়িকাদের জিজ্ঞেস করবেন, আমার কথা সাচ আছে কি না!
সহশিল্পী বলে, দেখেন না আমারে বসাইয়া রাখছে, শুটিংয়ে ডাকে না। ফখরু ভাই বলে, কাল ডিরেক্টরকে বলে দেব, ডাকবে। সহশিল্পী বলে, তাহলে ভাই আপনারে পাইয়া তো ভালোই হলো।
ফখরু ভাই বলে, তা সন্ধ্যায় কি ব্যস্ত আছেন? সহশিল্পী তাকে খুশি করার ভঙ্গিতে বলে, আপনি ফ্রি থাকলে আসেন রুমে। আলাপ করমুনে।
ফখরু কিছুক্ষণ ভেবে বলে, সে হবে, টাইম বের করা যাবে।
দূরে দাঁড়িয়ে এক নৃত্য পরিচালক ফখরু ভাইয়ের পটানোর টেকনিক দেখছিল। আর মিটিমিটি হাসছিল। মেয়েটি চলে যেতেই নৃত্য পরিচালক ফখরু ভাইয়ের কাছে আসে। তাকে দেখে ফখরু ভাই ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে। তার হাত ধরে বলে, ডোন্ট পুট অ্যাশ অন মাই ফুড...কী বলে, বাড়া ভাত মে ছাই না ঢালো...অনেক কষ্টে ম্যানেজ করেছি। পরিচালক কিছু বলে না। হাসে। ফখরু ভাইয়ের সন্দেহ হয়। পকেট থেকে বেনসন সিগ্রেটের একটা প্যাকেট দিয়ে বলে, নে ভাই, পথে কাঁটা হবি না, ফুল হ...
সন্ধ্যায় ফখরু ভাই মেয়েটার রুমে গিয়ে দেখে, মেয়েটি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। ফখরু ভাই বলে, তুমি বহুৎ ভালো মেয়ে আছ, আমার অপেক্ষায় আছ—বলে মেয়েটির হাত ধরে, চলো অন্দর ছে...মেয়েটি ঝ্যাংটা মেরে তার হাত ছাড়িয়ে নেয়। বলে, আমি তো জানি না আপনি ইংরেজি পত্রিকার সম্বাদিক। সিনেমা পত্রিকা হইলেও কথা ছিল। আপনার ওই পেপার আমাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কেউ তো পড়ে না। বলে ভেতরে গিয়ে মেয়েটি দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। আর দূরে দাঁড়িয়ে নৃত্য পরিচালক হাসছিল। ফখরু ভাই খেপে যায়। বলে, তুমি বেঈমান আছ। তোমার সব খবর আমি জানে, সব লিখিয়া দিব...আমাকে দেখে শালা মুছকুরাতা হ্যায়...ওই জেল্লা রহেগা নেহি...
ড্যানিয়েল-সবুজ দুজনেই হেসে ওঠে। ড্যানিয়েল বলে, এইটা সুমিতা দেবীর বাড়ি, চিনে রাখেন, কাজে লাগবে।
ওরা দুজনেই নায়িকার চারতলার বাড়িতে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। ড্যানিয়েল বলে, এই যে আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছি, এটা মনে রাইখেন। শিরোনাম দেবেন, অমুকে সিঁড়ি পেয়ে গেছে—এখন ওপরে উঠছে।
দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে নায়িকা স্মিত মুখে দাঁড়ান। ড্যানিয়েল আগে যায়। নায়িকা সবুজের দিকে তাকান। তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় এনে বসান।
ড্যানিয়েল ফোড়ন কাটে। বলে, মেঘ না চাইতেই জল।
নায়িকাও কম যান না। বলেন, জানতাম মেয়েরা হিংসা করে। এখন দেখছি পুরুষরাও পিছিয়ে নেই। আপনি তো ঘরের লোক। আর উনি তো নতুন, তাই একটু সমাদর করতে হবে না। নায়িকা সবুজের দিকে তাকিয়ে বলেন, তা ভাই কী খাবেন? ঠাণ্ডা, না গরম?
সবুজ ঠিক বুঝতে পারে না। বলে, ঠাণ্ডা মানে কী?
— এই কোক, ফান্টা।
সবুজ বলে, এসব আমি খাই না।
নায়িকা ড্যানিয়েলকে বলেন, তা ভাই আপনি?
ড্যানিয়েল বলে, সে যখন না বলেছে তাহলে আমিও না।
নায়িকা বলেন, তা কী করে হয়! একটা কিছু তো খেতে হবেই।
সবুজ বলে, একটু আগেই লাঞ্চ করেছি। কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। তা ছাড়া আরেক জায়গায় যেতে হবে। ড্যানিয়েল প্রমাদ গুনে। নায়িকা বেশ চালাক-চতুর। বলেন, এ এলাকায় তো নায়িকা যেমন আছে, তেমনি আছে অভিনেত্রীও, তা কার কাছে যাচ্ছেন?
সবুজ বলে, আমি নতুন তো, কাউকে ঠিক চিনি না। যাব স্টেডিয়ামে খেলা দেখতে। ড্যানিয়েল হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।
সবুজ বলে, আজকে তো কেবল পরিচয় হলো। আরেক দিন আমরা এসে ইন্টারভিউ নেব না হয়। আর ফটোগ্রাফারকে বলব আপনার ছবি নিতে। এর মধ্যে কোথাও কি আপনার শুটিং আছে। নায়িকা বলেন, আপাতত নেই। কথা চলছে।
নায়িকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওরা অভিনেত্রীর বাড়িতে যায়। নায়িকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ড্যানিয়েল আশপাশে তাকিয়ে দেখে, কেউ ওদের ফলো করছে কি না। ওরা একজনকে নায়িকার বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে। ড্যানিয়েল লোকটাকে দেখায়। বলে, হালারে চিনছেন? সবুজ মাথা নাড়ে। ও একটা দৈনিক পত্রিকার সিনেমার পাতার রিপোর্টার। সপ্তাহে এক দিন হাফ পেজ ফিল্মের জন্য বরাদ্দ। তার জন্য কী খাটাখাটি! নায়িকা সারা দিনই ইন্টারভিউ দেয়। শালায় এখন আমাদের জন্য আনা কোকে ভাগ বসাবে। বিকেলের নাশতাটা হয়ে গেল নিখরচায়!
অভিনেত্রী অঞ্জু দত্তের বাসা মেইন রোডের ওপরে। বারান্দায়ই দাঁড়িয়ে ছিল। ওদের দেখে মুচকি হাসে। সবুজ বলে, ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সারা দিন মনে হয় রোড শো করে! ওই যে পানের দোকান আর সেলুনের সামনে কজন দাঁড়িয়ে অভিনেত্রীকে দেখছে।
ড্যানিয়েল বিরক্ত হয়। বলে, এই মাতারিরে আমি অনেকবার বলেছি, আড়ালে থাকো। মানুষ তোমার জন্য ওত পেতে বসে থাকবে দিনের পর দিন, তোমার দেখা পাবে না। আর চড়ুই পাখির মতো ফুরুৎ ফুরুৎ করে সারাক্ষণ লোকজনকে দেখা দিলে হলে গিয়ে লোকে তোমাকে দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। কে শোনে কার কথা!
বারগ্যান্ডি রঙের একটা শিফনের শাড়ি পরেছে অভিনেত্রী অঞ্জু দত্ত। তার সঙ্গে ম্যাচ করে হাতা কাটা ব্লাউজ। ঠোঁট দুটি রাঙিয়েছে গাঢ় লাল রঙের লিপস্টিকে। গায়ের রং কাঁচা হলুদ বর্ণের। মাথায় কোঁকড়া চুল। তাকে কোথায় যেন দেখেছে মনে করতে চেষ্টা করে। মনে পড়ে যায়। হিন্দি ছবিতে। নায়িকা নিম্মির সঙ্গে তার বেশ মিল। সে কথা বলতেই অঞ্জু দত্তের চোখে-মুখে দীপ্তি খেলে যায়।
সে উত্তেজিত হয়ে বলে, থ্যাংক ইউ...আপনার এই কথাটা আমাকে অনেকেই বলেছে। ড্যানিয়েল মনে মনে খিঁচে যায়। বলে, শালা বাটপাড়! নায়িকা পটানোর টেকনিক শালায় ইতোমধ্যে ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে দেখছি!
ড্যানিয়েলের উদ্দেশে অঞ্জু দত্ত বলে, থ্যাংক ইউ ভাইয়া, উনাকে নিয়ে এসেছেন। এসেই কেমন মনের মধ্যে একটা তীর মেরে দিল। বলে সবুজের হাত ধরে তার পাশে বসে। বাহ আপনার হাতটা কত নরম! আপনার মনটাও বেশ নরমই হবে। কফি পান করবেন তো নিশ্চয়ই! বলে ভেতরে চলে যায়।
ড্যানিয়েল সোফায় হাত-পা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। সবুজ ড্যানিয়েলের উদ্দেশে মোলায়েম
সম্পর্কিত খবর
বাইরে কা কা করছে একটা কাক। নাজুকে শোনাতে পারলে খুশি হতো। সেদিন বলছিল, ‘ভোরে এখন আর কাকের ডাক শুনি না। কাক কি হারিয়ে যাচ্ছে? কাকের শহর ঢাকায় সাতসকালে একটা কাক ডাকবে না—এ কেমন কথা!’
কাক নিয়ে অবশ্য মাথাব্যথা নেই মাশুকের।
মাশুকের ভাবনায় বাদ সাধে এক খদ্দের। দিনের প্রথম কাস্টমার।
‘অরিজিনাল লেদার শু আছে?’
প্রশ্নটা বিরক্তিকর! সমিতির মার্কেটে এসেছে লেদার শু কিনতে? মাশুক কুশলী জবাব দেয়, ‘পিওর লেদার পাবেন না, মিক্সড হবে। তবে এগুলা লেদারের চেয়ে কম না।
‘দেখান তো ভাই।’
র্যাক ভর্তি বিভিন্ন ধরনের জুতা সাজানো। এক দিকে আঙুল তুলে মাশুক বলল, ‘ওইখানে নতুন কিছু শু আছে। দেখেন কোনটা পছন্দ হয়।
লোকটা এগিয়ে গেল র্যাকের দিকে। মাশুক এই জুতার দোকানে ক্যাশ আগলায়। জুতা দেখানো বা খদ্দেরের পায়ে গলিয়ে মাপ ঠিক করা তার কাজ নয়। অল্পবয়সী দুই তরুণ কাজটা করে। কিন্তু সকাল সাড়ে দশটায়ও কারো আসার নাম নেই।
‘ভাই, এই জোড়া নামান। নিয়া আসেন, দেখি।’
নরম কুশনের টুলে গিয়ে বসল ক্রেতা। ছোকরা দুটো আসছে না কেন? মাশুকের মাঝেমধ্যে এমন রাগ হয়, দুজনের নামে মালিকের কাছে নালিশ দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু দমে যায়। ওরা দুজনই ছেলের বয়সী। মায়া লাগে।
মাশুক বাধ্য হয়ে লেগে গেল খুবই অপ্রিয় একটা কাজে। লোকটা ধুলোমলিন পুরনো জুতা থেকে পা দুটি বের করতেই ছুটে পালাতে ইচ্ছা করল তার। মোজায় এমন গন্ধ, কেনার পর চিজ দুখানায় কখনো পানি পড়েছে কি না সন্দেহ!
লোকটা নতুন জুতা পায়ে গলিয়ে মচমচ করে কয়েক কদম হেঁটে দেখল। তারপর মুখ বাঁকা করে বলল, ‘নাহ, জুত নাই। রাইখ্যা দেন।’
লোকটার ধুলোমলিন পুরনো জুতা ডাকঘরের সিলমোহরের মতো একটা ছাপ রেখে যায় মাশুকের মনে। পরিবার থেকে দলছুট এই দেহটা এখনো বয়ে বেড়ানো যাচ্ছে। যখন আরো বয়স হবে, কর্মক্ষম থাকবে না, ঠিক ওই ধুলোমলিন জুতা বনে যাবে সে। হায় জীবন!
তাড়াহুড়া করে আসায় সকালের নাশতাটাও সারা হয়নি আজ। পেটে সারিন্দা বাজাচ্ছে ক্ষুধা। কিছু মুখে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওরা না এলে বাইরে যাবে কী করে?
পরিষ্কার থাকার একটু বাতিক আছে মাশুকের। লোকটার নোংরা মোজা হাতড়ে গা ঘিনঘিন করছে। হাত না ধুলেই নয়। এ সময় সুরেলা আওয়াজ তোলে মোবাইলের রিংটোন। কল দিয়েছে নাবিলা। হাত ধোয়ার কথা ভুলে কল রিসিভ করে মাশুক।
‘কী করছ, বাবা?’
‘এইতো—দোকানে বসছি।’
‘আজ দুপুরে আসতে পারবা?’
‘কেন?’
‘তোমার এই একটা বিশ্রী স্বভাব, একটা প্রশ্ন করলে জবাব না দিয়া পাল্টা প্রশ্ন করো। আসতে পারবা কি না?’
‘খুব দরকার?’
‘উহু রে, আবার প্রশ্ন! আইসো।’
‘দেখি।’
‘দেখি আবার কী? দেখার কী আছে? আসবা, ব্যস।’
লাইন কেটে দেয় নাবিলা। মাশুকের হৃদয়গভীরে একটা কুলুকুলু স্রোত বয়ে যায়। ওদের কাছে যাওয়ার সুযোগ হলে এমন অনুভূতি হয়। আজব এক পরিস্থিতি। পরিবার নিজের, কিন্তু বাসা ওদের।
মাস কয়েক আগে মিরপুরের রুফটপ ওই ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। নাজু, নাবিলা আর নাহিদ। বড় একটা রুম দুই ভাগ করে দুটি বানানো হয়েছে। একটায় রান্নাবান্না চলে। সেখানেই এক কোণে খাট পেতে থাকে নাজু আর নাবিলা। বাথরুম একটাই। সেটা ছাদের আরেক প্রান্তে। আরেকটা রুম নাহিদের। সেখানে জায়গা হয়নি মাশুকের। মা-মেয়ে যত স্বচ্ছন্দে একসঙ্গে থাকা যায়, বাপ-ছেলের এক রুমে থাকাটা সহজ নয়। বিশেষ করে ছেলে যদি তরুণ হয় আর মুখের ওপর বলে, ‘কী করলা জীবনে? মায়ের জীবন তো তামা করছই, আমাদের জন্যও তো কিছু করতে পারলা না!’
বাধ্য হয়ে মেসে উঠেছে মাশুক।
এর মধ্যে দোকানের ছেলে দুটি এসেছে। সমিতির মার্কেটের দোকানগুলোতে ক্রেতার ভিড় জমছে। এখানে বেশির ভাগই নিম্নমধ্যবিত্ত। তারা দেখে বেশি, কেনে কম। কিনলেও দোনামনা থাকে—ঠকলাম কি না। এর পরও জুতার দোকানে বিক্রি মন্দ না। দিনে সাত-আট জোড়া বিক্রি করতে পারলে ভালো লাভ থাকে।
দুপুরের দিকে ফোনে মালিকের কাছ থেকে ঘণ্টা তিনেকের জন্য ছুটি নেয় মাশুক। বলে, বাসায় জরুরি কাজ। ছেলে দুটির ওপর দোকানের ভার বুঝিয়ে দিয়ে মিরপুরের বাস ধরে সে। মাথায় এলোমেলো চিন্তা। হঠাৎ এই জরুরি তলব কেন? টাকার দরকার, না অন্য কোনো সমস্যা? নাজু আজকাল নিজে ফোন করে না, মেয়েকে দিয়ে করায়। এখন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ চলছে। এই মুহূর্তে টাকা দেওয়া সম্ভব না, যা দেওয়ার তা তো দিয়েছেই।
মিরপুর-১০ গোলচত্বরে বাস থেকে নেমে যায় মাশুক। এখান থেকে বাসায় যেতে রিকশায় ৫০ টাকার মতো লাগে। মাশুক হেঁটেই যায়। গলির মাথায় সবজির ভ্যান। বাসায় কিছু সবজি নেওয়া যায়। খুশি হবে ওরা। কিন্তু দাম শুনে দমে যায় মাশুক। নতুন আলু ৭০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, বেগুন ১০০ টাকা। সবজির দামের কাছে জীবনের দাম পানি। সস্তার সবজি অবশ্য আছে। মুলা। বিশ টাকা কেজি। মাশুক নেয় কেজিখানেক।
এ বাসায় লিফট নেই। সিঁড়ি ভেঙে ছয়তলায় ওঠা কষ্ট। প্রবল ইচ্ছাশক্তি মাশুককে টেনে তোলে। টুকটুক করে মৃদু টোকা দেয়। নাজু দরজা খোলে।
‘তুমি!’
যেন তিরিশ বছরের জীবনসঙ্গীকে চিনতে অনেক কষ্ট। মাশুক গা করে না। সয়ে গেছে। তবে নাজুর জন্য মাশুকের এখনো অনেক মায়া।
মাশুক বিরস মুখে বলে, ‘নাবু ফোন দিয়া আসতে বলল। ভাবলাম জরুরি।’
‘আসো।’
দরজা থেকে সরে জায়গা করে দেয় নাজু। পেছনে নাবিলা এসে দাঁড়িয়েছে। মাকে তীক্ষ কণ্ঠে বলে, ‘বাবাকে দেইখা চমকানোর কী আছে, মা? নয় দিন পর আসল বেচারা!’
নাজু বলে, ‘আমাকে তো বললি না?’
‘তোমাকে বইলা কী হইব? তিতা কথা ছাড়া কিছু জানো?’
‘তিতা কথা তো এমনিই বাইর হয় না। তোর বাপের চুল পাইকা সাদা হইয়া যাইতেছে, তবু আক্কেল-বুদ্ধি পাকল না! দেখ, মুলা নিয়া আসছে! এইসব বলে কোনো বাসায় নেওয়ার জিনিস!’
‘মাসের কয় তারিখ আইজ? তুমি আমার পকেটের অবস্থা দেখবা না?’
‘টাকা না থাকলে আনবা না। তাই বইলা গ্যাসের ফ্যাক্টরি নিয়া আসবা?’
নাবিলা ফিক করে হেসে ফেলে। নাজুও যোগ দেয়।
মাশুক বিরক্ত হয়ে বলে, ‘এই জন্যই তোদের কাছে আসতে ইচ্ছা করে না। ভালো কিছু করলেও মরণ! মুলা দিয়া পাতা শুঁটকির চচ্চড়ি তুমি পছন্দ করো না? এই জন্যই তো...। এখন বলো কী হইছে?’
নাবিলা বলে, ‘কিছু হয় নাই, বাবা। বাসায় আজ ভালো কিছু রান্না হইছে। আমরা পোলাও-মাংস খাব, আর তুমি বাদ থাকবা, সেইটা কি হয়?’
মাশুক এতক্ষণে খেয়াল করে, রান্নাঘর প্লাস থাকার ঘরটায় দারুণ সুবাস! কয়েক দিনের না-খাওয়া অভাগার মতো হাসি ফোটে তার। বলে ফেলে, ‘পোলাওয়ের সঙ্গে কী করছ তোমরা? গরু, না মুরগি?’
নাবিলাও হাসে, ‘দুইটাই।’
‘কী উপলক্ষে এত কিছু?’
নাজু বলে, ‘আরে, নাহিদ ওর এক বন্ধুরে খাওয়াইব। সেও রাইড শেয়ার করে।’
এখন দুপুর দুইটা। এত বেলা পর্যন্ত না-খাওয়া মাশুকের আর তর সয় না। বলে, ‘কী দিবা দাও। খুব ক্ষুধা লাগছে।’
নাজু ভেতরে ভেতরে টেনশনে অস্থির। আজকের দাওয়াতের বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। নাহিদ যে বন্ধুকে নিয়ে আসবে, সেও পড়াশোনা ছেড়ে রাইড শেয়ার করে। নাহিদ বলেছে, ওর জানা মতে ছেলেটির বাজে কোনো নেশা নেই। কোনো মেয়ের সঙ্গেও নেই, তবে খুঁজছে। পছন্দমতো পেলে বিয়ে করবে। নাবিলাকে দেখে সে রকম আগ্রহ দেখালে বিয়ের কথা পাড়বে নাহিদ।
নাবিলা দেখতে-শুনতে মন্দ না। মেধাবীও। এসএসসিতে সায়েন্স থেকে জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। মেডিক্যালে পড়ার ইচ্ছা। না হলে পাবলিক ভার্সিটি। কিন্তু নাহিদ বলে, বাবার যে অবস্থা, কলেজে থাকতে থাকতে নাবিলাকে পার করতে হবে। আইবুড়ো হলে তখন ছেলে পাওয়া মুশকিল।
নাজু একটু আপত্তি তুলেছিল, অমনি রেগে গেল ছেলেটা। বলল, ‘আমি এত বিয়ার করতে পারব না, মা। বোঝা হালকা করতে হইব। আমারও তো ভবিষ্যৎ আছে। বি প্র্যাকটিক্যাল!’
নাজু আর কিছু বলেনি। টাকা-পয়সা না থাকলে এ বয়সে অনেক অধিকার বেদখল হয়ে যায়। নাহিদ পইপই করে বলেছে, ‘বাবা যেন কিছুতেই জানতে না পারে। পরে জানাইলেই হইব।’
এ জন্যই নাজু কিছু জানায়নি মাশুককে। নাবিলাও জানে না এই দাওয়াতের আসল কারণ। মেয়েটা হুট করে বাবাকে নিয়ে আসায় এখন ভারি বিপদ হয়েছে। কখন যে ওরা এসে পড়ে! বাবাকে দেখলে নাহিদ এখন হয়তো কিছু বলবে না, পরে ঠিকই ঝাল ওঠাবে।
নাজু বলে, ‘তাড়াতাড়ি খাইয়া চইলা যাও। দেরি করলে দোকানের মালিক আবার কী বলে!’
হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসে পড়ে মাশুক। নাবিলা ঘরে রাখা মোটা কাগজের একটা শপিং ব্যাগ ছিঁড়ে বিছিয়ে দেয় বাবার সামনে। বলে, ‘সকালে কী দিয়ে নাশতা করছ, বাবা?’
মাশুক এড়িয়ে যায়, ‘সকালের কথা এখন জানার দরকার আছে?’
‘রোজ সকালে নাশতা করার সময় তোমার কথা মনে পড়ে, বাবা। মা দুধ-চা দিত, তুমি তেল ছাড়া পরোটা ভিজাইয়া খাইতা। মা বলে আর কাঁদে।’
‘তুইও এখন কাঁদবি নাকি?’
নাবিলা ওদিক ফিরে মুখ আড়াল করে। মাশুকের বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস উঠে আসে। করোনার আগে ভালোই ছিল ওরা। তখন এত লোয়ার লেভেলে না, বেশ ভালো একটা আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানে হিসাব বিভাগে ছিল। দুই কামরার একটা ছিমছাম বাসায় ছিল। আলাদা কিচেন, দুটি বাথরুম। নাহিদ তখন ঢাকা কলেজে অনার্সে পড়ে। নাবিলা স্কুলে। হুট করে করোনা এলো, ভোজবাজির মতো উধাও হলো চাকরিটা। তারপর কয়েকটা মাস একদম বেহদ্দ বেকার। করোনা গেলে ব্যাংকে যা ছিল, তা দিয়ে শেষরক্ষা হিসেবে একটা ফাস্ট ফুডের দোকান দিয়েছিল। জমল না। পুরো ১০ লাখ টাকা গচ্চা। নাহিদের পড়াশোনা ওখানেই শেষ। তবু ভাগ্যিস, ধারদেনা করে ওকে একটা মোটরবাইক কিনে দিতে পেরেছে। চারটা বছর ছোট-বড় নানা ঢেউ সামলে শেষে এই জুতার দোকানে ঢুকেছে মাশুক। বেতন যা পায়, তা দিয়ে কোনোমতে টেকা যায়, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না।
বাবাকে পোলাও-মাংস বেড়ে দেয় নাবিলা। অনেক দিন এমন ভালো খাবার খায় না মাশুক। রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
সব শেষে দই খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে মাশুক। নাবিলা বলে, ‘তোমার বেতন কি আর বাড়বে না, বাবা?’
‘বাড়বে কিভাবে? বাড়ানোর কথা বলারই তো সাহস হয় না।’
‘তোমার সাহস নাই দেইখাই তো আমাদের এই অবস্থা। ভাইয়া ঠিকই বলে। মালিককে বলবা যে জিনিসপত্রের দাম বেশি, চলা যায় না।’
মাশুক কিছু বলে না। হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ে। নাজুর ফোনে রিংটোন। কল দিচ্ছে নাহিদ। বুকটা ধড়াস করে ওঠে। এসে গেছে নিশ্চয়ই! ভয়ে ভয়ে ফোন ধরে। কিন্তু না, জরুরি কি একটা কাজ পড়েছে। এখন না, রাতে আসবে ওরা। হাঁপ ছাড়ে নাজু। যাক, এ যাত্রা বাঁচা গেছে!
নাজু এবার বলে, ‘খেয়ে একটু আরাম করেই যাও। একদিন একটু লেট হইলে কী আর বলবে?’
মাশুকেরও ভরপেট খেয়ে নড়তে ইচ্ছা করে না। ওই বিছানায়ই চিত হয়ে শুয়ে পড়ে। নাবিলা মাথার কাছে বসে। বাবার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আর কয়েকটা মাস কষ্ট করো, বাবা। আমি এইচএসসি দিয়া টিউশনি করব। তোমাকে আর মেসে থাকবে হইব না। তখন আরেকটা ভালো বাসায় উঠব।’
নাবিলা বলেই চলে, ‘আর যদি ভার্সিটিতে ভর্তি হই, হলে উঠতে পারি...’
নাবিলার সব কথা কানে যায় না মাশুকের। আবেশে চোখ বুজে আসে। ঘোরলাগা চোখে স্বপ্ন দেখে সে। সবাই একসঙ্গে নতুন একটা বাসায় উঠেছে। বারান্দায় আসা নরম রোদে গা পেতে বসে আছে সে। ভেতরে চায়ের কাপে টুং টাং। এখনই আসবে ভাপ ওঠা চা। কিন্তু শীত বিকেলটা বড্ড ক্ষণস্থায়ী। কখন যে মিষ্টি বিকেল অস্তাচলে বিলীন হয়, টের পায় না মাশুক।
পুরনো হলেও এখনো চাপা রিনঝিন হাসি ঢেউ খেলে যায় ছ’ফুটি এই গলিতে—বাঁ দিকে সালেহা মঞ্জিলের উঁচু দেয়াল, ডান দিকে আম-কাঁঠালগাছের নিরিবিলি ছায়ায় পর পর দুটি টিনশেড বাংলোবাড়ি। সামনে গলি গিয়ে পড়েছে দু’পায়া পথে আর পেছনে এল সাইজ টিনশেড এই এলাকার থেকে যাওয়া একমাত্র মেস—ইঞ্জিনিয়ার্স মেস। যে ইঞ্জিনিয়াররা গাছপালায় ছাওয়া শান্ত পরিবেশে এই মেসবাড়িটার প্রথম বাসিন্দা ছিলেন, এখন নিশ্চিত কোনো না কোনো অভিজাত পাড়ায় তাঁরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন।
ইলিয়াস ঢুকতে গিয়ে পুরনো ভাঙাপ্রায় টিনের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে যায়।
সুবাসটা চেনা চেনা, অথচ মোটেই চেনা নয়। হাসিটাও এই রকম—পুরনো হাসির ধরন, যা চেনা যায় যায় না। চকিতে মনে পড়ে ইলিয়াসের মানুষকে চেনার আগেই বোধ হয় তার হাসি চেনা যায়।
স্কুলে হেডমাস্টার সাব আজ বলে দিয়েছেন—আমি দুঃখিত ইলিয়াস সাব, আপনার জন্য বোধ হয় কিছু করতে পারলাম না। কিভাবে করব বলুন, একজন মন্ত্রী যদি সামান্য একটা স্কুল শিক্ষকের চাকরির জন্য রিকমেন্ড পাঠিয়ে আবার টেলিফোনে রিকোয়েস্ট করেন, তাহলে কী করা যাবে! আপনি সাময়িক নিযুক্তি নিয়ে কাজ করেছেন—আপনার একটা দাবি আছে, কিন্তু আমার করার নেই কিছুই।
মন্ত্রীদের হাত কত দীর্ঘ! একটা মানুষের হাত কত দীর্ঘ হতে পারে? কোনো কোনো বংশের লোকদের হাত নাকি তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হয়—এ রকম কথা বলা হয়ে থাকে। সেটাও তো আর শরীর ছাড়িয়ে যায় না। তবে মন্ত্রীর হাত শরীরের তোয়াক্কাই করে না, অশ্বখুরের দাগের পরিমাণ ফাঁকফোকরে ননি-মাখনের খানিকটা আভাসও জিহ্বাগত হওয়ার বাইরে থাকে না!
হাত নিয়ে ভাবতে ভাবতে ইলিয়াস মেসে ঢুকছিল। টিনের ভাঙা গেটে হাত রাখার সঙ্গে সঙ্গে ওই হাসি আজও দুরন্ত তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়ল।
গোপন কড়া নাড়ার এই শব্দ ঝরনার মতো বইছে এখন তার বুকের ভেতর। অবাক কাণ্ড, দীর্ঘ হাতের ছোবল যে ক্ষত তৈরি করেছে, তার ওপর ঝরনার পানি পড়তেই বেদনা ধোঁয়ার মতো উড়তে থাকল—আসলে উড়তে থাকল কী! পুরনো অভ্যাস তো থাকে!
মুচকি হাসিটা ধরে রেখেই রুমে ঢুকল। রুমমেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি অ্যাকাউন্টস অফিসার রফিক মাড়ির গোড়ায় গুল ঠেসে দিয়ে পুরনো অভ্যাসে অস্বাভাবিক জোরে হাত ঝাড়ছিল।
ইলিয়াস ঢোকামাত্র তার মুখে দৃষ্টি স্থির করে হাতঝাড়া ভুলে উৎসাহিত হয়ে উঠল, কী কাম হইয়া গ্যাচে! হবে না ভাই, আপনের কপাল ভালো। কইছিলাম না—চিন্তা কইরেন না। আরে ভাই—আপনে আপনের কপাল দেখতে না পাইলে কী হইব—আমরা তো দেখতে পাই। আপনের কপালের গড়ন আলাদা—এই রকম গড়নপদের কপাল দেখলেই চিনবার পারি—হেই ইস্ট পাকিস্তান ওয়াপদার আমলে ক্লার্ক হইয়া ঢুকছি—কত কপাল দেখছি। অহন একনজর দেখলেই কইয়া দিতে পারি কী আছে কপালে। না, কপালতত্ত্ব নিয়া পড়াশোনা করি নাই, এইডা অভিজ্ঞতা। বুঝলেন ভাই, অভিজ্ঞতার কোনো বিকল্প নাই।
রফিক গুলের ক্রিয়ায় মুখে জমে ওঠা পানি দরজা দিয়ে বাইরে পিক করে ছুড়ে দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ইলিয়াসের হাসি মিলিয়ে গেছে—জামার বোতাম খুলতে খুলতে বলল, কাম হয় নাই, রফিক ভাই!
রফিক বিছানা থেকে উঠে ইলিয়াসের সামনে এসে দাঁড়াল, কন কী, হয় নাই! হয় নাই ক্যান? আপনে তিন মাস কাজ করছেন—অহন আপনে, ডিপার্টমেন্টাল ক্যান্ডিডেট রুলে আছে আপনের প্রিফারেন্স।
ইলিয়াস বলল, কলোনিতে পাঁচ বছর আগে আপনার নামে বাসা অ্যালট হয়েছে—তার পরও বাসায় উঠতে পারছেন না কেন?
রফিক হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে বলল, আরে ভাই, এই কিচ্ছা না কত দিন কইছি। গত পাঁচ বছরে আমি যত কথা কইছি—তার বেশি অর্ধেক খরচ হইছে এই কিচ্ছা কইতেই। তো আর কওয়া যাইব না, পরশু দিন অফিসে হুমকি দিয়া গ্যাছে।
ইলিয়াস বলল, কন কী! হুমকি দেওয়ার জন্য অফিসে গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়েছে?
রফিক হাত-পা ছেড়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল, আরে ভাই, গুণ্ডা হইলে বুঝতাম—গুণ্ডায় হুমকি দিব না তো কী করব, হুমকি দিয়া গ্যাছে ওই মেয়েটা। কই নাই যারা জবরদখল কইর্যা রাখছে বাসা ওদের ওই মেয়েটা। কয় গান গায়—শিল্পী। এ যে কোন শিল্প সে কি আর বুঝি না! জানেন, ছোটবেলায় গেরামে দেহতত্ত্বের গান শুনছি, আর অহন এই সময়ে ঢাকার শহরে দেখছি দেহশিল্পের দাপট!
ইলিয়াস বলল, গোটা দেশটাই এখন মাসলম্যানদের হাতে জিম্মি—এদের হাত থেকে উদ্ধার না পেলে দেশ চলবে না!
রফিক বলল, আরে দূর সাব, আপনে কী কন! এই যে মেয়েটা আমারে রীতিমতো হুমকি দিয়া গ্যাল—সে কি মাসলম্যান? এ হলো সফট মাসল ওম্যান। এখন এদের যুগ, এদের হাতে জিম্মি এখন সমাজ। হার্ডওয়্যারের যুগ শেষ, এখন সফটওয়্যারের যুগ!
ইলিয়াস বিছানায় বসে পড়ে বলল, বুঝলাম না ভাই কী কইলেন সাংকেতিক ভাষায়।
রফিক বলল, আরে ভাই, আপনেরে আর কত বুঝাইবাম। সাংকেতিক ভাষা হইল এই যুগের ভাষা। আপনে তো ম্যালা নভেলটভেল পড়েন। দেখেন না আজকাল মডার্ন জনপ্রিয় লেখকরা কেমন শর্টহ্যান্ডের মতো সংকেত দিয়া দিয়া তরতর কইর্যা লেইখ্যা যায়। মনে হয় চিন্তা নাই ভাবনা নাই—কাগজ-কলম নিয়া বসে আর ফরফরায়্যা লেখা শেষ কইর্যা ফালায়। এই কথা কইছে এক মহাজনপ্রিয় লেখক এক সাপ্তাহিকে সাক্ষাৎকারে। কথা বেঠিক না—চিন্তা-ভাবনা যদি কিছু করতে হয় তো করব পাঠকরা।
ইলিয়াস বলল, এটা আপনার অন্যায়, রফিক ভাই—আপনি জানেন সারা বিশ্বের সাহিত্যে পরিবর্তন এসেছে। আমাদের লেখকরাও—
রফিক তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, রাত কয়টা দেখছেন? অহন হাতমুখ ধুইয়া খাইতে বসেন।
লোকটার মেজাজ এই বাসা নিয়ে ইদানীং খিটখিটে হয়ে উঠেছে। তবে সময়মতো খাওয়া আর ঘুমানোর ব্যাপারে ইলিয়াসকে প্রতিদিন তাগিদ দিতে ভোলে না।
খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল ইলিয়াস। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে সেই রিনঝিন হাসিটা তার মশারির ভেতর ঢুকে পড়ল—সে এখন থইথই হাসির ঢেউয়ে নিমজ্জিত। এমন তো হতে পারে, কাল খুব ভোরে এই গলির বাসিন্দারা জেগে ওঠার আগে ভাঙা গেট দিয়ে বের হতেই দেখবে—কী দেখবে! কোনো ছবি স্পষ্ট হয় না। সাদা কাগজের মতো একটা ভোর ওত পেতে রয়েছে—এ রকম সাদার মুখোমুখি হতে ভয় পায় সে, দম আটকে আসে তার।
ইলিয়াস উঠে বসে বিছানায়। মশারি গুটিয়ে টেবিলের ওপর থেকে হাতড়ে পানির গ্লাসটা তুলে নেয়—ঢকঢক করে খানিকটা পানি পান করে।
তারপর ডাকে, রফিক ভাই ঘুমিয়েছেন?
রফিক জিজ্ঞেস করল, ঘুম আসছে না? ঘুমান, ঘুম হইল শরীরের বিশ্রাম। চিন্তা কইর্যা কিছু হয় না—যা হওয়ার এমনিই হয়। ঢাকার শহরটা একটা সমুদ্র—এইখানে রুই-কাতলার পাশাপাশি মলা-পুঁটিও থাকে। তবে থাকার একটা ফরম্যাট আছে—আয়ত্ত না হওয়া পর্যন্ত অস্থির অস্থির লাগে, হইয়্যা গ্যালে দেখবেন একেবারে নিশ্চিন্ত পানির মতো জীবন। নেন ঘুমান।
ইলিয়াস বলল, আপনি সজাগ ছিলেন—ঘুমান নাই?
রফিক বলল, আরে কইয়েন না, হঠাৎ আপনের ভাবিরে দেখলাম—
ইলিয়াসের কণ্ঠে বিস্ময়, ভাবিরে দেখলেন! কী স্বপ্ন দেখছেন?
রফিক হেসে ওঠে, আরে না—ঘুমাই নাই তো স্বপ্ন দেখব ক্যামনে!
ইলিয়াস বলল, তাহলে ভাবিরে দেখলেন কেমনে?
রফিক বলল, মশারির পাশে আইস্যা দাঁড়াইল। আপনে যখন পানি খাইলেন তখন কইল—যাইগা, ইলিয়াস ভাইয়ে দেখলে কী কইব? শত হউক এইডা মেস তো!
ইলিয়াস থ—লোকটা বলে কী—মাথায় গোলমাল দেখা দেয়নি তো! সে চুপ হয়ে যায়—মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করে না।
অনেকক্ষণ পর রফিক কথা বলে ওঠে—কী, ঘুমাইলেন?
ইলিয়াস সাড়া দেয়, না।
রফিক বলল, ইলিয়াস সাব, আপনে আমার ছোট ভাইয়ের মতন, কী কই আপনেরে। জানেন, বিয়া করলাম—দু’টা ছেয়েমেয়েও হইল, কিন্তু সংসার করতে পারলাম না। একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর একজন ঢাকায়। সংসার বলতে যা বোঝায়, প্রতিদিনের সংসার, তা হয়!
রফিকের দীর্ঘশ্বাস ঘরের বাতাস ভারী করে তোলে—এত ভারী যে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
ইলিয়াস জিজ্ঞেস করল, রফিক ভাই, আমি যখন এলাম, তখন বাইরে কোনো হাসির শব্দ শুনেছিলেন?
রফিকের কণ্ঠে বিস্ময়, হাসি! কার হাসি?
ইলিয়াস বলল, এই—এই কোনো মহিলার!
রফিক আপন মনে আওড়াল—মেয়েমানুষের হাসি! না তো—কন কী! শুনছেন আপনে?
ইলিয়াস বলল, হ্যাঁ। গত কয় দিন যাবৎই শুনি—ভাঙা গেটটায় হাত রাখতেই রিনঝিন হাসি...
রফিক হেসে ওঠে, দূর কী কন! আপনে শোনেন আর আমি শুনি না, কেউ শুনে না—এইটা হয় নাকি? এইটা আপনের ভেতরে লুকাইয়া আছে—ফাঁক পাইলেই বাইর হয়!
ইলিয়াস বলল, এটা কী কন রফিক ভাই? আমি স্পষ্ট শুনেছি, একদিন-দুইদিন না, গত এক সপ্তাহ ধরে শুনছি—মিষ্টি সুরেলা হাসি, ঠিক ঝরনা থেকে পানি গড়ায় যেমন শব্দ করে!
রফিক ওকে থামিয়ে দেয়—ব্যস, হইয়া গ্যাছে, আর কইতে হইব না। এই যে আপনের ভাবি আইস্যা দাঁড়াইল—এইটা ক্যামনে? আরে ভাই, ভেতরে লুকাইয়া থাকলে ফাঁক পাইলেই বাইর হইয়া আসে। ভেতরটা যখন অসহ্য হইয়া ওঠে, তখনই বাইর হয়।
ইলিয়াসের গা ছমছম করে ওঠে—সে বুকে হাত দেয়—অনুভব করার চেষ্টা করে সত্যই রিনঝিন হাসিটা ভেতরে আছে কি না!
সকালে হালকা সাজ
সকালে হালকা ও আরামদায়ক পোশাক পরা উচিত কারণ এসময় ছিমছাম, স্নিগ্ধ সাজই সুন্দর লাগে।
সকালের পরিবেশে হালকা যেকোনো কিছুই ভালো মানায়। মেকআপ, কনট্যুরিং, ব্লাশ ও মাশাকারায় হালকা ভাব ধরে রাখতে পারেন। সকালে চুলের সাজে পনিটেল করে নিন।
দুপুরে চাই আরাম
গরম আবহাওয়া এখন। রেড বিউটি স্যালনের স্বত্বাধিকারী ও রূপ বিশেষজ্ঞ আফরোজা পারভীন বললেন, ‘ঈদের দিন দুপুরে ভারী মেকআপ না করাই ভালো। বেইস মেকআপ ম্যাট রাখুন। গরমে ত্বক বেশি ঘামলে বা তেলতেলে হলে ভালো করে মুখ ধুয়ে টোনার লাগিয়ে নিন। চেষ্টা করুন মেকআপের সব উপাদান যেন ম্যাট হয়। এতে গরমে ঘামলেও মেকআপ নষ্ট হবে না। চোখে ঘন মাশকারা ও আইলাইনার দিতে পারেন। চোখের সাজে স্মোকি ভাবও এই সময় সুন্দর লাগবে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে লিপস্টিক দিন ঠোঁটে। ন্যুড কালার লিপস্টিকও রাখতে পারেন। কানে দুল আর গলায় হালকা লকেট বেছে নিতে পারেন। দুপুরের সাজে চুল বেঁধে রাখাই বেশি আরামদায়ক হবে।’
রাতে জমকালো
রাতের বেইস মেকআপ মানায় ভালো। সাজও জমকালো হয়। রাতে জমকালো কাজ করা পোশাকের সঙ্গে ভারী মেকআপ, ভারী গয়না, চোখের সাজে রঙের বাহার, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক রাতে আরো বেশি সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুলবে। বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভ কেয়ারের স্বত্বাধিকারী শারমিন কচি বললেন, ‘রাতের সাজে মানানসই হাইলাইটার ব্যবহার করুন। গাঢ় ব্লাশ অন বেছে নিন। ঠোঁটেও থাকবে উজ্জ্বল রং। চোখে রঙিন সাজ বা স্মোকি আই রাতে ভালো দেখাবে। চুলের সাজে লম্বা বেণি সুন্দর মানাবে। চাইলে চুল ছেড়েও রাখতে পারেন।’
যখন যেমনই সাজুন, সবার আগে নিজের ব্যক্তিত্ব ও আরামদের দিকটা প্রাধান্য দিন। গরমে সাজবেন তো অবশ্যই, তবে তা যেন নিজের সৌন্দর্য আর সুস্থতায় কোনো ব্যাঘাত না ঘটায়। মনে রাখবেন, সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখা সবচেয়ে জরুরি। তবেই তো ঈদের আনন্দ সবার সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগ করবেন।
পাঞ্জাবি পরতে ভালোবাসেন না এমন পুরুষ কমই। ঈদের দিন তো নতুন পাঞ্জাবি ছাড়া জমেই না। এ জন্য ঈদ ঘিরে নতুন নতুন পাঞ্জাবির পসরা সাজিয়ে বসে ফ্যাশন হাউসগুলো। ফ্যাশন হাউস কে ক্রাফটে এসেছে বর্ণিল নকশার পাঞ্জাবি।
বিশ্বরঙের শোরুমে ম্যানিকুইনগুলোর বেশির ভাগই ঈদের পাঞ্জাবি পরা। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘এবার নকশা ও থিমের চেয়ে আরামই বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে পাঞ্জাবির কাপড়ে। কারণ গরমের মধ্যে। সে জন্যই আরামকে বেছে নেওয়া। সুতি, কটন, সেমিকটন, লিনেন ও পাতলা তাঁতের কাপড়ে তৈরি হয়েছে এবারকার ঈদ পোশাক।
প্রিন্টে পরিপাটি
প্রিন্টের পাঞ্জাবির প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ সব সময়ই। এবারও প্রিন্টের পাঞ্জাবির জয়জয়কার। ফ্যাশন হাউস ওটু, জেন্টল পার্ক, লা রিভ, টুয়েলভ, অঞ্জন’স, লুবনান, রিচম্যান থেকে শুরু করে ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠান ঈদ উপলক্ষে প্রিন্টের নতুন পাঞ্জাবি এনেছে। লালচে সুতি পাঞ্জাবিতে কালো প্রিন্টের নকশা, হাতায় কালো রঙের পাইপিংয়ের প্রিন্ট যেমন দারুণ সাড়া ফেলেছে, তেমনি গাঢ় সবুজ শেডের জমিনে হালকা সবুজ প্রিন্ট, তার সঙ্গে এমব্রয়ডারির নকশা যুক্ত করে অভিজাত ভাব আনা হয়েছে। এসব পাঞ্জাবির বোতামের আলাদা নকশা ও ম্যাটেরিয়ালেও পাওয়া যাবে ভিন্নতা। এ ছাড়া ফুল, ফল, পাখি, লতাপাতা ও প্রকৃতির নানা মোটিফ যুক্ত হয়েছে এবারকার প্রিন্টের পাঞ্জাবিতে।
কাটছাঁটে নতুন কী
গলা, বুক, হাতা ও কাঁধের কাটছাঁটে রয়েছে আলাদা বৈচিত্র্য। সারা লাইফস্টাইলের ডিজাইনার শামীম রহমান বলেন, ‘কম বয়সীদের জন্য জমকালো ও ভিন্ন ধাঁচের প্যাটার্নের পাঞ্জাবি এনেছি। আলাদা কাপড় জুড়ে দেওয়া, বোতামের পরিবর্তন, বুকের কাটে ভিন্নতা, এমব্রয়ডারি ও সুই-সুতার কাজের সাহায্যে নতুনত্ব যোগ করা হয়েছে। কখনো বুকের এক পাশ খালি রেখে আরেক পাশে নকশা, কখনো কাঁধের কাছে ভিন্ন কাপড় জুড়ে দিয়ে ভিন্নতা আনা হয়েছে।’
একেকজনের একেক রকম চাহিদার কথা মাথায় রেখে পাওয়া যাবে তিন ধরনের পাঞ্জাবি—রেগুলার ফিট, স্লিম ফিট ও স্লিম শর্ট। এখনকার ট্রেন্ড লম্বা কাটের লুজ ফিট পাঞ্জাবি। অভিজাত লুকেরও পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে বিভিন্ন ফ্যাশন হাউসে। সিল্ক, মসলিনের মতো দামি কাপড়ে তৈরি এসব পাঞ্জাবিতে অভিজাত ভাব তুলে ধরতে অতিরিক্ত ভ্যালু অ্যাড করতে ব্যবহার করা হয়েছে নানা রকম ম্যাটেরিয়ালের অলংকার।
কখন কেমন পাঞ্জাবি
ঈদের সকালে হালকা রঙের পাঞ্জাবি বেশি মানানসই। ঈদের জামাতে বেশি উজ্জ্বল রং বেমানান মনে হবে। হালকা রঙের পাঞ্জাবি সকালের আবহে স্নিগ্ধ ভাব এনে দেবে। ঈদ বিকেলে ও রাতে উজ্জ্বল রঙের পাঞ্জাবি বেছে নিন। কমলা, হালকা সোনালি, হলুদ ও গাঢ় নীল রঙের পাঞ্জাবি পরা যাবে। বিকেলের সূর্যের সোনালি রং কিংবা রাতের আলো-আঁধারি পরিবেশে দারুণ মানিয়ে যাবে এমন পাঞ্জাবি। বেছে নিতে পারেন ম্যাচিং পাঞ্জাবিও। কয়েক বছর ধরেই ট্রেন্ডে রয়েছে ম্যাচিং পোশাক। সব বয়সী সদস্যদের জন্য পাওয়া যাবে একই নকশার পাঞ্জাবি।
কোথায় পাবেন, কেমন দাম
বসুন্ধরা সিটি শপিং মল, যমুনা ফিউচার পার্ক, সুবাস্তু আর্কেড, রাপা প্লাজা, পুলিশ প্লাজার মতো বড় বড় মার্কেটের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমগুলোতে পাওয়া যাবে ঈদের নতুন পাঞ্জাবি। একটু কম দামে ভালো মানের পাঞ্জাবি পাওয়া যাবে নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, বেইলি রোড, মিরপুর শাহ আলী মার্কেটসহ ছোট-বড় মার্কেটগুলোতে। মিরপুর, নিউমার্কেট, গুলিস্তান, বায়তুল মোকাররম, বঙ্গবাজারে আলাদা পাঞ্জাবির মার্কেট রয়েছে। ব্র্যান্ডের পাঞ্জাবি পাবেন এক হাজার ৩০০ টাকা থেকে পাঁচ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে। ব্র্যান্ডের বাইরের পাঞ্জাবির দাম পড়বে ৩০০ থেকে এক হাজার টাকার মধ্যে।