ঢাকা, রবিবার ০৬ এপ্রিল ২০২৫
২২ চৈত্র ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, রবিবার ০৬ এপ্রিল ২০২৫
২২ চৈত্র ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৬

তাহসিনা সফল হলে হাসবে বিশেষ শিশুরা

  • বুয়েটের ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্রপ্রিয়েট টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. তাহসিনা ফারাহ সানাম। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর নানা জটিলতা নিরসন নিয়ে। এই গবেষণার জন্য পেয়েছেন ইউনেসকো-ওডাব্লিউএসডি ফেলোশিপ। প্রকল্পটি সফল হলে অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগের বাধা দূর হবে। খুব অল্প বয়সে সন্তানের অটিজম শনাক্ত করতে পারবেন অভিভাবকরা। তাহসিনা সেই গল্প শুনিয়েছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ককে
শেয়ার
তাহসিনা সফল হলে হাসবে বিশেষ শিশুরা

আমার জন্ম চট্টগ্রামে, যদিও সেখানে খুব বেশিদিন থাকা হয়নি। বাবা ছিলেন বিচার বিভাগে, অতিরিক্ত জেলা জজ হিসেবে অবসর নেন। মা বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার। সেই সুবাদে ১৯৮৬ সালের দিকে আমরা ঢাকায় চলে আসি।

তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি মেজো। প্রথম শ্রেণি থেকেই ভিকারুননিসা নূন স্কুলে পড়েছি। আপু একই স্কুলের ছাত্রী। এখন তিনি শিশু বিশেষজ্ঞ।
ছোট ভাইও ডাক্তার।

 

ভিত গড়ে দিল বিদ্যালয়

প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ক্লাসে সেরা তিনের মধ্যে থাকত আমার নাম। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। পড়াশোনার পাশাপাশি গান, নাচ, বিতর্কসহ স্কুলের প্রায় সব কিছুতেই অংশ নিতাম।

শৈশবে নজরুল একাডেমিতে নাচও শিখেছি বছর চারেক। পরে নাচের চর্চা আর করিনি। অবশ্য এখনো ছবি আঁকি, যদিও এ বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। আসলে ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে তৈরি হওয়া সেই আনন্দের জগতে এখনো আমার বিচরণ। প্রচুর গান শুনতাম।
  অঞ্জন দত্তের গান আর গানের পেছনের গল্প আমাকে এক কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যেত। আমার পরিবারও ছিল খুব ছিমছাম, পরিপাটি।

 

বুয়েটে পড়তেই হবে

একসময় ভাবতাম, নিজের একটি ব্যান্ডদল থাকবে, সেখানে গিটার বাজাব। আবার স্কুলের স্যারদের দেখে ভাবতাম, তাঁদের মতো হব। তবে নবম শ্রেণির আগ পর্যন্ত ডাক্তার হব, এটিই ছিল পণ। একবার এক বিজ্ঞান মেলায় বুয়েটের এক ভাই এলেন, যিনি অসাধারণ কনসেপ্টে কুইজের প্রশ্ন করতেন। উনাকে দেখেই প্রথম বুয়েট সম্পর্কে জানলাম। তখন মনে হলো বুয়েটে পড়তেই হবে। কলেজে একবার বিজ্ঞান ম্যাগাজিনের সহসম্পাদক হলাম। সেখানকার একটি ফিচারের জন্য বুয়েটে গেলাম ইইই বিভাগের কয়েকজন বড় ভাইয়ের কাছে। তাঁরা তখন ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের জন্য বুয়েটের শিক্ষকদের সঙ্গে কাজ করছিলেন। সেটি ছিল জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ল্যাবে ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করতে দেখলাম নিজের চোখে। এভাবে কাজ হয় জানতাম না। এত ভালো লাগল যে মনে হলো বুয়েটে না পড়লে সব বৃথা।

 

সেই বুয়েটের শিক্ষক

বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস বিভাগে ভর্তি হলাম ২০০৩ সালে। বুয়েটে পড়তে পড়তেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। অধ্যবসায় আর হার না মানা মনোবলের কারণে সেই স্বপ্ন মুঠোয় ধরা দিল। ২০১১ সালে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলাম ইনস্টিটিউট অব অ্যাপ্রপ্রিয়েট টেকনোলজিতে (আইএটি)। মাস্টার্স শেষ হওয়ার পরপরই।

এখন গবেষণাকর্ম নিয়েই মেতে আছি। মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিংয়ের অ্যাপলিকেশন নিয়ে। আইএটির প্রাথমিক লক্ষ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে স্নাতকোত্তর প্রগ্রাম অফার, শিল্পকর্মীদের জন্য সংক্ষিপ্ত কোর্স ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা, প্রযুক্তির চাহিদা এবং নীতিগুলো মোকাবেলায় গবেষণা ও উন্নয়নে মনোনিবেশ করা। আমাদের ইনস্টিটিউট উচ্চমানের শিক্ষা, গবেষণা এবং আউটরিচ কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশে টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাই আমার গবেষণাও দেশীয় লাগসই প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন কাজ করছি অটিজম শনাক্তকরণ, স্মার্ট টোল ম্যানেজমেন্ট, ই-কমার্স ম্যানেজমেন্ট, স্মার্ট বিল্ডিং এনার্জি ম্যানেজমেন্ট এবং ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে।

 

বিষণ্ন মুখগুলো দেখে খারাপ লাগে

পিএইচডি করে ফেরার পর গবেষণাকে কিভাবে দেশের কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে ভাবতে থাকলাম। আমার ছেলে যে স্কুলে পড়ে, সেখানে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদেরও আলাদা শাখা আছে। সেখানে অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা পড়ে। ছেলেকে নিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসার সময় সেসব শিশুকে দেখতাম। তাদের অভিভাবকদের পর্যবেক্ষণ করতাম। সেই মা-বাবাদের চেহারায় যে গভীর বিষণ্নতা দেখেছি, সেটি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। তখন অটিজম নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলাম। দেখলাম, এখানে আমাদের মতো এআই গবেষকদের অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। ধীরে ধীরে আমার পিএইচডির গবেষণাকে এই খাতে সম্প্রসারণ করার অ্যালগরিদম ডেভেলপ করলাম। এভাবেই শুরু।

 

স্বপ্নের প্রকল্পে এলো ফেলোশিপ

ইউনেসকো-ওডাব্লিউএসডি (অর্গানাইজেশন ফর উইমেন ইন সায়েন্স ফর দ্য ডেভেলপিং ওয়ার্ল্ড) ফেলোশিপও পেয়েছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে অটিজম শনাক্তকরণ এবং তাদের যোগাযোগকে সহজতরকরণের গবেষণায়। অটিজম জটিল নিউরোডেভেলপমেন্টাল ব্যাধিগুলোর একটি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুরা বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। তারা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ (ইশারা ভাষা) ব্যবহার করে। তবে বাংলাদেশে দক্ষ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অনুবাদক অপ্রতুল এবং এটা বেশ ব্যয়বহুল। এই জটিলতা নিরসনে ওয়াই-ফাই সিগন্যাল ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে বাংলা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ শনাক্তকরণে ডিজিটাল সহকারী সাইনকেয়ার তৈরি করা হবে। এ ক্ষেত্রে অটিস্টিক শিশুদের সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে শনাক্ত করা হবে।

প্রকল্পটি সফল হলে অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগের বাধা দূর হবে। যা তাদের অনুভূতি প্রকাশ এবং মানসিক স্বাস্থ্য উন্নয়নে দারুণ কাজে দেবে। অভিভাবকরা খুব অল্প বয়সে সন্তানের অটিজম শনাক্ত করতে পারবেন। ফলে সেই শিশুদের সঙ্গে বাংলা ইশারা ভাষায় ভাব বিনিময় করতে পারবেন।

 

সুনন্দা বৈদ্যকেও অভিনন্দন

এই ফেলোশিপটির মেয়াদ তিন বছর। গবেষণা প্রকল্পের জন্য প্রত্যেক ফেলো সর্বোচ্চ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার পাবেন। ফেলোশিপের অর্থায়ন করছে কানাডার ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ সেন্টার (আইডিআরসি)। উদ্দেশ্য আমাদের মতো গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোতে আন্তর্জাতিক মানের গবেষক ও গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলা। ফেলোশিপের আওতায় নেতৃত্ব, ব্যবস্থাপনা দক্ষতা ও যোগাযোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণও প্রদান করা হবে। আমার সঙ্গে এবার বাংলাদেশ থেকে একই ফেলোশিপ পেয়েছেন সুনন্দা বৈদ্য। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকিউলার বায়োলজীর শিক্ষক। তিনি মাথা-ঘাড়ের টিস্যু ও অঙ্গের ক্যান্সার প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করবেন। বিশেষ করে এই ধরনের ক্যান্সারে টিএলআর ৪ (প্রোটিন)-এর ভূমিকা নিয়ে গবেষণা করবেন। সুনন্দা তাঁর কাজের ব্যাপারে ভীষণ প্যাশনেট।

 

সেই মুহূর্তটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে

ফেলোশিপ নিতে গত ১৪ এপ্রিল ইতালির ট্রিয়েস্টে শহরে গেলাম। পুরস্কার গ্রহণের জন্য মঞ্চে উঠার মুহূর্তটি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এটা কেবল ব্যক্তিগত অর্জন নয়, বরং বিজ্ঞানে নারীদের জন্য এক সম্মিলিত বিজয়। কারণ, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের একজন তরুণ বিজ্ঞানী হিসেবে গবেষণার জন্য আমার যে প্যাশন, তা বাস্তবে রূপ দিতে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু সংকল্প, অধ্যবসায় আর পরিবারের সমর্থনের ফলে সব চ্যালেঞ্জ উতরে গিয়েছি। বিশেষ করে মা-বাবা পাশে না থাকলে এতদূর আসা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না।

ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং এবং আইওটির ওপর গবেষণা ল্যাব ও রিসার্চ সেন্টার তৈরি করতে চাই। যেখানে শুধু বুয়েটের শিক্ষার্থীরা নয়, সারা দেশের মেধাবীরা গবেষণার জন্য আসবে, এআইকে মানবকল্যাণে কাজে লাগাবে। এতে বিদেশি প্রযুক্তির ওপর আমাদের নির্ভরতা কমবে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

[ দিনগুলি মোর ]

বাবার পছন্দে কিনব আবার

শেয়ার
বাবার পছন্দে কিনব আবার
অলংকরণ তানভীর মালেক

গোটা এক দশক ফুরিয়ে গেল বর্ণহীন ও নিস্তেজ ঈদ কাটিয়ে। পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার গড়ার যুদ্ধে শৈশবের সোনালি দিনগুলোকে বিসর্জন দিয়ে বাড়ি থেকে ১৬২ কিলোমিটার দূরে পাড়ি জমিয়েছি। ২০১৬ সালে সেই ঘর থেকে বেরিয়েছি আর আনুষ্ঠানিকতায় বাড়ি ফেরা হয়নি। মাসে, ছয় মাসে কিংবা ঈদে বাড়ি যাই।

যান্ত্রিক শহরে এখন সব কিছুই যান্ত্রিক মনে হয়। এখানে নেই মায়ের আদরমাখা শাসন। বাবার সারাক্ষণ তদারকির চাপও নেই। চারদিক কেবল কংক্রিটের আবরণে ছেয়ে আছে।

গোটা দশক ধরে আস্ত একটি দালানের চিলেকোঠায় যৌবন ফুরিয়ে যাচ্ছে।

বড্ড মনে পড়ছে আজ শৈশবের ঈদ আনন্দের সোনালি দিনগুলোর কথা। তখন তো ঈদ মানে জীবনের সর্বোচ্চ তৃপ্তি খুঁজে পাওয়া, যেখানে ছিল আনন্দের ছড়াছড়ি। রমজানের শুরুর দিন থেকেই শরীর ও মনের সেদিনের উচ্ছ্বাস আমৃত্যু মনে থেকে যাবে।

এই উচ্ছ্বাস শৈশবের স্বপ্নগুলোকে পূর্ণতা এনে দেওয়ার।

একদিন বাবার বেতন-বোনাস চলে এলো। সে খবর অবশ্য মায়ের কাছেই জেনেছি। ঈদের আনন্দ আরেকটু বেড়ে গেল। স্পষ্ট মনে আছে, বাবা আমাদের চার ভাই-বোনকে নিয়ে শপিংয়ে যেতেন।

বাবা আমাদের দুটি অপশন দিতেন। প্রথমত, আমরাসহ গিয়ে শপিং করতে চাইলে গ্রামের শপিং সেন্টার থেকে কেনাকাটা করবেন। দ্বিতীয়ত, আমরা না গেলে বাবা শহরের শপিং সেন্টার থেকে কেনাকাটা করবেন।

এখানে প্রথম অপশনটি একটু কঠিন ছিল, যদিও নিজে গিয়ে শপিং করার মজা আলাদা। কিন্তু শপিং থেকে বাড়ি ফেরার পর নিজের পছন্দে কেনা কাপড় নিজের কাছেই অপছন্দনীয় হয়ে ওঠে। এই আফসোস বুকে বয়ে নিয়ে কত ঈদ কাটিয়েছি।

দ্বিতীয় অপশন ছিল খুবই চমকপ্রদ। কারণ বাবা শহরের শপিং সেন্টার থেকে নিয়ে গেছেন, মানে অবশ্যই দারুণ কাপড় এনেছেন। এই বিশ্বাসেই বুক ফুলিয়ে কাজিনদের সঙ্গে কাপড় সুন্দরের প্রতিযোগিতায় জিততে চাওয়ার যে তৃপ্তি, সেটি পৃথিবীর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গ্রামে রাত ৮টার দিকে ঘুমিয়ে পড়তাম। বাবা যেদিন শহরে কেনাকাটা করতে আসতেন, সেদিন তাঁর ফিরতে রাত হতো। প্রায় রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ। আমরা বাবা আসা পর্যন্ত জেগে থাকতাম। মা বকাবকি করলেও ঘুমাতাম না। রাত ১২টার কাঁটা ছুঁই ছুঁই। ততক্ষণে মা ঘুমিয়েছেন। আমরা চার ভাই-বোনই জেগে আছি। হঠাৎ বারান্দায় দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে দৌড়ে এলাম। দরজা খুলে দেখি বাবা দুই হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে। পেছন থেকে আমার বোন জান্নাত দুষ্টুমি করে বলেই ফেলল, জি বাবা, অনুমতি দেওয়া হলো। তারপর হৈ-হল্লা করে মায়ের ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলাম। মা-ও উঠে আমাদের সঙ্গে ঈদের কাপড় দেখার উচ্ছ্বাসে যোগ দিলেন।

কেন জানি সোনালি শৈশবের হারানো দিনগুলোতে বাবার পছন্দে কেনা কাপড়েই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য পেতাম। তারপর ভীষণ উচ্ছ্বসিত ও প্রফুল্ল মনে আমরা চার ভাই-বোন ঈদ আনন্দ উদযাপনে মাতোয়ারা হয়ে পড়তাম।

দশক ফুরিয়ে যাচ্ছে, বাবার পছন্দের কেনা কাপড় পরা হয় না। শৈশবের সেই স্বর্ণালি মুহূর্তের স্মৃতিগুলো আজ নিজের অজান্তেই চোখ ভিজে যাচ্ছে।

তাই ঠিক করেছি, এবার ঈদের কেনাকাটা বাবার পছন্দেই করব। বাবার সঙ্গে শপিংয়ে যাওয়ার সেই সোনালি দিনগুলোতে ফিরতে চাই। ফিরতে চাই ফেলে আসা শৈশবের সেই ঈদ আনন্দে মাতোয়ারা হওয়ার দিনে।

 

রাহমান জিকু

শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

স্বপ্নচূড়ায় মহিদুল

    চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের মহিদুল। নতুন কিছু করার ভাবনা থেকেই গড়ে তুলেছেন ‘স্বপ্নচূড়া বাঁশ শিল্প’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তাঁর তৈরি দৃষ্টিনন্দন ও শ্বৈল্পিক নানা ধরনের শোপিস আর আসবাবের চাহিদা দেশজুড়ে। লিখেছেন শেখ মামুন-উর রশিদ
শেয়ার
স্বপ্নচূড়ায় মহিদুল
মহিদুল এখন দিনরাত ব্যস্ত থাকেন কাজে।ছবি : লেখক

সুন্দরগঞ্জ উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার পশ্চিমে বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের রামধন এলাকায় বাড়ি মহিদুলের। নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন স্বপ্নচূড়া বাঁশ শিল্প নামে হস্তশিল্পের প্রতিষ্ঠান। প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে হাতের নিপুণ ছোঁয়ায় বাঁশের ওপর খোদাই করা শৌখিন জিনিসপত্র। শোভা পাচ্ছে বাঁশের তৈরি গ্লাস, মগ, কেটলি, হুঁকা, কানের দুল, ফুলদানি, কলমদানি, স্ট্র ইত্যাদি।

আরো বাঁশের তৈরি নানা আসবাব।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-2a.jpg

একসময় আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন মহিদুল। মা-বাবা, ভাই ও স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সুখেই কাটত দিন। কিন্তু হঠাৎ তাঁর জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার।

বাবার ক্যান্সার ধরা পড়লে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। কিছুদিন পর তাঁর ভাইও ক্যান্সারে আক্রান্তের খবর এলে সব দিকেই যেন অন্ধকার দেখেন। তাঁদের চিকিৎসার খরচ জোগাতে গিয়ে পথে বসার দশা হয় মহিদুলের। বাবা-ভাই দুজনই ক্যান্সারের কাছে হার মানেন।
নিঃস্ব মহিদুল আবার শুরু করেন শূন্য থেকে। ঘুরে দাঁড়ানোর এই লড়াইয়ে খুঁজতে থাকেন ব্যতিক্রম কিছু। সেই চিন্তা থেকেই করতে থাকেন বাঁশের কাজ, যে বাঁশ আজ তাঁকে স্বাবলম্বী করেছে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-2a.jpg

তাঁর বাবা আব্দুল ওয়াহেদ বন বিভাগে কাজ করতেন। তিনি বাঁশ ও কাঠ দিয়ে শৌখিন জিনিসপত্র তৈরি করতে পারতেন।

বাবার কাছ থেকে সেটি শেখেন মহিদুল। শখের বশে শেখা কারুকাজই পরে তাঁকে বাঁচার দিশা দিয়েছে। শুরু করেছিলেন ছোট পরিসরে কিছু শোপিস বানানোর মধ্য দিয়ে। মানুষের চাহিদা দেখে একসময় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেন। শুরুতে এসব পণ্যের বিক্রয় ও বাজারজাতে সহযোগিতা করতেন তাঁর স্ত্রী ফারজানা ববি। নিজ উপজেলার বিভিন্ন অফিসে এসব আসবাব বিক্রি করতেন। ধীরে ধীরে তাঁর বাঁশের তৈরি আসবাবের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। এখন দিনরাত ব্যস্ত থাকেন বাঁশের আসবাব তৈরিতে। এই শিল্পে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ নেই, জনবলও নেই।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-2a.jpg

নিজ জেলার চাহিদা মিটিয়ে এসব পণ্য বগুড়া, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, রংপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন। চাহিদামতো আগেই তাঁকে অর্ডার দেন গ্রাহকরা। এরপর নিখুঁতভাবে তৈরি করেন এসব পণ্য। যেকোনো নকশা বা ছবিও এঁকে দেন।

মহিদুল ইসলাম বলেন, প্রায় ৩০ বছর ধরে বাঁশ দিয়ে শখের বশে নানা কিছু বানাতাম। করোনার সময় এটাকে পেশা হিসেবে নিই। শুরুতে কষ্ট করতে হয়েছে। ধীরে ধীরে পণ্যের চাহিদা বাড়তে থাকে। এখন মাসে প্রায় ৫০ হাজার টাকা আয় করছি। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ব্যবসাটা আরো বড় পরিসরে শুরু করতে পারতাম।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-2a.jpg

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাজ কুমার বিশ্বাস বলেন, মহিদুলের কোনো সহযোগিতা দরকার হলে উপজেলা প্রশাসন তাঁর পাশে থাকবে। যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা হবে।

বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার বলেন, মহিদুলের পণ্যের কদর সবখানে। এখন দরকার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।

মন্তব্য

সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’

    এএফসি এশিয়ান কাপ বাছাই পর্বে আজ নতুন জার্সি পরে ভারতের বিপক্ষে লড়বে বাংলাদেশ ফুটবল দল। এর নকশাকার তাসমিত আফিয়াত আর্নি। এই সেই আর্নি, যিনি ছয় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে অনুষ্ঠিত ‘মিস ইউনিভার্স’-এ রিকশা, বর্ণমালা, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশ, জামদানিসহ দেশীয় নানা উপাদানে পোশাকের নকশা করে প্রশংসিত হয়েছিলেন। উত্তর আমেরিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ব্লগ আনোকি মিডিয়া ২২ মার্চ প্রভাবশালী চার মার্কিন-দক্ষিণ এশীয় ফ্যাশন ডিজাইনারের নাম প্রকাশ করেছে, যাঁরা নিজেদের ফ্যাশন ভাবনা ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিশ্বব্যাপী। এই সংক্ষিপ্ত তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশি আর্নি। লিখেছেন পিন্টু রঞ্জন অর্ক
শেয়ার
সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’
তাসমিত আফিয়াত আর্নি। ছবি : সংগৃহীত

ঢাকার মেয়ে আর্নি। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইউনিটে সুযোগ পেয়েছিলেন। বাবা চেয়েছিলেন মেয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে ভর্তি হোক, কিন্তু মেয়ে চাইল গ্রাফিক ডিজাইন পড়তে।

শেষমেশ আর্নি গ্রাফিক ডিজাইনেই ভর্তি হলেন। কিন্তু অভিমানে বাবা কথা বলা বন্ধ করে দিলেন কিছুদিন। আর্নিরও জেদ চেপে গেলবাবার কাছ থেকে এক পয়সাও নেবেন না। নিজের পড়ার খরচ নিজেই চালাতে লাগলেন।

 

ছাত্রাবস্থায় কাজে

কাজের খোঁজে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। ফ্যাশন হাউস ইয়েলোতে সুযোগও এসেছিল। ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে ইন্টার্নশিপ করেছেন। তখনো তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হয়নি।

এরপর পড়াশোনার পাট চুকানোর আগেই পোশাক নকশা, শিল্প নির্দেশনাসহ অনেক কাজে যুক্ত হয়েছেন। কয়েকটি রিয়ালিটি শোতেও অংশ নিয়েছেন। এনটিভির স্টাইলগুরুতে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ফ্যাশন ডিজাইনার। বিখ্যাত ডিজাইনার বিবি রাসেলের কাছ থেকেও প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। রুবাইয়াত হোসেনের আন্ডারকনস্ট্রাকশন চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক ছিলেন।
কিছুদিন ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিকে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন

২০১৮ সালে মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন জেসিয়া ইসলাম। সেখানে জেসিয়ার সব পোশাক নকশা করেছিলেন আর্নি।

রিকশা পেইন্ট, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রার মুখোশএগুলো নিয়ে এর আগেও আন্তর্জাতিক পরিসরে কাজ করেছেন আর্নি। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস ইউনিভার্সের আসরে শিরিন শিলা দেখা দিয়েছিলেন আর্নির নকশা করা শাড়ি, রিকশার হুড আর বর্ণমালার গয়নায়। আলোচিত সেই পোশাক নিয়ে সে বছরের ১৭ ডিসেম্বর অবসরে পাতায় ছাপা হয় প্রতিবেদন। শিরোনাম, বলতে হয়নি মেয়েটা কোন দেশের

পরে ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত মিস গ্র্যান্ড ইন্টারন্যাশনালেও প্রশংসিত হয় আর্নির নকশা করা লাল জামদানিতে তৈরি গাউনশাড়ি, তালপাতা থেকে অনুপ্রাণিত সোনালি মুকুট, মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা উপকরণের আঙ্গিকে তৈরি বেল্ট আর গয়না। ছিল সবুজ পাখা আর সবুজ রেশমি চুড়ি।

মাস কয়েক আগেই বিখ্যাত ওয়ার্ল্ড ফ্যাশন উইক-সাংহাই-এ অংশ নিয়েছেন। সেখানে ৯০টি দেশের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র নারী ডিজাইনার ছিলেন আর্নি। সাংহাইয়ে উপস্থাপিত তাঁর সংগ্রহের একটি বড় অংশের উপজীব্য ছিল জুলাই আন্দোলন। পরে অংশ নিয়েছেন কাতার ফ্যাশন উইকে।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

এবার ফুটবলের সঙ্গে

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে আর্নির পথচলা বেশিদিনের নয়। মাস দুয়েক আগে যোগ দিয়েছেন ফেডারেশনের মার্কেটিং প্রফেশনাল অ্যান্ড ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর হিসেবে। কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলে নাম লিখিয়েছেন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ফুটবলার হামজা দেওয়ান চৌধুরী। তাঁকে কেন্দ্র করে নতুন হাওয়া লেগেছে আমাদের ফুটবলে। ফেডারেশনও চাইছিল আন্তর্জাতিক মানের একটি জার্সি খেলোয়াড়দের গায়ে চাপাতে। সেখানেই কনসেপ্ট ডিজাইনার হিসেবে আর্নির অভিজ্ঞতাকে কাজে লেগেছে। আগের কাজগুলোর ধারাবাহিকতায় এবার করেছেন তিনি বাংলাদেশ ফুটবল দলের জার্সি।

https://asset.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2025/03.March/25-03-2025/2/kalerkantho-ob-1a.jpg

হৃদয়ে বাংলাদেশ

ক্রিকেট, ফুটবল বা হকিবাংলাদেশের জার্সি মানেই যেন লাল-সবুজের খেলা। তবে প্রথাগত সেই চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুন জার্সির নকশা করেছেন আর্নি, যেখানে ফুটবল এবং দেশের ইতিহাসের একটি সমন্বিত রূপের চিত্র মেলে। এই অ্যাওয়ে জার্সিজুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান নদীগুলোর প্রবাহ। দেশের মানচিত্রে যেভাবে নদী দেখা যায়, জার্সির বুকে সেভাবেই আঁকা হয়েছে নদী। জার্সিতে জ্যামিতিক ফর্মে ব্যবহৃত হয়েছে জাতীয় ফুল শাপলার মোটিফ। জার্সির কাঁধ ও হাতের অংশে হীরার মতো ফর্মে শাপলা ফুলকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জার্সির পেছনে ইংরেজিতে টাইপোগ্রাফির স্টাইলে লেখা বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রতিটি অক্ষর নিয়ে ডিজাইন করা হয়েছে মানচিত্র।

মিনিমাল ডিজাইন-এ তৈরি এই জার্সির আরেকটি উপাদান হলো ভিক্টরি, যেখানে ওয়াই চিহ্নটি জয়ের প্রতীক হিসেবে দুই হাত উঁচিয়ে উদযাপনের ভঙ্গিতে রাখা হয়েছে। দেশের নদীর প্রবাহকে ইংরেজি শব্দ ভিক্টরির ওয়াই আকারের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেন এই ধারায়ই নদী বয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব, পুনর্ব্যবহারযোগ্য উপাদান দিয়ে তৈরি জার্সির কাপড়ের মধ্যে এমবোস করা হয়েছে। ফ্যাব্রিকটি এমনভাবে করা হয়েছে, যেন ঘাম টেনে নেয়। গায়ে যেন কোনোভাবেই অস্বস্তি না লাগে। অ্যাওয়ে জার্সিটি লাল রঙের হলেও হোম জার্সিটি সবুজ রঙের। সেটি চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।

আর্নি বলেন, লাল জার্সি পরা খেলোয়াড়রা সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকলে পাখির চোখে পুরো দৃশ্যটি বাংলাদেশের পতাকার মতোই দেখায়।

নতুন জার্সি পেয়ে দারুণ খুশি ফুটবলাররাও। জার্সিটি গায়ে চড়ালে মনে হয়, যেন আমি বাংলাদেশকে কাঁধে নিয়ে মাঠে নামছি। জার্সিটি পরার পর হামজা চৌধুরী এমন মন্তব্য করেছেন বলে দাবি করেছেন আর্নি।

সেই আর্নির ‘হৃদয়ে বাংলাদেশ’
নিজের নকশা করা জার্সি হাতে আর্নি।

পোশাক কথা বলবে

কয়েক বছর আগে স্ট্রাইড ফ্যাশন ওয়ার নামে একটি ফ্যাশন হাউস প্রতিষ্ঠা করেছেন আর্নি। সেই সূত্রে অনেকগুলো বিয়ের পোশাকের অর্ডার তিনি পান। বেশির ভাগ গ্রাহক ভারত কিংবা পাকিস্তানি পোশাকের আদলে নকশাকে গুরুত্ব দিত বলে জানালেন আর্নি। অনেকটা বাধ্য হয়ে সেই ডিজাইনে পোশাক বানিয়ে দিতেন। মনে মনে ভাবতেন, দেশীয় উপাদান দিয়েই আধুনিক এবং আকর্ষণীয় অনেক পোশাকের নকশা করা যায়, কিন্তু এই ঝুঁকিটা কেউ নিতে চাচ্ছিল না। শেষমেশ নিজেই প্রচলিত সেই ধারণায় ধাক্কা দেবেন বলে ঠিক করলেন। ২০২২ সালে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। বর আমেরিকান।

সেখানে নিজের বিয়ে, গায়েহলুদ আর সংবর্ধনার সব পোশাকের নকশা নিজেই করেছেন রিকশা, জামদানির মতো দেশীয় মোটিফে। বাহবাও পেয়েছিলেন। পরে অনেকেই দেশীয় মোটিফে বিয়ের পোশাকের নকশা করিয়েছেন তাঁকে দিয়ে। আর্নি বললেন, সুন্দর ডিজাইন করে পোশাক বিক্রি করা অনেক সহজ, কিন্তু তরুণ-তরুণীরা পোশাক পরতে গিয়ে যে সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হয়, সেগুলোর সমাধান করে পোশাকের নকশা করা একটু কঠিন। সেই কাজটাই করি আমি।

আর্নির ভাষায়, স্ট্রাইড মূলত লাক্সারিয়াস সাসটেইনেবল ফ্যাশনে মনোযোগী। জামদানি, নকশিকাঁথা, গামছা, খাদি, রাজশাহী সিল্কের মতো স্থানীয় উপাদান দিয়েই আর্নি তৈরি করেন তাঁর টেকসই ফ্যাশনের সংগ্রহ, যেখানে রিকশা পেইন্ট, মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো মোটিফও থাকে।

চীন, যুক্তরাষ্ট্র, কাতারের মতো দেশে স্ট্রাইডের পোশাকের চাহিদা অনেক বেশি বলে জানালেন আর্নি। তিনি বলেন, এমনভাবে পোশাকের নকশা করতে চাই, যেন আমার হয়ে দেশের কথা বলে পোশাক।

মন্তব্য

চা শ্রমিকদের একজন লিটন আছেন

    মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে পিছিয়ে পড়া চা শ্রমিকদের জন্য কাজ করেন লিটন গঞ্জু। সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও লাইবেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরামের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ, মাদক বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
শেয়ার
চা শ্রমিকদের একজন লিটন আছেন
চা-শ্রমিকদের সচেতন করতে নিয়মিত উঠান বৈঠকের আয়োজন করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

অভাব-অনটনে বেড়ে ওঠা লিটনের। ৯ সদস্যের পরিবার। তিনজন চা শ্রমিক। লিটনও চা বাগানে কাজ করেন।

চেয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা হবেন। কিন্তু সেই স্বপ্নপূরণ হয়নি। অষ্টম শ্রেণির পর যে আর পড়তেই পারেননি লিটন। অভাবের কারণে তাকেও মা-বাবার সঙ্গে ছুটতে হয়েছে চা-বাগানে।

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার পাত্রখোলা চা-বাগান এলাকায় লিটনদের বাড়ি। চা শ্রমিকদের নিদারুণ মানবেতর জীবন লিটনকে ভাবায়। চাইতেন তাঁদের জন্য কিছু করতে। নিজের স্বপ্নপূরণ করতে না পারলেও তিনি চেয়েছেন চা শ্রমিকদের অন্য সন্তানদের স্বপ্নের মুকুল যেন ঝরে না যায়।

পাত্রখোলা চা-বাগান কমিউনিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একটি কক্ষ নিয়ে ২০২১ সালে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন লিটন। নাম পাত্রখোলা পাবলিক লাইব্রেরি। খোলা থাকে প্রতিদিন দুপুর ২টা পর্যন্ত। বই আছে হাজারখানেক। বিভিন্ন ব্যক্তি বই দিয়ে তাঁকে সহায়তা করেন।
আবার সামর্থ্য হলে পাঠকের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে নিজেই বই কিনে আনেন। লাইব্রেরিতে একসঙ্গে ১৫ জন বসে বই পড়তে পারে। চা শ্রমিক পরিবারের সবার জন্য উন্মূক্ত এই পাঠাগার।

অনেকের সহযোগিতায় চা-বাগানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাইসাইকেলও বিতরণ করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

অনেকের সহযোগিতায় চা-বাগানে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাইসাইকেলও বিতরণ করেন লিটন। ছবি : সংগৃহীত

কর্মক্ষম যাঁরা, তাঁরা যেন কাজ করে উপার্জন বাড়াতে পারেন সে জন্য স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় লিটন ব্যবস্থা করেছেন সেলাই প্রশিক্ষণের। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ জন চা-বাগানের নারী শ্রমিক সেলাইয়ের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অনেকেই এখন সেলাইয়ের কাজ করছেন। তাঁদের একজন যমুনা রাজবংশী। তিনি বলেন, ‘সেলাইয়ের কাজ শিখে অনেক উপকৃত হয়েছি। বাসায় বসে যা আয় করছি, তাতে দুবেলা ঠিকমতো খেতে পারছি।’

চা শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব বরাবরই। মাসিকের সময় ন্যাপকিন ব্যবহারে তাঁরা অভ্যস্ত না। আবার রোগবালাই হলে তা পরিবারের অন্য সদস্যদের বলতেও চান না। ফলে একসময় তাঁদের শরীরে জটিল রোগ বাসা বাঁধে। জরায়ুর ক্যান্সার, মুখ ও ত্বকের ক্যান্সার ইত্যাদি জটিল রোগে আক্রান্ত হন তাঁরা। এই বিষয়গুলো লিটনের নজর এড়ায়নি। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে উঠান বৈঠকের মাধ্যমে চা শ্রমিকদের প্রাথমিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে থাকেন বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার এই বিষয়ের অভিজ্ঞরাও। হাত ধোয়া, মাদক সেবনের অপকারিতা, স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের উপকারিতা—সবই বুঝিয়ে বলেন তাঁরা।

প্রতি মাসে একটি উঠান বৈঠক হয়। পাশাপাশি নারীদের মধ্যে অনেকের সহযোগিতায় স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন লিটন। লিটন বললেন, ‘মুখে বললেই তো হবে না। ওরা গরিব। টাকা দিয়ে ন্যাপকিন কেনা ওদের জন্য কঠিন। তাই ওদের মাঝে কয়েক হাজার ন্যাপকিন বিতরণ করেছি। কিভাবে ঘরে বসে স্যানিটারি ন্যাপকিন বানাতে হয়, তাও শিখিয়ে দিয়েছি।’

এ ছাড়া শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য সরাসরি বৃত্তি পেতে সহায়তা, বাইসাইকেলের ব্যবস্থা, জন্ম নিবন্ধন করতে সহযোগিতাসহ নানান ধরনের কাজ করেন তিনি। লিটনের সমাজ কল্যাণমূলক কাজগুলোতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের চা-বাগানে আমন্ত্রণ জানিয়ে লিটন একাধিকবার কর্মশালার আয়োজন করেছেন। যাতে চা-বাগানের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি নিতে পারে সহজেই। রীতিমতো মাইকিং করে ডেকে এলাকার মানুষকে জড়ো করে এই কর্মশালা করেছেন। এসব কর্মশালার সুফলও মিলছে। ইতোমধ্যে পাত্রখোলা চা-বাগানের দুটি মেয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি নিয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২৫ ইয়ুথ নামে একটি সংগঠনের সহায়তায় শিশুদের জন্য স্কুল চালু করেছেন পাত্রখোলায়। স্কুলে ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী আছে। চা জনগোষ্ঠী উন্নয়ন ফোরাম ও বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরাম নামে দুটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা লিটন। এর মধ্যে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী গঞ্জু সমাজসেবক ফোরাম সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেটভুক্ত হয় ২০১৯ সালে। নিজে প্রশিক্ষণও দেন। তিনি নিজে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এখন চা-বাগানের তরুণ-তরুণীদের হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনের বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন। এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ তার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে জানান।

ভবিষ্যতে একটি স্থায়ী ভবন নির্মাণ করতে চান, যেখানে লাইব্রেরির পাশাপাশি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং একটি মিলনায়তন থাকবে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০২২ সালে আরটিভি এসএমসি মনিমিক্স প্রেরণা পদক পেয়েছেন লিটন।

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ