<p>খুতবা জুমার দিনের গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। এটি সাধারণ মানুষকে দ্বিন শেখানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। ইসলামের অন্যান্য বিধানের মতো নবীজি (সা.) উম্মতদের জুমার খুতবা প্রদানের নিয়ম-নীতি শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি তা শিখিয়েছেন নিজের আমলের মাধ্যমে। হাদিসের গ্রন্থগুলোতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জুমার খুতবা প্রদানের যে বর্ণনা এসেছে তা তুলে ধরা হলো—</p> <p>১. দাঁড়িয়ে : নবীজি (সা.) দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। প্রয়োজন হলে তিনি বসতেন এবং আবার দাঁড়াতেন। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন। অতঃপর বসতেন এবং আবার দাঁড়াতেন। যেমন আজকাল তোমরা করে থাকো। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৬২)</p> <p>২. লাঠির ওপর ভর করে : মহানবী (সা.) লাঠির ওপর ভর করে খুতবা দিতেন। খুলাফায়ে রাশিদিন (রা.)-ও এভাবে খুতবা দিতেন। এ জন্য বেশির ভাগ মাজহাবের ইমামরা লাঠির ওপর ভর দিয়ে খুতবা দেওয়াকে সুন্নত বলেছেন। হাকাম ইবনু হাজন কুলাফি (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে জুমার নামাজ আদায় করেছি। জুমার খুতবায় রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি লাঠি অথবা ধনুকের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ান। অতঃপর পবিত্র ও বরকতপূর্ণ বাক্যের দ্বারা আল্লাহর প্রশংসা ও স্তুতি করেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১০৯৬)</p> <p>৩. মানুষের দিকে ফিরে : নবীজি (সা.) উপস্থিত শ্রোতাদের দিকে ফিরে খুতবা দিতেন। সাধারণ আলোচনার সময়ও তিনি শ্রোতাদের দিকে ফিরে থাকতেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন, নবীজি (সা.)-এর মিম্বারের তিনটি ধাপ ছিল। যখন তিনি খুতবার জন্য সেখানে উঠে সবার দিকে ফিরে বসতেন, তখন মুয়াজ্জিন দাঁড়িয়ে আজান দিত। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২২)</p> <p>সাহাল ইবনে সাআদ (রা.) থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে এসেছে, প্রথম যেদিন মসজিদে নববীতে মিম্বার স্থাপন করা হয় সেদিন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাতে আরোহণ করে প্রথমে নামাজ আদায় করেন। নামাজ শেষ করে উপস্থিত লোকদের দিকে ফিরে বলেন, ‘হে লোক সকল! আমি এরূপ করলাম, যাতে তোমরা আমার ইকতিদা করতে পারো এবং আমার নামাজ সম্পর্কে তোমরা জানতে পারো।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৭৩৯)</p> <p>৪. উঁচু আওয়াজে : মহানবী (সা.) উঁচু আওয়াজে খুতবা পাঠ করতেন। চার মাজহাবের ইমামরা এটাকে খুতবা প্রদানের মুস্তাহাব বলেছেন। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন খুতবা দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় রক্তিম বর্ণ ধারণ করত, কণ্ঠস্বর জোরাল হতো এবং তাঁর রাগ বেড়ে যেত, এমনকি মনে হতো, তিনি যেন শত্রু বাহিনী সম্পর্কে সতর্ক করছেন আর বলছেন : তোমরা ভোরেই আক্রান্ত হবে, তোমরা সন্ধ্যায়ই আক্রান্ত হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৮৯০)</p> <p>৫. খুতবা শুরুর আগে সালাম দিয়ে : মহানবী (সা.) খুতবা শুরু করার আগে সালাম দিতেন। ‘মারাসিলে আতা’ বইয়ে লেখা হয়েছে, “রাসুলে আকরাম (সা.) যখন মিম্বারের ওপর দাঁড়াতেন, তখন শ্রোতাদের দিকে মুখ তুলে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতেন।” (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২০)</p> <p>৬. শুরুতে আল্লাহর প্রশংসা করে : নবীজি (সা.) সাধারণত খুতবা ও আলোচনা আল্লাহর প্রশংসার মাধ্যমে শুরু করতেন। তাই হামদ ও সানার মাধ্যমে খুতবা শুরু করাকে ফকিহ আলেমরা মুস্তাহাব বলেছেন। তবে নবীজি (সা.) বৃষ্টির জন্য দোয়া প্রার্থনার আগে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন এবং ঈদের খুতবার শুরুতে তাকবির পাঠ করতেন। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২০)</p> <p>৭. নিয়মিত তিলাওয়াত করে : রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার খুতবায় নিয়মিত কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন। উম্মে হিশাম বিনতে হারিসা বর্ণনা করেন, ‘আমি কোরআন মাজিদের যা কিছু শিখেছি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুখে শুনে শুনে শিখেছি। কেননা তিনি প্রত্যেক জুমায় মিম্বারে উঠে খুতবা দিতে গিয়ে কোরআন পড়তেন।’ (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২০)</p> <p>৮. মানুষের জন্য দোয়া করে : জুমার খুতবায় মুসলিম উম্মাহ ও জনসাধারণের জন্য দোয়া করা মুস্তাহাব। নবীজি (সা.) জুমার খুতবায় মানুষের জন্য দোয়া করতেন। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। এ অবস্থায় রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিন মিম্বারের ওপর খুতবা দিচ্ছিলেন। এক গ্রাম্য ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! গবাদি পশুগুলো অকর্মণ্য হয়ে যাচ্ছে, পরিবারবর্গ ক্ষুধায় কষ্ট পাচ্ছে। অতএব, আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর দুই হাত ওঠালেন (এবং দোয়া করলেন)। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৫৮২)</p> <p>৯. পরকাল ও বিধি-বিধানকে প্রাধান্য দিয়ে : রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর খুতবায় আল্লাহর প্রশংসা-স্তুতি, তাঁর নিয়ামত, গুণাবলি, ইসলামের রীতি-নীতি, বিধি-বিধান, কিয়ামত, আল্লাহভীতি, আল্লাহর প্রিয় ও অপ্রিয় কাজ ইত্যাদি থাকত। তিনি বলতেন, হে মানুষ! আমি যত কিছু বলব, সবই তোমরা পালন করতে পারবে বা করবে এমন নয়। তবে সরল হয়ে যাও, তবেই তোমাদের জন্য সুসংবাদ। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২১)</p> <p>১০. সংক্ষেপে : মহানবী (সা.) খুতবাকে দীর্ঘায়িত করতেন না। তিনি পরিমিত ও সংক্ষিপ্ত খুতবা দিতেন। জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, আমি নবী (সা.)-এর সঙ্গে নামাজ আদায় করতাম, তাঁর নামাজ ছিল পরিমিত, তাঁর খুতবা ছিল পরিমিত। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ১৫৮২)</p> <p>অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) জুমার দিনে উপদেশ (ওয়াজ) দীর্ঘ করতেন না, বরং তা কয়েকটি সংক্ষিপ্ত বাক্য হতো মাত্র।(সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ১১০৭)</p> <p>১১. দুই খুতবার মধ্যে বসে : রাসুলে আকরাম (সা.) দুই খুতবার মধ্যে বসতেন। ফকিহ আলেমরা বলেন, দুই খুতবার মধ্যে বসা মুস্তাহাব (উত্তম), ওয়াজিব (আবশ্যক) নয়। জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) দুটি খুতবা দিতেন। উভয় খুতবার মধ্যে (খুতবায়) কোরআন পড়তেন এবং জনগণকে উপদেশ দিতেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৮৬৩)</p> <p>১২. তাওবার মাধ্যমে শেষ করে : ইমাম শাবি (রহ.) লেখেন, নবীজি (সা.) খুতবা শেষ করতেন তাওবা দিয়ে। বেশির ভাগ খুতবায় তিনি কোরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন। (জাদুল মাআদ, পৃষ্ঠা-১২০)</p> <p>আল্লাহ সবাইকে নবীজি (সা.)-এর যথাযথ অনুসরণ করার তাওফিক দিন। আমিন।</p> <p> </p>