<p>বান্দার প্রতি আল্লাহর নিয়ামত ও অনুগ্রহের অন্যতম হলো সন্তান। আল্লাহর এই বিশেষ অনুগ্রহ কতটা অমূল্য ও কাঙ্ক্ষিত তা শুধু নিঃসন্তান দম্পতিরাই অনুভব করতে পারে। সন্তান শুধু নিয়ামত নয়, এটি আল্লাহ প্রদত্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ আমানত।</p> <p>সন্তান প্রতিপালনে আল্লাহর কোনো হুকুম লঙ্ঘন করলে কিংবা সন্তানের ভরণ-পোষণসহ তার ঈমান ও ইসলাম শিক্ষার ব্যাপারে যত্নশীল না হলে এই আমানতের খিয়ানত হয়। মূলত এর মাধ্যমে আল্লাহ বান্দাকে পরীক্ষা করে থাকেন। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য এক পরীক্ষা। আর মহা পুরস্কার রয়েছে আল্লাহরই কাছে।’ (সুরা : আনফাল, আয়াত : ২৮)</p> <p>এই আমানত ও দায়িত্ব যথাযথ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। কারণ সন্তানের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক ও জীবনযাপনের প্রতিটি বিচ্যুতির বিষয়ে প্রত্যেক মা-বাবাকে পরকালে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রত্যেক ব্যক্তিই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই তার অধীনদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে।’(বুখারি, হাদিস : ৭১৩৮)</p> <p>দায়িত্বসচেতন মা-বাবার কর্তব্য হবে শৈশব থেকেই সন্তানকে ধর্মীয় শিক্ষা ও অনুশাসনে গড়ে তোলা; শয়তানের যাবতীয় অনিষ্ট ও উপকরণ থেকে সন্তানকে রক্ষা করা। কারণ শয়তান আদমসন্তানকে ছোট থেকেই আল্লাহর আনুগত্যহীন করার চেষ্টা করে। তাই শৈশবের সময়গুলোতে সন্তানের ঈমান-আকিদা, আমল-আখলাক ও শিক্ষাদীক্ষার ব্যাপারে যত্নবান হওয়া উচিত। আজকের লেখায় শৈশব থেকে সন্তানকে দ্বিনি আবহে গড়ে তুলতে মা-বাবার করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।</p> <p><strong>সন্তানের জন্য দোয়া করা</strong></p> <p>সন্তানের জন্য মা-বাবার কোনো দোয়াই বিফলে যায় না। দুনিয়া বা আখিরাতে আল্লাহ এই দোয়ার প্রতিদান দিয়ে থাকেন। মা-বাবার দোয়া কবুলযোগ্য হিসেবে হাদিসে ঘোষিত হয়েছে। ‘তিন ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাবা (-মা)র দোয়া, মুসাফিরের দোয়া এবং মজলুমের দোয়া।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫৩৬)</p> <p>নবীরাও তাদের সন্তান ও পরিবারের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে ও পরে নবীদের দোয়া চাওয়ার কথাগুলো পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত আছে। হজরত ইবরাহিম (আ.) এর দোয়া : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এমন পুত্র দান করো, যে হবে সেলাকদের একজন।’ (সুরা : সাফফাত, আয়াত : ১০০)</p> <p>অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে আমার প্রতিপালক! এই নগরকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দিন এবং আমাকে ও আমার পুত্রগণকে মূর্তিপূজা থেকে দূরে রাখুন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৩৫)</p> <p>‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকেও নামাজ কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও (এমন লোক সৃষ্টি করুন, যারা নামাজ কায়েম করবে)। হে আমার প্রতিপালক! এবং আমার দোয়া কবুল করে নিন।’ (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ৪০)</p> <p>জাকারিয়া (আ.)-এর দোয়া : ‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তোমার নিকট হতে পবিত্র সন্তান দান করো। নিশ্চয়ই তুমি দোয়া শ্রবণকারী।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ৩৮)</p> <p>‘হে রব! তাকে (সন্তানকে) এমন বানান, যে (আপনার) সন্তুষ্টিপ্রাপ্ত হবে।’ (সুরা : মারইয়াম, আয়াত : ৬)</p> <p>তা ছাড়া সন্তান ও পরিবারের জন্য দোয়া করা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের বিশেষ গুণ হিসেবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তারা এই দোয়া করে—হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করো, যারা হবে আমাদের জন্য নয়নপ্রীতিকর এবং আমাদেরকে করো মুত্তাকিদের জন্য অনুসরণযোগ্য।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৭৪)</p> <p>তাই নেক সন্তান ও ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষায় দীক্ষিত সন্তান পেতে হলে মা-বাবাকে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি দোয়া করতে হবে।</p> <p><strong>শিশুর কানে তাওহিদ ও রিসালাতের বাণী পৌঁছানো</strong></p> <p>জন্মের পর সন্তানের প্রথম শ্রবণ যেন তাওহিদ, রিসালাত ও আল্লাহর বড়ত্ব দিয়ে শুরু হয়। নামাজ ও কল্যাণের প্রতি আহবানসহ তাওহিদ, রিসালাত ও আল্লাহর বড়ত্ব দিয়ে সাজানো আজান-ইকামতের ধ্বনি শুনিয়ে দেওয়া নবীজির নির্দেশিত একটি পন্থা। হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যার সন্তান হয়, সে যেন তার ডান কানে আজান এবং বাঁ কানে ইকামত দেয়। (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৮৬১৯)</p> <p>শিশুহৃদয়ে আল্লাহ ও রাসুলের মহব্বত তৈরি হবে। শিশু যখন মুখ ফুটে কথা বলার চেষ্টা করে, তখন তাকে কালেমা ও আল্লাহর জিকির শেখানো উচিত। নবীজি (সা.) বলেন, তোমাদের শিশুদের সর্বপ্রথম কালেমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শেখাও। আর যখন মৃত্যুর মুখে উপনীত হয়, তখনো ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ তালকিন করো। কেননা যার প্রথম কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ আর শেষ কথাও হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, সে যদি হাজার বছরও বেঁচে থাকে, একটি গুনাহ সম্পর্কেও জিজ্ঞাসিত হবে না। (শুআবুল ঈমান, হাদিস : ৮৬৪৯)</p> <p>সাহাবি ও তাবেঈরা শিশু স্পষ্ট উচ্চারণে কথা বলতে সক্ষম হলে তার কানের কাছে সাতবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়তেন। ফলে শিশু সর্বপ্রথম যা উচ্চারণ করত তা হলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা, হাদিস : ৩৫১৯)</p> <p>এ ছাড়া দুধ খাওয়ানোর সময় ‘বিসমিল্লাহ’ জোরে বলা, দৈনন্দিন পঠিত দোয়াগুলো শিশুকে শুনিয়ে পড়া—মা-বাবার এমন অভ্যাস শিশুর পরিণত জীবনে আমলের ক্ষেত্রে সহজ ও স্বাভাবিক হবে।</p> <p><strong>সন্তানকে ভালো ও সুন্দর উপদেশ দেওয়া</strong></p> <p>সন্তান যখন বুঝে উঠতে শুরু করে, তখন তাকে বিভিন্ন সৎ উপদেশ দিতে থাকা। এ ক্ষেত্রে কোরআন ও হাদিসে উল্লেখিত উপদেশগুলো মা-বাবার জন্য উত্তম দৃষ্টান্ত। লুকমান হাকিম তার সন্তানকে যে সুন্দর উপদেশগুলো দিয়েছিলেন, পৃথিবীর সব মা-বাবার জন্য তাতে রয়েছে আদর্শ ও শিক্ষা। সন্তানকে দেওয়া লুকমান হাকিমের সেই উপদেশ ও শিক্ষাগুলো পবিত্র কোরআন থেকে তুলে ধরা হলো—</p> <p>একত্ববাদের শিক্ষা : ‘হে পুত্র, আল্লাহর সঙ্গে শরিক কোরো না। নিশ্চয়ই আল্লাহর সঙ্গে শরিক করা মহা অন্যায়।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৩)</p> <p>তাকওয়ার শিক্ষা : ‘হে পুত্র! যদি তা (পাপ-পুণ্য) হয় সরিষার দানার সমান এবং তা থাকে পাথরের ভেতর অথবা আসমান-জমিনের যেকোনো স্থানে, আল্লাহ তা উপস্থিত করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সূক্ষ্মদর্শী।’ (সুরা : লুকমান : আয়াত : ১৬)</p> <p>আল্লাহর আনুগত্যের শিক্ষা : ‘হে পুত্র! নামাজ কায়েম করো, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করো, মন্দ কাজে বাধা দাও এবং তোমার যে কষ্ট দেখা দেয়, তাতে ধৈর্য ধারণ করো। নিশ্চয়ই এটা অত্যন্ত হিম্মতের কাজ।’ (সুরা লুকমান : আয়াত : ১৭)</p> <p>আত্মশুদ্ধির শিক্ষা : ‘মানুষের সামনে (অহংকারে) নিজ গাল ফুলিয়ো না এবং ভূমিতে দর্পভরে চোলো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোনো দর্পিত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৮)</p> <p>ভদ্রতা ও শালীনতার শিক্ষা : ‘নিজ পদচারণে মধ্যপন্থা অবলম্বন করো এবং নিজ কণ্ঠস্বর সংযত রাখো। নিশ্চয়ই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট স্বর গাধাদেরই স্বর।’ (সুরা : লুকমান, আয়াত : ১৯)</p> <p>এ ছাড়া নবীজি (সা.) কিশোর ইবনে আব্বাসকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন, সেই উপদেশগুলোও শিশুদের দ্বিন ও ঈমানের পথে পরিচালিত হতে সহায়তা করবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদিন আমি নবী করিম (সা.)-এর পেছনে বসা ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে বৎস! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শেখাব। আল্লাহর বিধানগুলো সংরক্ষণ করবে, আল্লাহ তোমাকে হেফাজত করবেন। আল্লাহর দাবিগুলো (বিধান) আদায় করবে, তুমি আল্লাহকে তোমার সামনেই পাবে। আর যখন তুমি কোনো কিছু চাওয়ার ইচ্ছা করবে, তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। সাহায্য চাইতে হলে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবে। জেনে রেখো! যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো উপকার করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনোই তোমার উপকার করতে পারবে না। আর যদি সব সৃষ্টি একত্র হয়ে তোমার কোনো ক্ষতি করতে চায়, তবু তারা আল্লাহর নির্ধারিত পরিমাণ ছাড়া কখনোই তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। কলম তুলে নেওয়া হয়েছে এবং দপ্তরসমূহ শুকিয়ে গেছে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৫১৬)</p> <p>শৈশব থেকেই সন্তানদের ঈমান-আমল, আকিদা-বিশ্বাস ও ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে একটি আদর্শ ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথার্থ ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের সন্তানরা সেইসব শিক্ষালয় থেকে ইসলামী শিক্ষা ও চেতনা গ্রহণ করুক সে প্রত্যাশা করি। আল্লাহ তাআলা সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষাদীক্ষায় সব মা-বাবাকে আগ্রহী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।</p>