<p>মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভ করে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে দেশের সব শ্রেণির মানুষের মতো ছিল আলেমদেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ। ২৫ মার্চ কালরাতের পাকিস্তানি গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার মুক্তিকামী মানুষ। এই সময় বাংলার আলেমরাও তাদের সাধ্য ও সামর্থ্য অনুসারে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধে তাদের অংশগ্রহণ ছিল বহুমাত্রিক। যার কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলো—</p> <p><strong>১. সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি</strong></p> <p>বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে এক অবিস্মরণীয় নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ পাঁচটি প্রধান রাজনৈতিক দলের আটজন সদস্য নিয়ে সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিষদের সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী।</p> <p><strong>২. হাফেজ প্রধানমন্ত্রী </strong></p> <p>মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১০ এপ্রিল ১৯৭১ মুজিবনগর সরকার গঠিত হয়। ১৭ এপ্রিল সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন একজন হাফেজে কোরআন। মুক্তিযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়।</p> <p><strong>৩. আলেম শহীদ বুদ্ধিজীবী </strong></p> <p>সিলেটের মাওলানা অলিউর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি ‘শরিয়তের দৃষ্টিতে ৬ দফা’ এবং ‘৬ দফা ইসলামবিরোধী নয়’ ইত্যাদি পুস্তিকা রচনা করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তাকে আলবদর বাহিনী অপহরণ করে এবং ১৪ ডিসেম্বর তিনি শহীদ হন। ১৯৭২ সালে প্রণীত শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তাকে ডা. অলিউর রহমান নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেননা তিনি একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার ছিলেন।</p> <p><strong>৪. স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের আলোচক </strong></p> <p>মাওলানা উবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী এবং মাওলানা আবদুল্লাহ বিন সাঈ জালালাবাদী দুই আলেম ভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। বড় ভাই ছিলেন ইসলামী বিপ্লবী পরিষদের সভাপতি। তারা ইসলামের দৃষ্টিতে ছয় দফা বই লিখে বিতরণ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কোরআনভিত্তিক অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।</p> <p><strong>৫. যোদ্ধা সংগ্রাহক </strong></p> <p>চট্টগ্রামের আলেম মুফতি আবদুস সোবহান ছিলেন একজন ভাষাসৈনিক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তরুণদের যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।</p> <p><strong>৬. গেরিলা যোদ্ধা </strong></p> <p>কুমিল্লার আলেম মাওলানা আবদুর রহমান ছিলেন একজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ শুরু হলে তিনি জমাল সীমান্ত পার হয়ে ট্রেনিং ক্যাম্পে যান এবং চার মাসের দীর্ঘ ট্রেনিং শেষে একাধিক গেরিলা অভিযানে অংশ নেন। হাতিয়ার মাওলানা মোস্তাফিজুর রহমান ত্রিপুরার বড়ইতলি ক্যাম্পে অংশ নেন এবং বিভিন্ন গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।</p> <p><strong>৭. লিফলেট বিতরণ</strong></p> <p>রাঙামাটি জেলার কুলবাগিচা আজিজুল উলুম হিফজ ও এতিমখানা মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন মাওলানা আবু ইসহাক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি ‘পাকিস্তানিদের পক্ষ নেওয়া ইসলামবিরোধী’ শিরোনামে লিফলেট বিতরণ করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যোদ্ধা সংগ্রহ করতেন। রাজাকার বাহিনী তার পিছু নিলে তিনি গভীর জঙ্গলে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন।</p> <p><strong>৮. মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের যোগদান </strong></p> <p>মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামের মাওলানা আবদুস সোবহানের বড় আবদুল গফফার মুক্তিযোদ্ধা পরিষদ গঠন করেন এবং তিনি তাতে যোগদান করেন।</p> <p><strong>৯. রাঙ্গুনিয়া পতাকা উত্তোলন </strong></p> <p>দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র ছিলেন মাওলানা দলিলুর রহমান। তিনি শুরু থেকে ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন। তিনি তার পৈতৃক বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলেন। সেপ্টেম্বর মাসেই রাঙ্গুনিয়া স্বাধীন হলে তিনি সর্বপ্রথম লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন।</p> <p><strong>১০. ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ </strong></p> <p>মৌলভি সৈয়দ চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কমান্ডার মৌলভি সৈয়দ নামেই পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাঁশখালীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহের ব্যবস্থা করেন।</p> <p><strong>১১. বিমান হামলায় শহীদ</strong></p> <p>কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘোষণা দেন শহীদ রাষ্ট্রপতি মেজর জিয়াউর রহমান। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা বেতার কেন্দ্রটি রক্ষার জন্য জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় আশ্রয় নেন। ফলে মাদরাসাটির ওপর শ্যেন দৃষ্টি পড়ে পাকিস্তানিদের। তারা এখানে বিমান হামলা করে। এতে শহীদ হন মাদরাসার শিক্ষক মাওলানা দানেশ (রহ.)।</p> <p><strong>১২. মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা </strong></p> <p>মাওলানা নূরুল আফসার ছিলেন মনোরহাট সিনিয়র মাদরাসার শিক্ষার্থী। ৩১ আগস্ট ১৯৭১ তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তিনি ১০ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনে ফেনী ও নাজিরহাটের একাধিক অভিযানে অংশ নেন। যুদ্ধের পর একই রেজিমেন্টে সার্জেন্ট পদে যোগদান করেন।</p> <p><strong>১৩. মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দান </strong></p> <p>একাত্তর সালে নারায়ণগঞ্জ মিলনপাড়া জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব ছিলেন মাওলানা মতিউল ইসলাম। যুদ্ধের সময় তিনি রাতের বেলা তার মসজিদে মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন এবং এখান থেকে তারা বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা করত।</p> <p><strong>১৪. সংবাদ সংগ্রহ </strong></p> <p>কুড়িগ্রামের মাওলানা মির্জা মোহাম্মদ নূরুল হক ছিলেন একজন রণাঙ্গনের যোদ্ধা। তিনি ক্যাপ্টেন বুরহানুদ্দীন ও কর্নেল নওয়াজেশের অধীনে যুদ্ধ করেন। পাশাপাশি তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংবাদ সংগ্রহ করতেন। এ জন্য দিনের বেলা সুপারি বিক্রি করতেন।</p> <p><strong>১৫. সেকশন কমান্ডার</strong></p> <p>মাওলানা শামসুল হুদা কমান্ডার বোরহানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন এবং তিস্তা ব্যারেজ দখল অভিযানে অংশ নেন।</p> <p><strong>১৬. তিস্তা ব্রিজ দখল </strong></p> <p>মাওলানা আমজাদ হোসেন প্রথমে নাগেশ্বরীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে, পরে দার্জিলিংয়ে প্রশিক্ষণ নেন। ট্রেনিং শেষে তিস্তা ব্রিজ অপারেশনে অংশ নেন। ১৩ দিন যুদ্ধ করার পর তিস্তা ব্রিজ দখল করেন।</p> <p><strong>১৭. সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দান </strong></p> <p>ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ‘মাওলানা বাড়ির’ সন্তান মাওলানা মাহমুদুল হাসান। তার পরিবারের একাধিক সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বাড়িতে শত শত হিন্দু পরিবার আশ্রয় নেয়। এ জন্য পাকিস্তানি বাহিনী তাদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে।</p> <p><strong>১৮. জীবন, মাদরাসা ও বাড়ি সব দিলেন</strong></p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সময় যশোর রেলস্টেশন মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন মাওলানা আবুল হাসান যশোরী। তিনি তার মাদরাসার সব শ্রেণির মানুষকে আশ্রয় দেন। যাদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক নেতারাও ছিলেন। ফলে তার মাদরাসায় হামলা করে পাকিস্তানি বাহিনী। হামলায় মাওলানা আবুল হাসানসহ ২১ জন শহীদ হন। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী তার বাড়িতেও অগ্নিসংযোগ করে।</p> <p><strong>১৯. দল থেকে পদত্যাগ</strong></p> <p>নেজামে ইসলাম পার্টি পাকিস্তানি শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং যুক্তফ্রন্টের গুরুত্বপূর্ণ শরিক হলেও পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার দাবিতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এর প্রতিবাদে দল থেকে পদত্যাগ করেন এই দলের নেতা ও সভাপতির মুখপাত্র মাওলানা আতাউর রহমান খান।</p> <p><strong>২০. প্রবাসী সরকারের কর্মী </strong></p> <p>বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মাইলফলক ৭ মার্চের জনসমাবেশ। এই সমাবেশে দোয়া পরিচালনা করেন মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী। তিনি মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রবাসী সরকারের কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তিনি প্রতিদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কোরআন তিলাওয়াত করতেন।</p> <p><strong>২১. বাবার কাছে প্রশিক্ষণ </strong></p> <p>মিরপুরের জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ মাওলানা মোস্তফা আজাদ। তার বাবা ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন সাবেক সুবেদার। যুদ্ধ শুরু হলে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানী তাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। বাবার কাছে প্রশিক্ষণ নিয়ে ৯ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিলের অধীনে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন।</p> <p><strong>২২. মাদরাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প </strong></p> <p>মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজ মাদরাসায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন চরমোনাই দরবারের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ এছহাক (রহ.)। ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ক্যাপ্টেন আবদুল লতিফসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা নিয়মিত তার কাছে যাতায়াত করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় চরমোনাই আলিয়া মাদরাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি। মাদরাসার পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য দু-তিনটি কক্ষ ছেড়ে দেওয়া হয়। তারা সেখানে অস্ত্র মজুদ, খাবার, বিশ্রাম ও পরামর্শ করতেন। মাওলানা এছহাক (রহ.)-এর নির্দেশে তার জামাতা মাওলানা ইউসুফ আলী খান সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ‘কাজি’ তথা পারস্পরিক মতভিন্নতা হলে মীমাংসাকারীও ছিলেন। যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্রগুলো মাওলানা ইউসুফ আলী খানের কাছে গচ্ছিত রেখে যান, যা তিনি পরবর্তী সময়ে দারোগা আবদুল মান্নানের হাতে সোপর্দ করেন।</p> <p>এভাবেই আলেমরা মুক্তিযুদ্ধে বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন। আল্লাহ তাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমিন।</p> <p><em>তথ্যঋণ : ড. মোহাম্মদ হাননান রচিত ‘মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আলেম সমাজের ভূমিকা’ এবং শাকের হোসাইন শিবলি রচিত ‘আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোঁজে’</em></p> <p><br />  </p>