<p>‘আপনি সিসিটিভি নজরদারির আওতায় রয়েছেন।’ অফিসের সব দেয়াল ও পিলারে সাঁটানো রয়েছে এসব সতর্কবাণী। অফিসকে শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত রাখতে এমন উদ্যোগ থাকলেও বাস্তবচিত্র ঠিক উল্টো। অবাক করা ব্যাপার হলো, ঘুষসহ সব অবৈধ লেনদেনের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেন উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) নিজেই। </p> <p>গত ২৮ জানুয়ারি অনুমানিক পৌনে ১২টায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে কুমিল্লার লালমাই উপজেলা ভূমি অফিসে। এখানে উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভুমি) হিসেবে রয়েছেন নাছরীন আক্তার। তিনি নিজেই কাজের ধরন ও জমির পরিমাণ অনুযায়ী ঘুষের হার নির্ধারণ করে দেন। পদ অনুযায়ী ঘুষের টাকার ভাগ কে কত পাবে সেটাও নির্ধারণ হয় তার সিদ্ধান্তে। আর এসব লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি মৌখিকভাবে একজন অফিস সহায়ককে দায়িত্বও দিয়েছেন।</p> <p>সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলা ভুমি অফিসের জারিকারক মো. খোরশেদ আলম একজন সেবা গ্রহীতা থেকে প্রকাশ্যে চার হাজার টাকা (১ হাজার টাকার ৪টি নোট) ঘুষ গ্রহণ করছেন এবং ওই টাকা গুনে নিজের ব্লেজারের পকেটে রাখছেন। এরপর তিনি সেবাগ্রহীতাকে বলছেন, আপনি চলে যান। নামজারি হয়ে গেলে আমি আপনাকে জানাব।</p> <p>ঘুষের লেনদেনের বিষয়টি এই প্রতিবেদকের নজরে আসায় খোরশেদ আলম কিছুটা বিচলিত হয়ে বলেন, ডিসিআর কাটতে ১১৭০ টাকা নিয়েছি। কিন্তু অফিসের দেয়ালে থাকা সিসিটিভি ক্যামেরা দেখিয়ে টাকার পরিমাণ নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে না পেরে চুপ হয়ে যান।</p> <p>তবে সেবাগ্রহিতা কৃষক আবুল কাশেম অফিসের অন্য কর্মচারীদের উপস্থিতিতে সাংবাদিকদের বলেন, গত মাসে আমি এক শতক নাল জমি নামজারির জন্য আবেদন করেছিলাম। খোরশেদ আলম ভাই আমার কাছে মোট সাত হাজার টাকা চেয়েছিলেন। আমি বলেছি সাত হাজার নয়, ছয় হাজার টাকা দেব। সেদিন আমি দুই হাজার টাকা দিয়ে গেছি। গত বৃহস্পতিবার তিনি আমাকে বাকি টাকা নিয়ে অফিসে আসতে বলেছিলেন। তাই আমি আজ (রবিবার) অফিসে এসে বাকি চার হাজার টাকা শাহ আলম ভাইকে দিয়েছি। এখন তিনি বলতেছেন নামজারি হয়নি। দুয়েকদিন পরে আমাকে কল দিলে আবার আসতে হবে।</p> <p>ওইদিন বিকেলে ভুক্তভোগী কৃষক আবুল কাশেম এই প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনি চলে যাওয়ার আধা ঘণ্টা পর খোরশেদ ভাই আমাকে অফিসে ডেকে নিয়ে ঘুষের চার হাজার টাকা ফেরত দিয়েছে এবং নামজারির অনলাইন কপিও পেয়েছি। তবে আমি চাই, ভূমি অফিসে ঘুষের লেনদেন চিরতরে বন্ধ হোক।</p> <p>কৃষকের ওই নামজারিতে দেখা যায়, তিনি গত বছরের ২০ ডিসেম্বর উপজেলার সিধুচী মৌজায় ক্রয়কৃত এক শতক নাল জমি পুরোনো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম খতিয়ানে স্থাপন করতে আবেদন করেছেন। বাগমারা ইউনিয়নের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. আবদুল মালেক প্রস্তাবিত খতিয়ানে স্বাক্ষর করেন গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর। উপজেলা সার্ভেয়ার স্বাক্ষর করেছেন গত ৯ জানুয়ারি। আর এসিল্যান্ড খতিয়ানটি অনুমোদন করেছেন ১৮ জানুয়ারি। </p> <p>নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুমি অফিসের একাধিক কর্মচারী এই প্রতিবেদককে মুঠোফোনে বলেন, আমরা ছোট পদে চাকরি করি। বড়দের সিদ্ধান্তে আমরা চলতে হয়। প্রতি নামজারিতে এসিল্যান্ড ম্যাডামকে ২২০০ টাকা ও নাজিরকে ৫০০ টাকা দিতে হয়। এটা অফিসের সিদ্ধান্ত। তাছাড়া ডুপ্লিকেট কার্বন রশিদ (ডিসিআর) কাটতে ১১৭০ টাকা লাগে। সেবাপ্রার্থী থেকে ছয় হাজার টাকা নিলে সব খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকা আমরা কর্মচারীরা ভাগ করে নিই। প্রতিজনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পাই।</p> <p>উপজেলার একটি ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আগের এসিল্যান্ড স্যারেরা প্রতি নামজারিতে ১ হাজার টাকা করে নিতেন। বর্তমান এসিল্যান্ড ম্যাডাম যোগ দেওয়ার পর রেট বাড়িয়ে ২২০০ টাকা করেছেন। জমির পরিমাণ বাড়লে ম্যাডামের টাকার রেটও বেড়ে যায়। তখন সাধারণ মানুষ থেকে বেশি টাকা নিতে গেলে আমাদের বিপদে পড়তে হয়। তবে খতিয়ান সংশোধনের ক্ষেত্রে তিনি অফিস সহায়ক শাহ আলম ও মো. কাউছার আল রোমেনের মাধ্যমে চুক্তি করে টাকা নেন।</p> <p>ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, বর্তমান এসিল্যান্ড নাছরীন আক্তার ৩৬তম বিসিএস এর একজন কর্মকর্তা। তিনি ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর লালমাই উপজেলায় যোগদান করেছিলেন। তার কর্মকালে লালমাইয়ে ১০ হাজারের বেশি নামজারি সম্পন্ন হয়েছে।</p> <p>জারীকারক মো: খোরশেদ আলম ঘটনার দিন বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, আবুল কাশেম সাহেবকে চার হাজার টাকা ফেরত দিয়েছি। নামজারিও করে দিয়েছি। ওনার বিষয়ে আর কথা বলতে চাই না।  </p> <p>বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে সহকারি কমিশনার (ভুমি) নাছরীন আক্তারের সরকারি নম্বরে ঘটনার দিন থেকে পর পর তিন দিন একাধিকবার কল করলেও তিনি কল রিসিভ করেননি। ঘুষের লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠালেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।  </p> <p>লালমাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মৌমিতা দাশ গত মঙ্গলবার বিকেলে বলেন, বিষয়টি মাত্র জানতে পেরেছি। তদন্ত করে আমি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।</p> <p>কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ কাবিরুল ইসলাম খান বলেন, বিষয়টি আমি আপনার মাধ্যমে জানলাম। তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।</p> <p><br />  </p>