কুমিল্লার সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের ভারত সীমান্তবর্তী ছোট্ট গ্রাম ‘কমলপুর’। গ্রামটি ছোট্ট হলেও দেশজুড়ে এর খ্যাতি ‘বাটিক পল্লী’ নামে। এখানকার বাসিন্দারা কয়েক যুগ ধরে সাদা কাপড় বাহারি রঙে রাঙাচ্ছেন। তৈরি করছেন রংবেরঙের বাটিকেটের পোশাক, যা দেশ ছাড়িয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।
বেশ সুনামও এসব বাটিকের পোশাকের। তবে একসময়ে এই গ্রামের ঘরে ঘরে বাটিকের পোশাক তৈরি হলেও বর্তমানে তা কমে ১৫ থেকে ২০টি ঘরে এসে ঠেকেছে।
আরো পড়ুন
স্বাধীনতা দিবসে গুগল ডুডলে বাংলাদেশের পতাকা
মঙ্গলবার (২৫ মার্চ) বিকেলে কমলপুর গ্রামের বাটিক পল্লীর কয়েকটি ঘর ঘুরে দেখা যায়, ঈদুল ফিতরের আগে কর্মব্যস্ত সময় পার করছেন বাটিকের কারিগররা। সারা বছর বাটিকের চাহিদা থাকলেও ঈদ, বৈশাখ বা পূজা উৎসবে তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।
এবারের ঈদে কারিগররা নানা রঙের পোশাক তৈরি করছেন। শাড়ি, থ্রি-পিস, বিছানার চাদর ও ওড়না, লুঙ্গিতে নিত্যনতুন নকশা ফুটিয়ে তুলছেন তারা। এরপর বৈশাখ শুরুর আগে সাদা শাড়িতে বৈশাখী নকশার প্রস্তুতি চলছে।
আরো পড়ুন
৭১ এবং ২৪ আলাদা কিছু নয় : নাহিদ ইসলাম
বাটিক সম্পর্কে কারিগররা জানান, প্রথমে তাঁরা প্রিন্ট করার জন্য সাদা কাপড় কেটে নেন।
এরপর মোমের রঙিন পানিতে আলপনা করা কাঠের টুকরো দিয়ে সেই কাপড়ে নানা ধরনের নকশার ছাপ দেন। রঙের স্থায়িত্ব বাড়াতে কাপড় গরম পানিতে ভিজানোর কাজ করেন একদল নারী শ্রমিক। সেখান থেকে তুলে কাপড়ে মাড় দেয় অন্য আরেকটি দল। এরপর সেই কাপড় কয়েক দফা পানিতে ধুয়ে পরিষ্কার করে মাঠে রোদে শুকানো শেষে ইস্ত্রি করে বাজারজাতের জন্য প্রস্তুত করা হয়।
বাটিক রঙের কারিগর সুমন দাস ও মো. ইসমাঈল মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, আমরা প্রডাকশনে কাজ করি। কাজ বুঝে টাকা, যে বেশি কাজ করতে পারে তার টাকাও তত বেশি। তবে আমরা প্রতিদিন ৮০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করতে পারি।
আরো পড়ুন
মানবিক গুণের কখনোই মৃত্যু হয় না : হানিফ সংকেত
বাটিক পল্লীর দেলোয়ারা ডাইংয়ের মালিক মো. সাদ্দাম হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন কারখানা থেকে সাদা কাপড় সংগ্রহ করা হয়। পরে ডাইংয়ে এনে রংতুলিতে আলপনার কাজ করা হয়। টেকসই রং ও মানের জন্য বাটিক কাপড়ের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা ও চাহিদা বছরের পর বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ঈদ, বৈশাখ, ফালগুনসহ বিভিন্ন উৎসবে কমলপুরের শাড়ি, থ্রি-পিস, শার্ট ও বেডশিটের চাহিদা বাড়ে। আমার এখানে ৪০ থেকে ৫০ জন কাজ করে। সরকারিভাবে যদি আরো সহযোগিতা পাওয়া যেত, তাহলে আরো বেকারদের কর্মসংস্থান হতো।
তিনি আরো বলেন, আমরা প্রতি পিস বাটিক ৩০-৫০ টাকা লাভে পাইকারদের হাতে তুলে দিই।
কমলপুরের কুমিল্লা নিউ বাটিক ঘরের মালিক আবু ছায়েদ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, দিন দিন এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে। একসময়ে পুরো গ্রামে বাটিক প্রিন্টের কাজ করা হতো। এই কমলপুর গ্রামকে বাটিক পল্লী হিসেবেই সবাই চিনত, এখন কারখানা কমে গেছে। রং, কেমিক্যালের দাম চড়া, শ্রমিকের বেতন দিয়ে আর পোষায় না। তাই অনেকে এই পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আমার বাপ-দাদার পেশা হিসেবে আমি এখনো তা ধরে রেখেছি। সরকারি সহায়তা পেলে এই শিল্পকে সারা বিশ্বে পৌছে দেওয়া সম্ভব।
বাটিক শিল্প নিয়ে কাজ করা বিশিষ্ট গণমাধ্যমকর্মী তানভীর দিপু ও জহির শান্ত কালের কণ্ঠকে বলেন, ১৯৭৫ সালে লাল মিয়া মেম্বারের হাত ধরে এই কমলপুর গ্রামে বাটিক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এর পর থেকে আস্তে আস্তে বাটিক শিল্পের কুমিল্লার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কমলপুরের বাটিক পল্লী কুমিল্লাকে বিশ্বময় পরিচিত করেছে। এই কাপড়ের দাম কম হওয়ায় একসময়ে গ্রাম-গঞ্জের নারীরা বাটিক কাপড় ব্যবহার করতেন।
বর্তমানের এর ব্যবহার আগের মতো না থাকলেও চাহিদা এখনো কমেনি। এই শিল্পের উন্নয়ন, নতুন ডিজাইন এবং বাজারে সাফল্য দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে আরো উন্নতির মাধ্যমে কুমিল্লার বাটিক শিল্পকে বিশ্বব্যাপী একটি অনন্য স্থান নিশ্চিত করা সম্ভব।