<p>হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে অভিনয় জগতে আসেন গুণী অভিনেতা ফারুক আহমেদ। তার নির্মিত অসংখ্য নাটকে দেখা গেছে এই শিল্পী। শুধু নাটকেই নয়, তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল ফারুক আহমেদের। নানা আড্ডায় হাজির হতেন তিনি। তাই প্রয়াত এই কথাসাহিত্যিককে নিয়ে কম স্মৃতি নেই তার। প্রায়ই সেসব স্মৃতির ঝাঁপি মেলে ধরেন। কখনো পত্রিকার পাতায়, কখনো ফেসবুকে দেয়ালে তুলে ধরেন হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে পুরনো স্মৃতি।</p> <p>যেমন গতকাল রাতে বৃষ্টি দেখেই স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লেন ফারুক আহমেদ। তিনি লেখেন, ‘হুমায়ূন আহমেদের আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হলেই আমার হুমায়ূন ভাইয়ের কথা বেশি মনে পড়ে। তুমুল বৃষ্টি তিনি অসম্ভব ভালোবাসতেন। এককথায় তিনি ছিলেন বৃষ্টিবিলাসী মানুষ। আজ বিকেলে ঢাকা শহরে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। হুমায়ূন ভাইয়ের স্মৃতি একে একে ছবির মতো আমার মনে পড়তে লাগল। বাসায় এসে তাই তার স্মৃতি নিয়ে লিখতে বসলাম। যদিও আমার এই লেখাটি বৃষ্টির কোনো ঘটনা নিয়ে লেখা নয়। আজকের এই বিষয়টি পাঠকদের কাছে আমার বিবেচনায় নতুন মনে হবে। লেখার কারণ এটাই। বকবক না করে লেখার বিষয়ে আসি।’</p> <p>তিনি হুমায়ূন আহমেদের ক্যান্সারের দিনগুলো কথা মনে করে লেখেন, ‘হুমায়ূন ভাই তখন কর্কট রোগে আক্রান্ত।  আমেরিকায় কয়েকটি কেমোথেরাপি নিয়েছেন। হঠাৎ তার মন ছুটে গেল দেশের টানে। নুহাশপল্লীর টানে। ডাক্তারদের আপত্তি ছিল এই শরীরে দেশে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি তখন ডাক্তারদের বললেন, মাত্র ১৫ দিনের জন্য তিনি তার প্রিয় নুহাশপল্লী দেখে আবার চলে আসবেন। হুমায়ূন ভাইয়ের আবেগ, অনুভূতির কথা বিবেচনা করে আমেরিকার ডাক্তারা তাকে দেশে যাওয়ার অনুমতি দিলেন। হুমায়ূন ভাই দেশে ফিরেই নুহাশপল্লী চলে গেলেন। আমি নুহাশপল্লী যাব হুমায়ূন ভাইকে দেখতে। এর মধ্যে নুহাশপল্লী থেকে ফোন এলো হুমায়ূন ভাই নতুন নাটক করবেন আমাকে লাগবে। আমি অবাক। একজন মানুষ কর্কট রোগে আক্রান্ত অথচ কী তার প্রাণশক্তি। নাটক লিখবেন, নাটক বানাবেন। পরদিন সকালবেলা আমি একরকম ছুটে গেলাম নুহাশপল্লী। গিয়ে দেখি হুমায়ূন ভাই ড্রইংরুমে বসে সবার সঙ্গে নাশতা করছেন। আমি আসতে আসতে ভাবছিলাম এত দিন পর অসুস্থ হুমায়ূন ভাইকে কেমন দেখব? হয়তো দেখব তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন! কিন্তু না। আমাকে দেখেই তিনি অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে বললেন, ফারুক এসেছো? বসো। নাশতা করো। আমি তার কথায় বিস্মিত। একজন অসুস্হ মানুষ। কী স্বাভাবিকভাবে কথা বলছেন। আমি নাশতা খেতে তার পাশে বসলাম। তিনি এক টুকরা আম নিয়ে চুষতে লাগলেন। তারপর আমেরিকার গল্প শুরু করলেন। ট্রিটমেন্টের সময় আমেরিকার ডাক্তারদের সঙ্গে কী কী মজার ঘটনা ঘটেছে সেসব গল্প। গল্প শেষে হুমায়ূন ভাই  আমার দিকে তাকালেন।’</p> <p>নাটকের গল্প তুলে ধরে বলেন, “তারপর বলা শুরু করলেন, আমি একটা নাটক লিখছি। নাটকের নাম ‘পিপীলিকা’। ফারুক তুমি এই নাটকে অভিনয় করবে। আগামীকাল থেকে শুটিং।”</p> <p>আমি বললাম, জি, হুমায়ূন ভাই। পরদিন থেকে নাটকের শুটিং শুরু হলো। শুটিংয়ের ফাঁকে ফাঁকে গল্প। হুমায়ূন ভাই বলেন। আমার মুগ্ধ হয়ে শুনি। হুমায়ূন ভাইয়ের গল্প বলার ঢং ঠিক আগের মতো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হয় না তিনি এক কঠিন রোগে আক্রান্ত। এক বিকেলে শুটিং শেষ। তিনি তার প্রিয় লিচুগাছের নিচে বসে গাছের দিকে তাকিয়ে  আছেন। ডালে ডালে পাকা লিচু ঝুলছে। তিনি দেখছেন। আমি দূর থেকে বিষয়টা লক্ষ করলাম। আস্তে আস্তে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।  হুমায়ূন ভাই আমাকে দেখে বললেন, ফারুক বসো। আমি পাশে একটা খালি চেয়ারে বসলাম।</p> <p>তিনি বললেন, মুশাররফকে ডাকো। মুশাররফ নুহাশপল্লীর কেয়াটেকার।</p> <p>আমি চিৎকার করে ডাকলাম, মুশাররফ  ভাই। মুশাররফ ভাই আশপাশেই ছিলেন। তিনি দৌড়ে এসে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালেন।</p> <p>হুমায়ূন ভাই মুশাররফ ভাইকে বললেন, মুশাররফ তুমি একটা কাজ করো। গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসো। সময় ২৫ মিনিট। মুশাররফ ভাই মাথা নিচু করে বললেন, জি স্যার। বলেই ছুটলেন ছেলেমেয়েদের খোঁজে। আমি হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে চুপচাপ বসে রইলাম।</p> <p>হুমায়ূন ভাই একসময় কথা শুরু করলেন, কী আশ্চর্য তাই না ফারুক!</p> <p>আমি বললাম, কী আশ্চর্য  ভাই? তিনি বললেন, এই যে  প্রকৃতি, জোছনা, বৃষ্টি, নদী কী সুন্দর! একদিন হয়তো আমি এসব আর দেখতে পারব না। একুশের বইমেলা হবে। লোকেদের ভিড়, আড্ডা আমি সেখানে থাকব না। এটা কি মেনে নেওয়া যায়! হায়রে জীবন! আমি কিছু না বলে মূর্তির মতো বসে রইলাম। এক সময় তাকিয়ে দেখলাম হুমায়ূন ভাইয়ের দুই চোখের কোনায় পানি। আমার বুকটা তখন হু হু করে উঠল। কিছু বলতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর হুমায়ূন ভাই স্বাভাবিক গলায় বললেন, ২৫ মিনিট শেষ হয় নাই? কই মুশাররফ? এত দেরি করছে কেন?</p> <p>হুমায়ূন ভাই এই কথা জিজ্ঞেস করতেই আমি দেখি নুহাশপল্লীর গেট দিয়ে ১২-১৪ জন ছেলেমেয়ে নিয়ে মুশাররফ ভাই দ্রুত হেঁটে আসছেন।</p> <p>আমি বললাম, মুশাররফ ভাই আসছে। মুশাররফ ভাই এসেই বললেন, স্যার আমি আসছি। পুলাপান জোগাড় করতে দেরি হয়ে গেল। গ্রামের পুলাপান তো দুষ্টু। খেলা থুইয়া আসতে চায় না।</p> <p>হুমায়ূন ভাই মুশাররফ ভাইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করলেন, আছ কেমন তোমরা? ছেলেমেয়েরা সবাই একসাথে বলল,ভালো আছি ছার। আপনে কেমন আছেন?</p> <p>হুমায়ূন ভাই মৃদু হেসে বললেন, আমিও ভালো আছি। শোনো, তোমার কে কে গাছে উঠতে পারো হাত তোলো। গ্রামের ছয়-সাত বছরের ছেলেমেয়ে। প্রায় সবাই হাত তুলে জানাল তারা গাছে উঠতে পারে।</p> <p>হুমায়ূন ভাই দেরি না করে বলা শুরু করলেন, এখন একটা মজার কাণ্ড হবে। তোমরা এই লিচুগাছে উঠবে। তারপর যত পারো লিচু খাবে। আমি ওয়ান, টু, থ্রি বলব তোমারা লিচু গাছে ওঠা শুরু করবে। ঠিক আছে?</p> <p>সবাই আনন্দে হৈ হৈ করে বলল, ঠিক আছে। হুমায়ূন ভাই  সাথে সাথে বললেন, ওয়ান, টু, থ্রি।</p> <p>মাঝারি সাইজের লিচুগাছ। ছেলেমেয়েরা অতি দ্রুত গাছে উঠে লিচু খাওয়া শুরু করল। হুমায়ূন ভাই অবাক হয়ে ছেলেমেয়েদের  লিচু খাওয়া দেখতে লাগলেন। গাছের পাকা লিচু তারা খাচ্ছে আর হইচই করছে। কেউ আবার পকেটে ভরছে। যে কয়জন গাছে উঠতে পারে না তাদের জন্য নিচে ফেলছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য।</p> <p>হুমায়ূন ভাই এক সময় আমাকে বললেন, এমন সুন্দর দৃশ্য তুমি কখনো দেখেছো? এমন ভালোলাগার অনুভূতি কি অন্য কোনোভাবে পাওয়া যায়?</p> <p>আমি কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ বললাম, না ভাই এমন ভালোলাগার অনুভূতি কোনোভাবেই পাওয়া যায় না। হুমায়ূন ভাই আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, শোনো ফারুক একে বলে আকাশ সমান ভালোলাগা। একে বলে আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা।’</p>