<p>বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র, শব্দের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদের ৭৪তম জন্মদিন আজ। রসবোধের সঙ্গে লৌকিকতা আর অলৌকিকতার সমগ্র সুন্দরের মিশেলে বাংলা কথাসাহিত্যকে যিনি সমৃদ্ধ করেছেন, সেই কিংবদন্তির জন্মদিন আজ। বেঁচে থাকলে ৭৮ বছর পূর্ণ হতো নন্দিত এই কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকারের। </p> <p>হুমায়ূন ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার ও গীতিকার। বলা হয় আধুনিক বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের তিনি পথিকৃৎ। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান নতুন শৈলীর জনক। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত। তবে সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি দেশের নাটক ও চলচ্চিত্র অঙ্গনে যে অবদান রেখেছেন তা আজও চিরসবুজ হয়ে আছে। চলচ্চিত্র ও নাটকের বাইরে তিনি বেশ কিছু গানও রচনা করেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি পেয়েছে অসামান্য জনপ্রিয়তা। যেগুলোর সুর-সংগীত পরিচালনা করেছেন মকসুদ জামিল মিন্টু। তার কাছ থেকে গানগুলোর পেছনের গল্প জেনেছেন কামরুল ইসলাম।</p> <p><strong>চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে</strong><br /> ছবি : চন্দ্রকথা [২০০৩], কণ্ঠ : সেলিম চৌধুরী</p> <p>হুমায়ূন আহমেদের খুব প্রিয় একটি গান ছিল ‘মরিলে কান্দিস না আমার দায়’। এটা ‘চন্দ্রকথা’ ছবিতে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। সে জন্য গানটি রেকর্ড করা হয়। পরে হুমায়ূন ভাই বললেন, ‘ভাই, গানটি এমনিতে শুনে যে রকম ভালো লাগে, এখন শুনে সে রকম অনুভূতি হচ্ছে না।’ গানটি রেখে দেওয়া হয়। এরপর তিনি ‘চাঁদনি পসরে কে আমারে স্মরণ করে’ লিখে পাঠান। আমি সুর-সংগীত করে ফেলি। সেলিম চৌধুরী কণ্ঠ দিয়েছিলেন। হুমায়ূন ভাই গানটি শুনতে এসেছিলেন। শুনতে শুনতে দেখলাম তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আমাকে বললেন, ‘ভাই, এ গানটিই আমি ছবিতে ব্যবহার করব।’ </p> <p><strong>একটা ছিল সোনার কন্যা</strong><br /> ছবি : শ্রাবণ মেঘের দিন [১৯৯৯], কণ্ঠ : সুবীর নন্দী</p> <p>এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গান, যেটা হুমায়ূন ভাই আমাকে পাঠিয়েছিলেন। তখন সবে মোবাইল ফোন এসেছে। সম্ভবত ১৯৯৬ সালের কথা। আমি হুমায়ূন ভাইকে রেকর্ডিংয়ের একটি তারিখ দিয়েছিলাম, সুবীর দাকেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু পরে আমি বিষয়টা ভুলে যাই। রেকর্ডিংয়ের দিন হঠাৎ স্টুডিও থেকে আমার কাছে ফোন আসে। হুমায়ূন ভাই ও সুবীর দা স্টুডিওতে এসে বসে আছেন। প্রথমে আমি অবাক হলাম, কেন তাঁরা এসে বসে থাকবেন! পরে মনে পড়ল, আজ তো গান রেকর্ড করার কথা! আমি তাত্ক্ষণিক আমাদের রিদম, অর্কেস্ট্রার ছেলেগুলোকে ফোন করি, যাবতীয় প্রস্তুতি নিতে বলি। স্টুডিওতে যাওয়ার পর হুমায়ূন ভাই জানতে চান, গানের মিটার ঠিক আছে কি না, সুর হয়েছে কি না। অথচ তখনো আমি সুরই করিনি। আমি তাঁকে হাসতে হাসতে বলি, পত্রিকার লেখা থেকেও সুর করতে পারব। পরে রিদম সাজিয়ে, একলাইন একলাইন করে গানটির সুর করলাম আর সুবীর দা গাইলেন। তখন এটা চলচ্চিত্রের জন্য বানানো হয়নি। পরে হুমায়ূন ভাই ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ ব্যবহার করেছিলেন।</p> <p><strong>ও আমার উড়াল পঙ্খীরে</strong><br /> ছবি: চন্দ্রকথা [২০০৩], কণ্ঠ : সুবীর নন্দী</p> <p>হুমায়ূন ভাই কখনো গানের সুর কেমন হয়েছে, জানতে চাননি। তিনি গান লিখে পাঠিয়ে দিতেন, আমি সুর করে রাখতাম। ভয়েস রেকর্ডিংয়ের সময় শুনতেন তিনি। তাঁর সঙ্গে আমার কাজের সিস্টেম ছিল এটা। কিন্তু হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, ‘ভাই, কিভাবে গান সুর করেন, এটা দেখার খুব ইচ্ছা। একদিন বাসায় আসেন না, ছবির জন্য একটা গান করব।’ পরে তাঁর ধানমণ্ডির বাড়ি দখিণ হাওয়ায় গেলাম। বাড়ির নিচে গিয়ে দেখি, শামিয়ানা টানিয়ে প্রচুর রান্নাবান্না চলছে। ভাবলাম, কারো বাসায় হয়তো অনুষ্ঠান আছে। আমি হুমায়ূন ভাইয়ের ফ্ল্যাটে ঢুকে দেখি, গোটা পঞ্চাশেক মানুষ! আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, কী বিষয়? তিনি বললেন, ‘সুর করা দেখব, একা দেখে তো মজা নেই। তাই বন্ধু-বান্ধবকে ডেকেছি, সবাই মিলে দেখব।’ তিনি আমাকে ছবির সিকোয়েন্স বুঝিয়ে গানের কথা দেন, আমি অল্প সময়ের মধ্যেই প্রথম অংশের সুর করে ফেলি। শুনে সবাই খুব পছন্দ করে। এরপর সবাই মিলে খাওয়াদাওয়া করলাম। বের হওয়ার সময় হুমায়ূন ভাই জানতে চান, ‘ভাই, সুরটা কি মনে আছে?’ আমি বললাম, না ভাই। ভুলে গেছি। আপনি রেকর্ডও করেননি। তিনি বলেন, ‘গানটিতে আরেকটু বেদনার ছোঁয়া রাখলে সম্ভবত ভালো হতো।’ এটাই প্রথম এবং শেষবার, কোনো গানের জন্য তিনি আমাকে সাজেশন দিয়েছিলেন। পরে স্টুডিওতে বসে নতুন একটি সুর করি এবং এই সুরেই গানটি ছবিতে ব্যবহৃত হয়েছে।</p> <p><strong>আমার ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা</strong><br /> ছবি : শ্রাবণ মেঘের দিন, কণ্ঠ : সাবিনা ইয়াসমিন</p> <p>এ গানটাও ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এর জন্য করা হয়নি। ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ করার পর হুমায়ূন ভাই খুব পছন্দ করেছিলেন। সে সময় তিনি বিটিভিতে ‘রঙের বাড়ৈ’ নামে একটা অনুষ্ঠানের জন্য এ গানটি দিয়েছিলেন। প্রথমে এটি গেয়েছিলেন সুবীর নন্দী। তাঁর কণ্ঠেই বিটিভিতে গানটি প্রচারিত হয়েছিল। এটা সম্ভবত ১৯৯৭ সালে। পরে যখন ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ছবির সংগীত করছিলাম, হুমায়ূন ভাই জানান, তিনি ছবির একটি দৃশ্যে ‘ভাঙা ঘরের ভাঙা চালা’ গানটি ব্যবহার করতে চান এবং সাবিনা ইয়াসমিনকে দিয়ে গাওয়াতে চান। তাঁর কথা মোতাবেক পুনরায় গানটি রেকর্ড করা হয়।</p> <p><strong>বরষার প্রথম দিনে</strong><br /> ছবি : দুই দুয়ারী [২০০০], কণ্ঠ : সাবিনা ইয়াসমিন</p> <p>এ গানটাও ‘দুই দুয়ারী’র জন্য করা হয়নি। এই ছবির জন্য একটাই গান করা হয়েছিল—‘মাথায় পরেছি সাদা ক্যাপ’, আগুন গেয়েছিলেন। ‘বরষার প্রথম দিনে’ মূলত করেছিলাম ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’ নাটকের জন্য। এ নাটকের জন্য দুটি গান করেছিলাম, দুটোই সাবিনা ইয়াসমিন গেয়েছেন। পরে ‘বরষার প্রথম দিনে’ গানটি চলচ্চিত্রেও যুক্ত করা হয়েছিল।</p> <p><strong>অজানা আরেক ঘটনা</strong><br /> গানের গল্প শেষে হুমায়ূন আহমেদ প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণা করে একটি অজানা ঘটনা শোনালেন মকসুদ জামিল মিন্টু। সেটা তাঁর বয়ানেই শোনা যাক, “হুমায়ূন ভাই ছিলেন পারফেকশনিস্ট। কোনো কিছু পারফেক্ট মনে না হলে তিনি সেটা করতেন না। খরচ নিয়ে চিন্তা করতেন না। একটা ঘটনা মনে পড়ে; তিনি একটি ধারাবাহিক নাটক করেছিলেন—‘নীল তোয়ালে’। এ নাটকের ৭ পর্বের মিউজিক করলাম। একদিন তিনি ফোন করে বললেন, ‘ভাই, নাটকটি একটু দেখব। আপনি মিউজিক করেছেন, আপনিও থাকলে ভালো হতো। আপনার মন্তব্য জানতে পারলে ভালো লাগত।’ তো আমি নাটক দেখতে গেলাম। দেখার পর তিনি জানতে চাইলেন, কেমন লাগল। আমি বললাম, ভালোই তো। তিনি বলেন, ‘আপনি একবার মিউজিক করেছেন, আবার করতে হবে ভেবে মিথ্যা বইলেন না।’ এবার আমি জানতে চাইলাম, তাঁর কী মনে হয়? তিনি বললেন, ‘আমার তো একেবারে ভালো লাগেনি।’ পরে তিনি ওই সাত পর্বই বাদ দিয়ে দিলেন। নতুন করে প্রথম থেকে নাটকটির শুটিং করলেন। আমাকেও নতুনভাবে সংগীতায়োজন করতে বলেন। দেখুন, সাত পর্ব শুটিং করে ফেলা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়। সেটা বাতিল করে আবার প্রথম থেকে করা, এটা অনেক বড় ব্যাপার।”</p>