বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ, এটি অনেকের কাছেই শুধু একটি ক্যালেন্ডারের তারিখ। তবে বাঙালির কাছে এটি সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও আবেগের একটি প্রতিচ্ছবি। প্রাচীনকাল থেকেই খুবই আনন্দের সঙ্গে এই দিনটি উদযাপন করা হয়ে থাকে। পহেলা বৈশাখের একটি খাবার হচ্ছে চিড়া ভেজা, মুড়ি, মিঠাই, নারকেল কলার মিশ্রণ।
এ ছাড়া আরো একটি জনপ্রিয় খাবার হলো পান্তা-ইলিশ।
তবে ঠিক কবে থেকে বাঙালিদের নববর্ষের অনুষ্ঠানে এই পান্তা-ইলিশের প্রচলন হয়েছে, সেটির সঠিক ইতিহাস জানা নেই। আজকের প্রতিবেদনে আমরা জানব ঐতিহ্যবাহী বৈশাখ এবং এর সঙ্গে পান্তা-ইলিশের সম্পর্কের আদ্যোপান্ত।
আরো পড়ুন
ঘন ঘন ওয়েট টিস্যু ব্যবহারে কী ক্ষতি
বাঙালির আবেগ পান্তা ও ইলিশ
কথায় রয়েছে মাছে-ভাতে বাঙালি।
আর বাংলা নববর্ষ মানে বাংলা বছরের প্রথম দিন। তবে একেবারে শুরু থেকেই যে নববর্ষে পান্তা-ইলিশ খাওয়া হতো—এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে হ্যাঁ, যেহেতু বাংলা নববর্ষ সৌরপঞ্জিকা অনুসারে প্রবর্তিত হয় এবং প্রাচীনকালেও কৃষকদের কাছে অনেক বেশি জনপ্রিয় খাবার ছিল পান্তা ভাত। সে সময় অবশ্য ইলিশ মাছ ছিল অন্যান্য মাছের তুলনায় বেশ দামি একটি মাছ। তাই কৃষকদের খাবারের তালিকায় খুব একটা ইলিশ মাছের দেখা মিলত না। সে সময় তারা বিভিন্ন শাক-সবজি বা ভর্তার সাথে পান্তা ভাত খেতেন।
বাংলার ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন অধ্যাপক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। কিন্তু ইলিশ খাওয়ার সঙ্গে বাংলা নববর্ষের কি আদৌ কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানতে চাইলে মিস্টার খান বলেন, ‘বাঙালির নববর্ষ উদযাপনের চিরায়ত সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশের কোনো সম্পর্ক নেই।’
তিনি বলেন, ‘বৈশাখে যখন খরার মাস, যখন কোনো ফসল হতো না, তখন কৃষকদের হাতে পয়সাও থাকত না।
সুতরাং তাদের পক্ষে ইলিশ কিনে খাওয়া সম্ভব হতো না। সুতরাং এটা মোটেও সত্যি নয় যে কৃষকরা নববর্ষ উদযাপনে পান্তা-ইলিশ খেয়ে বছর শুরু করতেন। গ্রামবাংলায় নববর্ষের উৎসবই ছিল খুব ছোট আকারে। কৃষানি আগের রাতে একটি নতুন ঘটে কাঁচা আমের ডাল ভিজিয়ে রাখতেন, চাল ভিজিয়ে রাখতেন। সকালে কৃষক সেই চাল পানি খেতেন এবং শরীরে কৃষানি পানিটা ছিটিয়ে দিতেন। তারপর তিনি হালচাষ করতে যেতেন। দুপুরবেলায় পান্তা খেতেন কাঁচা মরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনো কখনো একটু শুঁটকি, একটু বেগুন ভর্তা ও একটু আলু ভর্তা দিয়ে খেতেন।’
তবে অনেকের মতেই গত শতকের আশির দশক থেকেই এই পান্তা ভাত খাওয়ার সূচনা ঘটেছে। সর্বপ্রথম ১৯৬৭ সাথে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এর শুরু হয়। এখন অবধি সেই ধারা চলমান। তবে শুরু থেকেই এই পান্তা-ইলিশের প্রচলন না থাকলেও আশির দশকে ১৯৮০ আবার কারো মতে ১৯৮১ সালে সর্বপ্রথম পান্তার সঙ্গে ইলিশের আয়োজন করা হয়।
একটি সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়ায় তথ্য মতে, সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন সর্বপ্রথম এই পান্তা-ইলিশের প্রস্তাব দেন। পরবর্তীতে সহকর্মীদের থেকে চাঁদা তুলে এই আয়োজন সম্পূর্ণ করা হয় এবং সেখানে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া যায়। এর পরের বছর থেকেই এটি ক্রমেই জনপ্রিয় হতে শুরু করে।
আরো পড়ুন
শিশুদের মুখ থেকে লালা পড়ে কেন
এরপর নব্বইয়ের দশকে এসে পান্তা-ইলিশ যেন বাঙালিদের জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। ঠিক এই কারণেই তখন শুধু রমনাতে নয় বরং সারা বাংলাদেশের সব জেলা শহরের অলিগলিতেও মানুষ নববর্ষে পান্তা-ইলিশ খাওয়া শুরু করে। এতে করে সারা বছরের তুলনায় এই নববর্ষে ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ পর্যন্ত। দাম যেমনই হোক না কেন, শখ কি আর দাম মানে বলুন। তাই তো আজও নববর্ষে বাঙালিরা ভর্তা ও পান্তার সঙ্গে ইলিশ খেতে ভোলে না।
পান্তা ভাত ও ইলিশের ঐতিহ্য ও উপকারিতা
পান্তা ভাত আমাদের স্বাস্থ্যগত দিক থেকে বেশ উপকারী। পান্তা ভাতে রয়েছে প্রো-বায়োটিক উপাদান, যা আমাদের দ্রুত খাবার হজমে সাহায্য করে। এ ছাড়া এটি আমাদের শরীরের তাপমাত্রার ভারসাম্য বজায় রাখে। গরমের দিনে পান্তা ভাত খেলে এটি আমাদের শরীর কে ঠাণ্ডা রাখতে সাহায্য করে। এ ছাড়া পান্তা ভাতে রয়েছে আয়রন, খনিজ উপাদান ও ভিটামিন-বি, যা আমাদের শরীরের জন্য উপকারী।
আরো পড়ুন
পুরনো বন্ধুত্ব ভাঙা কখন ইতিবাচক? কখন আবার বন্ধুত্বে ফিরবেন
অন্যদিকে ইলিশ শুধু আমাদের কাছে একটি সাধারণ মাছ না, বরং আমাদের ঐতিহ্য ও আবেগের প্রতীক। অসাধারণ ঘ্রাণ ও স্বাদের কারণেই এটি বিখ্যাত। এ ছাড়া এটি আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এই মাছে রয়েছে ওমেগা-থ্রি ফ্যাটি এসিড, যা আমাদের হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
বৈশাখি আয়োজনে পান্তা ইলিশ
বৈশাখের প্রধান আয়োজন বা বৈশাখি খাবার বলতেই এই পান্তা ও ইলিশ কে বোঝানো হয়ে থাকে। প্রতিবছর এই দিনে সকাল বেলায় সবাই পরিবার অথবা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে পান্তা-ইলিশ খেয়ে থাকেন। বিশেষ করে ঢাকার রমনা বটমূলে এই আয়োজন যেন এক মহা উৎসবে পরিণত হয়। রমনা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে পান্তা-ইলিশের আয়োজনের সঙ্গে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করা হয়।
আরো পড়ুন
কালো রঙের প্লাস্টিক দেহের জন্য ক্ষতিকর কেন
পান্তা-ইলিশের বিতর্ক ও বাস্তবতা
প্রতিবছর বর্ষবরণে এই পান্তা-ইলিশ নিয়ে অনেক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এর প্রধান কারণ হলো ইলিশের দাম। সত্যি বলতে আজও নিম্নমধ্যবিত্ত বা গরিবদের হাতের নাগালে নেই এই মাছ। আর পহেলা বৈশাখ শুরুর আগেই এই মাছের দাম যেন দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে যায়। ফলে উচ্চবিত্ত ছাড়া অন্য অনেক সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে চলে যায় এই ইলিশ।
এই বিষয়টি নিয়েই অনেকের মাঝে বিতর্ক ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তবে অনেকের মতেই শুধু উৎসবের জন্য ইলিশের ওপরে চাপ সৃষ্টি করা উচিত না বরং কিভাবে ইলিশ সংরক্ষণ করা যাবে এবং ন্যায্য দামে সকলের হাতের নাগালে পৌঁছানো যাবে, সেই বিষয়ে কাজ করা উচিত।
আরো পড়ুন
সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মুখ ফোলা থাকে কেন
সূত্র : বিবিসি বাংলা ও বিন্নি ফুড