<p>আজ সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস। এবারের আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবসের স্লোগান হচ্ছে, ‘শিক্ষকদের কথার স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন : শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন সামাজিক চুক্তি বা অঙ্গীকার’। শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষেত্রে যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন, সেটিকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়গুলোতে কার্যকরভাবে যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকরা যে ভূমিকা পালন করেন, সেই ভূমিকা অনুযায়ী তাঁদের পলিসি মেকিং পর্যায়ে যেমন কর্তৃত্ব নেই, তেমনি স্বীকৃতিও নেই। সেই স্বীকৃতি দেওয়া মানে হচ্ছে সামাজিকভাবে তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন করা, যার প্রকাশ ঘটতে হবে।</p> <p>শিক্ষকতা একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা, শিক্ষকদের সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজে নামতে হবে। মেধাবীরা শিক্ষকতায় আসছেন না। তাঁরা কি চ্যালেঞ্জ ফেস করতে ভয় পান? না। শিক্ষকতা পেশাকে আকর্ষণীয় করা কেন হচ্ছে না? এখানে কি শুধুই রাষ্ট্র দায়ী? শুধুই প্রশাসনিক কর্মকর্তারা অর্থাৎ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দায়ী? এখানে দায়ী কমবেশি সবাই। কিন্তু মূল ভূমিকায় থাকতে হবে শিক্ষকদের। আমরা কি তাঁদের সেই ভূমিকায় কখনো দেখতে পাই? যেমন শিক্ষা বিষয়ের বড় পদগুলো কিন্তু শিক্ষকরাই দখল করে আছেন (ডিজি-মাউশি, ডিজি-নায়েম, চেয়ারম্যান-এনসিটিবি, চেয়ারম্যান-শিক্ষা বোর্ড)। তাঁদের কাছ থেকে আমরা কি কাঙ্ক্ষিত মানের ভূমিকা কখনো দেখেছি? মন্ত্রণালয় পরিচালনা করেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা।</p> <p>তাঁরা একটু কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করবেন, সেটি স্বাভাবিক। তাই বলে দেশের শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নে, শিক্ষকদের প্রকৃত উন্নয়নে শিক্ষা প্রশাসক, যাঁরা মূলত শিক্ষক, তাঁরা কি সঠিক ভূমিকা পালন করছেন, নাকি তাঁরা প্রচলিত নিয়মকেই আঁকড়ে ধরে আছেন? সেই আলোচনাও আজ করতে হবে। শিক্ষকদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা থাকতে হবে, প্রণোদনা থাকতে হবে। আরো থাকতে হবে চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিযোগিতা। যেমন এবার সরকারি কলেজের ৮৯২ জন শিক্ষককে অধ্যাপক পদে উন্নীত করা হয়েছে।</p> <p>শিক্ষকদের জন্য এটি একটি প্রণোদনা। কিন্তু এটি কি শিক্ষকদের ক্ষমতায়নের কথা বলে? প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয় করা হয়েছে, কিন্তু তাই বলে তাঁরা কি ক্ষমতায়িত? অন্য চাকরি বাদ দিয়ে কি সবাই সেই সরকারি চাকরির জন্য প্রাথমিক শিক্ষক হচ্ছেন? এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের খুঁজতে হবে শিক্ষক দিবসের আলোচনায়। শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা প্রশাসনিক পদে আসাটাইকেই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মনে করেন! তার চেয়েও দুঃখজনক হচ্ছে যেসব পদে অবৈধ অর্থের লেনদেন ও প্রাপ্তি রয়েছে, আমাদের মাননীয় শিক্ষকরা ওইসব পদে বসার জন্য যেন পাগলপ্রায়!</p> <p>দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটে চলেছে শিক্ষক নির্যাতন আর জোরপূর্বক পদত্যাগ করানোর ঘটনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তব্য দিয়েছেন, কিন্তু কোনো কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। একজন শিক্ষক কোনো একটি দলকে সমর্থন করতেই পারেন, কিন্তু তাঁর মহানুভবতা, আদর্শ, কাজ, আচার-আচরণ কোনোভাবেই তাঁর শিক্ষার্থীকে একটুও স্পর্শ করবে না। একজন প্রকৃত শিক্ষক তাঁর আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে পারেন না। সেই জায়গাটি কিন্তু আমরা অনেক শিক্ষক নিজেরাই নষ্ট করেছি, মারাত্মকভাবে নষ্ট করে ফেলেছি! তা না হলে আমাদের দেশে এখনো অনন্য ব্যতিক্রম ছাড়া শিক্ষার্থীরা কিন্তু শিক্ষকদের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করে না, করতে পারে না, আমাদের কালচারে নেই, সে যত বড় মাস্তানই হোক।</p> <p>কিন্তু কোথায় যেন কী হয়েছে! অনেক প্রতিষ্ঠানপ্রধান আছেন, যাঁরা শিক্ষকতার চেয়ে কোনো দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা এবং সেটিকে পুঁজি করে অনেক কিছু করা, ক্ষমতা প্রদর্শন করা বা প্রভাব খাটিয়ে অর্থ উপার্জন করা ইত্যাদি বিষয় ঘটাচ্ছেন, যা শুধু দৃষ্টিকটু নয়, সমাজ ধ্বংসের পাঁয়তারা। এ ধরনের শিক্ষকরা নিজেদের অজান্তেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মনে স্থান করে নিতে পারেন না, সমাজ তাঁদের অন্য চোখে দেখে। এখানে শুধু সমাজকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কিভাবে শিক্ষকদের সেই সম্মানের জায়গাটি ধরে রাখা যায়, কিভাবে শিক্ষকদের প্রকৃত সম্মান অর্জনের পথে হাঁটা যায়, সেটি আজকের মুখ্য আলোচনা হতে পারে। আগামীর পৃথিবী বাসযোগ্য করার ক্ষেত্রে অন্যান্য পেশার চেয়ে শিক্ষকদের ভূমিকা এবং গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়, বরং বহুগুণ বেশি। সেই প্রত্যয় নিয়েই আমাদের এগোতে হবে।</p> <p>পৃথিবীর সব শিক্ষককে অভিনন্দন!</p> <p><em>লেখক : শিক্ষা গবেষক এবং সাবেক কান্ট্রি ডিরেক্টর, ভাব বাংলাদেশ </em></p> <p><em>চিফ অব পার্টি, ব্র্যাক শিক্ষা</em></p> <p><em>masumbillah65@gmail.com</em></p> <p> </p>