<p>পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের মতো তাঁর স্ত্রী ও দুই মেয়েও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) ডাকে সাড়া দেননি। গতকাল সোমবার বেনজীরের স্ত্রী জীশান মীর্জা এবং দুই মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন তাঁরাও দুদকে হাজির না হয়ে গত বৃহস্পতিবার তাঁদের লিখিত বক্তব্য দুদকে দাখিল করেন। </p> <p>সেখানে তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। যদিও তাঁদের ওই আবেদন নাকচ করে দুদকের মূল নথিতে যুক্ত করে রাখা হয়েছে।</p> <p>দুদকের ডাকে হাজির না হয়ে বেনজীর এবং তাঁর পরিবারের তিন সদস্য মূলত আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছেন।</p> <p>গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের স্ত্রী ও দুই কন্যাকে জিজ্ঞাসাবাদের দিন ধার্য ছিল। তবে তাঁরা আজ (গতকাল) দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে উপস্থিত হননি। তাঁরা একটি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন, যেখানে তাঁদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে।’</p> <p>তিনি বলেন, ‘এই আবেদনটি বেনজীর আহমেদের আবেদনের সঙ্গেই গত বৃহস্পতিবার জমা দেওয়া হয়। আমাদের অনুসন্ধান টিম দুদক আইন ও বিধি মোতাবেক কাজ করছে। আশা করছি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অনুসন্ধান টিম তাদের প্রতিবেদন কমিশনে দাখিল করতে পারবে।’</p> <p>অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনুসন্ধান টিমের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রতিবেদন দেখে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে। অন্যান্য ব্যক্তির ক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়ায় যেসব কার্যক্রম চলে, ঠিক একইভাবে এ ক্ষেত্রেও সেসব কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে। কমিশনের অনুসন্ধান টিম স্বাধীনভাবে কাজ করছে।</p> <p><strong>একাধিক মামলার প্রস্তুতি</strong></p> <p>প্রথম দফার পর এবার দ্বিতীয় দফায় দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে মুখোমুখি না হয়ে বেনজীর আহমেদ তাঁর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ হারিয়েছেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে এবং তাঁর পরিবারকে আর সময় দেওয়া হবে না বলে দুদক সূত্র জানিয়েছে। অবশ্য দুদকের আইনে সময় চেয়ে দ্বিতীয়বার আবেদনের সুযোগ নেই।</p> <p>এমন পরিস্থিতিতে শিগগিরই তাঁর ঠিকানায় সম্পদ বিবরণী দাখিলের নোটিশ পাঠানো হবে। এরপর ২১ কর্মদিবস এবং পরে সময়ের আবেদন করলে আরো ১৫ কর্মদিবস সময় পাবেন তিনি। তবে বিদেশে অবস্থান করায় বেনজীর যেমন দুদকের নোটিশ গ্রহণ করতে পারবেন না, তেমনি দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতেও ব্যর্থ হবেন।</p> <p>সম্পদ বিবরণী দাখিল না করলে দুটি মামলা করা হবে। দুদকে সম্পদ বিবরণী দাখিল না করার জন্য হবে ‘নন-সাবমিশন’ মামলা, আর বেনজীর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের যেসব অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে আরেকটি ‘অবৈধ (জ্ঞাত আয়বহির্ভূত) সম্পদ অর্জনের’ মামলা করা হবে। কমিশনের অনুসন্ধানকারী দল তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। দুদক আইনে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় ১০ বছর এবং নন-সাবমিশন মামলায় তিন বছরের সাজার বিধান রয়েছে।</p> <p><strong>বেনজীর পর্তুগালে, পরিবার দুবাইয়ে</strong></p> <p>গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল কালের কণ্ঠে সংবাদ প্রকাশের পরপরই স্ত্রীর চিকিৎসার নামে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমায় বেনজীর এবং তাঁর পরিবার। সেখান থেকে তাঁরা ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের অধীনে বেনজীরের কেনা মালয়েশিয়ার বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। এরপর মালয়েশিয়া থেকে সপরিবারে চলে যান দুবাই। সেখানে পরিবারের সদস্যদের রেখে বেনজীর পর্তুগালে পাড়ি জমান বলে জানা গেছে।</p> <p><strong>সপরিবারে দুদকে তলব</strong></p> <p>গত ২৮ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাঁদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করে চিঠি দেয় দুদক। চিঠিতে ৬ জুন বেনজীর আহমেদ এবং ৯ জুন তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, মেয়ে ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির থাকতে বলা হয়। আরেক মেয়ে জাহরা বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি। তবে প্রথম দফায় দুদকের ডাকে হাজির হননি বেনজীর আহমেদ। দ্বিতীয় দফায় ২৩ জুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে ফের দুদকে তলব করে চিঠি দেওয়া হয়। দ্বিতীয় দফায়ও তিনি দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে সাড়া দেননি।</p> <p><strong>বেনজীরের সম্পদ জব্দে হ্যাটট্রিক</strong></p> <p>দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত তিন দফায় বেনজীর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ক্রোক ও ফ্রিজের আদেশ দিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ তৃতীয় দফায় গত ১২ জুন বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের নামে থাকা আরো আটটি ফ্ল্যাট এবং ২৫ একর (৬০.৫ কাঠা) ২৭ কাঠা জমি জব্দের (ক্রোক) আদেশ দিয়েছেন আদালত। এই ফ্ল্যাটগুলোর অবস্থান ঢাকার বাড্ডা ও আদাবরে। জমি নারায়ণগঞ্জ, বান্দরবান ও উত্তরায়। একই সঙ্গে বেনজীর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা বেসরকারি সিটিজেন টেলিভিশন ও টাইগার ক্রাফট অ্যাপারেলস লিমিটেডের শেয়ার অবরুদ্ধের আদেশও দিয়েছেন আদালত।</p> <p>দ্বিতীয় দফায় গত ২৬ মে একই আদালত বেনজীর আহমেদের স্ত্রী জীশান মীর্জার নামে থাকা মাদারীপুরে ২৭৬ বিঘা জমি এবং বেনজীর পরিবারের নামে থাকা গুলশানের চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে থাকা ১৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও তিনটি বিও হিসাব এবং ৩০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়। সাভারের কিছু জমিও রয়েছে একই আদেশের আওতায়।</p> <p>প্রথম দফায় গত ২৪ মে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর এবং তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), চারটি ক্রেডিট কার্ড ও ছয়টি বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।</p> <p><strong>বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান শুরু যেভাবে</strong></p> <p>সর্বপ্রথম কালের কণ্ঠে ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’ এবং ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’ শিরোনামে গত ৩১ মার্চ ও ২ এপ্রিল পৃথক দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদন দুটি প্রকাশের পর দেশে-বিদেশে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মূলত এর পরই দুদক বেনজীর এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে গত ২১ এপ্রিল বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দুদক চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেন হবিগঞ্জ-৪ (মাধবপুর-চুনারুঘাট) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন।</p> <p>পরের দিন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন এক সংবাদ সম্মেলনে বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধান শুরুর তথ্য জানান। তিনি বলেন, ১৮ এপ্রিল কমিশন সভায় এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন সহকারী পরিচালক নিয়ামুল আহসান গাজী ও জয়নাল আবেদীন।</p> <p>বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পুলিশের আইজি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র‌্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‌্যাব এবং র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান যে সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেয় তাঁদের মধ্যে বেনজীরও ছিলেন।</p>