<p>গত বছরের তুলনায় এ বছর মৌসুমের শুরুতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের হার কিছুটা কম হলেও মৃত্যুর হার দ্বিগুণ। ডেঙ্গুর চারটি ধরনের মধ্যে এ বছর তিনটি ধরনই সক্রিয়। দ্বিতীয় বা আরো বেশিবার আক্রান্ত হলে অনেকের অবস্থা খারাপ হতেই পারে। ফলে এবার হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। আর এসব কারণে সতর্ক হওয়ার এখনই সময়। ডেঙ্গু সাবধানতা নিয়ে লিখেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।</p> <p>ডেঙ্গুর উপসর্গের ধরন পাল্টে গেছে। এখনকার ডেঙ্গুতে যেসব উপসর্গ দেখা দিচ্ছে তা হলো, হঠাৎ জ্বর আসা আবার জ্বর না থাকা, কাশি, শরীর ব্যথা, বমি বা বমি বমি ভাব, অসহ্য পেটে ব্যথা, চোখে ব্যথা, দেহে র‌্যাশ ওঠা, প্রেসার ও পালস কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া, প্রস্রাব কম হওয়া, দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, মস্তিষ্কে প্রদাহ, হাত-পা ফুলে যাওয়া, দেহে পানি আসা, পাতলা পায়খানাসহ প্লাটিলেটও অনেক কমে যাচ্ছে। সুস্থ হতে বেশ কয়েক দিন হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে ভর্তি রোগীদের।</p> <p><strong>পাল্টে গেছে এডিস মশার আচরণও</strong><br /> মূলত এডিস ইজিপ্টি প্রজাতির মশার কামড় থেকেই ডেঙ্গু হয়। এই জীবাণু একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। আগে আমরা বলতাম, এডিস মশা সূর্য ওঠার সময় এবং সূর্য ডোবার সময় কামড় দিলে ডেঙ্গু হয়। সে হিসেবে দিনের বেলায় মশারি ব্যবহার করতে, এমনকি ফুলহাতা পোশাক পরতে পরামর্শ দিতাম। তবে এই মশা আসলে ঠিক কোনো সময় কামড়ায় এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে।</p> <p>কীটতত্ত্ববিদের সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, ২৪ ঘণ্টাই এডিস মশা কামড়ায়, যাতে ডেঙ্গু হতে পারে। তবে রাতের অন্ধকারে কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে, ঘর আলোকিত থাকলে রাতেও কামড়াতে পারে। মোটকথা, বদলে গেছে ডেঙ্গুবাহী এডিস মশার আচরণ। ডেঙ্গু এখন সারা বছরের অসুখ হয়ে গেছে।</p> <p><strong>ডেঙ্গু এনএস১ রিপোর্ট নেগেটিভ হলেও কি কারোর ডেঙ্গু হতে পারে?</strong><br /> সব ধরনের পরীক্ষা করার দরকার নেই। ডাক্তার যেসব পরীক্ষা করার প্রয়োজন মনে করবেন, তা-ই পরীক্ষা করতে হবে। ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এনএস১ পরীক্ষাই যথেষ্ট। ডেঙ্গু এনএস১ পরীক্ষার রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে, তাহলে সেই রোগীর ডেঙ্গু হয়েছে বলে ধরা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, রোগীর ডেঙ্গু হয়েছে কিন্তু রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এর মূল কারণ হলো তিনি পরীক্ষাটি সঠিক সময়ে হয়তো করেননি। কেননা জ্বর আসার প্রথম তিন দিন পর্যন্ত ডেঙ্গু ভাইরাস রক্তের মধ্যে পজিটিভ থাকে। এরপর তা নেগেটিভ হয়ে যায়। তখন রক্তে ওই ভাইরাসের উপস্থিতি মেলে না। এ জন্য জ্বর আসার প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ডেঙ্গু এনএস১ পরীক্ষাটি করা উচিত। জ্বর আসার তিন দিনের মধ্যে করলেও হয়, তবে তিন দিন পর এনএস১ পরীক্ষা করলে কোনো লাভ হয় না।<br />  <br /> <strong>জ্বর হলে কী করা যাবে না</strong><br /> জ্বর হলে শুধু প্যারাসিটামলজাতীয় ওষুধ খেতে হবে। কোনোমতেই ব্যথানাশক ওষুধ সেবন এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিকজাতীয় ওষুধ সেবন করা যাবে না। যাঁদের দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু হয়েছে, তাঁরা বেশি সতর্ক থাকবেন, প্রয়োজন মনে করলে হাসপাতালে ভর্তি হবেন। যাঁরা ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভারের মতো জটিল রোগে ভুগছেন (কো-মরবিডিটি), তাঁরা মৃত্যুর উচ্চঝুঁকিতে থাকেন।</p> <p><strong>হাসপাতালে ভর্তি হবেন কখন?</strong><br /> চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থার হঠাৎ অবনতি হচ্ছে। বিশেষ করে জ্বরের শুরুতেই অথবা দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে ভয়াবহ জটিলতা দেখা দিচ্ছে। বেশির ভাগ রোগীর মধ্যে শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। ফলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অনেকে মারা যাচ্ছে। এ জন্য পরামর্শ হলো, জ্বর হলে প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এনএস১ রক্ত পরীক্ষাটি করুন। ডেঙ্গু ধরা পড়লে চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করুন। চিকিৎসক যদি বলেন, তাহলে হাসপাতালে ভর্তি হোন। কেননা দেরি করে হাসপাতালে ভর্তি হলে জটিলতা বাড়ে।<br />  <br /> <strong>কোন রোগীদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে?</strong><br /> ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরন রয়েছে—ডেন-১, ২, ৩ ও ৪। এবার এই চার ধরনের মধ্যে একাধিক ডেন সংক্রিয় রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় দেখা গেছে, এ বছর ডেন-১, ২ ও ৪—এই তিন ধরনে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। একাধিক ডেন-এ আক্রান্ত রোগীরাই বেশি মারা যাচ্ছে। এ ছাড়া কো-মরবিডিটির রোগীরা বেশি মারা যাচ্ছে। গর্ভবতী নারী এবং শিশুরাও ডেঙ্গুর মৃত্যুঝুঁকিতে আছে।</p> <p><strong>সিবিসি পরীক্ষা</strong><br /> প্লেটলেট গণনা এবং রক্তের ক্ষয়জনিত হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বা রক্তাল্পতা, হেমোটোক্রিট এবং লাল রক্তকণিকার পরিমাণ (আরবিসি) জানতে কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষাটি বেশ ভূমিকা রাখে। সিবিসির রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা মারাত্মক ডেঙ্গু হচ্ছে কি না, সেটি বুঝতে পারেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেন। তাই ডেঙ্গু হলে অন্যান্য পরীক্ষার পাশাপাশি এই পরীক্ষাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ।</p> <p><strong>ডেঙ্গু হলে আরো কী কী পরীক্ষা করা গুরুত্বপূর্ণ?</strong><br /> ডেঙ্গু ভাইরাস কারো দেহে ঢোকার পর দেহের সব সিস্টেমকে অ্যাটাক করে। লিভার আক্রান্ত হয়েছে কি না, এ জন্য লিভারের এনজাইম, এসজিপিটি, এএলটি ইত্যাদি, কিডনি ফাংশন দেখার জন্য সিরাম ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি পরীক্ষা করা ভালো। এতে রোগীর প্রগনোসিস বা উন্নতি বোঝা যায়, যাতে বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় বা সিভিয়ার ডেঙ্গু ঠেকানো যায়।</p> <p><strong>২৪ ঘণ্টাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে</strong><br /> এডিস মশার আচরণ পাল্টে যাওয়া যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বটে। এডিস মশার কামড়ানো যদি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে শুধু ওই সময়টায় সতর্ক থাকলেই হতো। তাই এখন দিনরাত ২৪ ঘণ্টাই মশার কামড় থেকে রেহাই পাওয়ার সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে মশক নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে, মশার কামড়ানো প্রতিরোধ করতে হবে।</p> <p><strong>সতর্কতা</strong><br /> স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে, ডেঙ্গু প্রতিরোধে ঘরের বা অফিসের বা কর্মস্থলের জানালা সব সময় বন্ধ রাখতে হবে, মশার কামড় থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব শরীর ঢেকে রাখতে পারে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। পরিবার, প্রতিবেশী ও কমিউনিটির মধ্যে ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিচ্ছন্নতা অভিযানে সবাইকে সরাসরি যুক্ত হওয়ার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। মশার প্রজনন রোধে করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, ঘরে ও আশপাশের যেকোনো পাত্রে বা জায়গায়, মাঠ অথবা রাস্তায় পানি জমতে দেওয়া যাবে না। ব্যবহৃত পাত্রের গায়ে লেগে থাকা মশার ডিম অপসারণে পাত্রটি ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হবে। ফুলের টব, প্লাস্টিকের পাত্র, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, মাটির পাত্র, বালতি, টিনের কৌটা, ডাবের খোসা বা নারকেলের মালা, কনটেইনার, মটকা, ব্যাটারি সেল, ফ্রিজে জমে থাকা পানি তিন দিনের মধ্যে ফেলে দিতে হবে, ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দ্রুত যোগাযোগ করতে হবে। ডেঙ্গুবিষয়ক বিশেষ বার্তায় আরো জানানো হয়, ডেঙ্গু নিয়ে যেন মানুষের মধ্যে আতঙ্ক না ছড়ায়। সাধারণ চিকিৎসায়ই এই রোগ সেরে যায়। তবে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং হেমোরেজিক ডেঙ্গু  মারাত্মক হতে পারে।</p>