<p>মাদাগাস্কার দ্বীপের এখন ভয়ানক দুর্দশা। এই দ্বীপ ব্রিটিশমুক্ত হয়েছে ঠিকই। কিন্তু এখনো বিদেশি শক্তিগুলো তৎপর। কেউ মাদাস্কারকে নিরাপত্তার নামে নিজেদের সৈন্য সেখানে সৈন্য মোতায়েন করেছে। কেউ আবার সৈন্য মোতায়েনকারী দেশটা নিয়ে মাদাগাস্কারকে সতর্ক করেছে। কিন্তু মাদাগাস্কারের স্বৈরশাসক সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে দিব্যি। দেশের অবস্থা খারাপে দিকে যাচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যে আকশ ছুঁয়েছে, দ্রব্যমূল্যের দাম লাগাম ছাড়া হয়েছে, কিন্তু শাসকের কোনো হেলদোল নেই। তিনি শুধু জনতাকে আশা দিচ্ছেন—শিগগিরই মাদাগাস্কার ধনী দেশ হয়ে যাবে।</p> <p><strong>কীভাবে হবে?</strong></p> <p>ওই যে জিকালির ভবিষ্যদ্বাণী—যিনি মস্ত জাদুকর। বড় বড় সব কাণ্ড ঘটিয়ে গোটা আফ্রিকা জুড়ে নাম কামিয়েছিলেন। উনিশ শতকে। লোকে তাকে ভালোবাসত! সেই ভালোবাসায় যতটা না শ্রদ্ধা ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ভয়। কালো জাদুর ভয়। আফ্রিকার সেকালের গোত্রপতিরা তার নামে জয়ধ্বনি করত, প্রণাম করত গড় হয়ে। সেখানে সাধারণ মানুষ তো কোন ছার!</p> <p>সেই জিকালি নাকি একবার এসেছিলেন মাদাগাস্কারে, করেছিলেন ভবিষ্যৎ। মাদাগাস্কারের অবস্থা তখন আরও খারাপ। ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ, গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব, ষড়যন্ত্র, কুশিক্ষা, কুসংস্কারে নিমজ্জিত মাদাগাস্কারিরা তখন কিছুদিনের জন্য হালে পানি পেয়েছিল। আদতে জিকালির আবির্ভাবে বদলায়নি কিছুই, উপরন্তু কলাটা-মুলোটা, সোনাটা-রূপাটা, গরীবের রক্তপানি করে অর্জিত সম্পদটা দক্ষিণা হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। বদলে দিয়েছিলেন এক আশার বাণী—আসলে ভবিষ্যৎবাণী।</p> <p>যাওয়ার আগে মাদাগাস্কারের সবচেয়ে শক্তিশালী গোত্রপতির হাত ধরে বলে গিয়েছিলেন, এই দেশ একদিন সোনায় মুড়ে যাবে, নদীতে বইবে গলিত সোনার প্রবাহ—সেখান থেকে সোনা তুলবে আর বিক্রি করবে। পুরো পৃথিবী তোমাদের সেলাম করবে তখন।</p> <p>গোত্রপতি আশান্বিত হয়ে বলেছিলেন, কবে আসবে সেই দিন, মহামান্য জিকালি?</p> <p>‘ধীরে বৎস, ধীরে,’ জিকালি বলেছিলেন, ‘সবুরে মেওয়া ফলে।’’</p> <p>কথা শুনে গোত্রপতির হাসিটা মিলিয়ে গেলেও, সেদিন থেকে আশায় বুক বেঁধেছিলেন। তিনি তো বটেই, গোটা মাদাগাস্কার দ্বীপের লোকেরা সেদিন থেকে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু—জিকালি যখন বলেছেন, একদিন নিশ্চয়ই তাঁর ভবিষ্যদবাণী সত্যি হবে। </p> <p>একদল লোক সেই ভবিষ্যৎবাণীকে পুঁজি করে একটা সংগঠন গড়ে তোলে—জিকালি সংঘ।</p> <p>২. <br /> জিকালি সংঘ এখন ধোপদস্তুর রাজনৈতিক দল। আর তাঁদের নেতা মাদাগাস্কারের বর্তমান শাসক—রামত্রাহী। জিকালি ভবিষ্যৎবাণীকে পুঁজি করে দিনের পর দিন নিজের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসে আছেন।</p> <p>লোকজনের কিছু করার নেই। তাঁরাও জিকালিকে বিশ্বাস করে—একদিন সত্যিই সোনার নহর বইবে মাদাগাস্কারের নদীগুলোতে।</p> <p>কিন্তু এত দিনের সলিড বিশ্বাসে সম্প্রতি চিড় ধরাচ্ছেন মাদাগাস্কারের মুক্তিকামী নেতা হোভা রাহাদিয়ান। তিনি বলছেন, নতুন সম্ভাবনার কথা বলছেন, শাসকের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলছেন। আর বলছেন—জিকালির ভবিষ্যদ্বাণী আশায় বসে থাকলে মাদাস্কারের সত্যিকারের মুক্তি কোনো দিন আসবে না, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনও হবে না। সত্যিকারের মুক্তি আনতে হলে, জিকালির ভবিষ্যদবাণীকে ঝেড়ে ফেলে নিজেদের কাজ করতে হবে, উৎপাদন করতে হবে।</p> <p>এই নিয়ে দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছে মাদাস্কারের জনগণ। বলাই বাহুল্য, জিকালির ভবিষ্যদবাণী সত্যি হবে, এমন কথা বলার লোকের সংখ্যা অনেক বেশি। অন্যদিকে হোভা রাহাদিয়ানের সমর্থক হাতে গুণে কয়েকজন।</p> <p>একদিন এক হোভা সমর্থকের সঙ্গে জিকালি সমর্থকের তর্ক চরমে উঠেছে। হোভা সমর্থক শিক্ষিত-যুক্তিবাদী লোক। অন্যদিকে জিকালি সমর্থক শিক্ষিত, তবে যুক্তির ধার ধারেন না৷ জিকালির ওপর, তাঁর ভবিষ্যদবানীর ওপর অগাধ আস্থা তার।</p> <p>হোভা সমর্থক বলছেন, আর কত দেরি হবে? মাদাগাস্করের সব মানুষ না খেয়ে মার গেলে এদেশে সোনার নহর বইবে?</p> <p>জিকালি সমর্থক ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আপনার মতো লোক যতদিন আছে, যারা জিকালিকে মানে, তাদের জন্য জন্যই জিকালির ভবিষ্যদবাণী কার্যকর হচ্ছে না। আপনারা যেদিন মাদাগাস্কার থেকে সাফ হয়ে যাবেন, সেদিনই জিকালির ভবিষ্যৎবাণী ফলতে শুরু করবে।</p> <p>‘কবে সেটা, আরও একশ বছর পরে, নাকি পৃথিবী ধ্বংসের পরে।’ বিদ্রুপের সুরে বললেন হোভা সমর্থক।<br /> ‘পৃথিবী ধ্বংসের পরে নয়, আগেই।’ বললেন জিকালি সবর্থক। ‘জিকালি যখন বলেছেন, তখন হবেই।’<br /> জিকালির সমর্থক বুঝলেন, এর সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। এরা একটা প্যারাডক্সের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।</p> <p>৩.<br /> এরপর তিনশ কোটি বছর কেটে। পৃথিবী অনেক উন্নত হয়েছে এতটাই, সেটা বিংশ শতাব্দীর মানূষ কল্পনাই করতে পারে না। </p> <p>মাদাস্কারও উন্নত হয়েছে, সেই দরিদ্র মানুষ একজনও নেই। কিন্তু এখনো মানুষ দুই মতবাদে বিশ্বাসী। একদল জিকালির সমর্থক, একদল হোভার সমর্থক। এখনো তারা তর্ক করে—মাদাগাস্কারের নদীতে গলিত সোনার নহর বইবেই। কিন্তু ভূত্ত্বাকিরা মাদাগাস্কারের মাটির নিচে সোনার খনির কোনো সন্ধান আজও পাননি। তবুও একদল জিকালির ভবিষ্যদবাণীকেই আকড়ে ধরেছে। </p> <p>জিকালি বলেছেন যখন, একদিন সত্যি হবেই। জিকালি কোনো নির্দিষ্ট সময়ের উল্লেখ করে যাননি। তারমানে ভবিষ্যতে একদিন হবেই৷ ভবিষ্যতে গিয়ে কে প্রমাণ করবে জিকালি মিথ্যা ভবিষ্যৎবাণী করেছেন।</p> <p>এখানকার প্যারাডক্সটা হলো, ভবিষ্যতে একদিন হবেই, কিন্তু সেটা ভবিষ্যতে গিয়ে প্রমাণ করার কোনো সুযোগ নেই।</p> <p>জিকালি মিথ্যা বলেছেন, অথচ শক্তপোক্ত যুক্তি দিয়েই সেটা যে মিথ্যা তা প্রমাণের উপায় নেই। <br /> ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কোনো ঘটনা যতক্ষণ না ঘটছে তক্ষণ পর্যন্ত সেটা ভবিষ্যতেই থেকে যাচ্ছে, বর্তমানে রূপ নিচ্ছে না। কিন্তু ঘটতে হলে সেটাকে কোনো না কোনো সময় ভবিষ্যৎ থেকে বর্তমানে রূপ নিতেই হবে, তারপর একসময় সেটা অতীতে চলে যাবে। কিন্তু যে ভবিষ্যৎ সব সময় ভবিষ্যতেই রয়ে যায়, তাকে মিথ্যা প্রমাণই বা করবেন কিভাবে?</p> <p><strong>বিশেষ দ্রষ্টব্য :</strong> জিকালি হলো হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বিখ্যাত ‘অ্যালান কোয়াটারমেইন’ সিরিজের এক নেতিবাচক চরিত্র। তিনি তুকতাক, তন্ত্র-মন্ত্রের নামে বুজরুকি করে আফ্রিকার গোত্রপতি ও সাধারণ জনতাকে দীর্ঘদিন মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন। অবশ্য বাস্তবে জিকালি নামে কেউ ছিল কি না, এ কথা জানা যায় না।</p>