মায়ানমারে ভয়াবহ ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা সোমবার দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে এবং ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের জীবিত উদ্ধারের আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে। এ পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী এক সপ্তাহের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
মায়ানমারের শাসক সামরিক জান্তা এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, শুক্রবারের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে ‘জীবনহানি ও ক্ষতির প্রতি সমবেদনা জানাতে’ ৬ এপ্রিল পর্যন্ত জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে।
বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুর ১২টা ৫১ মিনিট ২ সেকেন্ডে ৭.৭ মাত্রার এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে, যা ভূমিকম্পটি আঘাত হানার সুনির্দিষ্ট সময়।
সে সময় জনগণকে থেমে গিয়ে ভূমিকম্পের শিকারদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি গণমাধ্যমকে সম্প্রচার বন্ধ রেখে শোক চিহ্ন প্রদর্শনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া মন্দির ও প্যাগোডায় প্রার্থনার আয়োজনও করা হবে।
জান্তা সোমবার আরো জানায়, এখন পর্যন্ত নিশ্চিত মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ৫৬ জন।
আর আহতের সংখ্যা তিন হাজার ৯০০ ছাড়িয়েছে এবং এখনো ২৭০ জন নিখোঁজ। তবে এই সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। মৃতদের মধ্যে তিনজন চীনা নাগরিক ও দুজন ফরাসি নাগরিক রয়েছেন বলে চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম ও প্যারিসের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।
উদ্ধার অভিযান ধীর হয়ে আসছে
এদিকে এই ঘোষণার মধ্যেই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম মান্দালয়ে উদ্ধার অভিযানের গতি কমে আসছে।
১৭ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার এ শহরটিতে এখনো হাজারো মানুষ বাড়ি ফিরতে পারেনি।
মান্দালয়ের সাজ্জা নর্থ মসজিদের প্রধান প্রশাসক অং মিন্ট হুসেইন বলেন, ‘পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে এটি ব্যাখ্যা করা কঠিন।’
টানা চার রাত ধরে বহু মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাস্তায় রাত কাটাচ্ছে। কেউ কেউ তাঁবুর ব্যবস্থা করতে পারলেও অনেকেই রাস্তার ওপর কম্বলে শুয়ে আছে, ভবনধসের আশঙ্কায় দালান থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে।
ভূমিকম্পের প্রভাব এতটাই ভয়াবহ ছিল যে শত শত কিলোমিটার দূরে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককেও ৩০ তলাবিশিষ্ট একটি নির্মীয়মাণ ভবন ধসে পড়ে।
সেখানে অন্তত ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
খোলা আকাশের নিচে হাসপাতাল
অন্যদিকে মান্দালয়ের এক হাজার শয্যার সাধারণ হাসপাতাল খালি করে ফেলা হয়েছে এবং শত শত রোগীকে বাইরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতালের পার্কিং এলাকায় স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা অনেক রোগীকে কেবল একটি পাতলা ত্রিপল দিয়ে সূর্যের তাপ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বজনরা তাদের পাশে থেকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, কেউ হাত ধরে আছেন, আবার কেউ বাঁশের পাখা দিয়ে বাতাস করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা যা পারছি, তা-ই করছি। আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
অস্বাভাবিক গরমে উদ্ধারকর্মীরা ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন এবং মৃতদেহ দ্রুত পচে যাওয়ায় শনাক্তকরণে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তবে সোমবার থেকে মান্দালয়ের রাস্তায় কিছু যানবাহন চলতে শুরু করেছে, রেস্তোরাঁ ও হকাররা ফের কাজ শুরু করেছেন। শহরের একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মসজিদের সামনে শত শত মুসলিম ঈদুল ফিতরের নামাজও আদায় করেন।
মানবিক সংকট আরো ঘনীভূত
মায়ানমার এমনিতেই বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি ছিল। দেশটি ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর চার বছর ধরে গৃহযুদ্ধে বিপর্যস্ত, অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ভূমিকম্পটিকে সর্বোচ্চ স্তরের জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং জীবন বাঁচানোর জন্য আট মিলিয়ন ডলারের জরুরি তহবিল চেয়েছে। আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সংস্থাও ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা চেয়ে আবেদন করেছে।
অত্যন্ত বিরল এক পদক্ষেপে সামরিক জান্তার প্রধান মিন অং হ্লাইং আন্তর্জাতিক সহায়তার আবেদন জানিয়েছেন। অতীতে বিচ্ছিন্ন মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরও বিদেশি সহায়তা নিতে অপারগতা দেখিয়েছিল।
জান্তা মুখপাত্র জাও মিন টুন সোমবার চীন, রাশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি মিত্র দেশের সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা আহতদের চিকিৎসা ও নিখোঁজদের সন্ধানে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’
তবে ভূমিকম্পের পরও সামরিক বাহিনী বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। একটি সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠন এএফপিকে জানিয়েছে, ভূমিকম্পের পরপরই তাদের ওপর বিমান হামলায় সাতজন যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। সোমবারও আরো কিছু বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে।
মায়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বাহিনী ও বিভিন্ন জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠী লড়াই করছে, যা ইতিমধ্যে ৩৫ লাখের বেশি মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে।
এদিকে ব্যাঙ্ককে ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে ভারী যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে এখন পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে এবং অন্তত ৭৫ জন এখনো নিখোঁজ রয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখনো জীবিতদের উদ্ধারের আশা পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়নি।