সেই সঙ্গে প্রতি চারটি মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যে একটি আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পরিশোধ সক্ষমতা অর্জনের যে প্রতিশ্রুতি ছিল তা পূরণে এখনো সফল হয়নি।
অফিশিয়াল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসিস্ট্যান্স (ওডিএ) নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘ উন্নত দেশগুলোর জন্য তাদের মোট জাতীয় আয়ের (জিএনআই) ০.৭ শতাংশ ওডিএতে বরাদ্দ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। ২০২২ সালের নেট ওডিএর পরিমাণ ছিল ২০৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২১ সালের চেয়ে ১৫.৩ শতাংশ বেশি। এই সাহায্য বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল উন্নত দেশগুলো ইউক্রেন ও শরণার্থীদের সহায়তা করবে। স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রদত্ত সহায়তা প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পেয়েছে। জাতিসংঘ প্রকাশিত দ্য লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রিজ রিপোর্ট-২০২৩ অনুযায়ী, ২০২১ সালে ৪৬টি স্বল্পোন্নত দেশে সাহায্য হিসেবে দেওয়া মোট অর্থ ছিল প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা তারা ২০২০ সালে প্রাপ্ত সর্বাধিক প্রায় ৭৩ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে কম। বৈদেশিক সাহায্যের উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, উন্নত দেশগুলো তাদের জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ ওডিএ হিসেবে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। ২০২২ সালে মাত্র পাঁচটি দেশ—লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, নরওয়ে, জার্মানি ও ডেনমার্ক এই লক্ষ্য পূরণ করতে পেরেছিল। বেশির ভাগ উন্নত দেশের এই প্রতিশ্রুতি পূরণের ব্যর্থতা উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর ওপর বোঝা চাপিয়ে দেয়।
২০১৪ সালে আংকটাডের হিসাব অনুযায়ী, উন্নয়নশীল দেশে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ২০১৫ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ৩.৯ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। সে সময় আংকটাড ১০টি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে বিবেচনা করে এবং এসব খাতে মোট বিনিয়োগের ঘাটতি ছিল ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক ওয়ার্ল্ড ইনভেস্টমেন্ট রিপোর্ট ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী এই ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি। জ্বালানি, পানি ও পরিবহন অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। সেই সঙ্গে গত বছরের তুলনায় ২০২২ সালে বিশ্বে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে ১২ শতাংশ। উন্নয়নশীল দেশে এই বিনিয়োগের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে এই বিনিয়োগের পরিমাণ কমেছে।
উন্নত দেশগুলো থেকে ওডিএ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পেলেও তাদের সামরিক ব্যয় রেকর্ড হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২ সালে বিশ্বে সামরিক খাতে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, আট বছর ধরে এই খাতে ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এসডিজি ১৭-এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল দোহা উন্নয়ন এজেন্ডায় আলোচনা শেষ করার মাধ্যমে একটি সর্বজনীন, নিয়মভিত্তিক, উন্মুক্ত, অবৈষম্যহীন এবং ন্যায্য বহুপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা তৈরি করা। দোহা ডেভেলপমেন্ট এজেন্ডার প্রধান উদ্দেশ্য হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাণিজ্য সম্ভাবনা প্রসারিত করা। ২০০১ সালে কাতারের দোহায় মন্ত্রী পর্যায়ের চতুর্থ বৈঠকের ২২ বছর পর দোহা রাউন্ড, যেটাকে উন্নয়ন রাউন্ড হিসেবে দেখা হয়েছিল, তা এখন কোনো ফলাফল ছাড়াই মৃতপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। এই রাউন্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বাজারে প্রবেশাধিকার সহজতর করে, ন্যায্য নিয়মসমূহের বাস্তবায়ন এবং টেকসই প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বৃদ্ধি থেকে লাভবান হতে সক্ষম করা। দুর্ভাগ্যবশত এটা পরিহাসের বিষয় যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বর্তমানে যেভাবে কাজ করছে তা থেকে বোঝা যায়, দোহা রাউন্ড তার প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। এসডিজি ১৭-এর আরো একটি লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক রপ্তানিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর হিস্যা দ্বিগুণ করা। কিন্তু ২০১১ সাল থেকে বৈশ্বিক পণ্য ও সেবা রপ্তানিতে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অংশ ১ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করা যায়নি এবং ভবিষ্যতে তা বৃদ্ধি করা যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের মধ্যে এমন কিছু বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, যা দেশীয় বাজারে উৎপাদনকে উৎসাহিত করে বিশ্ববাণিজ্যকে নিরুৎসাহ করছে। আমেরিকার ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট, ভারতের মেক ইন ইন্ডিয়া পলিসি বা চীনের মেড ইন চায়না : ২০২৫ পরিকল্পনা—এসব নীতির প্রধান উদ্দেশ্য হলো অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং দেশীয় উৎপাদনকে উৎসাহ দেওয়া। বিশ্বের মোড়ল দেশগুলোর এই ধরনের নীতি বা কৌশল গ্রহণ করার অর্থ হলো তুলনামূলক সুবিধার বা কম্প্যারেটিভ অ্যাডভান্টেজের মাধ্যমে অন্য বাণিজ্য অংশীদারদের লাভ করার পথ বন্ধ করে দেওয়া। এতে বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নয়নের যে ধারণা এবং এসডিজির যে মূল প্রতিশ্রুতি, ‘কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না’, সেটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেই সঙ্গে বিশ্বের বড় দেশগুলো তাদের বাণিজ্যনীতিতে যে ধরনের ভর্তুকির ব্যবস্থা রেখেছে, তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মধ্যে যে অচলাবস্থা চলছে, তাতে এ ধরনের নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে মনে হয় না।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তার শক্তিশালী ও স্বচ্ছ বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়ার কারণে অন্যান্য সংস্থা থেকে আলাদা। কিন্তু বর্তমানে আপিল বিভাগকে অকেজো করার মাধ্যমে এই সংস্থার বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া নিয়ে সদস্য দেশগুলো অনেক দিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। তাদের বিরোধের কারণে ডিসেম্বর ২০১৯ সালের পর থেকে আপিল বিভাগে বিচারক নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিচারকের অভাবে বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তি করা যাচ্ছে না, যা বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী চলমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা এবং দ্বন্দ্ব বৈশ্বিক সহযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে, যা এসডিজি লক্ষ্য অর্জনের বিষয়ে সংশয় তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাপী অংশীদারত্ব এখন খণ্ডিত, এবং এই সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য একটি সম্মেলনের প্রয়োজন রয়েছে। চলমান সম্যসাগুলো সমাধান না হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা নতুন মাত্রা পেয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের আগ্রাসন আলোচিত হলেও ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রধান বিষয় হলো অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং তা বিশ্বব্যবস্থায় কিভাবে সন্নিবেশিত হবে তা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের রেষারেষি এবং এশিয়ার চীন ও ভারতের আঞ্চলিক প্রতিপত্তির লড়াই বিশ্ব অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তাকে উসকে দিচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার বর্তমান দোদুল্যমান অবস্থার একটি বড় কারণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উৎকাণ্ঠা, যেন নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় চীন এবং বড় উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশি সুবিধা না পায়।
বাণিজ্যের চিরাচরিত ক্ষেত্র, যেমন—পণ্যদ্রব্য ও সেবা খাতের পাশাপাশি নতুন বিষয়, যেমন—প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও তার বাণিজ্য নিয়ে রীতিমতো এখন তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। বস্তুত বিশ্ব বাণিজ্যের অনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখন প্রকট হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্র তাদের জন্য বিশ্ব বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা চরম দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নয়নশীল সব দেশেই ব্যাপক বিনিয়োগ দরকার। অবকাঠামো নির্মাণ, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, শিল্প—সর্বত্র প্রয়োজন রয়েছে নতুন পুঁজির। কিন্তু আবার বেল্ট ও রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় করা বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যকে চীনের প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তারের উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। ফলে অনেক উন্নয়নশীল দেশ, যারা চীনের বর্ধিত বিনিয়োগের মাধ্যমে লাভবান হতে চায়, তাদের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ১৯৬০ থেকে ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধের খেসারত দিতে হয়েছিল তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশকে। সে রকম একটা অবস্থার দিকে বিশ্ব আবার ঝুঁকে পড়েছে।
উন্নয়ন অংশীদারত্ব এখন খণ্ডিত, দুর্বল ও অস্পষ্ট। ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার বিরূপ প্রভাবকে যথাযথভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়বে। এসডিজি সনদকে বিশ্ব উন্নয়ন কাঠামোর মূল নির্দেশিকা হিসেবে ধরে নিয়ে বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে কিভাবে একটি বহুমাত্রিক জবাবদিহির মধ্যে নিয়ে আসা যায়, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।