ঘিঞ্জি, দারিদ্র্য, স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে থাকা শিশুদের মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। বয়স ও পরিবেশের এই প্রভাবের বাইরেও ঠিক কোন ছেলে-মেয়ে বাতজ্বরে ভুগবে, তার জেনেটিক ধাত আছে। উল্লেখ্য, একবার এ রোগ হলে বারবার এ দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রোগের লক্ষণসমূহ
প্রধান লক্ষণ
♦ হৃদযন্ত্রের প্রদাহ (কার্ডাইটিস) : শিশুদের বাতজ্বরে সবচেয়ে মারাত্মক অসুবিধা এটি, যা ৫০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে হতে পারে। এর ফলে যেসব উপসর্গ দেখা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে—শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, পায়ের পাতা ফুলে যাওয়া। কখনো বা কোনোরূপ উপসর্গ ছাড়া অনেকটা গোপনে শিশু কার্ডাইটিসে আক্রান্ত থাকতে পারে।
♦ গিরায় ব্যথা ও ফুলে যাওয়া (আর্থ্রাইটিস) : শতকরা ৭০-৮০ ভাগ বাতজ্বরের শিশু এ লক্ষণ নিয়ে আসতে পারে। সচরাচরভাবে দুই দিকের একই প্রকারের বড় বড় অস্থিসন্ধি যেমন পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, কনুই, হাতের কনুুই, হাতের কবজির গিরা ফুলে যায়। অন্যান্য বহু রোগে শিশুদের গিরায় ব্যথা বা ফোলা দেখা যায়। তবে বাতজ্বরে গিরা ব্যথা ও ফুলে যাওয়ার কিছু বিশেষত্ব আছে। যেমন—
জয়েন্টের ব্যথা এতটা বেশি পরিমাণের থাকে যে শিশু তা স্পর্শ করতেও দেয় না।
একটা গিরায় ব্যথা কমে এলে অন্য একটি গিরায় ব্যথার পরিমাণ বেড়ে যায়।
কোনো চিকিৎসা না পেলেও গলাব্যথা ও ফোলা দু-তিন সপ্তাহের মধ্যে আপনাআপনি সেরে যায়, কিন্তু শিশুকে অ্যাসপিরিন বা এজাতীয় ওষুধ খাওয়ানো হলে ওষুধ খাওয়ানোর ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গিরা ব্যথা ও ফোলার সম্পূর্ণ অবসান ঘটে, যা শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ে অসুবিধা ঘটায়। সে কারণে শিশুর গিরা ব্যথা বা গিরা ফোলা দেখা দিলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ না দেখিয়ে ওষুধ খাওয়ানো উচিত না।
♦ নিয়ন্ত্রণহীন অঙ্গ সঞ্চালন (কোরিয়া): শিশুদের বাতজ্বর নির্ণয়ের জন্য যা একক পরিপূর্ণ লক্ষণ।
♦ চামড়ার নিচে ছোট ছোট গুটি হওয়া (সাবকিউটেনিয়াস নডিউল): এই লক্ষণ থাকলে নিশ্চিতভাবে ধরে নিতে হবে বাতজ্বরের শিশু কার্ডাইটিসে আক্রান্ত হয়েছে।
♦ শরীরের বিভিন্ন অংশে লালচে দাগ দেখা দেওয়া (ইরিথেমা মার্জিনেটাম)
গৌণ লক্ষণ
♦ জ্বর, যা সচরাচর বেশি মাত্রার নয়
♦ শুধু গিরা ব্যথা (আর্থ্রালজিয়া)
♦ বাড়তি ইএসআরসি-আরপি।
♦ ইসিজিতে পাওয়া প্রলম্বিত পি-আর ইন্টারভেল
♦ শিশু পূর্বে বাতজ্বরে ভুগেছে, এরূপ ইতিহাস।
অত্যাবশ্যকীয় শর্তাদি বোঝাতে যে স্ট্রেপটোকক্কাই কর্তৃক গলা ব্যথায় ভুগছে তার আলামতগুলো যদি পাওয়া যায়, যেমন :
♦ থ্রোট সোয়াব কালচার
♦ এ-এস ও টাইটার ও এজাতীয় অন্যান্য এনজাইমের বাড়তি মান
♦ স্কারলেট ফিভারের চিহ্নসমূহ।
রোগ নির্ণয়
কোনো একক রোগলক্ষণ বা পরীক্ষা বাতজ্বর নির্ণয় নিশ্চিত করে না। কোনো শিশুকে পরীক্ষা করে যদি দুটি প্রধান লক্ষণ বা একটি প্রধান লক্ষণ ও কমপক্ষে দুটি অপ্রধান লক্ষণ পাওয়া যায় এবং সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় শর্তটি পূরিত হয়, তা হলে শিশু বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার জোরদার আশঙ্কা। শিশুর বাতজ্বর নির্ণয়ের এই নিয়মকে ‘জোনস প্রণীত নির্দেশিকা’ বলা হয়। বাতজ্বর রোগ নির্ণয়ে এখন পর্যন্ত এই নির্দেশিকা খুবই কার্যকর বলে বিবেচনা করা হয়।
চিকিৎসা ও প্রতিরোধব্যবস্থা
♦ শিশুর বাতজ্বর হলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে আশু চিকিৎসা নেওয়া উচিত। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তিপূর্বক সম্পূর্ণ বিশ্রামসহ চিকিৎসকের নির্দেশ মেনে চিকিৎসা চালাতে হবে।
♦ প্রতিরোধক ওষুধ: পেনিসিলিন গ্রহণের মাধ্যমে শিশুর বাতজ্বর ও বাতজ্বরজনিত হৃদরোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রাথমিক প্রতিরোধ: পাঁচ থেকে ১৫ বছর বয়সের ছেলে-মেয়েদের স্ট্রেপটো গলাব্যথা সন্দেহ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা করানো হলে বাতজ্বর হওয়া থেকে শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব। এই ব্যবস্থাকে প্রাথমিক প্রতিরোধক ব্যবস্থা বলে। এই ব্যবস্থায় গলাব্যথা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাংসপেশিতে একটিমাত্র বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন (শিশুর ওজন ২৭ কেজির নিচে হলে ছয় লাখ ইউনিটের ও ২৭ কেজির বেশি হলে ১২ লাখ ইউনিটের) নিতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দিনে চারবার করে একটানা ১০ দিন পেনিসিলিন ট্যাবলেট সেবন করা যেতে পারে।
সেকেন্ডারি প্রতিরোধক ব্যবস্থা: যারা এক বা একাধিকবার বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে অথবা বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে ভুগছে তাদের জন্য এ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যবস্থায় প্রতি তিন-চার সপ্তাহ অন্তর একটি বেনজাথিন পেনিসিলিন ইনজেকশন নিতে হয়। এটা না করে বছরে দু-চারটা ইনজেকশন দিয়ে কোনো লাভ নেই।
যেসব ছেলে-মেয়ে বাতজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে কিন্তু হৃদযন্ত্রের ক্ষতি হয়নি তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছর এই প্রতিরোধক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ১৩ বছরের নিচের ছেলে-মেয়েদের ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত অবশ্যই গ্রহণীয়।
বাতজ্বরজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে এ ব্যবস্থা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী দীর্ঘদিন পর্যন্ত কখনো বা সারা জীবন পর্যন্ত গ্রহণ করতে হতে পারে।
বাতজ্বর ও খাদ্যপুষ্টি : যেসব শিশুর বাতজ্বর হয়েছিল তাদের নিম্নলিখিত জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত—
নিয়মিত খেলাধুলা, মুক্ত বিশুদ্ধ বাতাস ও বিশুদ্ধ পরিবেশে সময় কাটানো। দাঁত, মুখ বা কোনো ইনফেকশন, ঠাণ্ডা লাগা থেকে সতর্ক হওয়া। প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফল, মাছ, শস্যজাতীয় খাবার খাওয়া। চা, কফি, টিনজাত খাবার ও বাইরের তৈরি খাবার না খাওয়া।
অভিভাবকদের যা লক্ষ রাখতে হবে—
♦ একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর শিশুকে ডাক্তার দেখানো।
♦ ভালো হয়ে যাওয়ার পর শিশুর আবার দুর্বলতা, ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ, শরীরের বৃদ্ধি ঠিকমতো না ঘটা প্রভৃতি দেখা দিলে অবিলম্বে শিশু চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ।