ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫
২ বৈশাখ ১৪৩২, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৬

ঢাকা, মঙ্গলবার ১৫ এপ্রিল ২০২৫
২ বৈশাখ ১৪৩২, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৬

মস্তিষ্কে রক্তনালি ফেটে যাওয়া, কারণ আছে, উপসর্গ নেই

  • মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ ‘সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ’কে মেলানো হচ্ছে অ্যাটম বোমের সঙ্গে। জানাচ্ছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের নিউরোলজিস্ট ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু
অন্যান্য
অন্যান্য
শেয়ার
মস্তিষ্কে রক্তনালি ফেটে যাওয়া, কারণ আছে, উপসর্গ নেই
মডেল : কিন্নরী। ছবি : কাকলী প্রধান

মস্তিষ্কে অনেক রক্তনালি থাকে। এগুলো জালের মতো বিস্তৃত হয়ে মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ করে। একটি রক্তনালি ভাগ হয়ে দুটি শাখায় পরিণত হয়। রক্ত চলাচলের সময় এই ভাগ হওয়া অংশে রক্তের চাপ পড়ে বেশি।

ফলে রক্তনালির এই অংশ দুর্বল হয়ে পড়ে। চাপ বেড়ে গেলে এই দুর্বল অংশ ফুলে যায়, যেটিকে বলে অ্যানিউরিজম। একসময় অ্যানিউরিজম ফেটে যায়। ফেটে যাওয়া অংশ দিয়ে রক্ত মস্তিষ্কের আবরণীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
আর একেই বলে ‘সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজ’। এই রোগকে অ্যাটম বোম বলা হচ্ছে কেন? কারণ হলো গবেষণালব্ধ তথ্য মতে, এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির ১০ থেকে ২০ শতাংশ মারা যায় হাসপাতালে পৌঁছার আগেই। আরো ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ মারা যায় প্রথম ৩০ দিনের মধ্যেই। মানে, মোট আক্রান্তের ৫০ শতাংশ মারা যায় প্রথম ৩০ দিনের মধ্যে।
তাহলে প্রশ্ন, বাকি অর্ধেকের কী হয়? জীবিতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে বেঁচে থাকে। কাজেই এই রোগটি প্রাণহারী।

 

কেন হয় এ রোগ?

এ রোগ কেন হয় তার সঠিক কারণ জানা যায় না। তবে কিছু কারণে ফুলে যাওয়া রক্তনালি ফেটে যাওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। সেই কারণগুলো হলো :

►   ধূমপান।

►   উচ্চ রক্তচাপ।

►   পরিবারে এই রোগের ইতিহাস থাকলে।

►   মদপান।

►   কিডনির রোগ অটোসোমাল ডমিন্যান্ট পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ। এটি বংশগত কিডনির রোগ। এই রোগে কিডনিজুড়ে অনেক সিস্ট হয়। কিডনি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। কিডনির সঙ্গে লিভার বা অন্যান্য অঙ্গে সিস্ট হতে পারে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্কের রক্তনালি ফুলে গিয়ে অ্যানিউরিজম হতে পারে।

 

উপসর্গ

সাব-অ্যারাকনয়েড হেমোরেজের মূল কারণ অ্যানিউরিজম। এটি মাথায় থাকলে কিন্তু কোনো লক্ষণ দেখা যায় না, যদি না সেটি বড় হয়ে টিউমারের আকার ধারণ করে। অ্যাটম বোম বাস্ট হলে যেমন প্রাণহানি হয়, ঠিক তেমনি অ্যানিউরিজম রাপচার বা ফেটে গেলে উপসর্গ দেখা দেয়। এ রোগের উপসর্গ শুনেই রোগ নির্ণয় করা যায়। মূল ও প্রধান উপসর্গ হলো মাথা ব্যথা। শুধু মাথা ব্যথা নয়, তীব্র মাথা ব্যথা। এমন মাথা ব্যথা জীবনে কখনোই হয়নি। অনেকে বলেন, মাথায় বাজ পড়ার মতো ব্যথা। ব্যথা শুরু হয়ে কিছু সময়ের মধ্যে খুব তীব্র আকার ধারণ করে। অনেকের মাইগ্রেন থাকে, তাঁদেরও তো মাথা ব্যথা হয়। তাহলে তাঁরা কিভাবে আলাদা করবেন? তাঁরা আলাদা করবেন এভাবে যে এমন তীব্র মাথা ব্যথা এর আগে কখনো হয়নি। শুধু মাথা ব্যথা নিয়েই এক-তৃতীয়াংশ রোগী হাসপাতালে আসেন।

তবে মাথা ব্যথার সঙ্গে বমি হতে পারে, আক্রান্ত ব্যক্তি অজ্ঞান হতে পারেন। আক্রান্ত ব্যক্তির ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, চোখের পাতা পড়ে যেতে পারে, শরীরের কোনো পাশ অবশ হতে পারে এবং চোখে দেখার সমস্যা হতে পারে।

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

এই রোগ নির্ণয়ে মাথার সিটিস্ক্যান করা হয়। বেশির ভাগ রোগীর সিটিস্ক্যানে মস্তিকের আবরণীতে রক্ত ধরা পড়ে। তবে রক্তক্ষরণ যদি কম হয়, তাহলে কিন্তু সিটিস্ক্যানে এই রোগ না-ও ধরা পড়তে পারে। এমনটি হলে নিউরোলজিস্টরা পিঠের হাড়ের মধ্যের রস নিয়ে পরীক্ষা করে এই রোগ নির্ণয় করতে পারেন। আর মাথার অ্যাটম বোম বা অ্যানিউরিজম নির্ণয় করার জন্য কন্ট্রাস্ট বা ওষুধ দিয়ে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করতে হয়। আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য মস্তিষ্কের এনজিওগ্রাম করতে হয়, যেটিকে বলা হয় ‘ডিজিটাল সাবট্রাকশন এনজিওগ্রাম’ বা সংক্ষেপে ‘ডিএসএ’। অত্যাধুনিক এই পরীক্ষাটি এখন আমাদের দেশেই হচ্ছে হরহামেশাই।

 

চিকিৎসা কী?

প্রথমে একটি সুখবর দিতে চাই। বাংলাদেশে এই রোগের অত্যাধুনিক চিকিৎসা হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও এই চিকিৎসা হয়। এই অত্যাধুনিক চিকিৎসাকে বলে ‘কয়েল এম্বোলাইজেশন’। এটি এক ধরনের সার্জারি, তবে মিনিমাল ইনভেসিভ সার্জারি। মানে, এই অপারেশনে মাথা কাটা-ছেঁড়ার প্রয়োজন পড়ে না। কুঁচকিতে ক্যানুলা পরানোর পর ক্যাথেটার ও ওয়ারের সাহায্যে মস্তিষ্কের রক্তনালিতে প্রবেশ করা হয়। এরপর অ্যানিউরিজমে প্রবেশ করে কয়েল বা বিশেষ ধরনের তার বসিয়ে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে অ্যানিউরিজম ফেটে গিয়ে আর রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে না।

দেশের মধ্যে আগারগাঁও ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে একটি বিভাগ আছে। এরা এভাবে অপারেশন করে। খুব দক্ষ, প্রশিক্ষিত টিমের মাধ্যমে সরকারিভাবে এ সেবা দেওয়া হচ্ছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অল্পবিস্তর এ ধরনের অপারেশনের সুযোগ আছে। বেসরকারিভাবে দু-একটি জায়গায় এ অপারেশন হচ্ছে। এ অপারেশনে ঝুঁকি খুব কম। রোগী দু-চার দিনের মধ্যেই বাসায় যেতে পারেন। আরেকটি পদ্ধতি হলো মাথা কেটে অপারেশন করা। এ ক্ষেত্রে মাথা কেটে অ্যানিউরিজম খুঁজে বের করে ক্লিপ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।

 

আমার মাথায় কি অ্যাটম বোম আছে?

খুব জটিল প্রশ্ন। অ্যাটম বোম ফেটে না যাওয়া পর্যন্ত বোঝার উপায় নেই। তবে কোনো কারণে সিটিস্ক্যান বা এমআরআই করাতে গিয়ে এটি না ফাটলেও ধরা পড়তে পারে। তাহলে কি আমরা সবাই সিটিস্ক্যান করাব? না, এর প্রয়োজন নেই। কারণ খুব অল্পসংখ্যক মানুষের মস্তিষ্কে অ্যানিউরিজম থাকে। আবার যাদের অ্যানিউরিজম থাকে, তাদের সবার ফেটে যায় না। কাজেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে খোঁজার দরকার নেই। তবে যাদের পরিবারে নিকটাত্মীয়দের (যেটিকে আমরা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেশনশিপ বলি) যদি দুজন বা এর বেশিজনের এই রোগ দেখা দেয় এবং কিডনির রোগ অটোসোমাল ডমিন্যান্ট পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ থাকে, তাহলে অবশ্যই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হবে।

মন্তব্য

সম্পর্কিত খবর

গরমে নিরাপদে থাকার কৌশল

শেয়ার

শিশুর হিস্টিরিয়া রোগ

অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী
শেয়ার
শিশুর হিস্টিরিয়া রোগ

অনেক কাহিনির একটি

রাশেদার বয়স ১০ বছর। শহরের নামকরা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। মেধাবী ছাত্রী। ভালো ছাত্র-ছাত্রীরা একটু সংবেদনশীল থাকে।

সে-ও তাই। মা-বাবা দুজনেই তাকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে এসেছেন। ১০ দিন ধরে ফিট, বুকে ব্যথা উপসর্গ। রাশেদার গলায় চকচকে দুটি নতুন তাবিজ।
এ অবস্থায় তার মা-বাবা দিশাহারা হয়ে ঝাড়ফুঁক-তাবিজের আশ্রয় নেন। তাকে তেল পড়া, পানি পড়া খাওয়ানো হয়েছে। গরম তেল তার নাকের দুই ছিদ্রে ঢেলে দেওয়া হয়েছে। তাই সেখানে বেশ ব্যথা ও ক্ষত দেখা যাচ্ছে।
রাশেদার মা জানালেন, তাবিজ দুটিতে হাদিয়া বাবদ এক হাজার টাকা নেওয়া হয়েছে, তার এক পয়সাও নাকি কম নেয়নি।

 

হিস্টিরিয়া সম্পর্কে যা জানা যায়

রাশেদা জানায়, তার মা-বাবা যদি পরস্পর ঝগড়া করেন বা কেউ যদি তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে, তবে তার খারাপ লাগে। বুক ব্যথা করে, বুক জ্যাম হয়ে যায়, মাথা ঝিমঝিম করে।

হিস্টিরিয়া এক ধরনের মনোরোগ। এর ফলে স্নায়বিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে।

আমাদের দেশে শিশু ও নারীরা তাদের কষ্ট, মনের ব্যথা অন্যদের কাছে অনেক ক্ষেত্রে পৌঁছাতে পারে না। তখন শিশু এসব মর্মযাতনা শারীরিক উপসর্গে সাজিয়ে সে প্রকাশ করে। এভাবে শিশু তার সাইকোলজিক্যাল যন্ত্রণা লাঘবের একটা পথ খুঁজে নেয়। দ্বিতীয়ত, এসব উপসর্গের কারণে শিশু দুর্বল হয়ে পড়ে। দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে না। কারণ এতে সে কাছের মানুষের কাছে নানা ধরনের সহানুভূতি লাভ করে।

 

লক্ষণ

অদ্ভুত রকমের হাঁটাচলা।

মেকি ফিট।

কাজকর্মের সময় হাতে-পায়ে অবশভাব, অক্ষমতা।

কথা বলতে অসুবিধা, ভাঙা স্বর।

চোখে দেখতে না পারা।

কখনো কখনো স্মৃতিশক্তি লোপ বা বুদ্ধিস্তর কমে যাওয়া।

কখনো বা পরিচিত জায়গা ছেড়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে উদাসীনের মতো মাইল দূরে চলে যাওয়া।

শিশুর হাত-পা পক্ষাঘাতগ্রস্তের মতো দেখালেও শারীরিক পরীক্ষায় দেখা যায় তার স্নায়ুতন্ত্র সুস্থ আছে, অন্ধ সেজে থাকলেও পরীক্ষায় বোঝা যায় তার চোখের মণির সব রিফ্লেক্স স্বাভাবিক।

 

চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা

শিশুর সম্পূর্ণ শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরীক্ষা। শারীরিক পরীক্ষায় কোনো রোগের প্রমাণ না মিললে অযথা পরীক্ষা না করানো।

শিশুর হিস্টিরিয়ার উৎপত্তির কারণগুলো সহজভাবে শিশুকে ব্যাখ্যা করা। আরোগ্যলাভের নিশ্চয়তা দান। শিশুর সঙ্গে বিরোধ সম্পূর্ণ পরিত্যাজ্য।

ওষুধের চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দিলে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

 

রোগ প্রতিরোধ

অধুনা লাইফস্টাইলের কারণে শিশুর সাইকোসোশ্যাল সমস্যার হার বাড়তির দিকে। মা-বাবা, অন্যান্য ভাই-বোন, স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকারা, চারপাশের সংস্কৃতি, বংশগতির ধারা তার মনের ওপর প্রতি মুহূর্তে আলো-ছায়ার মতো খেলে। শিশুর মধ্যে কোনো মানসিক সংকট চিহ্নিত হলে অযথা অবৈজ্ঞানিক অপচিকিৎসায় সময় নষ্ট না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা।

 

লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান

শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল

প্রাসঙ্গিক
মন্তব্য

শিশুর বিকাশে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব কতটুকু?

অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু
অধ্যাপক ডা. গোপেন কুমার কুণ্ডু
শেয়ার
শিশুর বিকাশে ইলেকট্রনিক ডিভাইসের প্রভাব কতটুকু?
ছবি : কাকলী প্রধান

আজকাল নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির বেশির ভাগ পরিবারে শিশুদের হাতে এই যন্ত্র দিয়ে অভিভাবকরা নিজেদের কর্ম সম্পাদন করে থাকেন।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, শিশুকে খাওয়ানোর সময় ডিভাইসটি ব্যবহার করা হয়। এতে একসময় তাদের মধ্যে এমন অভ্যাসে পরিণত হয়, যেন এই যন্ত্র ছাড়া শিশুকে খাওয়ানো সম্ভবই না। এ ছাড়া অনেক দিন ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাদের কারো কারো মধ্যে স্ক্রিন ডিপেনডেন্সি ডিস-অর্ডারস (এসডিডি) হতে পারে।

স্ক্রিন ডিপেনডেন্সি ডিস-অর্ডারসে শিশুদের মধ্যে কিছু শারীরিক ও মানসিক সমস্যা পরিলক্ষিত হয়। শারীরিক সমস্যাগুলো হলোঘুমের অসুবিধা, পিঠ বা কোমরে ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখের জ্যোতি কমে যাওয়া, ওজন বেড়ে যাওয়া, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি। শারীরিক অসুবিধা ছাড়াও কারো কারো মধ্যে ইমোশনাল উপসর্গ, যেমনউদ্বিগ্নতা, অসততা, একাকিত্বতা, দোষী বোধ ইত্যাদি হতে পারে। তাদের মধ্যে বাইরে যাওয়ার প্রবণতা কমে যায় এবং দীর্ঘ সময় ধরে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ফলে তাদের মধ্যে বিভিন্ন রকম মানসিক সমস্যা দেখা দেয়।

অধ্যাপক ডা. এরিখ সিগম্যান তাঁর গবেষণায় বলেছেন যে অনেক সময় হঠাৎ করে এই মোবাইল ডিভাইস তুলে নিলে তাদের মধ্যে Withdrawal symptoms আসতে পারে। ফলে তারা মোবাইল থেকে সহজেই বিরত থাকতে পারে না বা মোবাইল সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে পারে না।

মোবাইল ফোন সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে দুই থেকে পাঁচ বছরের শিশুরা। একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের উপযুক্ত সময় প্রথম পাঁচ বছর।

মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশ হলো শিশুর ক্রমে ক্রমে এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে শিশুর কথা বলতে শেখা, হাঁটাচলা শেখা এবং স্বাভাবিক বুদ্ধির বিকাশ হওয়া। আর এই সময় শিশুর একদিকে দীর্ঘ সময়ে মোবাইল গেম খেলা, ইউটিউব দেখা; অন্যদিকে স্বাভাবিক উদ্দীপনামূলক খেলাধুলা না করায় শিশুর স্নায়বিক বিকাশ ভীষণভাবে ব্যাহত হয়। শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ নির্ভর করে পরিবেশ ও অন্য শিশুদের সঙ্গে শিশুর ভাবের আদান-প্রদানের ওপর। বলা হয়, শিশু শেখে দেখতে দেখতে এবং অন্যদের সঙ্গে খেলতে খেলতে।

অধিক সময় শিশু মোবাইল ডিভাইসের সংস্পর্শে থাকায় মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সামাজিক যোগাযোগ এবং সমবয়সী শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা-মেলামেশা একেবারেই কমে যায়।

এ ক্ষেত্রে গবেষকরা শিশুর বিকাশের প্রারম্ভে অত্যধিক মোবাইল ব্যবহার শিশুর মস্তিষ্কের গঠনপ্রকৃতির ভিন্নতার কথাও উল্লেখ করেছেন।

বিজ্ঞানী ডি এস্কিসটাকিস বলেছেন, শিশু অবস্থায় অতিমাত্রায় মোবাইল ফোন এবং টিভি দেখা শিশুদের মধ্যে পরবর্তী সময়ে অতিমাত্রায় চঞ্চলতা দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানী ডি এ থমসন বলেছেন, অতিমাত্রায় মোবাইল, টেলিভিশনে আসক্তি এবং ঘুমের সময় কমে যাওয়া শিশুদের বিকাশের বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

আমেরিকান একাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস ও টেলিভিশন কমিটি শিশুদের ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে সর্বসম্মতিক্রমে নিম্নরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুরা সারা দিনে এক-দুই ঘণ্টা স্ক্রিন দেখতে পারবে, কিন্তু সেটি অবশ্যই মানসম্মত অনুষ্ঠান হতে হবে।

দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের হাতে মোবাইল দেওয়া অনুৎসাহিত করা হয়েছে।

শিশুদের বেডরুম থেকে টেলিভিশন সরিয়ে ফেলতে বলা হয়েছে।

তারা শিশু বিকাশের ক্ষেত্রে কিছু উদ্দীপনাকে উৎসাহ প্রদান করছেন, যেমনশিশুর সঙ্গে কথা বলা, গল্প করা, ছড়া বলা, গান করা ইত্যাদি।

 

শিশুদের মোবাইল ডিভাইস ব্যবহার প্রতিরোধে অভিভাবকের করণীয়

মা-বাবার সচেতন হওয়াটাই শিশুর মোবাইল ব্যবহার কমাতে পারে।

শিশুদের মোবাইল বাদ দিয়ে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে হবে।

সৃজনশীল কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, যেমনছবি আঁকা, গল্প করা, গান করা, পাজল খেলা, লুডু খেলা ইত্যাদি।

মা-বাবাকে সম্ভব হলে শিশুদের সঙ্গে এসব খেলায় অংশগ্রহণও শিশুর মোবাইল ব্যবহার কমাতে পারে।

 

শিশুর অতিমাত্রায় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারের প্রভাব

শিশুর সামাজিক যোগযোগ ও শারীরিক কসরত কমে যাওয়া, আচরণগত অসুবিধা, অসামাজিকতা, অতিচঞ্চলতা ও হিংসাত্মক আচরণ।

শিশুর স্বাভাবিক স্নায়বিক বিকাশ কমে যাওয়া।

শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সমস্যা, যেমনচক্ষু সমস্যা, মাথা ব্যথা ইত্যাদি।

 

 লেখক : চেয়ারম্যান, শিশু নিউরোলজি বিভাগ

বিএসএমএমইউ

 

মন্তব্য

রোগের নাম হিমোফিলিয়া

ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
শেয়ার
রোগের নাম হিমোফিলিয়া

হিমোফিলিয়া একটি বিশেষ ধরনের রক্তরোগ, যে রোগে শরীরে রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হয়। এই রোগে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এটি একটি বংশগত রোগ, যা জিনের মাধ্যমে উত্তর প্রজন্মে পরিবাহিত হয়।

আমাদের শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত হয়।

শরীরের নিয়মেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই রক্তপাত থেমেও যায়। রক্ত জমাট বাঁধতে কাজ করে প্লেটলেটসহ নানা রকম ফ্যাক্টর। এই ফ্যাক্টর উৎপাদনে সমস্যা হলে রক্ত জমাট বাঁধায় সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না।
এটিই হিমোফিলিয়া।

বিশ্বে প্রতিবছর ১৩০ মিলিয়ন শিশু জন্মগ্রহণ করে, যার মধ্যে ২০ হাজার শিশু জন্মগতভাবে হিমোফিলিয়া নিয়ে জন্মায়। বিশ্বে ১০ হাজারে একজন এই রোগে ভুগছে, যার ৭৫ শতাংশ রোগীই সঠিক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।

 

হিমোফিলিয়া কিভাবে হয়?

শুরুতেই বলেছি হিমোফিলিয়া একটি বংশানুক্রমিক জিনগত রোগ।

এই রোগে রক্ত জমাট বাঁধার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তাই শরীরে কোথাও কেটে গেলে আর রক্তপাত বন্ধ হয় না। আমাদের শরীরের এক্স ক্রমোজোমে এফ৮ (F8) ও এফ৯ (F9) নামের জিন থাকে, যা ফ্যাক্টর-৮ ও ফ্যাক্টর-৯ নামের প্রোটিন তৈরির কাজে জড়িত। শরীরের কোথাও কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে এই ফ্যাক্টরগুলো কাজ করে। এই প্রোটিন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কম পরিমাণে থাকলে রক্ত জমাট বাঁধায় সমস্যা দেখা দেয়।
কোথাও কেটে গেলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, তখন এই রোগকে বলা হয় হিমোফিলিয়া। হিমোফিলিয়া সাধারণত দুই প্রকার। যথাহিমোফিলিয়া ও হিমোফিলিয়া বি। এ ছাড়া হিমোফিলিয়া সি নামেও এক ধরনের হিমোফিলিয়া আছে, যা খুবই বিরল।

মেয়েরা সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় না, এ রোগের বাহক হয়। পুরুষরাই মূলত এই রোগে আক্রান্ত হয়।

 

লক্ষণ

অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ বা কেটে গেলে রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়াটাই হিমোফিলিয়ার মূল লক্ষণ। সাধারণত শিশু বয়সেই এ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পায়।

কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ করে রক্তক্ষরণ, শরীরের কোথাও আঘাত লাগলে সেই জায়গাটি নীলচে হয়ে ফুলে যায় অর্থাৎ চামড়ার নিচে রক্তক্ষরণ; মাংসপেশি ও অস্থিসন্ধিতে রক্তক্ষরণ; হাঁটু, কনুই ও অন্যান্য অস্থিসন্ধি ফুলে যাওয়া; শরীরের কোথাও কেটে গেলে দীর্ঘক্ষণ রক্ত ঝরা; দাঁত তোলার পর বা সুন্নতে খতনা করার পর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়া, শিশু হামাগুড়ি দেওয়ার সময় হাঁটুতে কালচে দাগ হওয়া, নবজাতকের নাভি কাটার সময় দীর্ঘক্ষণ রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি।

 

হিমোফিলিয়ার বংশগতি

যদি বাবা সুস্থ ও মা বাহক হন, তবে ছেলেসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ আর মেয়েসন্তানের বাহক হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ।

যদি বাবা রোগী ও মা সুস্থ হন, তবে সব ছেলেসন্তানই সুস্থ হবে এবং সব মেয়েসন্তানই বাহক হবে।

যদি বাবা রোগী ও মা বাহক হন, তবে ছেলেসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ। আর মেয়েসন্তানের রোগী হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ এবং বাহক হওয়ার আশঙ্কা ২৫ শতাংশ।

সুতরাং প্রত্যেক হিমোফিলিয়া পুরুষ রোগী বিয়ে করতে পারবে, তবে সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

সাধারণত শুধু পুরুষরাই এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং নারীরা এই রোগের বাহক। তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নারীরাও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বাবা রোগী ও মা বাহক হলে মেয়েরাও রোগী হতে পারে। তাই হিমোফিলিয়া রোগীর সঙ্গে নিকটাত্মীয়, যেমনখালাতো, মামাতো বা ফুফাতো বোনের বিয়ে হলে দুজনই রোগী হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

 

বাংলাদেশে হিমোফিলিয়া

বাংলাদেশে কতসংখ্যক হিমোফিলিয়া রোগী আছে তার আসলে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে বিশ্বজরিপে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ হাজারে একজন হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়। সেই হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৭ হাজার হওয়ার কথা থাকলেও দেশীয় এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রায় তিন-চার হাজার রোগী নিয়মিতভাবে চিকিৎসাসেবার আওতায় আছে।

 

চিকিৎসা

অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ থেকে সাবধান থাকাই এই রোগের প্রধান চিকিৎসা। তাই আক্রান্ত রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চলতে হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা, ক্রাইয়োপ্রেসিপিটেট পরিসঞ্চালন করতে হয়। ফ্যাক্টর-৮ ও ফ্যাক্টর-৯, যা এই রোগীদের শরীরে পর্যাপ্ত পরিমাণে তৈরি হয় নাএগুলো ইনজেকশনের মাধ্যমে নিতে হয়। এসব ইনজেকশন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে হিমোফিলিয়া রোগের সঠিক চিকিৎসা বাংলাদেশের বেশির ভাগ রোগীরই নাগালের বাইরে। সঠিক চিকিৎসার অভাবে অনেক মা-বাবা অকালে তাঁদের সন্তান হারান।

হিমোফিলিয়া রোগে আক্রান্ত রোগীর সম্পূর্ণ নিরাময়ের জন্য জিনথেরাপির বিষয়টি গবেষণায় রয়েছে এবং উন্নত দেশগুলোতে জিনথেরাপি সফলভাবে সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো জিনথেরাপি চালু হয়নি।

 

প্রতিরোধ

হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত রোগী যত দিন বেঁচে থাকে, তত দিন চিকিৎসার মধ্যে থাকলেও স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারেন না। তাই এই রোগ প্রতিরোধের জন্য জনসচেতনতা সৃষ্টি করা অত্যন্ত জরুরি। হিমোফিলিয়া কী, এই রোগের কারণগুলো এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয় সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকলে অনাগত শিশুরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। প্রত্যেক মানুষের বিয়ের আগে কাউন্সেলিং, জেনেটিক পরীক্ষা করতে পারলে এবং সেই অনুযায়ী বিয়ে হলে এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। অথবা বিয়ে করার পর যদি এই রোগ ধরা পড়ে, তবে গর্ভধারণকালীন প্রি-নাটাল ডায়াগনসিস করে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন যে অনাগত শিশুটি হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত কি না। অর্থাৎ এই রোগ সম্পর্কে সচেতনতা থাকলে এই রোগ অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যদিও এই রোগ শুধু যে বংশানুক্রমিকভাবেই সঞ্চারিত হয় তা নয়, অন্যভাবেও এই রোগ হতে পারে। তাই এই রোগ সম্পর্কে জানা থাকাটা জরুরি।

 

 

হিমোফিলিয়া রোগীদের অবশ্য পালনীয়

বিষয়গুলো কী কী?

নিয়মিত রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া।

হিমোফিলিয়া ট্রিটমেন্ট সেন্টারে নিবন্ধন করে নিয়মিত চিকিৎসাসেবার আওতায় থাকা।

আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা আছে এমন কাজ বা খেলাধুলা না করা।

মাংসে ইনজেকশন না দেওয়া।

রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ/বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ছোট থেকে বড় কোনো ধরনের অস্ত্রোপচার না করা।

Anticoagulants (Heparin, Warfarin), NSAIDs (Aspirin, naproxen etc.) গ্রহণ না করা।

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথার ওষুধ গ্রহণ করা।

 

লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ, জাতীয় ক্যান্সার

গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা

মন্তব্য

সর্বশেষ সংবাদ