প্রধান উপদেষ্টা সেটিকে সর্বজনীন করার উদ্যোগ নিয়ে জাতিকে একটি বিভাজন থেকে রক্ষা করেছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘আগামী দিনের নতুন বাংলাদেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত দেশকে পেছনে নিয়ে যাবে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র জানায়, মূলত বিএনপির বিরোধিতার কারণে ছাত্ররা এই উদ্যোগ থেকে পেছনে সরে। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের এই উদ্যোগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে প্রথম থেকেই বিএনপিতে সন্দেহ, সংশয় ও উদ্বেগ ছিল। বিদ্যমান সরকার কাঠামো থেকে কেন তাঁরা এই উদ্যোগ নিচ্ছেন তা নিয়ে বিএনপির কাছে ভিন্ন ধরনের বার্তা ছিল।
দলটির একাধিক সূত্র জানায়, গত রবিবার বিকেলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঘোষণাপত্রের বিষয়ে তাঁদের আপত্তির কথা অবহিত করেন। সাক্ষাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে এককভাবে জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিলে দেশে যে বিশৃঙ্খলা-সংকট তৈরি হবে, সেই শঙ্কার কথা প্রধান উপদেষ্টাকে জানান মির্জা ফখরুল। মূলত তার পরই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। ওই রাতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গুলশানের বাসায় যান অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টা, যাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁরাও বিএনপি মহাসচিবের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাননি। এ ছাড়া সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টাও তাঁর সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন।
জানা গেছে, বিএনপির পাশাপাশি ছাত্র আন্দোলনের নেতারা আরো যে কয়েকটি দলের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তারাও বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। বিএনপির মনোভাব জানতে পেরে ছাত্রদের উদ্যোগে ওই দলগুলোও সাড়া দেয়নি। এ ছাড়া ডান ও বামপন্থী গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দলের সঙ্গে ছাত্র নেতৃত্ব যোগাযোগ করেনি বলেও জানা গেছে। ফলে দলগুলোর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
একাধিক সূত্র জানায়, জামায়াত ছাড়া বেশির ভাগ দলের সম্মতি নেই—এমন সংবাদ সরকার ও গুরুত্বপূর্ণ মহলের কাছে পৌঁছলে তারাও বিষয়টি নিয়ে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এক পর্যায়ে সোমবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বৈঠক করে গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
বিএনপিসহ তিনটি দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘোষণাপত্রের কয়েকটি বিষয় নিয়ে তাঁদের আপত্তি আছে। বিশেষ করে বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের বিষয়টি। আরো কয়েকটি স্পর্শকাতর বিষয় ছিল, যা গুরুত্বপূর্ণ মহলের চোখ এড়ায়নি। এ বিষয়গুলো দেশকে সংকটে ফেলতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। এর বাইরে কয়েকটি দল গত রবিবার ও সোমবার বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের বিরোধিতা করে বক্তব্য-বিবৃতি দেয়।
কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল : বিএনপির স্থায়ী কমিটি
একটি দলের ইন্ধনে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার মাধ্যমে দেশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। নির্বাচনকে বিলম্বিত করে তারা চলমান শাসনক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল বলে মনে করছে দলটি।
গত সোমবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলটির নেতারা এমন অভিমত ব্যক্ত করেন বলে বৈঠক সূত্র জানিয়েছে। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে পাশ কাটিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে তা অরাজকতা তৈরি করবে।
জানা গেছে, স্থায়ী কমিটির বৈঠকের শুরুতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাত্রনেতাদের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ এবং এরপর তাঁর সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতাদের সাক্ষাতের বিস্তারিত তুলে ধরেন।
বৈঠকে নেতারা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র প্ল্যাটফরমের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে জনগণ, রাজনৈতিক দল এবং বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কেউ যুক্ত নয়। ছাত্ররা তাঁদের নিজেদের মতো করে বাংলাদেশের একটি চরিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা যে সংবিধান বাতিল করে দেওয়ার কথা বলছেন, সেই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রের একটা কাঠামোগত অবস্থান আছে। বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল করে দেওয়া হলে দেশে একটি নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হবে এবং সেই পরিস্থিতি জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং জনগণের গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কারা পৃষ্ঠপোষকতা করছে—স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কয়েকজন নেতা সেই প্রশ্নও তোলেন। নেতাদের কেউ ছাত্র আন্দোলনের এসব উদ্যোগের দৃশ্যমান কোনো পৃষ্ঠপোষক খুঁজে পাচ্ছেন না। তবে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে জামায়াতের ইন্ধন আছে বলে মনে করেন নেতারা।
বৈঠকে দু-একজন অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাঁদের কাছে ‘ষড়যন্ত্র’ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ বিএনপিকে টার্গেট করেই পুরো নকশা তৈরি করা হয়েছে।
বৈঠকে বিএনপির এক নেতা বলেন, ছাত্রদের কর্মসূচিকে ঘিরে সারা দেশ থেকে যেভাবে গাড়ি বোঝাই করে লোকজন আনা হচ্ছে, তাঁদের অর্থের উৎস কী? তাঁদের অনেকে এখনো ছাত্র, অন্যরা কয়েক দিন আগেও ছাত্র ছিলেন। সে কারণে তাঁদের কার্যক্রম জনমানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অন্য একজন নেতা বলেন, ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের কেউ ছাত্রলীগ, কেউ ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিএনপির কারো কারো অভিমত, গণ-আন্দোলন-বিপ্লবের ঘোষণাপত্র দিতে হয় আন্দোলনের আগেই। জুলাই-আগস্টের যে গণ-আন্দোলন, ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের আগেই সেটার ঘোষণাপত্র তুলে ধরলে জনগণ তাদের সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেত। কারণ আন্দোলনটা শুরু হয়েছিল কোটাবিরোধী ইস্যুতে। মানুষ তাদের সেই ঘোষণাপত্র গ্রহণ করবে কি করবে না, সে ব্যাপারে তারা তখন সিদ্ধান্ত নিত। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের প্রায় পাঁচ মাস পর ছাত্ররা যে বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসছে, সেটা সংকট ছাড়া অন্য কিছু তৈরি করবে না। যে বিষয়গুলো বলা হচ্ছে, সেটা বাস্তবসম্মত নয়।